প্রিয়াঞ্জনা এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই (পর্ব ২৭)

0
701

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-২৭
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

অধ্যক্ষ মোশতাক সরকারের কক্ষে দুজন ব্যক্তি বসে আছেন। দুজনেই শেখের চড় অঞ্চলের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী। সরু বারান্দা ধরে কিছুক্ষণ হাঁটার পর এই কক্ষটি চোখে পড়ে। মেইনগেটের সাথে লাগোয়া কামড়া। শাহবাজ শুধায়,
“স্যার, আসবো?”

ভারী চশমা পরেন মোশতাক সরকার। তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকালেন সুদর্শন, ভদ্র ছেলেটার পানে। উনার ছেলের বয়সী। মুখে বললেন,
“আসুন, স্যার।”

অধ্যক্ষ স্যারের কাঁচের বড় টেবিলের সামনে দুটো চেয়ার রাখা। সেখানে বসে আছেন কাপড় ব্যবসায়ী আকরাম খাঁ এবং সুঁতো ব্যবসায়ী ছলিমুদ্দীন। আকরাম খাঁ শাহবাজের চেয়ে বড়জোর বয়স পাঁচেকের বড় হবে। কালো দীর্ঘাকার শরীর। রাগী চোখ। স্বাভাবিকভাবে তাকালেও মনে হয় রেগে আছেন। গলার সুর বেশ মোটা। একসময় বেশ প্রতিযোগিতা দিতো শাহবাজের সাথে। আজ ভাগ্য কোথায় এনে দাঁড় করালো শাহ্কে! ছলিমুদ্দীন বয়স্ক মানুষ। লাল দাঁড়ি মুখে। পরনে পাঞ্জাবি। শাহবাজ পাশে এসে দাঁড়ায়। সময় দেওয়া হয়েছিলো দুভাবে। এই দুজন সময় দিয়েছিলেন তিন মাসের। কারণ তাদের টাকার অংক কম। পঞ্চাশ লক্ষ। আর বাকি তিনজন সময় দিয়েছিলেন ছয় মাসের। মনে হচ্ছে না তারা এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করবেন। তাছাড়া তিনমাসও তো এখনো হয়নি। আরো বেশ কিছুদিন বাকি আছে। অধ্যক্ষ স্যার বললেন,
“উনারা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন। আপনি চিনেন?”

শাহবাজ খুব লজ্জা পাচ্ছে। তার মুখটা লালবর্ণ হয়ে উঠেছে। উত্তর দিলো,
“জ্বি”
তারপর আকরামের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভাই, বাইরে চলেন। এটা আমার কর্মক্ষেত্র।”

আকরাম ধমকে উঠলেন।
“কেন? যা বলার স্যারের সামনেই বলেন।”
“চাচা, বাইরে চলেন। এখানে হাঙ্গামা না করি।”

ছলিমুদ্দিন নরম হলেন। আকরামকে বললেন,
“ভাতিজা, চলো বাইরে গিয়াই কতা কই। হের একটা মান সম্মানের ব্যাপার আছে।”
“রাখেন তো চাচা, বাটপারের আবার মান-সম্মান!”

শাহ্ এর কথাটা লাগলো খুব।
“আকরাম ভাই, কথাবার্তা সামলে বলবেন। আপনিও জানেন আমিও জানি আসল ঘটনা কি। আমি যে টাকা নেইনি এটা মনে হয় পুরো মাধবধী, শেখের চড় বাসীরাই জানে। হাতি বিপদে পড়লে চামচিকাতেও লাথি মা রে।”

আকরাম দাঁড়িয়ে গেলেন। অনেকটা তেড়েই গেলেন শাহ্ এর দিকে। উঁচু গলায় বললেন,
“তুমি মুখ সামলে কথা বলো।”

মোশতাক অবস্থা বেগতিক দেখে বললেন,
“থামেন। এভাবে একজন মানুষের কাজের জায়গায় এসে ব্যক্তিগত বিষয়ে আলোচনা করা ঠিক না। এটা শাহবাজের কাজের জায়গা। আপনারা কথা বললে বাইরে কোথাও বসে বলুন।”

