প্রিয়াঞ্জনা এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই (পর্ব ১৩)

0
657

#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-১৩
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

ছন্দ কাটা জীবন। তাল হারানো মন। ছাদের রেলিং এর পাশটায় দাঁড়িয়ে নিজের জীবনকে অনেকটা আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো লাগছে সুমনার কাছে। কলঙ্কিত জীবন তার। সবই জ্বলে যায়, পুড়ে যায়। ছোটবেলায় জন্ম দিতে গিয়ে যখন মা মারা গেলেন তখন বাবা কোলে তুলেও দেখেনি তাকে। কত যুদ্ধ, কত পরিশ্রম করে নিজেকে গড়ে তুলেছিলো। পায়ের নিচের মাটিকে লাগতো চোরাবালির ন্যায়। কোথাও দাঁড়াতেও ভয় হতো। অবচেতন মন বাস্তবতা বুঝতো না। ভালোবাসার কাঙাল ছিল বেহায়াটা। তখনই ডিপার্টমেন্টের সামনে সাপের কবল থেকে রক্ষা করলো এক যুবক। মন তখন লোভী হয়ে উঠে। সেই যুবকের হাসি, তার আদর মাখা ডাক, তার ছোট ছোট কেয়ারিং। মন আঙুল তুলে মস্তিষ্ককে বোঝায় এই সেই স্বপ্নের পুরুষ। একান্ত পুরুষ। তোমার পুরুষ। এত এত ভালোবাসার স্বপ্ন, সুখের স্বপ্ন যে দেখিয়েছিলো সে আজ এতটা পরিবর্তিত! সময় বদলায়, ভালোবাসা বদলায়। কথাটা ঠিক? হয়তো কিঞ্চিৎ ভুল। আজ যদি প্রীতম সন্তান জন্ম দানে অক্ষম হতো তখন কি সুমনা তাকে ছেড়ে যেতো? কখনোই না। লালবর্ণ আকাশ। দুটো চিল উড়ে বেড়াচ্ছে। বাতাসে শরতের ঘ্রাণ। মূলত জুঁই ফুলের ঘ্রাণের কারণেই এতটা অনেক অনুভব করা যাচ্ছে। বিল্ডিং ঘেঁষে দুটো জুঁই ফুলের গাছ আছে। পুকুর পাড়ে সদ্য কাশফুলের দল উঁকি দিচ্ছে। বাড়ির সামনেই সোজা পাকা রাস্তা। একটি বাচ্চা মেয়ে স্কুল থেকে ফিরছে হয়তো। হাতে বই, কাঁধে ব্যাগ। পরনে নীল ফ্রক। মাথায় সাদা হিজাব। কোনো টেনশন নেই, কোনো দোটানা নেই। সুমনা এখন ছাদ থেকে লাফ দিবে। এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় কষ্টগুলোর যদি তালিকা করা হয় তাহলে তন্মধ্যে একটি হলো প্রিয় মানুষ, ভালোবাসার মানুষকে ঘৃণা করা। এই যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এই যন্ত্রণা হৃদয়ে সুপ্ত থাকে। অনেকটা বিষধর বিষের মতো। আস্তে আস্তে নিষ্প্রাণ করে দেয় মন, দেহ, প্রাণ। সুমনার পক্ষে এই অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করা সম্ভব নয়। সুমনা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। প্রকৃতি দেখে নেয় শেষ বারের মতো। এবারে পরপারে যাওয়ার পালা।

দুপুরে জমির দলিল সম্পন্ন হয়েছে। আড়াই কোটি টাকার ঝামেলা ভেঙেছে শাহবাজ। এছাড়াও পাঁচজন ব্যাক্তি টাকা পাবেন। আরো আড়াই কোটি প্রয়োজন। তারা সময় দিয়েছে কেবল ছয়মাস। এই আড়াই কোটি টাকা কোথায় পাবে তা নিয়ে শাহবাজ বেশ চিন্তায় রয়েছে। তবে যেহেতু কিছুটা ঋণ কমেছে তাই স্বস্তিও হচ্ছে মনে। শিবপুরের চাচার নাম্বার আবার বহু কষ্টে জোগাড় করেছে সে। বদরুজ্জামান ভূঁইয়া প্রথমে আকাশ থেকে পরেছিলেন এটা শুনে যে শাহবাজ শিক্ষকতা করবে। তাও মেইন শহর ছেড়ে দূরে। সম্পূর্ণ শুনে তিনি বেশ হতবাক হয়েছেন। এত সুন্দর একজন ছেলের জীবন যে এরকম ভাবে নষ্ট হয়ে যাবে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি। ভদ্রলোকের নিজের বাড়ি। সেই বাড়ির দুতালায় দুটো কামরা খালি আছে। আপাতত শাহবাজ সেখানেই প্রিয়াঞ্জনাকে নিয়ে উঠবে। শিক্ষকতা করবে শিবপুর অগ্রণী মডেল কলেজ নামক সদ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া কলেজে। বাকিটা আল্লাহ তায়া’লা যা চান। শাহবাজ সিদ্ধান্ত নেয় আগামীকাল রাতে প্রিয়াঞ্জনাকে চলে আসতে বলবে। নিজের অর্ধাঙ্গীকে ছাড়া থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বিগত কয়েকটি মাস কেবল এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলো শাহবাজ চৌধুরী। শ্রাবণ কাটিয়ে ভাদ্র আসবে। শরতের আগমন ঘটবে। সেই সাথে প্রাণপ্রেয়সীকে পুনরায় আপন করে পাবে শাহবাজ। অন্তর কাঁপছে।
রিমন ছেলের পাশে বসে আছে। রিফাত পড়ছে হলদে লাইটের আলোতে। শাহবাজ বসলো চৌকিতে।
“চলে যাবি শাহ্?”
“হুম”
“যাওয়ার আগে ভাবীকে নিয়ে আছিস এই গরিবখানায়।”

