#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২৯
নাদিয়ার আত্মসম্মানে আ ঘা ত লাগলো প্রচুর। রাগও লাগছে। ওকে কখনো কেউ এভাবে বকেনি। বাবাকে সে শ্রদ্ধা করে। একমাত্র বাবাই তাকে মাঝেমাঝে এভাবে বকে। তাও শুধু রেজাল্ট খারাপ হলে বকে। কোথাকার কোন লোক! ভালোই তো বেসেছে নাদিয়া। কোনো অপরাধ তো করেনি। ওঁর সাহস হয় কি করে নাদিয়াকে ধমকানোর! এর প্রতিশোধ তো নাদিয়া অবশ্যই নিবে। চোখ-মুখ ফুলে গিয়েছে তার। কাঁদতে কাঁদতে মুখ একেবারে লালবর্ণ। নাদিয়া বিছানায় শুয়েছিলো। সেখান থেকে উঠে বাবা-মায়ের ঘরে গেলো। বদরুজ্জামান সাহেব চা পান করছিলেন। নাজমা ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। বাবার কাছে গিয়ে কোলে মাথা রাখে নাদিয়া। বদরুজ্জামান সাহেব মেয়ের চোখমুখ দেখে বুঝতে পারলেন কিছু একটা হয়েছে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হইছে, মা?”
“বাবা, বাবা…
বলেই উচ্চ সুরে কেঁদে উঠে নাদিয়া। নাজমা বেগম হন্তদন্ত হয়ে মেয়ের কাছে এলেন। বদরুজ্জামান সাহেবকেও বেশ চিন্তিত দেখালো। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন,
“বাবাকে বলো মা। কেউ বকেছে? বীথি ঝগড়া করেছে?”
কান্নার কারণে কথাই বলতে পারছেনা নাদিয়া। নাজমা মেয়ের শিয়রের কাছে বসলেন। কিছু সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর ক্ষান্ত হয় নাদিয়া। নিজ থেকেই বলতে শুরু করে,
“বাবা, আমি তোমাকে একটা অভিযোগ করবো। তুমি কথা দাও এর বিচার করবা?”
বদরুজ্জামান সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“কি কথা মা?”
“বাবা, তোমার কথাতেই আমি শাহবাজ স্যারের কাছে পড়া শুরু করি। উনি খুব খারাপ বাবা। উনি আমার শরীরে বাজেভাবে স্পর্শ করেছে কয়েকবার। আজকেও করেছে।”
বদরুজ্জামান সাহেব মেয়ের কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তার জানা মতে শাহবাজ খুবই ভালো ছেলে। যদিও তার বাবার চরিত্র খারাপ ছিলো। কিন্তু..
নাজমা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন,
“আমি আগেই বলেছিলাম। যে ছেলের বাবা তিন বিয়ে করছে সেই ছেলের চরিত্র আর কেমন হবে! না, আপনি জন দরদী সাজছেন। এখন এর বিহিত করেন।”
নাদিয়া কখনো বাবাকে মিথ্যা বলেনা। এটা পরিবারের সবার জানা। মেয়েকে তাই অবিশ্বাসও করা যাচ্ছেনা। তবুও তিনি মেয়েকে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
“নাদিয়া, মা। তুমি কি সত্যি বলছো?”
“আমি তোমাকে কখনো মিথ্যা বলেছি বাবা!”
নাদিয়ার কান্নার বেগ বাড়ে। নাজমা রেগে যান। ক্রুদ্ধ সুরে স্বামীকে বলেন,
“এত বড় একটা ঘটনার পরও মনে হচ্ছে মেয়ে মিথ্যা বলছে! মেয়ের প্রতি এই বিশ্বাস?”
