প্রিয়াঞ্জনা এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই (পর্ব ৩২)

0
744

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-৩২
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

চন্দ্রবিলাস ঘরটি এই কয়েকমাসেই বড্ড আপন হয়ে গিয়েছিলো। সবকিছু যখন গুছিয়ে নিচ্ছিলো তখন ভিষণ কষ্ট হচ্ছিলো প্রিয়াঞ্জনার। আজ রাতেই তারা গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিবে। শাহবাজ যেহেতু একেবারে চলে যাবে তাই প্রথমে অধ্যক্ষ মোশতাকের সাথে দেখা করে সে। কথা হয় বেশ অনেকক্ষণ। মোশতাক সাহেব মন ভরে দোয়া করেছেন শাহবাজের জন্য। ছেলেটা মেধাবী, পরিশ্রমী। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো সহজ-সরল। ছেলেটা যেন আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তিনি অন্তর থেকে দোয়া করেছেন। তারপর শাহবাজ আসে তার একজন শিক্ষার্থীর বাসায়। গতমাসের বেতন দেয়নি তারা। ছাত্রের মাকে শাহবাজ বললো,
“আন্টি, আমার বেতনটা যদি দিয়ে দিতেন তাহলে ভালো হতো।”
“স্যার, কয়েকদিন পরে নেন। বিপদে আছি।”
“আমি শিবপুর ছেড়ে চলে যাচ্ছি আন্টি। আর কখনো আসতে পারবো কিনা জানিনা।”

ভদ্রমহিলা যথেষ্ট ধনবান। স্বামী পল্লী বিদুৎ অফিসে চাকুরি করেন। কিন্তু মহিলার স্বভাবই এমন। গৃহশিক্ষকদের টাকা দিতে চান না। তিনি বললেন,
“তাহলে পরে শিবপুর আসলে নিয়েন।”
“অন্তত কিছু টাকাও যদি দিতেন তাহলে উপকার হতো আন্টি।”

মহিলা ধমকে বলে উঠলেন,
“এত টাকা টাকা করছেন কেন, স্যার? হাভাতে আপনি?”

শাহাবাজ লজ্জা পেলো। বেরিয়ে এলো তাদের বাড়ি থেকে। এমন চার হাজার টাকা এক সময় শাহবাজের একদিনের রেস্টুরেন্টের বিল ছিলো। আজ এই টাকার জন্য কথা শুনতে হয়েছে তাকে। ভাগ্য সত্যিই অদ্ভুত!
নাদিয়া ছাদে গোলাপ দেখছে সাথে গুণগুণ করে গান গাইছে। প্রিয়াঞ্জনা পাশে এসে দাঁড়ায়। তার আকস্মিক আগমনে চমকে যায় নাদিয়া। আজ আকাশ মেঘলা। হালকা হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। প্রিয়াঞ্জনা মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“তুমি যে কাজটা করেছো একদম ভালো করো নি নাদিয়া।”
“কি করলাম আমি?”
“নাটক করো না। আমার সামনে নাটকের প্রয়োজন নেই।”
“আপনার সাথে নাটক করার কিংবা কথা বলার ইচ্ছেও আমার নেই।”
“আমার শাহ্কে আমি চিনি, নাদিয়া। সে কেমন আমি জানি। নিষ্পাপ, এতিম মানুষটাকে তুমি কষ্ট দিয়েছো। আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রেখেছি। তিনি তোমার বিচার করবেন।”
“আপনি আমাকে এভাবে বলতে পারেন না। গজ ব আল্লাহ আপনাদের উপরেই ফেলছে। বড় বড় কথা বলেন।”

নাদিয়াও কম না মুখে মুখে তর্ক করছে।
“ঠিক আছে। দেখা যাবে সামনে কি হয়। আমি কখনো মানুষকে অভিশাপ দেইনা। কিন্তু তোমরা আমার শাহ্ কে বিনা কারণে আ ঘা ত করেছো। আমার শাহ্ অসহায়। এতিমের উপর অন্যায় আল্লাহ ও সহ্য করেন না।”
“হইছে, রাখেন। আপনার আজাইরা কথা শোনার সময় নাই। আপনার জামাই একেবারে ধোঁয়া তুলসি পাতা।”

ভেংচি কেটে নাদিয়া নিচে চলে গেলো। রাতেই শিবপুর ছাড়ে শাহবাজ, প্রিয়াঞ্জনা। ভেলানগর বাসস্ট্যান্ডে রিমন এবং সুফিয়ার সাথে দেখা করে পাড়ি জমায় গাজীপুর। বাসে উঠে বসার পর প্রিয়াঞ্জনা অনুভব করলো প্রথমদিনের মতো লাগছে। সেদিনের মতো বৃষ্টিও হচ্ছে আজ। শরীফ জামান সাহেবের সাথে প্রিয়াঞ্জনার কথা হয়েছে। এত অমায়িক মানুষ সে খুবই কম দেখেছে। ভালো মানুষের চোখ দেখলেই চেনা যায়। জামান সাহেব সত্যিকার অর্থেই একজন ভালো মানুষ।

