#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__৫১ [সমাপ্তি পর্ব]
ইয়ামিন দর্শিনীর দিকে এগিয়ে যায়। দর্শিনী নিজেকে রক্ষা করতে একধাপ পিছিয়ে যায়। একসময় ইয়ামিন তাকে স্বশব্দে দুটো থাপ্পড় দেয়। দর্শিনীর গাল যেন জ্বলে যাচ্ছিল। তাছাড়া থাপ্পড়ের বেগে দর্শিনী নিচে পড়ে যেতে নেয়। তবে নিজেকে পেটের ভরে উবুর হয়ে পড়ে যাওয়া থেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। ইব্রাহিম খলিল নিজের কার্য হাসিল করতে প্রিয়মা বেগমকে বিশ্রী গালি দিয়ে বলেন,
‘মেয়েকে বাঁচাতে চাইলে স্ট্যাম্প পেপারে সই কর। নাহলে তোর চোখের সামনেই তাকে সুন্দর মৃত্যু উপহার দেবো। ভালো চাইলে চুপচাপ স্ট্যাম্প পেপারে সই করে দে।’
দর্শিনী ইব্রাহিম খলিলের কথায় আঁতকে উঠে। প্রিয়মা বেগম অসহায় হয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। এতোক্ষণ ধরে তিনি দলিলে সই করেনি। কিন্তু তারা দর্শিনীকে প্রিয়মা বেগমের দূর্বলতা বানিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করতে ডেকে এনেছেন। তিনি সই না করলে দর্শিনীর বিপদ। ইব্রাহিম যেই সম্পত্তির জন্য এতো নিচে নেমেছে। সেখানে সবার অধিকার রয়েছে। তাছাড়া সম্পত্তির পরিমাণ অধিক। তাছাড়া নিজের ভাইয়ের ছেলেরা, অন্য চাচাতো ভাই, বোন সবার অধিকার রয়েছে সেখানে। বর্তমানে সবকিছু এখন প্রিয়মা বেগমের নামে। তবে একসময় তাকে সবার অধিকার বুঝিয়ে দিতে হবে। প্রিয়মা বেগমের বাবা বেঁচে থাকতে সন্দেহ করেছিলেন। ভবিষ্যতে এমন কিছু ঘটতে পারে! এজন্যই তিনি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সম্পত্তির মালিকানা মেয়ের নামে করে গেছেন। যেখানে সবার অধিকার আছে। সেখানে প্রিয়মা বেগম একজনকে সবটা কীভাবে দিবেন? এটা হয়না! তাছাড়া তিনি কখনো এমন কুৎসিত চিন্তাভাবনা ভেতরে আনেনি। দর্শিনীকে বাঁচাতে সবার অধিকার নষ্ট করার মতো বিশাল অন্যায় কাজটা করতে যাচ্ছেন তিনি। তবে সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ভাবে। প্রিয়মা বেগমকে রাজি করাতে শুরু থেকেই উনার উপর অত্যাচার করছিলো ইব্রাহিম খলিল। কিন্তু যখন দেখলেন কোনো ভাবেই রাজি হচ্ছে না। তখন দর্শিনীকে মারার হুমকি দেয় ইব্রাহিম। তিনি কার্যসিদ্ধিতে দর্শিনীকে টোপ হিসাবে ব্যবহার করেছেন। তবে সম্পূর্ণ প্ল্যান ছিল ছেলে ইয়ামিন আয়ভির!
ইব্রাহিম বেশি সময় নিলেন না। স্ট্যাম্প পেপার গুলো প্রিয়মা বেগমের হাতে দিলেন। প্রিয়মা বেগম মেয়ের দিকে তাকালেন। ইয়ামিন দর্শিনীকে গান পয়েন্টে রেখেছে। যেন বাবার ইশারা পাওয়া মাত্রই দর্শিনীকে চিরদিনের জন্য মুক্তি দিতে কার্পণ্য করবে না। দর্শিনী সাহস করে বলে,
‘ওরা যেটা চাইছে সেটা মারাত্মক অন্যায়। মা, তুমি ওদেরকে সমর্থন করো না।’
দর্শিনীর কথা শুনে ইব্রাহিম খলিল এসে স্বশব্দে থাপ্পড় বসালেন। দর্শিনীর কোমল ঠোঁটের কোণে আঘাতে রক্ত গড়িয়ে পড়ল। ইব্রাহিম দর্শিনীর পেছনের চুলগুলো শক্ত করে টেনে দাঁত পিষে বলে,
‘জীবন্ত কবর দিয়ে দিবো বুঝেছিস? আর একটা শব্দ উচ্চারণ করবি তো মৃ’ত্যু যন্ত্রণা কেমন ভালো মতো উপলব্ধি করতে পারবি।’
প্রিয়মা বেগম রেগে গেলেন। যত যাই হোক মেয়ের উপর আঘাত তিনি সহ্য করবেন না। তিনি ইব্রাহিম খলিলকে বললেন,
‘আমি সই করে দেবো। আমার মেয়েকে ছেড়ে দে।’
ইব্রাহিম খলিল ক্রুর হাসলেন। প্রিয়মা বেগম তাকে সর্বদা আপনি বলে ডাকতো। কিন্তু এখন তুই সম্বোধন করছে। এতে রাগ হলেও প্রকাশ করলেন না। কারণ তুই ডাক শোনার মতো কাজ করছেন তিনি। দলিলে সই হোক আগে! তারপর দুই আপদকে শিক্ষা দিবেন ঠিক করলেন। ইয়ামিন এখনো দর্শিনীকে গান পয়েন্টে রেখেছে। প্রিয়মা বেগম মেয়েকে বাঁচাতে সই করে দিলেন। সই করা শেষে ইব্রাহিম খলিল আর ইয়ামিন উচ্চশব্দে হাসলেন। তাদের লক্ষ্য সফল হয়েছে। হঠাৎই ইয়ামিন পৈশাচিক একটা কাজ করতে এগিয়ে আসলো। সে দর্শিনীর পেটে লাথি মারতে উদ্ধত হতেই প্রিয়মা বেগম মেয়েকে সামনে থেকে ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন। দর্শিনীর কোন ক্ষতি হয়নি! কিন্তু ইয়ামিনের লাথিটা প্রিয়মা বেগমের উপর তীর্যক ভাবে পড়েছে। উনি পীঠে তীব্র ব্যথা পেয়েছেন। দর্শিনী মাকে জড়িয়ে কান্না করে দেয়। সে ইব্রাহিম খলিলকে অনুরোধ করে তাদেরকে টর্চার না করতে।