ছলিমুদ্দিনও একই কথা বললেন। বাধ্য হয়ে আকরামকেও তা মানতে হলো। শাহ্কে সে এবার খেল দেখিয়ে ছাড়বে। খুব তেজ ছিলো একসময়। শাহবাজ চৌধুরীর নাম ডাকে চায়ের দোকানে বসা যেতোনা। এত সুনাম হতো তার। আর আজ! মাঝেমধ্যে হাসি আসে তার। কলেজের বাইরে টং দোকান। শাহবাজের সাথে মোশতাকও এসেছেন। ডানপাশের বেঞ্চিতে বসলো শাহবাজ আর মোশতাক স্যার। বামপাশের বেঞ্চিতে ওরা দুজন। আকরাম বললো,
“আমাদের টাকা কবে দিবা?”
“সময় তো শেষ হয় নাই এখনো। আরো তো কিছুদিন সময় আছে। সালিশে তো তাই কথা হয়েছিলো।”
“রাখো, তোমার সালিশ। টাকার পোড়ানি বুঝো তুমি?
স্যার আপনে তো জ্ঞানী মানুষ। আপনে বলেন পঞ্চাশ লাখ টাকা কি হাতের মোয়া? টাকা যদি সময় মতো না পাই!”

মোশতাক অবাক হলেন। শাহবাজ বললো,
“আপনারা একবারও কি আমার অনুমতি নিয়েছিলেন টাকা দেওয়ার আগে?”
ছলিমুদ্দিন মুখ খুললেন,
“পুরানা কতা উঠাইয়ো না মিয়া। স্ট্যাম্পে তোমার সাইন আছিলো। তোমার চাচায় বললো তুমি বলছো টাকার কতা। তাছাড়া তোমার জামাল চাচা আছিলো তোমার ডাইন হাত। এটা তো আমরা সবাই জানতাম। সে আইসা বললো টাকা দেন। সাইনও আছে। এরপরে কি আর না আছে?”
আকরাম বললেন,
“এসব কথা থাক। আমরা আসছি হুঁশিয়ার করার জন্য। আগামী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে টাকা চাই শাহবাজ। নয়তো খুব খারাপ হইবো। ভাইবো না
মা র ধো র হইবো। ডাইরেক্ট একশনে নামবো আমরা। কিছুদিন জেলের ভাত আর রিমান্ডের সিদ্ধ ডিম ভিতরে ঢুকলে টাকা আপনাআপনি বের হইবো নে।”

এত লজ্জা পেলো শাহবাজ। তার মাথা নিচু হয়ে গেলো। তারা চলে গেলেন। মোশতাক শাহবাজকে কি বলবেন বুঝে পেলেন না। উঠে চলে এলেন। ছেলেটাকে দেখে যা বুঝেছেন খুবই আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন। হয়তো তার সামনে এসব কথা হওয়ায় লজ্জা পেয়েছে।
সন্তান হওয়ার খবরে ঠিক যতটা খুশি হয়েছিলো শাহবাজ এখন যেন ঠিক ততটুকুই মুষড়ে পড়লো। সে টাকা দিতে পারবেনা। এটা তো নিশ্চিত। এত টাকা কোথায় পাবে সে! সব তো শেষ। নিজের বাসস্থান পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে। আর কি করবে শাহ্! দু’হাতে মুখ ঢেকে বেঞ্চিতে বসে রইলো শাহ্। তার ভিষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সে যদি জেলে চলে যায় প্রিয়াঞ্জনার কি হবে! কিছু ভাবতে পারছেনা শাহবাজ। কলেজ ছুটি হয়ে গিয়েছে। এখন সময় প্রায় সাড়ে চারটা। চিন্তায় চিন্তায় সাড়া শরীর ঘামছে তার। সাদা শার্ট ঘামে ভিজে চুবচুবে। শাহবাজ বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো।
‘আমার দুঃখগুলো সযত্নে মুছিয়ে দিও তোমার সুখেরও পরশে’

