প্রিয় সুখ-১৫
___________________
বর্ষার মৌসুম। বৃষ্টিদের আনাগোনা বেশি রয়েছে। নিজের চরম রূপ প্রকাশিত করে এরা অবিরাম বর্ষণ হচ্ছে। ঝুমঝুমিয়ে নেচে গেয়ে শব্দ তুলে মাটি স্পর্শ করছে বিন্দু বিন্দু ফোঁটা। আম গাছ গুলোর রং গাঢ় হয়ে উঠেছে। উঠান ভিজে চৌচির। পানি পায়ের তলদেশ ডুবিয়ে দেওয়ার যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে। এক রাতের অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত সামনের পুকুরের কিছু সিঁড়ি ডুবিয়ে দিয়েছে। সকালের সূর্যমামাকে ঢেকে মেঘ রাজ্য আজ ভয়াবহ রেগে গর্জন করে উঠছে। বিদ্যুতের ঝিলিক নীল রেখার আকার ধরণ করে উঠছে থেকে থেকে। উদাসীন চোখে বৃষ্টি দেখছেন ছোট খালামনি। জীবনটা তার কিঞ্চিৎ এলোমেলো। ঘরে দুটি বড় মেয়ে তার। এত বড় মেয়ে শহর অঞ্চলেই ভাল দেখায়। গ্রামে মেয়েদের বিয়ে হয় কচি খুকির বয়সে। এই যে তার বিয়ে হয়েছিল যখন, তখন বয়স ছিল সবে চৌদ্দ হবে। মিতুরবাবা তখন তিরিশের পুরুষ। অথচ এখন মনে হচ্ছে তার মেয়েগুলোর বয়সই তিরিশ হয়ে যাবে। সব বিপত্তি ঘটিয়েছে মিতু। স্বামীরা একটু মারেই। বকেই। তাই বলে চলে আসতে হবে? তিনি আবার দীর্ঘশ্বাস নেয়। দোষ তার মেয়ের নয়। তিনি জানেন। মাঝে মাঝে মানুষ খুব হতাশায় অন্যায়কে ঢেকে দিতে চায়। মনে মনে চায় হয়ে যাওয়া কিছু ঘটনা বদলে দিতে। মিতু আপুর জন্যেই মুলত ফাবিহার বিয়েটা থেমে রয়েছে। এটাই ছোট খালামনির ধারণা। যদিও এসব তার মনের কথা। স্বামী আর কতকাল বিদেশ করবে। এখনও জীবনের চাকা ঘুরাতে অক্ষম তিনি। মনে প্রাণে চাইছেন দুই মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে শ্বাস ফেলতে। আফিয়া এসে বসে বোনের পাশে। ভিজা ঝড়ঝড়ে কন্ঠে বলে উঠেন,’ কিরে বুবু তোর আবার কি হইছে। ভিতরে অনেক কাজ। তুই বসে আছিস কেন?’
ছোট খালামনি বেশ মন খারাপ করে বললেন,’ মিতুর কথা ভাবছি। মেয়েগুলোর জন্য বড্ড চিন্তা হয়।’
আফিয়া বিগলিত হেসে বলল,’ মেয়ে কি তোর একলার আছে? আমগো নাই? ‘
ঠোঁট ঝুলিয়ে হাসলেন ছোট খালামনি। তার চিন্তা ধারা খুব অদ্ভুত। মনে মনে তিনি ভাবলেন কোথায় নীহারিকা আর কোথায় তার মেয়েরা। মনে মনে ভাবতে ভাবতেই তিনি মুখ ফুঁটিয়ে বললেন,’ নীহুর সাথে ওদের মিলাই কি লাভ ক। নীহু শহরের মাইয়া। আর কোথায় আমার মাইয়ারা।’
ফোঁস করে শ্বাস ফেলে ছোটখালামনি। মনে খুব হতাশা। আফিয়া বিলকিস হেসে উঠে বললেন,’ তুই একটা পাগল বুবু। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষ নিজের নিজের জায়গায় ঠিক হয়। এবং পরিপূর্ণ হয়। মানুষের উচিঁৎ এক মানুষের সাথে আর এক মানুষের তুলনা না করা বুঝলি। আর নীহারিকার মাঝে কি এমন আহামরি আছে বল তো? উল্টো আমার মিতুকেই ভাল লাগে। হাসে খেলে। হইহই একটা ভাব আছে। কত কাজ জানে। নীহুটা তো কথায় কথায় মাথা গরম করে। রাগে চোখ মুখ লাল করে ফেলে। রাগটা বাবার মত পেয়েছে। যেমন জঙ্গল বাপ তেমন জঙ্গলী মেয়ে।’
নাক ছিকটে বাপ মেয়ের বদনামি করল আফিয়া। ছোটখালামি হাসলেন। পিছন থেকে একটা কড়া ঝাঁঝাল কন্ঠ কানে আসতেই কিঞ্চিত ভড়কে গেলেন আফিয়া। মেয়েকে দেখে মুখটা চুপসে যাওয়া বেলুনে রূপ নিয়েছে। নীহারিকার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি। মায়ের দিকে একটু ঝুঁকে সে বলল,’তুমি যে বাবাকে নিয়ে এসব বল সে জানে?’