অফিসের কাজের ফাঁকে আবিদের দর্শিনীর কথা মনে পড়ে। আজকে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার কথা ছিল তার। হঠাৎ করেই প্রচন্ড অস্থিরতা অনুভব করে আবিদ। দর্শিনীকে মনে পড়ছে। সে তৎক্ষণাৎ ব্লেজার হাতে নিয়েই বেরিয়ে পড়ে। ফোনটা চেক করার কথা মাথাতেই ছিল না আবিদের। সে বাড়ির উদ্দেশ্যে যেতে হঠাৎ করেই ফোনে দর্শিনীর নাম্বার থেকে অসংখ্য ফোনকলস, ম্যাসেজ দেখতে পায়! ফোন স্ক্রিনে এতোগুলো মিসড কল দেখে আবিদের হাত কেঁপে উঠে। দর্শিনীর কোনো বিপদ হয়নি তো? তৎক্ষণাৎ আবিদ ম্যাসেজটি অপেন করে। আবিদ ম্যাসেজটি মন দিয়ে শুনলো। ইব্রাহিম খলিল, ইয়ামিন আয়ভি, সেদিনের ছেলেগুলো! এখন সবকিছু তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। তীব্র রাগে আবিদের হাতের রগগুলো ফুলে উঠেছে। এইমুহূর্তে যদি ইব্রাহিমের শিরশ্ছেদ করতে পারতো অনেক হালকা অনুভব করতো নিজেকে। আবিদ তৎক্ষণাৎ স্বশব্দে গাড়ি ঘুরিয়ে মুহতাসিম ভিলার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
দর্শিনীর পেটে ব্যথা হঠাৎই বেড়ে যায়। সে আর্তনাদ করে উঠে। প্রিয়মা বেগম বুঝলেন মেয়ের লেবার পেইন উঠেছে। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন দর্শিনীকে নিয়ে। তাকে এখুনি দর্শিনীকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া উচিত কিন্তু কীভাবে নেবেন? তিনি ইব্রাহিম খলিলের কাছে হাত জোড় করে বললেন,
‘আমার মেয়েটাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। প্লীজ আমাকে সাহায্য করুন! আমার মেয়েটাকে বাঁচতে দিন। আমি আপনাকে সবকিছু দিয়ে দিয়েছি যা কিছু আপনার প্রয়োজন ছিল। আমার মেয়েটাকে বাঁচান দয়া করে।’
ইব্রাহিম খলিল ক্রুর হাসলেন। যদিও দর্শিনীকে মারার কোনো ইচ্ছে তার ছিলোনা। আজ যদি দর্শিনী ইয়ামিনের সহধর্মিনী হতো তাহলে ঠিকই বাঁচিয়ে রাখতেন। এখন যদি তিনি বাঁচিয়ে রাখতে চায় তাহলে ইয়ামিন সেটা হতে দিবেনা। তিনি প্রিয়মা বেগমের উদ্দেশ্যে বলেন,
‘আমার হাতে কিছুই নেই। আমি দয়া করে বাঁচাতে চাইলে ইয়ামিন সেটা হতে দিবেনা। আমার ছেলেটার রাগ বেশি। হসপিটালে নেওয়ার কোনো চান্স নাই! বসে থেকে মেয়ের মৃত্যুর সময় গুণতে থাক।’
দর্শিনী ইব্রাহিম খলিলের কাছে অনুরোধ করে বলে,
‘প্লীজ আপনি আমাকে নয়, আমার বাচ্চাটাকে বাঁচতে দিন। ও আমার স্বামীর প্রাণ! দয়া করে আমার বাঁচ্চাটাকে ছেড়ে দিন।’
দর্শিনীকে এভাবে মিনতি করে কাঁদতে দেখে ইব্রাহিম খলিল কিছুটা নরম হয়ে ইয়ামিনের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন কী করবে? ইয়ামিন চোখ গরম করে বলে,
‘আজকে তুই আর তোর বাচ্চা দুজনেই মরবি।’
ইয়ামিন দর্শিনীর পেট বরাবর শুট করতে যাবে তখনই প্রিয়মা বেগম তাকে দূরে সরিয়ে সামনাসামনি দাঁড়ায়। ইয়ামিন রাগের বশে সত্যি সত্যি ফায়ার করে দেয়। গুলিটা সোজা প্রিয়মা বেগমের বুকে গিয়ে লাগে। এতো জোরে গুলির শব্দ পেয়ে আবিদ ভয় পেয়ে যায়। ভাবতে থাকে দর্শিনী ঠিক আছে তো? সে গেট পেরিয়ে দৌঁড়াতে থাকে! দর্শিনী ফুলো পেট নিয়ে ব্যথায় উঠে দাঁড়াতে পারল না। কাঁদতে কাঁদতে মা বলে আর্তনাদ করে উঠল। প্রিয়মা বেগমের চোখে অশ্রুধারা। তিনি শব্দ করে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লেন। ইয়ামিন এবার দর্শিনীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সে ইয়ামিনকে হিংস্র রূপে দেখে চমকে উঠে। দর্শিনী কান্নাভেজা চোখে বারবার অনুরোধ করে তার বাচ্চাকে