#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২৫
মানুষ অনেক সময় তার আশেপাশের ঘটনা মানতে পারেনা। মনে হয় এটা আমার তন্দ্রার জগত। তন্দ্রায় আছি আমি। ধারণা করা যায়, নিখুঁত এই অনুভূতিটি সম্পর্কে সমগ্র মানুষ জাতিই জ্ঞাত। জীবনের কোনো না কোনো একসময় এইরূপ অনুভূতি গিলতে হয়েছে সকলকেই। যদি না হয়ে থাকে তবে অদূর ভবিষ্যতে অনুভূতিটি অনুভব করার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগই বলা চলে। কিছুক্ষণ পূর্বেও এমন অনুভূতি হচ্ছিল প্রাপ্তির। তার সাথে যা ঘটেছে তা সে কখনোই মানতে পারবেনা। কিন্তু তাও ঘটনাটি ঘটেছে। সময় নামক স্রোতে সেই ঘটনাটি স্থান দখল করে নিয়েছে। প্রাপ্তি স্থির, ক্লান্ত, ব্যথায় জর্জরিত শরীরটা নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। অর্ধনগ্ন শরীরটা ঢাকা পাতলা সাদা একটি নকশিকাঁথা দ্বারা। ফাহিম কোনো মজা করছিলোনা। সে বর্বর, জা নো য়া র তার প্রমাণ সে দিয়েছে। তার দুজন বন্ধু সৌরভ এবং হেমন্ত এসেছিলো রাত আটটার দিকে। তাদের নাস্তা দিতে হয়েছে প্রাপ্তিকে। শাশুড়ী বাড়ি নেই। কাজের লোকও নেই। বেশ রাত পর্যন্ত তিনজন মিলে ম দ পান করেছে। হাসি-ঠাট্টার পাশাপাশি টেলিভিশনে চলেছে অশ্লীল নীল ছবি। প্রাপ্তি শোবার ঘরে এককোনায় বসেছিলো। ভয়ে তার প্রাণ ওষ্ঠাগত। নিজের সম্ভ্রম হারিয়ে ফেলার ভীতিতে হৃদপিণ্ডও যেন স্থির হয়ে যাচ্ছিল। মোবাইলটাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ভয়ে প্রাপ্তির মনে হচ্ছিলো সে মা রা যাবে । অবশ্য তাতেই বোধহয় ভালো হতো। ঘড়িতে সময় তখন দশটা। ঘরে প্রবেশ করে মাতাল এক যুবক। অপরিচিত নয়। বিয়েতে এসেছিলো। ঘরের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে গেলো। উচ্চ শব্দে হিন্দি গান বাজতে শুরু করলো বাইরে। লোকটা যত কাছে আসছিলো ততই কুঁকড়ে যাচ্ছিলো প্রাপ্তি। তারপর….
তারপর বহু চিৎকার, কান্নাও প্রাপ্তিকে রক্ষা করতে পারেনি। অপবিত্র স্পর্শ গ্রাস করে তাকে। কেমন আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলো প্রাপ্তি। কি কি যে ঘটলো কিছুই তার স্মরণে নেই। এই পৈশাচিক বর্বরতা থামে অনেক রাতে। শরীর তথা মনের তীক্ষ্ণ ঘা একেবারেই সহ্য করা যাচ্ছিলো না। বহু কষ্টে উঠে বাথরুমে ছুটে যায় প্রাপ্তি। চিৎকার করে কেঁদে উঠে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বারবার আঘাত করে নিজের দু গালে। চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে চায় যেন। ঠান্ডা, বিশুদ্ধ জলের ফোঁটা শরীরে পড়া মাত্রই কামড়ে উঠে। ঘষে ঘষে সকল অপবিত্রতা দূর করায় মত্ত হয়ে উঠে ছোট এই কিশোরী। এক সময় বসে পড়ে বাথরুমের দেয়াল ঘেঁষে নিচে। পানির নিচে কতক্ষণ ছিলো কে জানে! চোখ লাল হয়ে উঠে তার।
উঠে দাঁড়িয়ে গায়ে বস্ত্র জড়িয়ে নেয়। বাইরে বেরিয়ে চুপচাপ খাটে শুয়ে পড়ে ঘুমের ভান ধরে। ঘরে প্রবেশ করে মোবাইলটা বেডের পাশের টেবিলে রেখে বাথরুমে চলে যায় ফাহিম। মোবাইল হাতে নেয় প্রাপ্তি। নরসিংদী থানার নাম্বার তার মুখস্থ। মানুষের সুপ্ত মন বলেও একটি জিনিস আছে। সুপ্ত মনে বেশ সুপ্ত ইচ্ছে থাকে। অনেক সময় মস্তিষ্কের অজান্তে শরীর সেই সুপ্ত ইচ্ছায় সাড়া দেয়। মায়ের নাম্বারে কল দেয় প্রাপ্তি। থানার নাম্বার না উঠিয়ে তার হাত মায়ের নাম্বারে কল দিয়ে দিয়েছে। মা নামক মানুষটাকে প্রাপ্তি অনেক ভালোবাসে। একেবারে মা ন্যাওটা সে। ছোটবেলা থেকেই মা বলতে অজ্ঞান। বাথরুমে পানির শব্দ হচ্ছে। রিং হচ্ছে ফোনে। হাত কাঁপছে প্রাপ্তির। ফাহিম দেখে ফেললে বিপদ। সে কি বারান্দায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিবে? ভাবতে ভাবতেই কল রিসিভ হয়। মায়ের গলা,
“ফাহিম বাবা?”
