প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৪৮

0
115

#প্রিয়দর্শিনী🧡
#প্রজ্ঞা_জামান_তৃণ
#পর্ব__৪৮

সময় কীভাবে চলে যায় সহজে বোঝা যায় না। দেখতে দেখতে দু’মাস হয়ে গেছে। আবিদ দর্শিনীর জীবন আগের ন‍্যায় সুন্দর ভাবেই চলছে। কোন পরিবর্তন নেই! সেদিনের পর থেকে এই দু’মাসে দর্শিনীর ভার্সিটি লাইফে কোন সমস্যা হয়নি। আবিদ তার সেফটির জন‍্য সব উপায় অবলম্বন করেছে। তবে চৌধুরী বাড়ির পরিবেশ আগের চেয়ে অনেকটা বদলে গেছে এখন। কেমন যেন নিঃশব্দ অবস্থা! এইতো গত মাসেই আসফি ভিসা পেয়ে কানাডা চলে গেছে। অন‍্যদিকে শবনম চৌধুরী চলে গেছেন অস্ট্রেলিয়া। শেষ পযর্ন্ত আবিদ ফুপিকে আঁটকাতে চেয়েছিল। কিন্তু চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি! আসফি আর শবনম চৌধুরী কেউই দেশে থাকতে রাজী নন। তাদের চলে যাওয়ার কথা শুনে শত অনুরোধ করা সত্ত্বেও দুইজনে সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। তারপর থেকেই বাড়িতে কেমন নিশ্চুপ অবস্থা বিরাজমান। বাড়ির চঞ্চল ছেলেটা কেমন যেন বদলে গেলো! আবার সবাইকে ছেড়ে চলেও গেলো। অনুসা বেগম, শাহরিয়ার চৌধুরী নিজেদের ছোট ছেলে, বোনকে মনে করে কষ্ট পায়। চৌধুরী বাড়িতে এখন শুধু আরহান আর আবিদ আছে। অবশ‍্য শবনম চৌধুরী মাঝে-মধ‍্যেই ভিডিও কলে কথা বলে সবার সঙ্গে। কিন্তু আসফি সেভাবে কথা বলেনা। তবে সপ্তাহ পরপর বাবা-মার খোঁজখবর নেয়!
অনুসা বেগম এবং শাহরিয়ার চৌধুরী আসফিকে মনে করে কষ্ট পায় তবুও সবটা মেনে স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করছেন প্রতিনিয়ত।