ছেড়ে দিতে। ইয়ামিন শুনছে না! হঠাৎ-ই বুট পরিহিত পা-দিয়ে দর্শিনীর পেটে আঘাত করতে যায়। দর্শিনী আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে আর্তনাদ করে। তার পেটে আঘাত পাওয়ার আগেই আবিদ চলে এসেছে। আবিদ দ্রুত ইয়ামিনের ডান-পা ধরে ফেলে। তৎক্ষণাৎ সর্বশক্তি দিয়ে মুচড়ে দেয় ইয়ামিন গগনবিহারী চিৎকার করে উঠে। ইবলিশটা তার দর্শিনীকে মারতে উদ্ধত হয়েছিল। আবিদ তাকে এতো সহজে ছাড় দিবেনা। ইব্রাহিম সবটা হতবিহবল হয়ে দেখতে থাকে। তিনি কিছুই করতে পারছিলেন না। পরবর্তীতে আবিদ স্বজোরে ইয়ামিনের পা–দুটো উল্টে ফ্লোরে আঁছাড় দেয়! মাথায় প্রচন্ড আঘাত পায় ইয়ামিন। তৎক্ষণাৎ ফিনকি দিয়ে নাক মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। ফ্লোরে শব্দ করে পড়ায় হাতের গানটা অদূরে প্রিয়মা বেগমের কাছে ছিঁটকে যায়। প্রিয়মা বেগম তখন বুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। ছেলের এমন অবস্থা দেখে ইব্রাহিম রাগের বসে নিজের হাতের গান দিয়ে আবিদকে পেছন থেকে শুট করে দেয়। আবিদ বুঝতে পারেনি এমন কিছু হবে। তৎক্ষণাৎ স্বশব্দে একটা গুলি আবিদের পীঠ বরাবর এসে বিঁধে। আবিদ ছিঁটকে পড়া হতে নিজেকে সামলে নেয়। প্রথমে মায়ের এখন স্বামীর এমন ভয়াবহ অবস্থা দেখে দর্শিনী কাঁদতে থাকে। পেটের তীব্র ব্যথার চেয়ে দর্শিনীর কাছে এই দৃশ্যগুলো বেশি পীড়াদায়ক ছিল।
প্রিয়মা বেগম নিজেকে শক্ত করে গানটা তুলে নেন। তিনি ইয়ামিনের উদ্দেশ্যে পরপর তিনটা গুলি ছুঁড়েন। ইয়ামিন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিচেই পড়ে থাকে। ফ্লোর ভেসে যায় রক্তে। ইব্রাহিম খলিল ইযামিন বলে চিৎকার করে উঠেন। পরক্ষণেই ইব্রাহিম প্রিয়মা বেগমের দিকে গুলি ছুঁড়তে থাকেন। প্রিয়মা বেগম বুঝে যান তার হাতে বেশি সময় নেই। ইব্রাহিম বেঁচে থাকলে তার মেয়ে, জামাইকে মেরে দিবে। তৎক্ষনাৎ তিনি ইব্রাহিমকে টার্গেট করে হৃদপিণ্ড বরাবর সব গুলি ছুঁড়ে মারেন। বন্দুকে উপস্থিত শেষের গুলিটা হৃদপিণ্ড ভেদ করে গেলে ইব্রাহিম সেখানেই লুটিয়ে পড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ইব্রাহিমের বাকি সহযোগী গুলো ভয়ে পেয়ে পালিয়ে যায়। ইয়ামিনও বাবার মতো সেখানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। প্রিয়মা বেগম বন্দুকটা ফেলে মেয়ের কাছে যেতে চান। কিন্তু পারেন না! তিনি সেভাবেই ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লেন। আবিদ পীঠে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সাহায্যের জন্য ফোনটা বের করে। কিন্তু আফসোস ফোনে চার্জ না থাকায় কিছুক্ষণ আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। দর্শিনীর ফোনটা অদূরে খণ্ডিত হয়ে পড়ে আছে। ইয়ামিনই ফোনটা ছুঁড়ে ফেলেছিল। এজন্যই আসার সময় আবিদ দর্শিনীকে ফোনে পায়নি। আবিদ কী করবে ভেবে পায়নি। পীঠে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে। তার কী করা উচিত? কাকে বাঁচাবে? নিজে কতক্ষণ স্টেবল থাকতে পারবে? আবিদ বুঝতে পারছেনা। প্রিয়মা বেগম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে অনেক কষ্টে বলেন,
‘বাবা! আমার হাতে সময় নেই। তুমি আমার মেয়েকে বাঁচাও। ওর লেবার পেইন শুরু হয়ে গেছে। এখন অ্যাম্বুলেন্সে ফোন দিলে তাদের অ্যাম্বুলেন্স আসতে সময় লাগবে। বেবি নরমালে হওয়া সম্ভব। তুমি চাইলে অতি সাবধানে নরমাল ডেলিভারী করতে পারবে। এতোক্ষণ ধরে আমার মেয়েটা পেইন সহ্য করছে। তুমি একটু চেষ্টা করে দেখো। আমি জানি তুমি পারবে।’
কথাগুলো বলেই প্রিয়মা বেগম চোখ বন্ধ করে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকেন। গুণে গুণে চারটা গুলি লেগেছে! চাইলেও বাঁচা সম্ভব না। অনেক দেরী হয়ে গেছে। মৃত্যুর পূর্বে তিনি আশরাফ সাহেব এবং দুই মেয়ের চেহারা স্বরণ করে নিলেন। ভাগ্যের কী নিদারুণ পরিহাস মৃত্যুর পূর্বে ভালোবাসার মানুষটিকে তিনি দেখে যেতে পারবেন না। তার আগেই হয়তো মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়বেন।