ঘটনা যদি সত্য হয়ে থাকে এর তো অবশ্যই একটা বিহিত হওয়া জরুরি। শাহবাজ তো এখানে কৃতঘ্নের পরিচয় দিলো। সত্যি বলতে স্ত্রীকে অনেক বলে শাহবাজদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। অনুরোধ করেছিলেন যেন তাদের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার না করে। নাজমা তার কথা রেখেছেন। তারা সবাই উপরে এলেন। ঘরের দরজা লাগানো। সেসময় শাহবাজ ঘরে ফিরেই প্রিয়াঞ্জনাকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তার মনে হচ্ছিল এত চিন্তা করলে সে মা রা যাবে। তার ঘুম প্রয়োজন। প্রিয়াঞ্জনাও কোনো প্রশ্ন করেনি। দরজায় হালকা করে টোকা দিলেন বদরুজ্জামান। শাহ্, প্রিয়া তখন গভীর ঘুমে। নাজমা জোরে জোরে দরজায় আ ঘাত করা শুরু করলেন। হাসিমুখে আপ্যায়ন করলেও তিনি শুরু থেকেই স্বামীর বিরুদ্ধে ছিলেন। যা করতেন তা অনেকটা মুখে মুখেই ছিলো তার। শাহদাত চৌধুরীর চরিত্র নিয়ে তিনি বহু কথা শুনেছেন। এটা ঠিক তার স্বামীকে সাহায্য করেছিলো। তবে চরিত্র তো খারাপ। সেই লোকের সন্তানকে তিনি বাড়িতে কি করে স্থান দিবেন! দুইজন অবিবাহিত কন্যা তার ঘরে। তারউপর এই ছেলের উপরেও প্রতারণা, টাকা মে রে দেওয়ার অভিযোগ আছে। শাহ্ এর ব্যবহার তাকে মুগ্ধ করেছিলো এ কথা তিনি অস্বীকার করেন না। মেয়েকে এই ছেলের কাছে পড়তে দেওয়ার ইচ্ছাও তার ছিলোনা। স্বামীর কথায় দিয়েছেন কেবল।
“কি করছো নাজমা!”
“ভয় পেয়েই দরজা খুলছেনা।”
বদরুজ্জামান ভ্রু কুঁচকালেন। মেয়েকে তিনি বিশ্বাস-অবিশ্বাস কোনোটাই করতে পারছেন না।
এমন সময় দরজা খুললো প্রিয়াঞ্জনা। গভীর ঘুম তার চোখে। চিন্তিত কন্ঠে শুধালো,
“কি হয়েছে চাচি?”
“তোমার স্বামীকে ডাকো।”
“উনি তো ঘুমাচ্ছেন।”
“নোংরা কাজ করে আবার ঘুম আসে কেমনে?”
নাজমার কথায় অবাক হলো প্রিয়াঞ্জনা। বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“মানে?”
নাদিয়া কান্না করে যাচ্ছে। বিথী ওকে সামলাচ্ছে। প্রিয়াঞ্জনাকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন নাজমা। বদরুজ্জামান চেয়েও থামাতে পারলেন না। সবাই ঘরে ঢুকলো। চেঁচামেচিতে শাহবাজ উঠে বসেছে বিছানায়। নাজমা বললেন,
“এই ছেলে। তুমি আমার মেয়ের গাঁয়ে হাত দিয়েছো কেন? ল ম্পট।”
শাহবাজ অবাক হয়ে নাদিয়ার পানে চাইলো। নাদিয়া মাথা নিচু করে কাঁদছে। উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“আপনি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা, চাচি।”
বদরুজ্জামান ভূঁইয়া সাহেব মুখ খুললেন এবার। ব্যথিত কন্ঠে বললেন,
“আপনাকে আমি বড় ভরসা করেছিলাম শাহবাজ। আপনি এই কাজটা করতে পারলেন?”
“কি করেছি আমি চাচা?”
নাজমা বললেন,
“এমন সাজছে যেন ভাজা মাছ উল্টায় খেতে জানেনা। আমার মেয়ে কখনো মিথ্যা বলেনা। বাবার কাছে তো নাই। সেই মেয়ে চোখ, মুখ ফুলিয়ে ফেলছে কান্না করে। কিছু না হলেই এমন করার মেয়ে আমার নাদিয়া না। তোমার সাহস কি করে হয় আমার মেয়ের গাঁয়ে হাত দেওয়ার! ছিঃ! বাপের মতনই চরিত্র পাইছো। মেয়েবাজ কোথাকার!”