‘ ওই বাবার চামচামি করবিনা। রাগ দেখাবি না একদম। ভুলেও না। যা মেহেদী দে। কাল তোর মামার বিয়ে না।’
চোখ মুখ কুঁচকে নেয় নীহারিকা। ভ্রুজোড়া ঈষৎ বাঁকিয়ে নিয়ে সে বলল,’ ভুলেও না মা। আই হেট মেহেদী।’
‘ তোর মত মেয়ে আমি আমার বাপের জন্মে দেখিনি। কখনো আই হেট বৃষ্টি। কখনো আই হেট মেহেদী। কখনো আই হেট হেন কখনো তেন। তোর মিতু আপুরে দেখ কত সুন্দর মেহেদী লাগিয়ে দিতে পারে। কত গুণ তার মাঝে দেখ। কিছু শিখ। আর এই দিকে তোর বলদ খালা মনে করে তুই সেরা। আমি যে কত বড় আহাম্মক জন্মদিছি আমিই জানি। দূর হ সামনে থেকে।’
নীহারিকা গায়ে মাখল না। মায়ের পছন্দের কাজ গুলোকে সে নাকচ করলেই তিনি চটে আগুন হয়ে যান। তার ইচ্ছে মেয়ে সাজু গুজু করবে। গুঁছিয়ে চলবে। একটু মেহেদী ভরা হাত হবে তার। কিন্তু মেয়েটি হয়েছে একদম নিরামিষ।
মিতু আপু হাজির হলো মেহেদী হাতে। আফিয়া বিলকিস পুরাই বাচ্চা যেন। হাত বাড়িয়ে তিনি বললেন,’ দে মা আমারে লাগাই দে। কত দিন দিনা।’
একে একে এসে বসল সবাই। রাত হওয়ার আগেই সবাই মেহেদীর রঙ্গে রাঙ্গা হতে শুরু করল। নীহারিকা বসে রইল সবার মাঝে। মিতু আপুর দারুণ হাত। মারাত্নক সব ডিজাইন তিনি নিমিষে শেষ করে ফেলে। তাযিন অসুস্থ বলে মামা তার হলুদের অনুষ্ঠান করতে নিষেধ করেছেন। তাতে কাজ হয় নি। তার বোনেদের লাফালাফির শেষ নেই। ধপ করে বসে জাওয়াদ। চমকে উঠে নীহারিকা। পাশ ফিরে চায়। দেখে জাওয়াদ অমাইক হাসি হাসছে। তাকে দারুন ফ্রেশ সতেজ দেখাচ্ছে। রূবাইদা এক হাতের মেহেদী উপরে তুলে রেখেছে। তাদের দেশে কেউ এভাবে মেহেদী দেয় না। সেও এই নিয়ে তিন কি চার বারের বেশি মেহেদী পড়েনি। জাওয়াদকে দেখে সে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,’ তুমি খুব সুন্দর জাওয়াদ। ‘
জাওয়াদের মুখটা পানসে দেখাল। বেশ দুঃখ মুখে ঢেলে সে বলল,’ এই সৌন্দর্য যার জন্য সৃষ্টি সেই তো দেখছে না মিস।’
রূবাইদা কৌতুহলি কন্ঠে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল,’ কে সে? যে এত সুদর্শন ছেলেকে দেখছে না?’
‘ আছে একজন। সে দেখেও দেখছে না।’
আড় চোখা ভাবে সে নীহারিকার দিকে নজর দিল। নীহারিকা উঠে দাঁড়াতেই জাওয়াদ বলল,’ আপনি মেহেদী পড়ছেন না?’
‘ আমার পছন্দ না।’ কাটকাট গলা নীহারিকার। জাওয়াদ বুকে একটি হাত চাপে। আর্তনাদ ভরা কন্ঠে আস্তে করে সে বলল,’ এই তীর চক্ষু আমার জীবন নিবে।’ একটু থেমে অবার বলল, ‘ আচ্ছা আপনাকে আমি মেহেদী পড়িয়ে দি?’
আশ্চর্য প্রশ্ন। নীহারিকার শরীর জ্বলে গেল যেন। এই লোকের কাজ নেই আর? শুধু তার পিছনে ঘর বেঁধে দখল করে বসেছে কেন? অসহ্য।
‘ আপনি এমন কেন?’ জাওয়াদ টেবিলের সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে বলল। নীহারিকা আপেল সহ ছুরি হাতের তালুতে উঠিয়ে নিয়ে বলল,’ জানি না। তবে আপনার সমস্যা বুঝতে পারছি না।’
‘ পারবেনও না। তবে আমি একটা বিষয়ে অবাক।’
‘ কোন বিষয়? ‘ ফাবিহা বেশ উৎসুক। জাওয়াদ হেসে পাশে তাকায়। চেয়ার টেনে নেয়। আরাম করে বসতে বসতে বলে,’ আপনি করে ডাকব না তুমি? ‘
ফাবিহা মুচকি হাসে।
‘ যেটা আপনার ইচ্ছে।’
‘ তুমি করেই ডাকি। আপনি শব্দটা না হয় শুধু প্রিয় হয়েই থাকুক।’
‘ আপনার মাঝে মস্ত গাফলা দেখছি ডাক্তার ভাই।’
দু’জনেই নীহারিকার দিকে দৃষ্টি রাখে। আপেলের উপরে ছুরিটা নীহারিকা ভয়াবহ ভাবে ধরেছে। তাকে খুব বিরক্ত আর রাগি দেখা যাচ্ছে। জাওয়াদ বর্ণনার সুরে বলল,’ দেখ আমি দেখতে অনেক সুন্দর। এটা আমার কথা নয়। সবাই বলে। তার উপরে একজন ডাক্তার। তার উপরে সরকারী একটা তকমা রয়েছে। ক্যাডার বলা চলে। আমার মত এত ভাল ছেলেকে কেউ এত অপছন্দ করতে পারে বলে তুমি চিন্তা করতে পারছ?’
‘ একদমই না। আপনি যদি আমাকে বিয়ে করতে চান আমি দুই পায়ে খাড়া।’
জাওয়াদ তার টকটকে লাল ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিল আলত জীভের স্পর্শে। নীহারিকা চোখ উল্টে একবার দেখে। এত সুন্দর একটি ছেলেকে তার ভাল লাগছে না? সে কি সত্যি মায়ের ভাষ্য মতে নিরামিষ? নিজের প্রতি নিজেই সন্দেহ নিয়ে চোখ রাখে আপেলে। জাওয়াদ বলল,’ দেখেছ তোমারও আমাকে পছন্দ। শুধু এই কন্যাটি বাদে। কেন প্রশ্ন করো তো?’
