প্রিয়াঞ্জনা এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই (পর্ব ২৮)

0
720

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২৮

আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে আকাশে। জ্যোৎস্না সর্বত্র। ‘চন্দ্রবিলাস’ ঘরটি সত্যিকার অর্থেই নামের মান রক্ষা করেছে। যিনি তৈরি করেছেন তিনি যে যথেষ্ট শৌখিন তা এক জ্যোৎস্নারাত ঘরে কাটালেই বোঝা যায়। খোলা বারান্দায় পাটি পেতে নিচে বসে আছে শাহবাজ চৌধুরী। তার বুকে চুপচাপ মাথা রেখে বসে আছে প্রিয়াঞ্জনা। বাম হাত দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে শাহ্। অপর হাতে চায়ের মগ। জ্যোৎস্নারাতে সকল আলো নিভিয়ে প্রিয় মানুষটাকে বুকে নিয়ে চা ভাগাভাগি করে পান করার অনুভূতি স্বর্গীয়। হালকা মৃদু ছন্দে বাতাস বইছে। পড়ন্ত বিকেলে সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়ালে কানে একরকম শব্দ আসে। সমুদ্রের ঢেউ আর হাওয়ার সংমিশ্রণে শব্দটি তৈরি হয়। এখানে অবশ্য আশেপাশে সমুদ্র নেই। তবে শব্দটি আসছে। সাথে ঝিঁঝি পোকার দল তাল মেলাচ্ছে। শাহবাজ ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয় প্রিয়াঞ্জনার কপালে।
“এখনো ভয় লাগছে?”
প্রিয়াঞ্জনা নিজের শাহ্ এর বুকে মুখ ঘষে। শাহ্ এর শরীরে এত প্রাণ কাড়া ঘ্রাণ! প্রতিটি নারীই বোধহয় স্বীয় পুরুষের শরীর হতে এমন ঘ্রাণ পায়। যা তাকে আকর্ষণ করে নিজস্ব পুরুষের আরো নিকটে যেতে। মুখে বলে,
“ভয় পাচ্ছিনা, শাহ্। আপনার বুকে মাথা রাখলে পৃথিবীর কোনো ভয় আমাকে স্পর্শ করতে পারেনা।”

ঠোঁটের কোণা প্রশস্ত হয় শাহবাজের। তার অর্ধাঙ্গী তাকে অনেক ভরসা করে। সে জানে। শাহবাজ ভরাট কন্ঠে গেয়ে উঠে,
“হামে তুমছে পেয়ার কিতনা
এ হাম নেহী জানেতে…
মাগার জী নেহী ছাকতে তোমহারে বিনা
হামে তুমছে পেয়ার……

নিস্তব্ধ রাতে প্রতিধ্বনি তুলে গানের সুর।

রাত প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। সুমনা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার পাশে। এত দ্রুত গাড়িগুলো যায়! রাস্তা পাড় হওয়ার সুযোগ নেই। আশেপাশে ব্রিজও নেই। চারটা পর্যন্ত স্টোরে কাজ করেছে। তারপর টিউশনি করিয়ে এখন বাড়ি ফিরছে সুমনা। মিরপুর ২ এ একটা ছেলেকে পড়ায়। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। এত দুষ্ট! সেখান থেকে আবার যায় মিরপুর ১০ এ। সেখানে পড়ায় মিতুল নামের একটি মেয়েকে। সারাদিন কাজের উপরেই থাকতে হয়। এখন শরীরটা এত ক্লান্ত লাগছে! বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট নিবে। তারপর আবার ব স্তির বাচ্চাগুলো চলে আসবে। ঘরের বাইরে ছোট উঠানের মতন আছে। সেখানে একটি ব্ল্যাক বোর্ড টানিয়েছে সুমনা। নিচে বড় পলিথিন পেতে দেয়। বাচ্চাগুলো বসে সেখানে।
রাস্তা পাড় হয়ে ওপাশে গেলে বাস পাওয়া যাবে। কি এক ঝামেলা। অন্ধকারের মাঝে আচমকা লাইট সহ্য করা যায় না। বড় বড় বাস, ট্রাকের আলো এত লাগছে চোখে! মাথাও ঘুরছে। আশেপাশে আরো মানুষজন আছে। সবাই রাস্তা পাড় হওয়ার জন্যই দাঁড়িয়েছে। একসময় খানিক ফাঁকা হয় মেইন রোড। সবার সাথে রাস্তা পাড় হয় সুমনা। ঢাকা শহর কখনোই শান্ত হয় না। এত রাতেও কত মানুষ আশেপাশে। বাসে উঠা আরেক সংগ্রাম। ঠেলাঠেলি করে উঠতে হয়। তারউপর আবার সিট নেই। সুমনার মুখ দিয়ে অস্ফুটে বের হয়ে এলো,
“ধ্যাঁত!”