“মা, আমি প্রাপ্তি।”
“তোমার ভাবিরে নিয়া হাসপাতালে আমরা। মাঝরাতে ব্যথা উঠছে। ফাহিম আর ভাবিরে নিয়া আসো প্রাইম হাসপাতালে। সিজার হইতাছে।”
“মা, আমার জরুরী কথা আছে তোমার সাথে। ফাহিম আমার সাথে খুব খারাপ কাজ করছে।”
“প্রাপ্তি, সবসময় এসব ভালোলাগেনা। স্বামী স্ত্রী তে সম্পর্ক হইবো এটা স্বাভাবিক। তোমাকে না ঐদিন বুঝাইলাম। এখন ফোন রাখো।”
“মা, তুমি শুনবেনা তাহলে? বাবাকে ফোন দাও।”
ফাহিম বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। প্রাপ্তির কাছ থেকে একপ্রকার মোবাইলটি কেড়ে নিয়ে কথা শেষ করলো। তারপর গলা চিপে ধরলো প্রাপ্তির। ভয়ংকর গলায় বললো,
“সাহস বেড়ে গেছে তোর? এতকিছুর পরও সাহসটা কোথ থেকে আসে?”
প্রাপ্তির মুখে কোনো রাও নেই। ফাহিম তখন প্রাপ্তির সামনে ভিডিও ধরে। প্রাপ্তিরই ভিডিও। সেই
ভ য়ংকর সময়টার ভিডিও। তাকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। পুরুষটাকে বুঝা যাচ্ছেনা। যতটা সাহস সঞ্চয় করেছিলো তা যেন নিমিষেই মিলিয়ে গেলো। হতবাক হয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো প্রাপ্তি। নিজেকে নর্দমা মনে হচ্ছে। ফাহিম হাসিতে ফেটে পড়ে। ভিডিওটার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কাকপক্ষীও যদি এই ঘটনা টের পায় তাহলে ভিডিও ভাইরাল করতে আমি সেকেন্ডও ভাববো না। বিছানা থেকে নেমে ফ্লোরে গিয়ে ঘুমা। তুই অপবিত্র।”
ধাক্কা দিয়ে তাকে নিচে ফেলে দিলো সে। প্রাপ্তির চোখদুটো আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেলো। মানসিক চাপ নিতে নিতে ক্লান্ত সে। আর পারছিলো না।
শাহবাজ পাগল হয়ে গিয়েছে। প্রিয়াঞ্জনার ধারণা শাহবাজ অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হয়েছে। এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা একই কাজ বারবার করেন এবং একই কথা বারবার বলেন। শাহবাজ তাই করছে। তাকে সে বিছানা থেকে নামতে দিচ্ছেনা। একটু পরপর এসে বলছে, ‘বিছানা থেকে নেমে ফ্লোরে হাঁটলে বেবির ক্ষতি হবে।’
এমন আজগুবি কথা প্রিয়াঞ্জনা কখনোই শুনেনি। সকাল থেকে সবকাজ চৌধুরী সাহেব নিজ হাতেই করেছেন। ভাতের মাড় গালতে গিয়ে তিনি হাতে ছ্যাঁকা খেয়েছেন। প্রিয়াঞ্জনা উঠতে চেয়েছিলো। তিনি তড়িৎ গতিতে এসে গদগদ সুরে উক্ত কথাটি আওড়ে আবার চলে গিয়েছেন। প্রিয়াঞ্জনার রীতিমতো বিরক্ত লাগছে এখন। সে কটমট করে বলে,
“আপনি কি আজকে কলেজে যাবেন না?”
“আজকে ছুটি নিয়েছি।”
করলা ভাজতে ভাজতে উত্তর দিলো শাহবাজ। প্রিয়াঞ্জনাকে বিচলিত দেখালো। এই লোক তাকে অতি যত্নের অত্যা চা র করবে। যা অত্যন্ত ভয়াবহ অত্যাচার। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে সে। কিছুক্ষণ পরেই ঘামে ভেজা শাহবাজ চৌধুরী কাজ শেষে প্রিয়াঞ্জনার পায়ের কাছে ফ্লোরে এসে বসেন। মাথা রাখেন কোলে। প্রিয়াঞ্জনা মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় শাহবাজের। আস্তে আস্তে অনুভব করে পেটের কাছটা ভিজে যাচ্ছে।
“শাহ্, আপনি কাঁদছেন?”