আবিদ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভাবতে থাকে কী করবে! এমন কঠিন পরিস্থিতিতে আবিদের মাথাকাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে। কী করবে বুঝতে না পেরে প্রথমে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ফোন করল। তারপর প্রিয়মা বেগমের কথা অনুযায়ী পীঠে গুলিবিদ্ধ অবস্থাতেই বিছানার চাদর দিয়ে মোটামুটি চর্তুরভূজের মতো করে দর্শিনীকে ঘিরে দিলো। পরপর দুইমিনিটের মধ্যে গরম পানি, পরিস্কার একটা কাপড় নিয়ে চর্তুরভূজ আকৃতির ঘিরে দেওয়া জায়গাই প্রবেশ করে দর্শিনীকে বলে,
‘জান ইউ হ্যাভ টু ডু ইট! আমার সঙ্গে চেষ্টা করো। হাতে সময় নেই!’
দর্শিনী তখন চিৎকার করে বলে,
‘আবিদ আমার প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে। মনে হচ্ছে শরীরের একটা হাড় অবশিষ্ট নেই সব ভেঙ্গে গেছে! আমার পক্ষে সম্ভব না। প্লীজ আমাকে হসপিটালে নিয়ে চলুন।’
‘দর্শিনী সময় নেই আমাদের হাতে! অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করেছি জানিনা কখন আসবে! ফ্রী আছে কী না সেটাও জানিনা! শুধু বলল আমরা দেখছি। আমার তোমাকে নিয়ে ড্রাইভ করার মতো শক্তি আপাতত নেই। মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে। পীঠে প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে! ব্যথা করছে ক্ষতস্থান! যেকোনো সময় আমি জ্ঞান হারাতে পারি। এখন তোমাকে চেষ্টা করতে হবে। অন্তত আমার মেয়ের কথা ভেবে চেষ্টা করে দেখ বউ!’
দর্শিনী ব্যথায় আর্তনাদ করে কাঁদছে। ইতিমধ্যে শরীর ঘেমে গোসল করে ফেলেছে। আবিদ দ্রুত তার চুলগুলো রাবার ব্যান্ড দিয়ে বেঁধে দেয়। পরক্ষণেই পেট হতে শাড়িটা সরিয়ে দেয়। তারপর ভীতিকর অবস্থায় দুইপা থেকে শাড়ি কিছুটা উপরে তুলে। দর্শিনী আবিদের হাত খামচে চিৎকার করে বলে,
‘আবিদ আমি মরে যাবো। এখানে নয়, এখানে নয় প্লীজ আমাকে হসপিটালে নিয়ে চলুন!’
‘দর্শিনী আমার কথা শোনো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকো! আমি বলছি তুমি পারবে। এর চেয়ে দ্বিগুণ ব্যথা সহ্য করতে হয় সিজার সেকশনে! তুমি তো জানোই হসপিটালে সিজার বলতে পেট কেটে বাচ্চাকে বের করা হয়। সেই ব্যথাটা সারাজীবন স্থায়ী হয়। পুস্পিতা ভাবীকে নিশ্চয়ই দেখেছো তিনি দীর্ঘদিন ধরে সিজারের ব্যথায় কষ্ট পেয়ে আসছেন। আমার দর্শিনী তো ব্রেইভ। একটু কষ্ট সহ্য করো। আমি জানি আমার তেজস্বিনী পারবে।’
দর্শিনী আবিদের কথায় জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। বাচ্চাটা পেটের ভেতরে নড়ছে। এজন্যই ব্যথাটা তীব্র অনুভূত হচ্ছে। দর্শিনী চেষ্টা করে হাঁপিয়ে যাচ্ছে। ঠিক মতো পারছে না! শুধু চিৎকার করছে। আবিদ এবার ঘাবড়ে যায়। তার পীঠেও মারাত্মক ব্যথা হচ্ছে! কিন্তু দর্শিনীর প্রসব যন্ত্রণার কাছে এটা হয়তো কিছুই না। আবিদ উপায় না পেয়ে গরম পানিতে হাত ডুবিয়ে হাতটা জীবাণু মুক্ত করে নেয়। তারপর পরিস্কার শাড়ির আঁচলটা গরম পানিতে ভিজিয়ে দর্শিনীর পেট হালকা করে মুছে দেয়। পরবর্তীতে পেটের উপর থেকে নিচে দিকে ধীরে ধীরে মৃদু চাপ দিতে থাকে। আবিদ দর্শিনীকে কাঁদতে দেখে সাহস করে নিচের দিকে চাপ প্রয়োগ করতে বলে। আবিদের কথায় দর্শিনী উপর উপর জোরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। এবং পেটে মৃদু চাপ দেয়। কিয়ৎক্ষণ বাদে দর্শিনী গগনবিদারী আর্তচিৎকার করে উঠে। তার শরীরের নীল রগগুলো যেন মুহূর্তেই ফুলে উঠল। দেড়ঘন্টা লেবার পেইন সহ্য করে দর্শিনী নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে ফুটফুটে সুন্দর এক রাজকন্যার জন্ম দেয়! কোন ধরনের জটিলতা ছাড়াই আবিদের মাধ্যমে!