প্রিয়াঞ্জনা শাহবাজের জন্য নাস্তা বানাচ্ছিলো। যদিও সকালবেলা সব রান্না-বান্না করেই শাহবাজ কলেজ গিয়েছে। তারপরও প্রিয়াঞ্জনারও তো মন চায় প্রিয় মানুষটাকে এটা-সেটা করে খাওয়াতে। ঘরে ঢুকেই প্রিয়াঞ্জনাকে রান্না ঘরে দেখে মেজাজ বিগড়ে গেলো শাহবাজের। বাড়ির পাশে বাজারে একজন ডাক্তার আপা বসেন। প্রিয়াঞ্জনাকে সেখানে দেখিয়ে এনেছে শাহবাজ। আপা বলেছেন একবার যেন জেলা হাসপাতালে গিয়ে দেখিয়ে আসে। আর বলেছেন খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করতে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নিতে।
হাতে তেমন টাকা নেই। বেতন পেলে জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাবে বলে মনস্থির করেছিলো শাহবাজ। কিন্তু মেয়েটা ওর একটা কথাও শুনেনা।সারাদিন এইকাজ, ঐকাজ। মেজাজ এমনিতেই খারাপ ছিলো। রান্না ঘরে ঢুকেই প্রিয়াঞ্জনাকে একটু উচ্চ গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“কি করছো তুমি?”
“আপনি এসে গেছেন। যান ফ্রেশ হয়ে আসুন। আলুর চপ করেছি। মুরগির ঝোল দিয়ে খাবেন। আপনার অনেক পছন্দ তো শাহ্। প্লিজ, বকবেন না। মুরগীর ঝোল তরকারি করলে সবসময় আপনাকে চপ করে দেই। আজ তাই মনটা মানলো না শাহ্।”

মৃদু সুরে বললো প্রিয়াঞ্জনা। দীর্ঘশ্বাস ফেললো শাহবাজ। এরপরে আর কি বলার থাকে তার। অসহায় কন্ঠে বললো,
“সবসময় আর এখন কি এক প্রিয়াঞ্জনা!”
“সেসব বাদ দিন। আজ কিন্তু আপনি বলেছিলেন আমাকে মেলায় নিয়ে যাবেন। না করতে পারবেন না কিন্তু!”

প্রিয়াঞ্জনার উৎফুল্ল কন্ঠ শুনে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা আর তার কাছে প্রকাশ করেনি শাহবাজ। প্রিয় খাবারও যেন গলা দিয়ে ভালো করে নামলো না শাহবাজের। মুখে হাসি বজায় রেখে প্রিয়াঞ্জনাকে বলেছে,
“ভিষণ মজা হয়েছে।”

আসলে অনেকেই বলে পুরুষেরা অভিনেতা। তারা ভালো অভিনয় করতে জানে। সত্যি তাই। মনের মাঝে হাজারো কষ্ট, মাথায় এক আকাশ চিন্তা রেখেও দিব্যি তারা পরিবারের সামনে হেসে যায়। চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করলেও হাসিমুখে পরিবারের সদস্যদের সাথে গল্প করে। পুরুষ হওয়া এত সহজ নয়। শত কষ্ট, চিন্তার মাঝে থাকলেও প্রিয় মানুষদের বলতে হয় ‘আমি ভালো আছি’। যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে তাদের এই আত্মত্যাগ।