মাসখানেক আগেই প্রজ্জ্বলিনী এবং তার বেবিকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হয়েছে। দর্শিনী সেই সময় বোনের আদুরে ছেলেকে নিয়ে মেতে থাকতো। প্রজ্জ্বলিনীকে যখন মুহতাসিম ভিলায় নিয়ে আসা হয় তখন দর্শিনী অনেকদিন আবিদকে ছাড়া বোনের কাছে থেকেছে। বলা বাহুল্য আবিদের মতো দর্শিনীও বাচ্চা পছন্দ করে। আজকে অফিসে থাকা অবস্থায় আবিদ বাসা থেকে খবর পায় দর্শিনী রান্নাঘরে সেন্সলেস হয়ে পরে গেছে। শাহরিয়ার চৌধুরী তৎক্ষণাৎ পারিবারিক ডাক্তারকে ডেকে এনেছেন। পরবর্তীতে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা যায় দর্শিনী প্রেগন‍্যান্ট। প্রেগন‍্যান্সির সময়টা খুবই স্বল্প ছিল! আবিদ নিউজটা পেয়ে বিস্মিত হয়েছে! বলতে গেলে নিজের বাবা হওয়ার সংবাদ পেয়ে তার অবস্থা হতবিহ্বল প্রায়! খবরটা পেয়ে আবিদ রিয়‍্যাক্ট করতে ভুলে গেছে। এতো তাড়াতাড়ি বাচ্চা চায়নি আবিদ! তাই জন‍্য দর্শিনীকে বারবার পিল নিতে বলতো। কিন্তু দর্শিনী তার কথা শোনেনি। আবিদের আনন্দ, দুঃশ্চিন্তা দুটোই একসঙ্গে হচ্ছে। আনন্দ হচ্ছে বাবা হবে ভেবে। অন‍্যদিকে দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে দর্শিনীর বয়স কম চিন্তা করে। আবিদ জানে প্রেগন‍্যেন্সিতে অনেক কম্পলিকেশন থাকে। সবচেয়ে বড় কথা দর্শিনীর বয়স উনিশ বছর সামথিং চলছে। বিশ বছর পূর্ণ হয়নি। আবিদের ভয়টা মূলত এখানেই! নিঃসন্দেহে দর্শিনী পিল না নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছে। খবরটা পাওয়া মাত্র আবিদ বাসায় চলে আসে। বাসায় ফিরে দেখে সবাইকে মিষ্টি মুখ করানো হচ্ছে। শাহরিয়ার চৌধুরী সহ বাড়ির সবাই আনন্দে মিষ্টি মুখ করছে। পুস্পিতার যেহেতু আট মাস চলছে! তাই সে আনন্দে যোগ দিতে পারেনি। তবে খবরটা শুনে পুস্পিতা প্রচণ্ড খুশি হয়েছে। আগে-পরে বাড়িতে দুইজন অতিথি আসতে চলেছে। তাই আনন্দের মাত্রাটা যেন বেশি! শাহরিয়ার চৌধুরী তৎক্ষণাৎ শবনম ফুপিকে ভিডিও কলে খুশির খবরটা দেয়। শবনম চৌধুরী আবিদের জন‍্য ভিষণ খুশি। তিনি দর্শিনীকে ভিডিও কলে দোয়া করলেন। আবার সবার সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিলেন। তিনি জানিয়েছেন, আবিদের সন্তানকে দেখতে তিনি ইন-ফিউচার বাংলাদেশে ব‍্যাক করবেন। চৌধুরী বাড়িতে সকলে আনন্দে আত্মহারা। বিশেষ করে দর্শিনী! একটা ছোট্ট প্রাণ তার ভেতরে বেড়ে উঠছে। খবরটা শোনার পর থেকেই মেয়েটা আনন্দে বারবার অশ্রুসিক্ত হচ্ছে। সেই ছোট্ট প্রাণটা আবিদ আর দর্শিনীর অংশ! বাচ্চাটা আবিদের জন‍্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ দর্শিনী উপলব্দি করতে পারছে। বাড়িতে ফিরেই আবিদ দর্শিনীর মুখোমুখি হয়। দর্শিনী তখন আবিদের মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর মুখ দেখে চুপসে যায়। ভাবতে থাকে আবিদ তার উপর রাগ করেছে কি? তাদের ছোট্ট বেবি হবে শুনে আবিদ নিশ্চয়ই খুশি হয়নি! নাহলে আবিদকে আনন্দিত লাগছেনা কেনো? অজানা আতঙ্কে দর্শিনী নীল হয়ে যায়। পরক্ষণেই আবিদের দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে। আবিদের মতিগতি বোঝা যাচ্ছে না। দর্শিনী মনে মনে ঠিক করে নেয় আবিদ বেবি না চাইলে সে একমুহূর্ত এখানে থাকবে না। এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে। তবুও বেবিকে জন্ম দিবেই! দরকার পড়লে দর্শিনী একাকী মানুষ করবে তার সন্তানকে। আবিদের সাহায‍্যের প্রয়োজন নেই!

দর্শিনী বিছানায় অর্ধশোয়া হয়ে বসে আছে। আবিদের নিস্তব্ধতা তাকে কাবু করে ফেলেছে। সে আবিদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরক্ষণেই মাথা নিচু করে ফেলে। আবিদ কেঁপে উঠল মনে হয়! পরক্ষণেই দর্শিনীর পাশে বেডেই বসে পড়ে। অনেকটা সময় নিস্তব্ধ হয়ে বসেছিল দুজন। আবিদ হঠাৎ-ই ইমোশনাল হয়ে দর্শিনীর নরম হাত আঁকড়ে অনেক গুলো চুমু খায়। তার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে! আবিদ একদমই কাঁদতে পারেনা। এই প্রথম তাকে কাঁদতে দেখল দর্শিনী! আনন্দে কাঁদছে নাকি অন‍্য কারণে দর্শিনী কিছুক্ষণ ড‍্যাবড‍্যাব করে চেয়ে বুঝতে চাইলো। তাদের অংশ পৃথিবীতে আসতে চলেছে! বাবা হিসাবে আবিদ ভিষণ আনন্দিত। আজকে সন্তানের সুবাদে আবিদের চোখে পানি দেখল দর্শিনী। স্বামী-স্ত্রী দুজনই নিঃশব্দে কাঁদছে। আবিদ তৎক্ষণাৎ দর্শিনীকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খায়। কিছুক্ষণ পর দর্শিনীকে ছেড়ে আলতো হাতে চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। দর্শিনী শোয়া অবস্থাতেই আবিদকে জড়িয়ে ধরে থাকে। আবিদ তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘আজকে আমি কতোটা খুশি হয়েছি, বলে বোঝাতে পারবো না বউ! বাবার কাছে খবরটা শুনে প্রথমে আমি বড়সড় বিষম খেয়েছিলাম। কেমন যেন বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না। ভেবেছিলাম বাবা হয়তো মজা করছে! পরবর্তীতে ডাক্তার আঙ্কেলের থেকে শিয়র হলাম। তিনি জানালেন সত্যিই আমি নাকি বাবা হচ্ছি! কথাটা মাথায় ক‍্যাঁচ করার পরপরই তোমার কাছে ছুটে এসেছি।’

আবিদের বুকের বাঁ-পাশে মাথা রেখে দর্শিনী বলে,

‘আমি আপনার গম্ভীর মুখশ্রী দেখে ভয় পেয়েছিলাম আবিদ! ভেবেছি আপনি খুশি হননি। হয়তো পিলের ব‍্যাপারটা নিয়ে আমার উপর ভিষণ রেগে আছেন। আপনি বাচ্চা চান না!’