কি সহজ সরল ছেলেটা। চিকন গড়ন, কালো গাঁয়ের রঙ। চোখে অসীম মায়া। কৃতজ্ঞতায় শাহবাজের চোখ ছলছল করে উঠে। রেলস্টেশনে যখন যাযাবরের মতো ঘুরছিলো শাহবাজ। এই ছেলেটাই তাকে আশ্রয় দিয়েছে। খাবার দিয়েছে। ঠিক একজন প্রকৃত বন্ধুরমতো। শাহবাজ ডাকে,
“রিমন?”
“কি?”

শাহবাজ জড়িয়ে ধরে রিমনকে। তার জিন্সের পকেটে গুঁজে দেয় পাঁচ হাজার টাকা।
“তুই আমার দুঃসময়ের বন্ধু রিমন। তোর ঋণ এই শাহবাজ চৌধুরী কখনো পূরণ করতে পারবেনা, ভাই।”

দুই বন্ধুর আবেগঘন মুহূর্ত দেখে সুফিয়ার চোখেও অশ্রু চলে আসে। শাহাবাজ ভাই একজন খাঁটি মানুষ।
সুফিয়ার কোনো ভাই নেই। বিগত কয়েকটি মাসে কেমন এক অজানা বন্ধনে শাহবাজ ভাইয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলো তারা। বাইরে থেকে ফিরেই বলতেন,
“ভাবী, ভাত দেন। ক্ষুধা লেগেছে।”

এত মায়া হতো সুফিয়ার। মানুষটা চলে যাবেন। সুফিয়া আল্লাহর কাছে প্রাণপণে দোয়া করে। এই মানুষটা যেন তার পরিবার নিয়ে ভালো থাকেন।

সুমনা চোখ বন্ধ করেছিলো অনেকক্ষণ। মাগরিবের আজান দিচ্ছে। জুঁই ফুলের ঘ্রাণ কড়া হয়ে উঠেছে। অসহনীয় কড়া। এই তো একটু পর কেবল শান্তি আর শান্তি। সামনে আগায় সুমনা। আরেকটুখানি..

হঠাৎ কে যেন কনুই ধরে টেনে পিছনে নিয়ে আসে। কম্পমান হৃদয় আরো জোরে কেঁপে উঠে। লাব-ডাব শব্দ প্রায় বাজছে সুমনার কানে। সে কি ছাদের দরজা লাগায় নি! আফসোস হয় তার। মইনুল সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। প্রীতি-প্রাপ্তির ইংরেজি শিক্ষক। ওঁকে দেখে কিঞ্চিৎ লজ্জা পায় সুমনা।

“কি করছিলেন আপনি? আমি যদি নিচ থেকে খেয়াল না করতাম তাহলে কি হতো বলুন তো!”
“কি হতো আবার ম রে যেতাম!”

এমন অকপট কথায় থতমত খায় মইনুল। প্রশ্ন করে,
“প্রাণ এত সস্তা আপনার কাছে? আপনি কি পাগল!”
“যা জানেন না তা নিয়ে কথা বলবেন না প্লিজ। আমার জীবনে কি ঝড় চলছে তা নিশ্চয়ই আপনি জানবেন না তাইনা? আপাত দৃষ্টিতে আপনার কাছে লাগতেই পারে আমি পাগল। কিন্তু আমার জীবনটা যদি আপনি যাপন করতেন তাহলে হয়তো একই কাজেটাই করতেন।”

বলেই প্রস্থান করে সুমনা। মৃ ত্যুতেও বাঁধা! এত অদ্ভুত কেন তার জীবন!

প্রিয়াঞ্জনা আপাতত ব্যস্ত। টুকটাক যা গুছানোর গুছিয়ে নিচ্ছে। শরতের কাশফুলের মতো দুলছে তার মন। শাহ্ আর সে আবার একসাথে থাকবে! নতুন মেয়েটার সাথে তার তেমন কথা হয়নি। সুমনা ভাবীকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া সত্যি কোনো ভাষা নেই প্রিয়াঞ্জনার। প্রীতম ভাইয়া যে এতটা নিচে নামবে কখনো কল্পনাতেও আসেনি তার।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here