নীল আকাশ। তুলতুলে মেঘেরা আপনমনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিশাল বিলের পাশে মেলা জমেছে। মানুষজনের ভিড় প্রচুর। প্রিয়াঞ্জনার হাতটা শক্ত করে ধরে আছে শাহবাজ। যদিও এই সময় প্রিয়াঞ্জনাকে মেলায় নিয়ে আসার কোনো ইচ্ছেই তার ছিলোনা। কিন্তু এমন ভাবে আবদার করলো! জানে তো কিভাবে তার শাহ্ মানবে। নিজ থেকে ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলেছে, ‘মেলা জমেছে নিয়ে যাবেন না শাহ্?’ আর না বলার উপায় ছিলো মহারাণীকে!
হরেকরকম দোকান বসেছে। কসমেটিকস, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, জামা-কাপড়, জিলাপি, ফুচকার দোকান আরো কত কি! দুজনে বিলের পাশ ঘেঁষে হাঁটলো অনেকটা সময়। বিলের পানি সবুজ রঙা। শাপলা ফুল নেই। তবে পাতা আছে অনেক। শো শো করে বাতাস বইছে। প্রিয়াঞ্জনা কোনো কিছুর বায়না করছেনা। আসলে তেমন কিছু কিনে দেওয়ার সামর্থ্যও শাহবাজের নেই। যে টাকা হাতে আছে তাতে আরো কিছুদিন চলতে হবে। খাবারে এখন ভালো জিনিস রাখতে হয়। ফল রাখা লাগে ঘরে। বাবু আর বাবুর মা উভয়ের জন্য তা প্রয়োজন। খুব সুন্দর একটি পায়েলের দোকান বসেছে। লাল, নীল, সবুজ পাথর দেওয়া একটা পায়েল পছন্দ হয়ে গেলো শাহ্ এর। প্রিয়াঞ্জনার পায়ে বেশ মানাবে। জিজ্ঞেস করলো,
“দাম কত চাচা?”
“একদাম পঞ্চাশ”

প্রিয়াঞ্জনা মানা করছে।
“আমার পায়েল লাগবেনা শাহ্”
“আমার যে লাগবে! আমার প্রিয়ার পায়েল পরা পা।”
আস্তে করে প্রিয়াঞ্জনার কানে কানে বললো শাহ্।

দোকানদারকে বললো,
“চাচা, কম হয় না?”
“না। একদাম।”

শাহবাজ কিনলো পায়েলটি।
“আপনিও না শাহ্! ছোট বাচ্চাদের মতো করেন। পাগল একটা।”

শাহবাজ প্রিয়াঞ্জনার ডান হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললো,
“পাগল তাইনা? পাগলেরা কিন্তু কামড়ে দেয়। তা তোমার কোথায় কামড় চাই?”
“বেশরম”

হাসছে শাহবাজ। একটু হলেও যেন সেসময়ের কথাগুলো মন থেকে সরিয়ে রাখতে চাচ্ছে সে। এই মুহূর্তটা তো আর আসবেনা! নাগরদোলা থেকে কিছুটা দূরে বড় চিংড়ি মাছের মাথা ভাজা হচ্ছে। এটা আবার প্রিয়াঞ্জনার পছন্দের খাবার। শাহবাজ জানে। এখন তো জীবনেও মুখ ফুটে বলবেনা। শাহবাজ দুটো নিলো বিশ টাকা দামের। কিন্তু এরপরই নাগরদোলার এখান থেকে চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে এলো। যা শোনা গেলো, একটি পাঁচবছরের ছোট বাচ্চা নিচে পড়ে গেছে। মাথা ফেটে মস্তিষ্ক বেরিয়ে গেছে। তারা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখান থেকে বেশ দূরেই নাগরদোলা। খোলা বড় মাঠ হওয়ায় দূরে দূরে সবকিছু। শাহবাজ প্রিয়াঞ্জনা কে নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলো। প্রিয়াঞ্জনার শরীর কাঁপছে রীতিমতো। সেদিনের ভেলানগরের
এক্সি ডেন্টটার কথা মনে পড়ে গেলো তার। এক পর্যায়ে বুকের মাঝে প্রিয়াঞ্জনাকে টেনে নিলো শাহ্। দূরত্ব কম তাও রিকশা নিলো শাহবাজ। একেই হয়তো বলে, ‘অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকায়ে যায়’।
আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাহবাজ। খুশি কখনোই তার জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হয় না। শাহবাজ চৌধুরীর জীবন বড্ড অন্যরকম।

(চলবে)…

(কেমন লাগে গল্পটা?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here