‘দর্শিনী, পুরুষ কিংবা নারী তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন তাদের সন্তান পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়! আদুরে স্বরে বাবা-মা বলে ডাকে! আজকে আমি তুমি দুজনেই পরিপূর্ণ হওয়ার পথে। আমি ভিষণ খুশি হয়েছি দর্শিনী! কতোটা খুশি হয়েছি বলে বোঝাতে পারবো না। তবে…!’

দর্শিনী তৎক্ষণাৎ মুখ তুলে তাকায়। আবিদকে জিগ্যেস করে,

‘তবে কী?’

‘আমি ভয় পেয়েছিলাম দর্শিনী! সেটা তোমার বয়সের জন‍্যই! বেবিকে প্রপারলি ক‍্যারি করার জন‍্য তোমাকে নূন‍্যতম বিশ বছর বয়সী হতে হবে। তাছাড়া প্রেগন‍্যন্সির জন‍্য পড়াশোনাতে সমস্যা সৃষ্টি হবে! তোমার এভাবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি দর্শিনী। প্রেগন‍্যান্সিতে অনেক কম্পলিকেশন থাকে! মানে আমি বলতে চাইছি, এতো পেইন সহ‍্য তুমি করতে পারবে না। তোমার সময় নেওয়া প্রয়োজন ছিল!’

‘ব‍্যাস আবিদ, অনেক বলেছেন আপনি! আমি আমার নিজের অংশকে ক‍্যারি করতে পারবো না এমন ভ্রান্ত ধারণা আপনার কী থাকা উচিত? কম বয়সে অনেক মেয়ের বেবি হয়েছে! তারা সবাই কী পেইন সহ‍্য করতে না পরে মারা গেছে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আমার বয়স বিশ বছর হতে দেরী নাই! বেবি হওয়ার পরেও পড়াশোনা করা যায়। যত কম্পলিকেশন, পেইন আসুক না কেনো আমি ঠিক পারবো! আপনি শুধু আমার পাশে থাকবেন কথা দিন। আপনি সারাজীবন আমার পাশে থাকলে মৃত্যু চলে আসুক, আফসোস করিনা। আপনার খুশির জন‍্য আমি সবকিছু করতে পারি ম‍্যাজিস্ট্রেট সাহেব!’

আবিদের হৃদপিণ্ড সর্বোচ্চ জোরে বিট করতে শুরু করেছে। দর্শিনীর মুখে মৃত্যুর কথাটা শুনে আবিদ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। দর্শিনী মৃদু ব‍্যথা পায় তবুও আবিদকে কিছু বলেনা। হিসেব অনুযায়ী দর্শিনীর মনোবল বাড়ানো উচিত আবিদের! অথচ আবিদের নিজেরই মনোবল শূন‍্যের কৌঠায়! আবিদ তার দর্শিনী নামক স্বপ্নকন‍্যাকে ভালোবাসে। ভালোবাসার পরিমানটা নিজের থেকেও বেশি! দর্শিনীর কষ্ট মানে আবিদের নিজের কষ্ট। তবুও দর্শিনীর দৃঢ়চেতা মনোভাবে আবারো হার মেনে নিলো আবিদ! আবিদ দর্শিনীকে বুকে জড়িয়ে আশ্বস্ত করলো সর্বদা তার পাশে থাকবে। তাকে ছেড়ে কখনো যাবে না! দর্শিনীর মুখে তৎক্ষণাৎ কিঞ্চিৎ হাসি ফুঁটে ওঠে। চোখে স্বচ্ছ পানি চিকচিক করছে! আবিদ তার কপালে অধর ছুঁয়ে বলে,

‘ভয় নেই দর্শিনী! আমি সর্বদা তোমার পাশে থাকবো! যদি কখনো মৃত্যু আমাদের মাঝে চলে আসে। আমি ঢাল হয়ে তোমাকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করবো। আমার পূর্বে মৃত্যু যেন তোমাকে ছুঁতে না পারে। আল্লাহর কাছে এটাই চাওয়া আমার!

দর্শিনী আবিদকে জড়িয়ে বলে,

‘আপনি ছাড়া আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে, আবিদ শাহরিয়ার চৌধুরী! দয়া করে এমন কথা কখনো বলবেন না। আপনার আমার পথচলা লম্বা সময়ের জন‍্য হোক! ইনশাআল্লাহ আল্লাহ চাইলে আমরা দীর্ঘ সময় একসঙ্গে থাকবো।’

#চলবে

[ এই গল্পের পাঠকদের বলছি, গল্পটা স‍্যাড এন্ডিং দিলে সবাই গ্রহণ করবেন তো? সবাই ভুলত্রু’টি মানিয়ে নিবেন প্লীজ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here