আবিদের মেয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই কান্না করে দেয়। তার কান্না শোনার আগেই প্রিয়মা বেগম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। দর্শিনী এখন অচেতন হওয়ার মতো অবস্থায়। নিজের মাকে হারিয়ে, প্রসবের মতো হাড়ভাঙ্গা ব্যথা সহ্য করে নিজের নাড়ি ছেঁড়া মেয়েকে দেখার পর তার চোখেমুখে এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠে। পরপরই মাকে মনে করে বিষণ্ন হয়ে পড়ে দর্শনী। চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুমালা গড়িয়ে পড়ে।
আবিদ মেয়েকে স্বযত্নে কোলে তুলে নেয়। বাবা হয়ে সর্বপ্রথম নিজের সন্তানকে কোলে তুলে অন্যরকম ভালোলাগা অনুভব করল আবিদ। আবিদের মেয়ে দেখতে তার মতোই। কিন্তু ত্বক পেয়েছে মায়ের মতো ধবধবে তুষার শুভ্রকায়! ঠোঁট যেন রক্তকণিকার ন্যায় টকটকে লাল। আবিদ মাশাআল্লাহ বলে তার কানের কাছে মৃদু স্বরে আজান দেয়। মেয়েকে পরিস্কার শুভ্র কাপড়ে মুড়িয়ে দর্শিনীর পাশে রাখে। পরবর্তী ধাপে আবিদ দর্শিনীর গর্ভফুলকে আলাদা করে দেয়। তৎক্ষণাৎ বাহিরে পুলিশের গাড়ি এবং অ্যাম্বুলেন্স দুটোর শব্দই শোনা যাচ্ছে। আবিদ আগেই ল্যান্ডলাইন থেকে হসপিটাল, পুলিশস্টেশনে ফোন দিয়ে রেখেছিল। তারপরই বাবা-মাকে জানিয়েছে! তারা হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বপরিবারে এখানে পৌঁছে যাবে।
আবিদ নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে দর্শিনীর শরীরের কাপড় ঠিক করে দেয়। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নার্স, ওয়ার্ডবয় বের হয়ে দর্শিনীকে স্টেচারে তুলে নেয়। সদ্যজন্মানো মেয়েকে কোলে নিয়েই আবিদ পুলিশ অফিসারকে সংক্ষেপে সবকিছু খুলে বলে। তারা ইব্রাহিম, ইয়ামিনের লাশকে পোস্ট মোর্টামের জন্য নিয়ে যায়। আবিদ এখানে ক্ষমতা প্রয়োগ করে প্রিয়মা বেগমের পোস্ট মোর্টাম আঁটকে দেয়। দর্শিনী চায়না তার মায়ের লাশের পোস্ট মোর্টাম হোক। ঘন্টা খানেক আগেই আবিদের পীঠে গুলি লেগেছিল! অথচ আবিদ কেমন স্বাভাবিক। তার শরীরে বিষক্রিয় ব্যথাটা পুরো ছড়িয়ে পড়েছে। আবিদ কোন রকম সহ্য করেছিল। তবে তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছেনা। আবিদের মাথাটা ঝিমঝিম করছে। যেকোনো সময় যেকোনো অঘটন ঘটে যেতে পারে। অ্যাম্বুলেন্সের লোকগুলো আবিদের ইশারার জন্যই অপেক্ষা করছে। আবিদ বললে তারা রওনা দেবে। পুলিশ লাশ নিয়ে চলে যাওয়ার পরপরই আশরাফ সাহেব এবং চৌধুরী বাড়ির সবাই মুহতাসিম ভিলায় উপস্থিত হয়েছে। আশরাফ সাহেব মৃত সহধর্মিনীকে দেখে ধ্বপ করে নিচে বসে পড়েন। উনার চোখে পানি। প্রিয়মা বেগম নেই! বিষয়টি তিনি মানতে পারছেন না। আবিদ সবাইকে ঘটনাটা বলে অ্যাম্বুলেন্সের দিকে যেতে থাকে। সবাই যেনো পাথর বনে গেছে সবটা শুনে। কিছু সময়ের ব্যবধানে মুহতাসিম ভিলার সবাই শোকাহত–মর্মাহত হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে অনুসা বেগম আবিদ, দর্শিনী এবং তাদের মেয়ে সহিসালামত ছিল বলে বারবার স্রষ্টাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিল।
পথিমধ্যেই আবিদ মেয়েকে কোলে নিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়তে নেয়! কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়েছে। তার সদ্য জন্মানো মেয়েটিকে সুরক্ষা দিতে আবিদ দর্শিনীর কোলে রেখে দেয়। পরক্ষণেই দূর্বলতার জন্য অচেতন হয়ে যায় আবিদ। পরবর্তীতে ওয়ার্ডবয়, নার্সরা তাকে স্ট্রেচারে করে দর্শিনীর পাশে তুলে নেয়! অ্যাম্বুলেন্স হসপিটালের উদ্দেশ্যে তার নিজস্ব গতিতে করুণ শব্দে চলতে শুরু করে। শুধু পেছনে ফেলে যায় চিরচেনা কয়েকজনকে!