যেই সিটের পাশে দাঁড়িয়েছে সেখানে বসা কালো হিজাব, নেকাব পরা একজন মহিলা। জানালার পাশে পুরুষ মানুষটি বসা। সুমনা চেনার চেষ্টা করলো। মইনুল সাহেব না? ইংরেজি শিক্ষক? তার ভাবার মাঝেই মইনুল জিজ্ঞেস করলেন,
“কিছু মনে করবেন না। আপনি কি সুমনা?”

থতমত খায় সুমনা। নিজেকে সামলে হাসি মুখে উত্তর দেয়,
“জ্বি, ভালো আছেন?”
“ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?”
“আছি, আলহামদুলিল্লাহ।”

মহিলাটিকে দেখিয়ে বলেন,
“আমার স্ত্রী। পনেরো দিন হয় বিয়ে করেছি। ও বললো ঢাকা ঘুরবে। তাই নিয়ে আসা।”

বোরকা-নিকাবে আসলে মেয়ে মানুষের বয়স বোঝা যায় না। সুমনাকে মেয়েটি সালাম দিলো। কন্ঠ একেবারেই তরুণীদের মতো। বেশ অনেকক্ষণ গল্প করলো তারা। সুমনার ইচ্ছে করছিলো বাড়ির খোঁজ নিতে। কিন্তু মনকে বোঝালো অতীতের কোনো স্থান তার জীবনে নেই। বাস আজিমপুর আসতেই তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেমে পড়লো সুমনা। রাস্তায় অনেক মানুষজন। সবাই সবার কাজে ব্যস্ত। কেউ ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরছে, কেউ দোকানদারি করছে, কেউ হয়তো ঘুরতে বেরিয়েছে। সুমনা বুঝতে পারলো তার হৃদয়ের সুপ্ত একস্থানে আ ঘা ত লাগছে। সে তো মইনুলকে প্রত্যাখানই করেছিলো। মইনুল তো নিজের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জানান দিয়েছিলো। সে বুঝিয়েছিলো সুমনাকে চায়। সুমনা সায় দিলে হয়তো সেও তাকে কাছে টেনে নিতো। সুমনা নিজেই সুযোগ দেয়নি। তার অনেক খুঁত। কি করে একজন অবিবাহিত, ভালো চাকরি করে এমন ছেলেকে ঠকাবে সে। ভালোই হয়েছে মইনুল নিজের জীবন গুছিয়ে নিয়েছেন। একা একা রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর কথাগুলো ভাবছে সুমনা। আকাশে আজ তেমন আলো নেই। গতকালের জ্যোৎস্না আজ মিলিয়ে গিয়েছে। দু একটা তারার অবশ্য দেখা মিলছে। হঠাৎ সুমনা অনুভব করে এত বড় জগতে সে আকাশের ঐ তারাগুলোর মতোই একলা।
মানব মন বড়ই বিচিত্র। কষ্টের মাঝে থাকলে কেউ যদি খানিক সমবেদনা, সহানুভূতি দেখায় তাকেই আপন ভেবে বসে থাকে। ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে যখন পাহাড়সম আ ঘ ত পায় সুমনা তখন সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো মইনুল।
আ ত্ম হ ত্যার হাত থেকে রক্ষা করেছিলো তাকে। হয়তো সুমনা হাত আঁকড়ে ধরলে তা ভালোবাসায় পরিণত হতো। তাহলে আর প্রীতম আর তার মাঝে কোনো পার্থক্যই থাকতো না। সেখানে কোনো আত্মসম্মানও থাকতো না। একসময় হয়তো মইনুলও তাকে খোঁটা দিতো। কিছুক্ষণ ভাবার পর সুমনার মনে হলো সে এখন যেমন আছে অনেক ভালো আছে। বেঁচে থাকার মতো বেঁচে আছে। কষ্ট হয়, বিরক্ত লাগে। তারপরও দিনশেষে সে ভালো আছে।