‘ নীহারিকার কথা বলছেন? হায় ভয়ংকর ব্যাপার। তার পছন্দ আলাদা। কেমন পছন্দ সে নিজেও যানে না। এমন কি সবার সাথে মিলেও না ডাক্তার ভাই। একটু পানি ঢেলে দিন তো।’
জাওয়াদ জগ থেকে পানি ঢেলে দেয়। দু’ হাতের কনুই মাঝে সেই পানিকে ঠাই দিয়ে ফাবিহা সামনে হাঁটে। জাওয়াদ একটু সামনে এগিয়ে ছোট ছোট শব্দে বলল,’ আপনাকে আমার খুব পছন্দ নীহারিকা। এর কোন কারণ জানা নেই। আপনার কি জানা রয়েছে?’
জবাব দিল না নীহারিকা। যথেষ্ট ঠান্ডা ভাবে সে আপেল কাটায় ব্যস্ত। জাওয়াদ আবার বলল,’ আমি কলেজ ক্রাশ, মেডিকেল কলেজের ক্রাশ এখন তো আবার হসপিটালের ক্রাশ। রোগীরাও আমার প্রেমে পড়ে যায়। আপনার কি আমাকে মোটেও ভাল লাগে না?’
বড্ড বিরক্তিকর চাহনী দিয়ে নীহারিকা জবাবে বলল,’ আপনি কি কোন ভাবে চাইছেন আমি আপনার প্রেমে পড়ি?’
জাওয়াদ জীবনে এই প্রথম নার্ভাস ফিল করল। তার মনে হচ্ছে এই নারী দৃষ্টিকে সে ভয় পাচ্ছে। কম্পিত হচ্ছে তার গলার স্বর। হ্যাঁ বলার প্রবল ইচ্ছে রইলেও তা চাপিয়ে দিয়ে সে বলল,’ আরে না। প্রেমে পড়তে হবে না। সে মেয়েরা এমনেই পড়ে। আপনি বরং ভাল করে কথা বলুন।’
‘ আপনি বলতে চাইছেন আমি ভাল করে কথা বলিনা?’
জাওয়াদ মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে। চাপা উত্তজিত হয়ে সে বলল,’ এত ত্যাঁড়া কেন আপনি? সব সময় কথা গুলো তীরের মত ছুড়ে ক্ষত সৃষ্টি করার ধান্দায় থাকেন।’
‘ আর আপনি ধান্দায় থাকেন সব সময় বিরক্ত করার রাইট।’
নীহারিকা ঠোঁটের মাঝে আপেল রাখে। জাওয়াদ হাসল। মাথার সিল্কি চুল পিছনে ঠেলে দিয়ে বলল,’ আপনার মূল্যবান কিছু মুহূর্ত আমাকে দেওয়া যাবে? যদিও উত্তর হবে না। তবুও চাইছি।’
জাওয়াদকে অবাকের চরম স্তরে পৌছে দিয়ে নীহারিকা উত্তর দিল,’ হ্যাঁ দিতে পারব। বলুন কেন চাই সময়?’
‘ বিয়ে করতে।’
চিবানো অংশ আর চিবাতে পারল না নীহারিকা। উল্টো ঘুরে সে জাওয়াদের দিকে রুক্ষ তীর্যক দৃষ্টি ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে বেশ রেগেই বলল,’ ফাইজলামু করছেন? আমার সাথে?’
জাওয়াদের হুশ ফিরে। একটু বেশিই পাগলামি করছে ইদানিং। সে না কি ডাক্তার! নিঃসন্দেহে এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। সবাই বলবে সে পাগল। পাগলামি করা ছাড়া আর কোন কাজ তার নেই। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দ্রুত বলল,’আপনার মামার বিয়ে করতে তো আরও একদিন সময় আছে আপনি বরং আমাকে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখান।’
‘ ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা করে দিব। আপনি এখন সরুন তো। অসহ্য।’
‘ আমার মত একজন ছেলেকে অসহ্য কিভাবে লাগতে পারে এটা ভেবেই আমি অবাক।’
মুখটাতে বিতৃষ্ণার ছাপ ফেলে নীহারিকা পরিষ্কার ভাষায় বলল,’ আমার অতিরিক্ত জিনিস পছন্দ না। এই যেমন আপনি অতিরিক্ত সুন্দর। ঠিক এই একটা জিনিস আমার আপনার মাঝে সবচেয়ে অপছন্দের বিষয়। আর যাকে সবাই পছন্দ করে তাকে আমার প্রচন্ড অপছন্দ। এই যে আপনি দুনিয়া ভর্তি মেয়েদের ক্রাশ এতে আমার বিন্দু মাত্র ইন্টারেস্ট নেই। আমি সাধারণ মানুষ পছন্দ করি। অসাধারণ মানুষ আমার সাথে যায় না। কারণ আমি সাধারণ। সো আপনার এই অসাধরণ রূপের রহস্য অন্যদের দেখালে আমি খুবই উপক্রিত হব। সাথে খুশি হব।’
জাওয়াদ উচ্চ শব্দে হেসে নীহারিকার হাতের কাঁটা আপেলের টুকরো তুলে নেয় নিজের আঙ্গুলের ভাঁজে।বিরক্ত চাহনী নীহারিকার। জায়গা ত্যাগ করতে করতে মিহি কন্ঠে জাওয়াদ বলল,’ আমি তো শুধু আপনার সামনেই অসাধারণ রূপের প্রকাশ ঘটাব। কারণ আপনিও অসাধারণ।’
নীহারিকা মনে মনে বিড়বিড় করল,’ উদ্ভট ছাগল লোক।’
আপেল কাঁটতে কাঁটতে চোখ তার শূন্যের ঘুরে রূবাইদার দিকে নিবন্ধিত হয়ে যায়। সোলানী উজ্জ্বল চঞ্চল রোদের কিরণ হঠাৎ করে জানালা ভেদ করে। রোদ উঠেছে। চমকে যায় নীহারিকা। খানিকের মাঝেই রোদ! ভারী আশ্চর্য হয়ে চোখ ঘুরিয়ে দেখে। রূবাইদা বড্ড বেশি সুন্দর। তার ফর্সা ধবধবে বিদেশি শরীর। সোনালী রং চুল। অসম্ভব সোনালী দু’টি চক্ষু। এত সুন্দর মেয়েকে কে না বিয়ে করতে চাইবে। কালোকে সুন্দর সুন্দর বলে বেড়ানো ছেলেগুলোও বিয়ে করার জন্য সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটির খোঁজ করে। এতে দোষের কিছু নেই। মানুষ সৌন্দর্য্যের পূজারী। এটি চিরন্তর সত্য। নীহারিকার চোখ জ্বলে