_______________
পরিশেষে,
আবিদের মেয়ে রূপকথা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সুস্থ স্বাভাবিকই ছিল! কিন্তু দর্শিনী নিজের জন্মদাত্রী মাকে হারিয়ে বিষণ্ন হয়ে গেছিল। মায়ের মৃত্যুদিনেই তো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মেয়ের জন্ম হয়েছে। তাই দর্শিনী বারবার নিজের মেয়ের মাঝে মাকে খুঁজতে থাকে। দর্শিনী সুস্থ ছিল! কোনো ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়নি। তবে আবিদের গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন হয়েছে। গুলিবিদ্ধ ইন্জুরি নিয়ে আবিদ যেভাবে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছিল। এখানেই মূলত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ডাক্তার বলেছে আবিদের ইন্জুরি সিরিয়াস। ক্ষতস্থানে বিষক্রিয়ার মাধ্যমে ইনফেকশন হয়ে গেছে। সার্জারি না করলে সেই জায়গাতে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভবনা একশত পার্সেন্ট! ডাক্তারের রিপোর্ট পাওয়া মাত্রই আবিদকে সরকারি প্রাইভেট প্লেনে করে মাদ্রাজ পাঠানো হয়েছে। মাদ্রাজে সার্জারী এক্সপার্টদের মাধ্যমে ট্রিটমেন্ট করানোর জন্য। আবিদ যখন সবাইকে বিদায় জানিয়ে মাদ্রাজের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দর্শিনী তখন মেয়েকে নিয়ে ডক্টরের অবজার্বেশনে ছিল। আবিদের সুযোগ হয়নি মেয়েকে দ্বিতীয়বার দেখার, কোলে নেওয়ার। দর্শিনী তখন অচেতন ছিল। আবিদের বহিরে যাওয়ার ব্যপারে কিছুই জানেনা। তাই আবিদ যাওয়ার আগে তার জন্য একটা চিঠি লিখে যায়। সেই চিঠিতে আবিদ সবটা বুঝিয়ে বলে দর্শিনীকে। এমনকি শেষের লাইনে মেয়ের নাম আদ্রিজা চৌধুরী রূপকথা রাখতে বলে। মাদ্রাজে দুইমাস অতিবাহিত হওয়ার পরে আবিদ দ্রুত সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসবে। এটা জেনেই দর্শিনী, রূপকথা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। দর্শিনী নিজের মেয়ের নাম কাউকে রাখতে দেয়নি। আবিদ যেভাবে বলেছে সবকিছু মেনে চলেছে! আবিদের অপেক্ষায় দিন পার করছে। চৌধুরী বাড়িতে সবাই রূপকথাকে আবিদের দেওয়া নামেই ডাকে। দর্শিনী তাদেরকে অন্যনামে ডাকতে নিষেধ করেছে। তবে ভাগ্য বুঝি সুপ্রসন্ন ছিল। তাই তো আবিদ সর্বপ্রথম নিজের মেয়েকে কোলে নিতে পেরেছিল। ফলস্বরূপ সবাই রূপকথাকে কোলে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। নাহলে আবিদ কোলে না নিলে দর্শিনী হয়তো আবিদের আগে কাউকে কোলে নেওয়ার পারমিশন দিতো না।
_____________
প্রিয়মা বেগমের মৃত্যুর পরে আশরাফ সাহেব একদম ভেঙ্গে পড়েন। কিছুদিন আগেই স্বেচ্ছায় কলেজ থেকে রিটায়ার্ড করেছেন তিনি। সহধর্মিনীর ইচ্ছে অনুযায়ী আশরাফ সাহেব উইল অনুযায়ী সম্পত্তি প্রিয়মা বেগমের ওয়ারিশদের নামে দিয়ে দেন। এমন কী প্রিয়মা বেগমের লাশকে দূরবর্তী গোরস্থানে দাফন না করে মুহতাসিম ভিলার গার্ডেন সাইডে নির্জন একটা জায়গাই দাফন করেন। প্রজ্জ্বলিনী, প্রিয়দর্শিনী দুইবোন মাকে প্রচন্ড মিস করে। মাকে ছাড়া মুহতাসিম ভিলাতে তারা বেশিক্ষণ থাকতে চায়না। বিশেষ করে দর্শিনী। এই বাড়িতে প্রিয়মা বেগমের অজস্র স্মৃতি রয়েছে। দর্শিনী এখানে আসলেই মাকে প্রচন্ড মিস করে। মা বেঁচে থাকতে দর্শিনী নিয়ম করে আসার জন্য ছটফট করতো। অথচ এখন মাঝেমাঝে অসুস্থ দাদাকে দেখতে যায়। কিন্তু আগের মতো থাকা হয়না সেদিনই ফিরে আসে। আশরাফ সাহেব একাকী থাকতে শিখেছেন। তিনি এখনো আফসোস করেন মৃত্যুবেলায় সহধর্মিনীকে দেখতে পাননি বলে। শবনম চৌধুরীর কষ্টটা তিনি বুঝতে পারেন! উনার কষ্টের পরিমাণটা