জবাব দেয় না শাহবাজ। এতিম শাহ্। ছোটবেলা থেকেই অনাদর, অবহেলায় বড় হয়েছে। মা নিজের সংসারে ব্যস্ত আর বাবা তার সংসারে। ছোট শাহ্ এর কথা কেউ ভাবেনি। ছাত্র অবস্থায় ঢাকা থাকাকালীন সময়টাও বেশ কঠিন ছিলো। তারপর তো কত চড়ায় উৎরাই আসলো জীবনে। প্রতিষ্ঠিত হলো। লাখ লাখ টাকা কামালো। আবার জীবনে বেশ বড় এক ধাক্কা।
এভাবেই কি তার জীবন কাটবে। ভিষণ অসহায় লাগছে। ভিতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। শাহবাজ না পারছে চিৎকার করতে আর না পারছে সহ্য করতে। চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তার। প্রিয়াঞ্জনা শাহবাজের মুখ তুলে কপালে চুমু খায়। তারপর সারা মুখে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। কপোলে লেপ্টে থাকা অশ্রু নিজ হাতে মুছে দেয়। গম্ভীর গলায় শাহ্ শুধায়,
“আমার এত কষ্ট কেন হচ্ছে প্রিয়াঞ্জনা?”
“কষ্ট হচ্ছে না হিংসে হচ্ছে। আপনার আদরে ভাগ বসানোর মানুষ আসছে যে তাই।”
ভারী পরিস্থিতি কিঞ্চিৎ হালকা হয়। শাহবাজ কিছুটা ঠিক হয়।
“আমার কি এত সুখ সইবে প্রিয়াঞ্জনা? আমার সন্তানকে আমি সত্যিই কি ছুঁয়ে দেখতে পারবো?”
শাহবাজের কন্ঠে উৎকন্ঠা। শাহবাজের ডান গালে আলতো করে হাত রাখে প্রিয়াঞ্জনা।
“আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন শাহ্। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা পরীক্ষা দিচ্ছি। ধৈর্যের পরীক্ষা।”
বিকেলে নাদিয়া আসে ছাদে। তার গোলাপ গাছগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে কিছুক্ষণ। প্রিয়াঞ্জনাকে বেতের চেয়ারে বসে বই পড়তে দেখে সে এগিয়ে আসে খোলা বারান্দায়। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে,
“প্রিয়া আপু, কেমন আছেন? বসতে পারি?”
প্রিয়াঞ্জনার সাথে বেশ ভাব জমানোর চেষ্টা করে নাদিয়া।
“বসো। তোমার স্যার একটু পরেই পড়াতে যেতো।”
“তা জানি। আপনার সাথে গল্প করতে আসলাম। কি বই পড়ছেন?”
“আকাশ জোড়া মেঘ।”
“কার লেখা?”
“হুমায়ূন আহমেদ স্যারের।”
“ওহ্”
শাহবাজকে অনেক বলে প্রিয়াঞ্জনা বাইরে এসে বসেছে। ট্রেতে করে চা নিয়ে বারান্দায় আসে শাহবাজ। নাদিয়াকে দেখেই মেজাজ বিগড়ে যায় তার। কই ভেবেছিলো বউয়ের সাথে বসে এই সুন্দর অপরাহ্ণ কাটাবে। তার চেয়ারটাও দখল করে নিয়েছে আপদটা।
“স্যার, আপনি চা বানাতে পারেন? ভালো তো। দুধ চা বানিয়েছেন?”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাহ্ উত্তর দেয়,
“হ্যাঁ”
“আমার দুধ চা খুব পছন্দ।”
এমনভাবে বললো নাদিয়া! শাহবাজ বুঝলো এই মেয়ে চা না খেয়ে আজ উঠবেনা। খুব জেদি নাদিয়া। আদরে আদরে বাবা-মা তাকে বাঁদর বানাচ্ছে।
“আমার চা টা নাদিয়াকে দিয়ে দিন শাহ্। আমার চা খেতে ইচ্ছে করছেনা।”
নাদিয়াকে এক কাপ চা দেয় শাহবাজ। নাদিয়া না করেনি। প্রিয়াঞ্জনার বেতের চেয়ারের পাশে দাঁড়ায় শাহবাজ। এক চুমুক চা খেয়ে কাপটা প্রিয়াঞ্জনার সামনে ধরে। প্রিয়াঞ্জনা ফিরে তাকালে বলে,
“খাও”
প্রিয়াঞ্জনা খায়। আশেপাশে কে আছে না আছে তা যেন পরোয়ানাই করলো না শাহবাজ। সেই পুরানো, জেদি শাহ্। এককাপ চায়ে ক্লান্ত অপরাহ্ণে ভালোবাসার বিনিময় হলো। অদৃশ্য সুর। একটি গানের কিছু লাইন। শাহ্ এর মনে বাজছে। তবুও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে প্রিয়াঞ্জনা। হয়তো টেলিপ্যাথি।
‘প্রিয়াঞ্জনা, এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই,
ডাইনে ও বায়ে আমি তোমাকে চাই,
দেখা না দেখায় আমি তোমাকে চাই,
না বলা কথায় আমি তোমাকে চাই..
(চলবে)….
(১২০০+ শব্দ 😒)