#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ৫ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে পেপার পড়ছিলেন রিদের বাবা মিস্টার আফজাল শেখ। রিদও বাবার পাশে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল। মিসেস ফাবিহা দুজনের জন্যই কফি নিয়ে এলেন।
কফি খেতে খেতে আফজাল শেখ বললেন,
‘তাহনা আর রাইশা কোথায়?’
মিসেস ফাবিহা মুচকি হেসে বললেন,
‘রুমে। আর কোথায়? তাহনা যখন থেকেই এসেছে ব্যাস। তোমার মেয়ে আর রুম থেকেই বের হতে চায় না। সারাক্ষণ তাহনার সাথে বকবক করেই যাচ্ছে। বেচারি বোধয় আমার মেয়ের অত্যাচারে পাগল হয়ে যাচ্ছে। দুজনে সারাক্ষণ কি যেন গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করে।’
মিস্টার আফজাল শেখ অট্টহাসি দিলেন।
‘ওদেরই ত বয়স এখন। ওরা এখন নিজেদের ইচ্ছায় চলবে।’
ওনাদের কথার মাঝে উপস্থিত হয় রাইশা আর তাহনা। রাইশা এসে তার বাবা গলা জড়িয়ে ধরে বাবার কোলে বসে পড়ে। আর তাহনা রিদের মায়ের কাছে গিয়ে বলে,
‘আন্টি? আমি কি আপনাকে হেল্প করতে পারি?’
‘তোমার না পরিক্ষা? পড়াশোনার কি অবস্থা?’
‘জি। ভালো।’
এবার রিদ একটু মুখ খুললো।
‘তাহনার টিচার’রা ত তাহনার বেশ প্রসংশা করলেন। সেদিন যখন গেলাম তখন ওনারা আমাকে তাহনার সম্পর্কে সব বলেছিলেন।’
মিস্টার আফজাল শেখ ছেলেকে সমর্থন করে বললেন,
‘আমার তাহনা মায়ের মতন ভালো মেয়ে কোথায় পাবে কেউ?’
এদিকে তাহনা লজ্জায় পড়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
তখনি রাইশা মুখ গোমড়া করে তার বাবাকে বলে,
‘কেন? আমি ভালো মেয়ে নই বুঝি?’
‘তুমিও ত আমার ভালো মেয়ে।’
রিদ আড়চোখে রাইশার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তুই ত একটা ডাইনি।’
রিদের কথায় রাইশা ক্ষেপে যায়। সে বাবার কোল থেকে উঠে সোজা রিদের কাছে গিয়ে ওর চুল টেনে ধরে দু’হাতে। রিদের হাতে থাকা ল্যাপটপ টা পড়ে যেতে নেয়। রিদ ব্যথায় রাইশার হাত ছাড়াতে গিয়ে ভুলেই যায় যে তার হাতে ল্যাপটপ টা ছিল। তাহনা দৌড়ে এসে ল্যাপটপ টা ফ্লোরে পড়ার আগেই ধরে ফেলে।
রাইশা রিদের চুল টানাটানি করতে করতে বলল,
‘আমি ডাইনি? তুমি কি? রাক্ষস, হনুমান একটা।’
রিদ রাইশার হাত ধরে নিজের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। এদিকে আফজাল শেখ মেয়েকে এক ধমক দিলেন। সাথে সাথেই রাইশা রিদের কাছ থেকে সরে যায়। রিদ অগ্নি দৃষ্টিতে রাইশার দিকে তাকায়। রাইশা এক দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায়।
এদিকে তাহনা রিদকে তার ল্যাপটপ টা দিয়ে রিদের মায়ের সাথে কিচেনে যায়।
___
বিকেল প্রায় চারটা বেজে নয় মিনিট! আছরের নামাজ পড়ে পড়তে বসলো তাহনা। দুদিন পর তার পরিক্ষা। প্রতিটি মিনিট এখন তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
তাহনার পড়ার মাঝেই রাইশা এসে তাহনার কাছ থেকে বইটা কেড়ে নিল। এতে তাহনা বিশ্মিত হয়ে বললো,
‘আরে, তুমি আমার বইটি এভাবে কেন নিলে?’
রাইশা বইটি বিছানার উপর রেখে মুখে বিরক্তির ছাপ নিয়ে বললো,
‘সারাক্ষণ বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকো কেন তুমি? মাথা ব্যথা করবে তো। চলো কাশ বাগানে ঘুরে আসি।’
‘আমার পরশু পরিক্ষা। আমি এখন কাশ বাগানে ঘুরতে যাবো?’