সুদে–আশুলে আশরাফ সাহেবের কাছে ফিরে এসেছে। যদিও সবকিছু পরিস্থিতি ছিল। শবনম চৌধুরী প্রিয়মা বেগমের মৃত্যুতে কষ্ট পেয়েছেন। তিনি আবিদের মেয়েকে দেখতে বাংলাদেশে ব্যাক করেছিলেন। সেইসময় আশরাফ সাহেবের সঙ্গে তার কথা হয়। প্রিয়মা বেগমকে খু’ন করা হয়েছে শুনে তিনি ব্যথিত ছিলেন। কথার ফাঁকেই আশরাফ সাহেব অতীতে তাদের মধ্যে যাকিছু ঘটেছিল। সবটা শবনম চৌধুরীকে খোলাশা করে বলেন। এই কথাগুলো কখনো বলার সুযোগ হয়নি আশরাফ সাহেবের। সবটা বলার পরে তিনি শবনম চৌধুরীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। উনার ধারণা শবনম চৌধুরীর সঙ্গে যাকিছু হয়েছে। সেটার প্রভাবেই জীবনে এমন সিচুয়েশন এসেছে। তিনি শবনম চৌধুরীর কাছে প্রিয়মার হয়েও ক্ষমা চাইলেন। অন্যদিকে শবনম চৌধুরী এতোবছর পরে অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য কথা জানতে পেরে হতবিহ্বল হন। তিনি এতোদিন যাবত আশরাফ সাহেবকে ভুল বুঝে গেছেন। অতঃপর সত্যিটা জানতে পেরে উনার চোখে অগোচরে পানি চলে আসলো। যাওয়ার আগে শবনম চৌধুরী আশরাফ সাহেবের উদ্দেশ্যে বলে যান,
‘সত্যি আমার কোন অভিযোগ ছিলনা! আফসোস ছিল প্রিয়মার জায়গাই হয়তো আমার থাকার কথা ছিল। আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম আশরাফ। আমি তোমার প্রতি রাগ করেছি, অভিমান করেছি। কিন্তু কখনো তোমাদের খারাপ চাইনি। বিদায়!’
শবনম চৌধুরীকে সবটা জানিয়ে কিছুটা অপরাধ বোধ থেকে মুক্তি পান আশরাফ সাহেব। অবশেষে দুই প্রাক্তনের সুন্দর একটা বিদায় মুহূর্ত তৈরি হয়! যাদের ব্যপারে কেউ কখনো জানতে পারেনি। আর না তারা কাউকে জানাতে চেয়েছেন। তারা দুজনেই ভালোবাসার মানুষকে স্বরণ করে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দুজনের মনে আজ কোনো আফসোস, অভিযোগ কিছু অবশিষ্ট নেই। আশরাফ সাহেব খুশি কারণ তিনি শেষমুহূর্তে প্রিয়মা বেগমকে ভালোবাসতে পেরেছেন বলে। অন্যদিকে শবনম চৌধুরী খুশি কারণ ভালোবাসার মানুষটি তাকে কখনো ধোঁকা দেয়নি বলে। সেদিন পরিস্থিতির চাপে পড়ে দুইজনের বিচ্ছেদ হয়েছিল। তবে আশরাফ সাহেব তাকে সত্যিই ভালোবেসে ছিলেন। এই কথাটুকু যথেষ্ট ছিল শবনম চৌধুরীর বেঁচে থাকার জন্য। তাদের গন্তব্য এখন আলাদা। দেরিতে, কিন্তু সত্যিটা জানতে পেরে শবনম চৌধুুরীর আর কোনো অভিযোগ নেই। তিনি সত্যিটাকে আগলে রেখে বাকিটা জীবন আরামসে কাটিয়ে দিতে পারবেন।
________________
চৌধুরী বাড়িটা জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে সাজানো হয়েছে। শুধুমাত্র আবিদ ফিরবে বলেই শাহরিয়ার চৌধুরীর এতোকিছু আয়োজন। ইতিমধ্যে বাড়িতে মেহমান উপস্থিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রজ্জ্বলিনী, উজান, তাদের একমাত্র ছেলে প্রহরও উপস্থিত। তাছাড়া আজকের অনুষ্ঠানে একটা বিশেষ কারণে নিহাল উপস্থিত আছে। সবাই মূলত আবিদকে দেখতে এসেছে। কিন্তু নিহালের আরো একটি উদ্দেশ্য রয়েছে। আজকে নিহাল শাহরিয়ার চৌধুরীর কাছে আদিবাকে চেয়ে নিবে। নিহাল যথেষ্ট কনফিডেন্ট শাহরিয়ার চৌধুরী তাকে মেয়ে জামাই হিসাবে গ্রহণ করবেন। তাছাড়া ডা. নিহাল রায়হান আদিবার জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি! রাজি না হওয়ার প্রশ্নই আসেনা। আজকের অনুষ্ঠানে সবার মাঝে আশরাফ মুহতাসিম অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি দর্শিনীর দাদুকে রেখে আসতে পারেনি। কারণ মুহতাসিম ভিলায় এখন আশরাফ সাহেব এবং আহমেদ মুহতাসিম একাই থাকেন। তবে প্রিয়মা বেগমের মৃত্যুর পরে আশরাফ সাহেব তেমন কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান করেনি।