উঠল। একটা অদ্ভুত অদৃশ্য রাগ চেপে বসল। হঠাৎ সে অনুভব করতে সক্ষম হলো, সে কোন বিশেষ কারণে এত অপরূপা মেয়েটিকে অপছন্দ করতে শুরু করেছে। কোন কারণে এটা বিমুগ্ধ জড়িত ঘটনা নয় তো? চমকে উঠতে উঠতে তার হাত কেঁটে রক্তের স্রোত বয়ে যায়। হাতের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠে সে। এত কাঁটল? কিভাবে? কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার সে খুব একটা ব্যথা অনুভব করছে না। পিঁপড়ের কামড় ব্যতীত কিছু মনে হচ্ছে না তার। হাসল মৃদূ ঠোঁট ঝুলিয়ে। রক্ত বড্ড বেইমান জিনিস। উঠতে বসতে বইমানি করে এরা। নির্গত হলেই মৃত্যু নিকটে।
______________________
প্রখর তাজা রোদ গুটি গুটি পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে এসে বসল তাযিনের শুকনো মুখশ্রীর উপরে। হঠাৎ করে অগ্নি শিখার ন্যায় জ্বলজ্বল করে উঠল মুখের বিন্দু বিন্দু ঘাম। সাথে কুঁচকে এলো কপালের চিকন ভাজ। মুখটা বিকৃত ভঙ্গীতে বাঁকিয়ে সে চোখ মুখ শক্ত করে রইল কয়েক মুহূর্ত। ধপ করে চোখ খুলে ফেলে সে। অর্পন স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে। তাযিন একটু উঠে বসল। তাকে দূর্বল দেখালেও মুখ খুবই সতেজ হয়ে উঠেছে। প্রকৃতীর জন্ম হয় যেভাবে। ঠিক সেভাবে। একটু একটু করে সতেজতা ভর করছে তার মুখশ্রীর উপরীভাগে। তাকে হঠাৎ করে দারুন সুদর্শন মনে হচ্ছে অর্পনের। চাপা হাসল সে। একটি ভ্রু দ্রুত উপরে তুলে নিয়ে তাকাল তাযিন। গম্ভীর কন্ঠে জানতে চাইল,’ হাসছিস কেন?’
অর্পন জবাবে কিছু বলল না। ইনজেকশন খুঁজতে সে আশেপাশে সাদা বক্স খুঁজতে শুরু করল। তাযিন বিরক্ত মুখে বলল,’ পানি দে। মুখ এমন জঘন্য তেঁতো হয়ে রয়েছে কেন?’
‘ এমন ভয়াবহ জ্বর থেকে উঠে এসে তোর মুখ সুস্বাদু খাবারের স্বাদে মুখরিত হয়ে থাকবে এটা ভাবার মত অবুঝ বালক তুই নস আমি জানি।’
অর্পন মুখটা খুবই অদ্ভুত করে রেখেছে। তাযিনের হাসি পেল। ইনজেকশন রেডি করছে সে। খুব সিরিয়াস ভাব। দেখে মনে হচ্ছে ডাক্তার হওয়ার জন্যেই এই ছেলের জন্ম।
‘ আমি জানি তুই আমাকে অপছন্দের তালিকায় প্রথমের বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছিস। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে তুই সারা রাত আমার সেবা করেছিস। কাহিনী কি? সামথিং গোলমেলে এয়ার।’
তাযিন হাসল। বাঁকা হাসি। বিরক্তিতে শরীর ঝনঝন করে উঠল অর্পনের। দুনিয়া তাদের বন্ধু ভাবলেও প্রকৃত অর্থে অর্পন খুব অপছন্দ করে তাযিনকে। অথচ তার পরেও তারা বন্ধু। এক সাথে সব জায়গায় ঘুরে। যেখানে যাবে তাযিন তাকে নিয়ে আসবে। শত্রুকে নিয়ে বসে এক প্লেটে খাবার খাওয়া তাযিনের একটা মুদ্রা দোষ। এটা তার প্রিয় একটা অদ্ভুত খেলা। আজ পর্যন্ত তার সব শত্রুর সাথে সে গলায় গলায় ভাব রেখে এসেছে। তবে অর্পনের সাথে তার মারাত্নক কোন শত্রুতা নেই। কিন্তু অর্পনের সবচেয়ে অপছন্দের মানুষটি তাযিন। তবুও তারা বন্ধু। হাস্যকর হলেও একটা ভয়াবহ সত্য।
‘ শত্রুকে বাঁচিয়ে রেখেই মজা। ‘
‘ নিঃসন্দেহে আমি একমত পৌষণ করছি। এই জন্যেই তোকে আমি এত ঘৃণা করতে পছন্দ করি।’
তাযিন হাসল। অর্পন জোরেই পুষ করল সুই। তাযিন রাগ প্রকাশের ধরণ দেখিয়ে বলল,’ তুই বরাবরই আমার পছন্দের।’ হঠাৎ অর্পনের হাত বাঁকিয়ে পিঠের সাথে ঠেসে ধরল তাযিন। আকর্ষিক কান্ডে হতচকিয়ে যায় অর্পন। সে জানে তাযিন ভাল আক্রমন করে। কিন্তু হুট করে করে বেশি। এটাই তার বিরক্ত লাগে। খুবই বাজে স্বাভাব। একটা গালি দিয়ে অর্পন হাত ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইনজেকশন এখনো তাযিনের বাহুতে ঘেষে রয়েছে। তাযিন বাম হাতে হাতটা মুচড়ে ধরে ডান হাতে ইনজেকশন তুলে নিল। ছুড়ে ফেলে বলল,’ ডোন্ড আন্ডারএস্টিমেট মি। অসুস্থ হয়েও আমি দূ্র্বল নই। রাগ দু’টো জিনিসের উপরে প্রয়োগ করা আমি পছ্ন্দ করিনা। এক শরীরে আর এক খাবারে।’
আর্তনাদ করে অর্পন ঝাঁঝাল গলায় বলল,’ হারামি হাত ছাড়। তোকে বাঁচিয়ে ভুল করলাম। রাতেই মরতে রেখে দিয়ে চলে যাওয়া উঁচিৎ ছিল। অকৃতজ্ঞ একটা।’
তাযিন হো হো শব্দে হাসল। হঠাৎ থেমে শব্দ বিহীন ভাবে বসল বিছানার কোণে। হাত পা একটু ঘুরিয়ে ঠিক করে নিল। একটা সময় সে শান্ত চুপচাপ হয়ে গেল। বরফের নেয় চোখে তাকিয়ে রইল দরজার দিকে। কি মনে করে ক্ষীণ স্বরে জানতে চাইল,’ নীহারিকা সারা রাত এখানে ছিল? এই রুমে?’