কেটে গেলো সাতমাস। গাজীপুরে আসার পর অভাবনীয় ভাবে বদলে গেলো শাহবাজ এবং প্রিয়াঞ্জনার জীবন। ব্যবসায় প্রবেশ করা মাত্রই একের পর এক সাফল্য। সোনার কাঠি, রূপার কাঠি ছুঁয়ালে যেমন রূপকথার জগতে দুঃখ দূর করা যায়; ঠিক তেমন করে একটা সুযোগ বদলে দিয়েছে শাহবাজের জীবন। জামান সাহেবের দোকানের পাশে নিজের দোকান দিয়েছে সে। আকরামের সকল টাকা পরিশোধ করেছে। আস্তে আস্তে অন্যদের ঋণও দিচ্ছে। কাপড়ের ব্যবসায় একবার যদি উপরে উঠা যায় তাহলে আর পিছনে ফিরে তাকানোর প্রয়োজন পড়েনা। শাহবাজের চৌকস বুদ্ধি, পরিশ্রম তাকে সফল করেছে। একজন ব্যবসায়ী নিজের দুটি কাপড় তৈরির কারখানা বিক্রি করে দিবেন। লসেই দিয়ে দিচ্ছেন। পনেরো লাখ টাকা দিয়ে সে কারখানা ক্রয় করে শাহবাজ। এই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে সে পাইকারি কাপড় নিতো। তিনি অনেক লস করেছেন ব্যবসায়। তাই নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিলেন সব মেশিন। কারিগরসহ শ্রমিক আছেন প্রায় একশত জনের মতো। কারখানা দুটো কোনা বাড়ির পাশেই। শাহবাজের কাপড় তৈরির ব্যবসায় অভিজ্ঞতা আছে। ম্যাজিকের মতো এই ব্যবসায়ও সে সফল। এইবার আর কাপড়ের ব্যবসায় সীমাবদ্ধ থাকেনি শাহবাজ। বাস কিনেছে চারটা। বাসের ব্যবসায় অনেক টাকা। একটু বুদ্ধি খাটালেই চলে। সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিতেও বিনিয়োগ করার ইচ্ছে আছে তার। এত দ্রুত আবার আগের অবস্থানে ফিরে আসবে কখনো কল্পনাও করেনি শাহবাজ।

গাজীপুরের এক আবাসিক এলাকার বহুতল ভবনে ডুপ্লেক্স বাসায় থাকতেন জামান সাহেব। শাহবাজ, প্রিয়াঞ্জনা এখানেই উঠেছিলো প্রথমদিন। আজও তারা এখানেই থাকে। প্রিয়াঞ্জনার কখনো মনে হয়নি জামান সাহেব তাদের অল্পদিনের পরিচিত। শাহবাজ এবং তার মাথায় সবসময় ছায়ার মতন থাকেন। ঠিক একজন বাবার মতন। সবকিছুতে গাইড করেন শাহবাজকে।
আর কিছুদিন বাদেই প্রিয়াঞ্জনার ডেলিভারি ডেট। জান্নাতের টুকরা আসবে তার ঘরে। মেয়েটা পেটে আসার পর থেকে সবকিছুতেই বরকত হচ্ছে। প্রিয়াঞ্জনাকে খাইয়ে দিচ্ছিল শাহবাজ। আপেল, কমলা, আনার এক বাটি ভরে এনেছে। কিছুক্ষণ আগেই প্রিয়াঞ্জনা বমি করে শাহবাজের শরীর ভাসিয়েছিলো। বিন্দুমাত্র বিরক্ত শাহবাজের চোখে ছিলোনা। বরং পরম যত্নে তাকে পরিষ্কার করে দিয়েছে। এখন ফল খাইয়ে দিচ্ছে। আজকাল প্রিয়াঞ্জনার মন ভালো থাকেনা। বারবার মনে হয় সবকিছু তো ঠিক হয়ে গিয়েছে। কোনো অভাব, দুঃখ তাদের নেই। শাহবাজ, অনাগত সন্তান এবং সে খুব সুন্দরভাবে বাঁচতে পারবে। কিন্তু যদি সে
মা রা যায়! মৃ ত্যু ভয় হয়। আলতো করে শাহবাজকে জড়িয়ে ধরে প্রিয়াঞ্জনা। গভীর আবেগে বলে,
“আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি শাহ্।”
“আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি, প্রিয়াঞ্জনা।”

প্রিয়াঞ্জনার উঁচু হয়ে আসা পেটের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে সেখানে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয় শাহবাজ। হাত দিয়ে স্পর্শ করে অনুভব করার চেষ্টা করে নিজের অংশকে। কি সুন্দর! এ জগতের নিয়ম। একজন পুরুষের অংশ বেড়ে উঠে তার আপনার চেয়ে আপন অর্ধাঙ্গীর গর্ভে। এ অনুভূতি স্বর্গীয়। অত্যন্ত স্নিগ্ধ। মানুষের জীবন বহমান। ঠিক নদীর মতন। কখনো স্থির, কখনো উত্তাল। জীবনসঙ্গীর খারাপ সময়ে যারা নিজের সুখের জন্য ছেড়ে যায় তারা স্বার্থপর। তারা কখনো ভালোবাসতে জানেনা। জীবনে কোনো না কোনো সময় অনুভব করে তারা অসুখী। অপরপ্রান্তে প্রিয় মানুষটার দুঃসময়ে পাশে থেকে ভরসা দিলে, বিশ্বাস করলে একসময় দুঃসময় কেটে যায়। বন্ধন মজবুত হয়। প্রকৃত সুখ অর্জন করা যায়।

(চলবে)…

(শেষের পথে। আর সর্বোচ্চ তিনটি পর্ব।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here