প্রতিদিন এই সময়টায় নাদিয়াকে পড়াতে আসে শাহবাজ। আরো তিনটি টিউশনি পেয়েছে। একটা সকালে করায়। বাকি দুটো কলেজ শেষ করে। নাদিয়াকে তাই মাগরিবের পর পড়ায়। সে যেহেতু বাড়িতেই থাকে তাই এই সময়টা বেছে নেওয়া। নাদিয়া আজকাল বেশ জ্বা লা চ্ছে শাহবাজকে। শাহবাজের রাগ হলো সুপ্ত রাগ। সহজে উঠেনা। কিন্তু একবার যদি রাগ উঠে তাহলে নিজেকে কোনোভাবেই সে ক্ষান্ত করতে পারেনা। পর্যাবৃত্ত গতি পড়াচ্ছে শাহবাজ। আজকাল তার কোথাও যেতে ইচ্ছে করেনা। প্রিয়াঞ্জনার কাছে থাকতে ইচ্ছে করে। চাইলেই কি আর সব পাওয়া যায়! টাকা দেওয়ার তারিখও আসছে। কি যে করবে শাহবাজ। তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তবুও চলতে হয়। ঘড়ির কাঁটার মতো ঘুরতে হয় জীবন নামক চক্রে। সরল দোলক এর সম্পূর্ণ বিষয়টা নাদিয়াকে বুঝালো শাহবাজ। সে চাইলেও টিউশনিটা ছাড়তে পারছেনা। বদরুজ্জামান সাহেব তাকে এখানে আশ্রয় দিয়েছেন। তাছাড়া টাকাও তো দিচ্ছেন। নাদিয়াকে পড়ানোর বদৌলতে সে ভালো অংকের টাকাই পায়। এত জটিল পরিস্থিতি! চাইলেও সব সম্ভব হয় না। বুঝানো শেষে জিজ্ঞেস করলো,
“বুঝেছো?”

নাদিয়া কোন ধ্যানে ছিলো সেই জানে। ঠোঁট প্রশস্ত করে বললো,
“জ্বি, স্যার”

‘স্যার’ বললো টেনে টেনে। বিরক্ত হলেও মুখে প্রকাশ করলো না শাহবাজ। গণিত করতে দিলো। একটা গণিতও করতে পারলো না নাদিয়া। শাহবাজ ধৈর্য্য সহকারে আবার বুঝালো। নাদিয়া তারপরও পারলোনা। আস্তে আস্তে রাগ প্রশস্ত হচ্ছিল শাহবাজের। হঠাৎ নাদিয়া এমন একটি অভাবনীয় কাজ করে বসলো! পা দিয়ে শাহবাজের পায়ে স্পর্শ করলো। এবারে রাগের মাত্রা হুট করেই বেড়ে গেলো শাহবাজের। ধমকে উঠে বলে,
“নাদিয়া, এনাফ।”

শান্ত মানুষটার এমন ধমকে চমকে যায় নাদিয়া।
“তোমার কার্যকলাপ খুবই জঘন্য,নাদিয়া। তুমি জানো আমি বিবাহিত। তারপরও এসব কেন কর? জীবনটাকে কি তোমার মুভি মনে হয়? নাকি আমাকে দুশ্চরিত্র মনে হয়? আমার স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা নিজ চোখেই তো দেখেছো। তারপরও এসব কেন? সুযোগ নিচ্ছো? আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছো? জবাব দাও?”

মাথা নিচু করে রেখেছে নাদিয়া। চোখে তার ঘোর বরষা।
“আমি তোমাকে আর পড়াবো না। ফাইজলামির একটা সীমা আছে। তুমি সেসব সীমা বহু আগেই অতিক্রম করেছো। আমি কি দুশ্চরিত্র, খারাপ চরিত্রের? আমাকে কি তোমার মেয়েবাজ, ল ম্পট মনে হয়?”

এবার কেঁদেই দিলো নাদিয়া।
“একদম কাঁদবেনা। আনসার মি। আজকে আমার জবাব চাই।”

নাদিয়া কেঁদেই চলেছে। উপরে চলে আসে শাহবাজ। মেয়েটাকে অনেক বুঝিয়েছে সে। তারপরও এসব করছিলো। তাই আর মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেনি। কথাটি একদম সত্য,

“Life is Not a Bed of Roses, but rather a Bed of Thorns”

(চলবে)….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here