‘ হুম।’ অর্পন নিজের হাতের দিকে নজর দিয়ে বলল। হাত ভেঙ্গেই দিলো যেন। ওহ করে শব্দ করে উঠে সে। চোখ রাঙ্গীয়ে বলে উঠে,’ তুই জানোয়ার একটা। দূর হ।’
ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে তাযিন দেখল অর্পন এখনও বসে আছে। ভারী আশ্চর্যের ব্যাপার হলেও তাযিনের মাঝে তার বিন্দু বিসর্গ প্রকাশিত হলো না। সে পূর্বের নেয় বিছানায় বসে বলল,’ নীহারিকা সত্যি রাত জেগেছিল? আমার জন্য?’
ধপ করে জ্বলে উঠা আগুনের ন্যায় অর্পন তাকাল। রিশরিশে কন্ঠে দাঁত চেপে বলল,’ তোর জন্য রাত জাগতে যাবে কেন? না তুই ওকে চিনিস না আমরা চিনি।’
‘ আমার কথা আমাকেই ফেরত! বাহ বাহ বেশ ভাল।’ তাযিন উঠে শার্টের খোঁজ করে। মনে পড় সেটা তার রুমে। একটা কড়া চায়ে ঠোঁট চুবিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তার তীব্র মাথা যন্ত্রণার অবশান হচ্ছে না বুঝতে পেরে সে রুম ত্যাগ করতে উদ্ধত হয়। অর্পন বেশ মন খারাপের ভঙ্গীতে বলল,’তুই এভাবে তাড়িয়ে কেন দিলি নীহারিকাকে? সে কষ্ট পেয়েছে।’
তাযিন হঠাৎ উগ্র মেজাজে ঝড়ের নেয় অর্পনের গলা চেপে ধরে। চেয়ারে বসা অর্পন দম বন্ধ অনুভব করছে। শ্বাস নিতে পারছে না। চোখ উপড়ে আসার উপক্রম। একটা সময় তার গলার স্বর কাশিতে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। পা হয়ে পড়ে শক্ত। তাযিন স্বাভাবিক শান্ত। উত্তেজিত নয় সে। কারও গলা চেপেও কিভাবে কেউ এত শান্ত? অর্পনের মুখশ্রী রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। তাযিন অদ্ভুত ভঙ্গীতে হেসে বলল,’ কষ্টটা তার জন্যে ছিল। তোর বা জাওয়াদের পাওয়ার প্রশ্ন উঠছে না। ‘
নাক উঁচিয়ে শ্বাস নেয় অর্পন। এই পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত প্রাণীর মাঝের একটি এই অসভ্যটা। মনে মনে সে খুবই রাগান্বিত হয়ে উঠে। পিছনে তাকিয়ে চোখ আগুন তাপে যুক্ত করে সে বলল,’ শুন তুই চাইলেও আমরা যা করতে পারব তা পারবি না। শতহোক প্রতিজ্ঞা বদ্ধ তুই। তাও ..’
অর্পন কথা শেষ করার আগেই চুপ করে গেল। তাযিন রেগে যাচ্ছে। মুখ থেকে শান্ত ভাব উবে যাচ্ছে। শান্ত শিষ্ট মানুষ রেগে গেলে সর্বনাশ ঘটে।
‘ তুই নীহারিকাকে পছন্দ করিস?’
অর্পন জবাব দিল না। গলায় হাত বুলিয়ে চলেছে সে। তাযিন শার্ট নিয়ে এসে পড়তে পড়তে বলল,’ অসম্ভব জিনিস চাওয়া তোদের কাজ। পাগল সব।’
‘ অসম্ভব তোর জন্য। আমারা চাইলেই পেতে পারি। জাওয়াদ তো আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে। নাফিস উদ্দিন কিন্তু তাকে দারুন পছন্দ করে। যদিও পছন্দ হওয়া তার রক্তে রয়েছে। সে দেখতেই দারুন।’
কথাটা ঝাঁঝ লাগিয়ে বলল অর্পন। যাতে তাযিন আক্রমনে একটু ঝুঁকে। সে ঝুঁকল না। খুব আয়েশি ভঙ্গীতে বলল,’ প্রেম, ভালোবাসা, নারী এসবের জন্যেই পুরুষের জীবন নয়। আমি এতে বিশ্বাসী। তাই আমাকে শুধু শুধু সামান্য নারী লোভ দেখিয়ে লাভ নেই অর্পন। ইউ নো বেটার দ্যান মি। আফার অল তুই শত্রু আমার। একজন মানুষকে তার শত্রুর চেয়ে বেশি ভাল খুব কম মানুষে চিনে।
‘ তোর সেবা করা ভুল ছিল।’
‘ আমার সামনে পড়াই ভুল তোর। নীহারিকাকে তোর খুব পছন্দ হয়েছে?’