চৌধুরী বাড়ির সামনে আবিদের হেলিকপ্টার ল্যান্ড করেছে মাত্রই। সবাই আগ্রহের সঙ্গে বাহিরে তাকিয়ে আছে। আবিদকে এক ঝলক দেখবে বলে! অন্যসবার মতো দর্শিনী অধির আগ্রহে আবিদের জন্য অপেক্ষা করছে। বাকি সবাই নিচে উপস্থিত ছিল। কিন্তু দর্শিনী মেয়েকে নিয়ে নিজের রুমেই আছে। অপেক্ষার অবশান ঘটিয়ে আবিদ বাড়িতে উপস্থিত হয়। সে কিছুক্ষণ সবার সঙ্গে দেখা করে নিজের রুমে চলে আসে। দীর্ঘদিন পরে বউ বাচ্চাকে দেখতে পাবে বলে আবিদের যেনো সামান্য দেরীটুকু সহ্য হলোনা। তৎক্ষণাৎ সে দর্শিনীকে দেখতে পায়। মসৃণ কালো খয়েরী সংমিশ্রণে শাড়ি পরিহিত— অপরূপ সুদর্শিনী রমণীটি! উদাসীন ভঙ্গিতে রাজকীয় বিছানায় ঘুমন্ত রাজকন্যাটির সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করছে। রাজকন্যাটির বাবার কথা বলছে কী? তার মসৃণ চুলগুলো যেন অবাধ্য! বারবার মুখের সামনে চলে আসছে। দর্শিনী রমণীটি সন্তপর্ণে অবাধ্য চুলগুলোকে কানের পেছনে গুঁজে নেয়। কী অপরূপ সেই দৃশ্য! ফোনে তখন লো–ভলিউমে একটা গান ভেসে আসছে। যেটা আবিদের কন্ঠেই প্রিয়দর্শিনীর জন্য ছিল!
স্বপ্নে দেখা স্বপ্নপরী‚
হাসি তার জোছনা মায়াবী!
হরণী চোখে তার‚ মোহিনী যে দৃষ্টি!
দুচোখে আমার ভাসে‚ তারই ছবি
আমার প্রিয়-দর্শিনী!
আবিদ দর্শিনীকে গভীর ভাবে দেখতে থাকে। মুহূর্তেই তার কন্ঠস্বর যেন অবরোধ হয়ে আসলো। সহসা আবিদ দর্শিনীকে ক্ষীণ স্বরে ডাকে,
‘প্রিয়দর্শিনী……!’
দর্শিনী আবিদের কন্ঠস্বর শুনে চমকে সামনে তাকায়। এতোদিন পর আবিদকে স্বশরীরে সুস্থভাবে দেখে দর্শিনী ইমোশনাল হয়ে যায়। হঠাৎই আবিদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কান্না করে দেয়! আকস্মিক জড়িয়ে ধরায় আবিদ কিছুটা পিছিয়ে যায়। পরক্ষণেই পরম আনন্দে দর্শিনীকে জড়িয়ে ধরে। শুধু জড়িয়ে ধরে থামেনি! দর্শিনীর শরীরের মিষ্টি সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে আবিদ তার গলাই মুখ গুঁজে! পরপরই কপালে, গালে, ঠোঁটে অজস্র চুমু খায়। তারা দুজনে যেনো মুহুর্তেই দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদ ভুলে গিয়ে সমস্ত দূরত্ব ঘুঁচিয়ে নেয়। কিয়ৎক্ষণ বাদে আবিদ দর্শিনীকে ছেড়ে মেয়ের কাছে যায়। মেয়ে তার ঘুমোচ্ছে। কী স্নিগ্ধ রূপ! রূপকথার বয়স দুইমাস চলছে। আবিদ ছোট্ট প্রাণটিকে খুব সন্তপর্ণে তার বলিষ্ঠ হাত দিয়ে কোলে তুলে নেয়। মেয়ের তুষার শুভ্র নরম গালে চুমু খায় আবিদ! বাবার কমল পরশে রূপকথা নড়েচড়ে উঠে। আবিদ সেটা লক্ষ্য করে অশ্রুসিক্ত চোখে দর্শিনীর দিকে চেয়ে সামান্য হাসল। এ যেনো প্রাপ্তির আনন্দ অশ্রু!
#সমাপ্ত
[ ~ প্রিয়দর্শিনীর সমাপ্তি পর্ব লিখতে গিয়ে প্রথমবার অন্যরকম মন খারাপ অনুভব করলাম। আমি গল্পটা যেভাবে শুরু করেছিলাম। ব্যস্ততা, প্রচন্ড অনিয়মের জন্য শেষপর্যন্ত সেভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি। তবুও যারা শুরু থেকে পাশে ছিলেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা রইল। গল্পের শুরুর দিকে অজান্তেই কিছু বানানে ভুলত্রুটি থেকে গেছে। বাকি পর্বগুলোতে আমি সব শুধরে নিয়েছি। তবুও যদি ভুলত্রুটি থাকে, আমার প্রথম লেন্থফুল গল্প হিসাবে, সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এটা আমার অনুরোধ রইল। আমি আদিবা নিহাল জুটির মধ্যে প্রেম দেখিয়েছি। এবার পাঠকের উদ্দেশ্যে তাদের বিয়েটা ছেড়ে দিলাম। সবাই তাদের বিয়েটা কল্পনা করে নিয়েন। যদি কখনো গল্পে ব্যাক করি তাহলে আবিদ দর্শিনীকে ফিরিয়ে আনবো ইনশাআল্লাহ। ততদিন পর্যন্ত সবাই ভালো থাকবেন, আল্লাহ্ হাফেজ ~ ]