শাহাবাজের রাগের মাত্রা আকাশ ছুঁয়েছে এবার। কি মিথ্যাবাদী মেয়েটা! সে হিং স্র বাঘের মতো তেড়ে গেলো নাদিয়ার দিকে। কেউ কিছু বোঝার আগেই
চ ড় বসিয়ে দিলো তার গালে। চিৎকার করে বললো,
“আমি কখনো তোমার গাঁয়ে হাত দিয়েছি। এই মেয়ে আল্লাহর কসম করে বলো কখনো এমন কিছু করেছি?”
নাদিয়া গালে হাত দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। নাজমা এক ধাক্কা দিয়ে শাহবাজকে সরিয়ে দিলেন। মেয়েদের ব্যাপারে তিনি পৃথিবীর কাউকেই ছাড় দেন না। নিজের খালাতো ভাইকেই পুলিশের হাতে দিয়েছিলেন।
“এই কু ত্তার বাচ্চা। কোন সাহসে আমার মেয়ের গাঁয়ে হাত তুলিস তুই।”
বদরুজ্জামানও বেশ রেগে গেলেন। তবে স্ত্রীকে আটকে ধরে সামলাচ্ছেন। সেই সাথে বললেন,
“এই কাজটা কিন্তু আপনি ঠিক করেন নাই। আমার সামনে আমার মেয়ের গাঁয়ে হাত কি করে তুললেন আপনি।”
শাহবাজও সমান তালে বলে যাচ্ছে। বড় কোনো
মা রা মা রি হতে পারে। প্রিয়াঞ্জনা তাই শাহবাজকে থামানোর চেষ্টা করলো। নাজমা প্রায় ছুটে এসেই শাহবাজের গালে চ ড় বসিয়ে দিলেন। হিংস্র বাঘের মতো গর্জে উঠলো শাহবাজ। রাগ এত পরিমাণে বেড়েছে তার। সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছেনা।
“আপনি কোন সাহসে আমার গাঁয়ে হাত দিলেন। এই মহিলা! নিজের মেয়ের চরিত্র সম্পর্কে জানা আছে আপনার? পায়ে পায়ে খোঁচা দেয়। বিবাহিত পুরুষের সাথে সম্পর্ক করতে চায়। বে * পয়দা করছেন একটা।”
অবস্থা বেগতিক হচ্ছে। শাহবাজের মাথায় র ক্ত উঠে গেছে। প্রিয়াঞ্জনা এক পর্যায়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলো শাহবাজকে। বদরুজ্জামান সাহেবকে বললো,
“চাচা, আমরা কালকে এই ব্যাপারে কথা বলি? আপনারা এখন যান।”
নাজমা চিৎকার করে বললেন,
“কোনো কথা নাই। দুইদিনের মধ্যে ঘর খালি চাই।”
একপ্রকার টেনে হিঁচড়ে নাজমাকে নিচে নিয়ে এলেন বদরুজ্জামান। প্রিয়াঞ্জনা বিস্মিত হয়ে ভাবলো,
‘মানুষ কত সহজে রূপ বদলায়!’ সে কখনো কল্পনাও করেনি এই মহিলা এমন! প্রথমদিন উনাকে দেখে মায়ের কথা মনে পড়েছিলো তার। মনে হয়েছিলো কত মমতাময়ী মহিলাটি! দরজা খোলা। শো শো বাতাস আসছে ঘরে। প্রিয়াঞ্জনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে শাহবাজ। সকল রাগ, ক্ষোভ অশ্রু হয়ে ঝরে প্রিয়াঞ্জনার কাঁধে। কখনো নিজের শাহ্ কে এতটা ভেঙে পড়তে দেখেনি প্রিয়াঞ্জনা।
“তুমি আমাকে বিশ্বাস করো তো প্রিয়াঞ্জনা?”
“নিজের চাইতেও বেশি।”
শাহবাজের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে প্রিয়াঞ্জনা। তার শাহ্কে আ ঘা ত করেছে মহিলা। তার বুকটা যে ফেটে যাচ্ছে। নিদারুণ কষ্ট হচ্ছে বুকের মধ্যিখানে। আর যে সহ্য হয়না। এত এত বিপদ! জীবনটা এমন কেন? যখনই তারা ভাসতে ভাসতে তরী খুঁজে পায় তখনোই আবার ডুবে যায়। এর শেষ কোথায়?
(চলবে)….