অর্পন বিরক্ত হয়ে বলল,’ হয়েছে। অনেক পছন্দ। কি করবি এবার বল?’
‘ বেশি কিছু করব না। তবে তুই ছ্যাঁকা খাবি।’
‘ এসব আমি খাই না। পছন্দ হয়েছে বলেই দুঃখে বিরহে দেবদাস হওয়ার মত বিশেষত্ব আমার মাঝে বিলুপ্ত। নারী ব্যতীত জীবনে বহুত কাম আছে। কবে ছাড়বি আমাকে বল? নাটক করতে করতে তো ভুলেই যাচ্ছি আমি একজন কার্ডিওলজিস্ট।’
‘ আমি যখন ছাড়া পাব।’
‘ তুই এই জীবনে আর ছাড়া পাচ্ছিস না। প্রেম ভয়ংকর আঠা। লাগলে ছাড়তে চায় না।’ আস্তে করে বিড়বিড় করল অর্পন। জোড়ে বললে গলায় চাপ পড়তে পারে। তাযিন শুনেনি ভেবেছে সে। প্রকৃত অর্থে তাযিনের কানে বাড়ি খেয়েছে সেই কথা গুলো। কিন্তু সে লাপাত্তা ভাব নিয়ে বলল,’ আম্মির জন্য এসেছি। তার মন ভরে যাক। শীঘ্রুই গন্তব্যে পৌছে যাব।’
‘ তোকে আমি বুঝিনা বিমুগ্ধ।’
তাযিন ভ্রু-যুগল খাদে নামিয়ে বলল,’ না বুঝার কি আছে?’
‘ এই যে তোর দুই নামের সাথে দুটি অস্তিত্বও রয়েছে। তুই দুই ধরনের মানুষ। তাযিন ভিন্ন বিমুগ্ধ আরও ভিন্ন। প্রকৃত অর্থে তুই কোন অস্তিত্বকে বেশি বহন করিস বল তো।’
‘ আমি অধীক সময় এক অস্তিত্বের সাথে থাকতে পছন্দ করিনা। যেমন তাযিনের প্রতি আমি প্রচন্ড তিক্ত বিরক্ত এখন।’
দরজা ভেদ করে তাযিন হেঁটে চলে গেল। অর্পন তাজ্জব হয়ে ভাবল নিজেকে নিজের তিক্ত বিরক্ত লাগে? আজব সব জিনিস। সে ফোন বের করল। তার আজকে একটা গুরুত্বপূর্ন রোগীর রিপোর্ট চেক করতে হবে। হার্ডে ব্লক পড়েছে দু’টি রিং বসাতে হবে দ্রুত।
____________________________
রান্নাঘরের সামনেই ডাইনিং টেবিল বসানো। নীহারিকা সেটার সাথে ঠেসে দাঁড়িয়ে এখনও আপেলে মত্ত রয়েছে। কাঁটা হাত বেঁধে সে আবার আপেলে ডুব দিতে হাজির হয়েছে। পৃথিবীর সব ফলের মাঝে তার আপেল দারুন প্রিয়। এক সাথে কম করে হলেও সে পাঁচটা খেতে পারে। আপেলের কচকচ শব্দ তার ভাল লাগে। মনে হয় রসে মুখ ভর্তি হয়ে উঠেছে। দাঁতের সাথে পিষে রসালো আপেল তাকে তিপ্তি অনুভব করায়। লাল টকটকে তিন নম্বার আপেলে ছুরি বসায় সে। গায়ে একটা সুগন্ধ আছে। আপেলকে নীহারিকার রুপসী মনে হয়। যার উপরের টকটকে রঙটা ভারী সুন্দর। কিন্তু কামড়ে খেতে পছন্দ করে না নীহারিকা। তার মতে সব কিছুর একটি শিল্প ভঙ্গী রয়েছে। ছুরি আপেলের বুকে বসিয়ে দিতেই কেউ ফুঁ দিয়ে গালের পাশের ওড়না নাড়িয়ে তুলে। চমকে উঠে নীহারিকা পাশে তাকায়। তাযিন ফুঁ টা দ্বিতীয় বার প্রদান করতেই তা নীহারিকার চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে ধৌঁয়ার মত। চোখে কৌতুহল খেলে গেল নীহারিকার। কিছু সময় তাকিয়ে থেকে ভোরের ঘটনা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই সে স্থান ত্যাগ করে অন্যপাশের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায়। তাযিন অদ্ভুত আচরণ করছে। সে উল্টো ঘুরে পাশে এসে দাঁড়াতেই নীহারিকা সরে যেতে নেয়। তাযিন অলস ভঙ্গীতে বলল,’ এত লাফালাফি করছেন কেন আপনি?’
কথা বলল না নীহারিকা। মনে মনে খুব অবাক হচ্ছে সে। এই ছেলে হঠাৎ তার সাথে কথা বলতে এসেছে কেন? তাযিন একদম ঘেঁষে দাঁড়াতেই নীহারিকা চোখ বড় করে বলল,’ কাছে আসছেন কেন? কেউ দেখলে বাজে ভাববে।’
‘ নিয়ত ভাল থাকতে হয়।’ সে ফ্রিজ খুলে। নীহারিকা নিজের কান্ডে বিস্মৃত। সে ফ্রিজের দরজার কাছেই ছিল। তাযিন বাঁকা ঠোঁট করে হাসল। পানিতে ঠোঁট চুবিয়ে বলল,’সকালের ব্যবহারটা আমি ইচ্ছে করে করতে চাইনি। সেটা আমার ভুল হয়েছে।’
ভ্রু কুঁচকে নীহারিকা বলল,’ শিকার করছেন?’
‘ নিজের ভুল শিকারের মাঝে আমার গর্ব হয়। দুঃখিত।’
রাগে শরীর জ্বলে উঠে নীহারিকার। চোখ হয়ে উঠে উজ্জ্বল আগুন। ক্ষমা যাচ্ছে তাও দাম্ভিকতা নিয়ে! ক্ষুদ্ধ কন্ঠে সে বলল,’ আপনার দুঃখিত আমি নিচ্ছি না। দূরে থাকুন। ‘
তাযিন হাসল। তবে সেটাকে হাসি বলা চলে না। উপহাস করে সে বলল,’ আমি নিজের ইচ্ছায় কাজ করতে পছন্দ করি। দূরে আমি না চাইলে আপনিও সরাতে পারবেন না।’
‘ রাগীয়ে দিবেন না। মাথা আগুন হয়ে আছে। সরুন।’
‘ রাগ তো আপনার জন্মের সাথেই মিশ্রীত। দাদুর মত হয়েছেন না চাচ্চুর মত?’
গায়ের ওড়না ঠিক করে নীহারিকা বলল,’ কে দাদু? কে চাচ্চু? আশ্চর্য!’
‘ আশ্চর্যের বড় একটা অংশ আপনি।’
‘ কথা ঘুরাতে আপনার চেয়ে বড় ওস্তাদ আমি জন্মে দেখিনি। বাবা এজন্যই বলে ছেলেদের থেকে দূরে থাক। যতসব ভেড়ার পাল।’
নীহারিকা চলে যেতে নেয়। তাযিন ফ্রিজের দরজা খুলে সামনে দাঁড়ায়। দু’জন দু’ পাশে। মাঝে অর্ধ দরজা। চকিতে তাকাল নীহারিকা। জ্বরের চোটে উদ্ভুত ব্যবহার করছে মনে হয়। তাযিন নিচু কন্ঠে জানতে চাইল,’ আপনার বাবার নাম যেন কি?’
‘ তা জেনে আপনি কি করবেন? পথ ছাড়ুন।’ রুক্ষ স্বর নীহারিকার। তাযিন ফ্রিজে বোতল রাখল। বলল,’ প্রশ্ন করেছি উত্তর দিন।’
এবার নীহারিকা প্রচন্ড রেগে গেল। হাতে থাকা ছুরি চেপে ধরল তাযিনের গলার মাঝ ভাগে। একটুও চমকায়নি তাযিন। সে যেন যানত এই ছুরির শিকার হতে চলেছে সে।
‘ বাবার মত অসভ্য স্বভাবের আপনি।’
রেগে আগুন নীহারিকা। তার বাবাকে নিয়ে কথা বলছে? কত বড় স্পর্ধা। ছুরি গভীরে নেওয়ার ভঙ্গীতে এগিয়ে নিল সে। বেশ লাল মুখ করে বলল,’ বাবা তুলে কথা বলছেন কোন সাহসে? ‘
‘ আমি সত্য বলতে পছন্দ করি। নামটা বলে দিলেই হলো। সাহস দেখাতাম না।’
‘ মরে গেলেও বলব না। অসভ্য বলেছেন কেন?’
‘ কারন আপনি তাই। ছুরি সরিয়ে নিন।’
‘ গলা কেঁটে রেখে দিব অসভ্য ছেলে।’
তাযিন উচ্চ শব্দে হেসে উঠে বলল,’ ছুরিই ধরতে পারেন না আবার গলা কাঁটার ধান্দা। বান্দা আপনি অবুঝ।’
নীহারিকা গলার দিকে তাকায়। সাদা গলায় সিলবার রঙ্গের ছুরি উল্টো হয়ে গেঁথে আছে। তাই তো ভাবছে কোন রিয়েকশন নেই কেন? নিজেকে আহাম্মক মনে হলো তার। সাথে এই ছেলেকে হঠাৎ বেয়াদপ ইতর মনে হচ্ছে। ছুরি আগের মত রেখে সে বলল,’ আপনার ছোট আন্টিকে প্রশ্ন করবেন তার অসভ্য মেয়ের বাবার নাম কি। আপনার মত বেয়াদপ পুরুষ আমি এই জীবনে কম দেখেছি। ‘
জাওয়াদ আর্তনাদ ভরা কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল,’ আর ইউ ফাইন নীহারিকা? করছেন কি? গলা কাঁটবেন না কি? ‘
তার চিৎকারে হল রুমের সবাই ছুটে আসে। নীহারিকার দিকে তাকিয়ে আফিয়া আঁতকে উঠে বলল,’ নীহু এসব কি? হাত থেকে ছুরি ছাড়। ছেলেটার লেগে যাবে।’
নীহারিকা ভড়কে যায়। জাওয়াদ ভয়ার্কত কন্ঠে বলল,’ আপনি সত্যি খুব মারাত্নক।’
মিতু আপু ছুটে এসে ছুরির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,’ আরে উল্টো ধরেছে। তাযিন ভাই মরবে না। নো চিন্তা। তা এই দাঙ্গার কারণ কি?’
রূবাইদা হাতের মেহেদী উপরে তুলে সবার ভীরে প্রবেশ করে চোখ উল্টে নেয়। অসুস্থ তাযিন কখন উঠে আসল? সে তো ভেবেছিল ঘুমচ্ছে। তাই ডিস্টার্ব করছিলো না। দ্রুত সে এসে ইংরেজিতে বলল,’ তুমি ঠিক আছ? জ্বরের শরীর নিয়ে উঠে এসেছ কেন? নীহারিকা কি করছ তুমি?’
ছুরি নামিয়ে নীহারিকা সবার আদিক্ষেতা দেখে বলল,’ উনি আমাকে বিরক্ত করছিল।’
ভূত দেখার মত চমকে উঠে উপস্থিত সবাই। এই দুই তিন দিনে সবাই জেনে গেছে তাযিন অত্যন্ত শান্ত ভদ্র ছেলে। খুব একটা কথা বলার পাত্র সে নয়। সেখানে বিরক্ত?’
তাযিন মৃদূ হেসে বলল,’ বাবার নাম জিজ্ঞেস করতেই তিনি রেগে আগুন। ছোট আন্টি আপনার হাজবেন্টের নাম কি?’
‘ নাফিজ উদ্দিন বাবা। নীহু তুই এত অসভ্য কিভাবে হতে পারলি? একটা নিরিহ ছেলেকে এভাবে করতে পারলি? তুই দিন দিন বেয়াদপ হয়ে উঠছিস। কথায় কথায় এত রাগ ভাল না। থাপড়ে গাল লাল করে দিব তোর। বাপের নামই তো জানতে চেয়েছে। তোর কি বাপ নেই? আজই তোর বাবার কাছে বিচার দিব। তার আদরের কলিজা কত বড় অসভ্যে পরিণত হয়েছে তাকে বুঝাতে হবে না। তোরে তো তখন পুরুষ্কার দিব।’
মা নীহারিকার হাত চেপে মুচড়ে ধরলেন। ব্যথা পেলেও তেমন পাত্তা দিলো না নীহারিকা। তাযিনের শরীর তার খন্ড খন্ড করতে ইচ্ছে করছে। এই ছেলে তার জীবনটা তেঁতো করে তুলেছে। যখন তখন অপমানের শিকারে ফেলছে তাকে। সুযোগ আসলে বিন্দু পরিমান ছাড় দিবে না বেয়াদপ বেপরোয়া একটা। জাওয়াদ পক্ষ নিয়ে বলল,’ আন্টি এভাবে বলবেন না। হয় তো মজা করছিল।’
তাযিন এবার মুখ খুলে বলল,’ আসলেই মজা করছিল। সত্য হলে অবশ্যই ছুরি উল্টো ধরতো না। কি বলেন মিস নীহারিকা?’
জবাব দিলনা নীহারিকা। তাযিনের দিকে তির্যক আগুন চোখে তাকিয়ে রইল। ভস্ম করে দিবে যেন। ভেবে পাচ্ছে না এই ছেলের সাথে শত্রুতাটা কোথায়।
সবাই তাযিনের হালচাল নিয়ে প্রশ্নে পঞ্চমুখ। নীহারিকা কোণে বসে রইল। রূবাইদা একটু দুঃখিত ভাব নিয়ে বলল,’রাতে আমি তোমাকে একবার দেখতে গিয়েছিলাম। তখন তুমি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে। ব্যাপারটা খুব মর্মান্তিক।’
মিতু আপু আস্তে করে বলল,’ তাহলে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলে কেন? যতসব।’
তিশা বেশ শুনতে পেলো। হেসে বলল,’ আরে ও বিদেশি পরিবেশে বড় হয়েছে। বাংলাদেশিদের মত তাদের মাঝে এত আবেগ কাজ করে না। খুব সহজ ভাবে সব কিছু মানিয়ে নেয় তারা। এটা তো অসুস্থ ছিল মাত্র। মৃত্যু হলেও তারা বাঙ্গালীর মত হাউ মাউ করে কেঁদে সময় অপচয় করে না।’
মুখ ভেঙ্গচি মারে মিতু আপু।
তাযিন বাঁকা চোখে নীহারিকাকে দেখে। মন খারাপের প্রলেপ ভরা মুখ তার। উদাসীন হয়ে টিভির দিকে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে। মনে মনে হেসে ফেলল সে। বিড়বিড় করে বলল,’মিস ক্ষিপ্তরানী আপনি সত্যি আপনার বাবার মত অসভ্য ধাঁচের। তবে আমি পছন্দ করছি। পরিবর্তন হতে হবে না। আচ্ছা পরিবর্তন না করতে চাওয়াই কি ভালোবাসা?’
তাযিন ইষৎ চমকে উঠে চোখ গুলো বুজে নেয়। তার শরীর মৃদু দূলে উঠেছে। যদি এটা ভালোবাসা হয় তাহলে সে অগ্নি গহ্বরে প্রবেশ করছে। ভয়াবহ অগ্নিকুণ্ডে তলিয়ে যেতে হবে তাকে। এটা অসম্ভব। এই মেয়েটি তার জন্য সৃষ্টি নয়। সে জানে। খুব ভাল করেই জানে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তবুও দিন শেষে, রাতের মধ্যভাগে সে এই মেয়ের ভাবনায় ডুবতে ভালোবাসে। যেনে বুঝে আগুনে ঝাপ দেওয়ার নামই কি ভালোবাসা?
__________________________
আসসালামু আলাইকুম। আশা করি সবাই ভাল আছেন। আমি আল্লাহর রহমতে ভাল আছি। অনেক দিন পরে আজ গল্প দিয়েছি। অবশ্যই কারণ রয়েছে। দেরির জন্য দুঃখিত। আপনাদের ভালোবাসা দেখে আমি মুগ্ধ। প্রতিদিনই সবাই আমার খোঁজে মেসেজ বক্স কাঁপিয়ে তুলেছেন। আমি ভাবতাম আমি যদি অনলাইন জগৎ থেকে হুট করে হারিয়ে যাই আপনারা ভুলে যাবেন। কিন্তু তা হয়নি। সত্যি আমি ভাবিনি এমনটা হবে। যারা প্রায় আমাকে মেসেজ করেছেন আমি জানি রিপ্লাই পাননি। তার জন্য খুবই দুঃখিত। আমি তেমন অনলাইনে এক্টিভ ছিলাম না। দুই তিনদিন পরে ঢুকলে দেখতাম। তখন আর রিপ্লাই করার মত ভালো লাগা কাজ করতনা। অসুস্থ ছিলাম। তাই আমি আন্তরিক ভাবে তাদের কাছে ক্ষমা চাইছি। আর গল্পটা যে এত পছন্দের তা আমি আগে জানতাম না। ইনশাআল্লাহ কালও গল্পের পর্ব পাবেন। দোয়া করবেন। আর অসংখ্য ভালোবাসা সকলের জন্য।
ধন্যবাদ।
ভালোবাসা রইল।
ভুলগুলো আল্লাহর দেওয়া মহান গুন ক্ষমার চোখে দেখবেন।
#চলবে…………
@হাফসা আলম……………..