তাহনার কথায় রাইশা জোরে হেসে বলে,
‘একটু ঘুরে এলে দেখবে মন ভালো থাকবে। পড়ায় একঘেয়েমি লাগবে না। ভাইয়া বলে আমাকে সবসময়।’
তাহনা কিছু বলে না। রাইশা তাহনা কে নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। যাওয়ার আগে তাহনা একটু পরিপাটি হয়ে নেয়। রাইশা আগে থেকেই রেড়ি ছিল।
বাড়ির বাইরে এসে তাহনা রিদ কে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। কিছুটা অপ্রস্তুত ছিল সে। ওরা আসা মাত্রই রিদ বলে উঠে।
‘রাইশা মহারাণী আপনি এসেছেন? আসুন? এবার আপনার আর আপনার পাশের জনের পদখানি গাড়িতে তুলুন।’
রিদের এমন কথায় রাইশার রাগ হলেও তাহনা শুনে মুচকি হাসতে থাকে। রাইশা গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে। তাহনাও হাসি থামিয়ে রাইশার পাশে বসে। রিদ নিজেও গাড়িতে উঠে গাড়ি চালাতে থাকে। আধুনিক বাংলা গান চালু করে সে। গন্তব্য কাশবন।
তাহনা গাড়ি জানালার কাচ দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সারি সারি গাছগুলো যেন খুব দ্রুত দৌড়াচ্ছে! গাড়িতে বেজে চলেছে খুব সুন্দর একটা গান। সেই গানটা অনুভব করছে তাহনা। পাশ থেকে রাইশা তাহনার সাথে বকবক করেই যাচ্ছে। কিন্তু তাহনার মন অন্যদিকে।
শহরের সুন্দর কাশবনটায় এসেছে তাহনারা। কাশবনের সাদা সাদা কাশ ফুল দেখে তাহনার মুখে প্রাপ্তির হাসি। রিদ তাহনা কে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘মাঝেমাঝে নিজেকে একটু সময় দিতে হয়। পড়ার মধ্যে সারাক্ষণ ডুবে থাকলে ব্রেনে চাপ বাড়বে। তখন অন্য কিছু একটা হয়ে গেলে সামলানো বড্ড দায় হয় পড়বে।’
তাহনা বিরক্তি নিয়ে বলে,
‘আপনারা ভাই বোন মিলে কি শুরু করলেন? আমি এতোটাও ভালো ছাত্রী নই। একটু চুপ করুন না।’
তাহনা কথা গুলো বলেই চলে গেল অন্যদিকে। এদিকে রাইশা আর রিদ একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। তাহনা কে এতো কিছু বলা বোধয় উচিৎ হয়নি তাদের। রিদ একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে রাইশা কে বলে,
‘বনু শোণ! তুই তাহনার কাছে যা আমি তোদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসছি। এই আইস্ক্রিম খাবি তো?’
আইস্ক্রিমের নাম শুনতেই রাইশা লাফিয়ে উঠে বলে,
‘খাবো না মানে। তুমি আমার জন্য ১০ টা নিয়ে আসবা।’
রিদ এক হাত উঠিয়ে রাইশা কে বলে,
‘আর একবার বল, থাপ্পড় একটাও মাটিতে পড়বেনা।’
রাইশা চুপ হয়ে যায়। তার ভাইকে চেনা আছে তার। যা বলে তা-ই করে।
‘দুজনের জন্য দুটো নিয়ে আসবো। এর বেশি না।’
রাইশা অসহায় দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মাত্র দুটো আইস্ক্রিম? তাও একটা করে পাবে সে? ধুর!
রাইশা জিদ দেখিয়ে তাহনার কাছে চলে গেল। তাহনা তখন কাশবাগান দেখতে ব্যস্ত! চারিদিকে কাশফুলের সমরহ দেখে মনে হচ্ছে সাদা মেঘ নেমে এসেছে আকাশ থেকে মাটিতে। দুটো কাশফুল ছিড়ে নিল তাহনা। রাইশা এসে তাহনার মতো নিজেও দুটো কাশফুল ছিড়ে নিল।
রাইশা তাহনা কে নিয়ে কাশবাগানের একপাশে হাটতে থাকে। সাথে কিছু খোশগল্প করে। রাইশা বলে,
‘আপু জানো। ভাইয়াকে যখনই বলি ঘুরতে যাবো। ভাইয়া আমাকে সব জায়গায় ঘুরতে নিয়ে আসে। এই যে এখন বললাম কাশবাগানে যাবো, ভাইয়া তার কাজ দ্রুত সেড়ে রেডি হয়ে গেল।’
তাহনা মুচকি হেসে বলে,
‘তোমার ভাইয়া খুব ভালো না?’
‘তা আর বলতে? তবে আমার সাথে ঝগড়া করে বেশি।’
‘ভাই বোনদের মধ্যে একটু আধটু ঝগড়া হবেই। তবে কথা হচ্ছে জীবনে একটা বড় ভাই থাকাটা খুব দরকার। যেটা তোমার আছে। তুমি খুব ভাগ্যবতী। যা আমার নেই। আমার কপাল অনেক খারাপ জানোতো।’
তাহনার কথা শুনে রাইশার মন খারাপ হয়ে যায়। রাইশা তাহনা কে স্বাভাবিক করানোর জন্য কয়েকটা হাসির কথা বলে। সাথে সাথেই তাহনা হেসে দেয়।
রিদ ওদের খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছে। হাটতে হাটতে যে কোথায় চলে গেল দুজন। লোকদের জিজ্ঞেস করেও লাভ হয়নি। রাইশা ফোনও নিয়ে আসেনি। রিদ পাশের একটা রাস্তা দিয়ে হাটতে থাকে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ওদের খোঁজার চেষ্টা করছে। নিজে নিজেই বলছে,
‘না বলে কোথায় চলে গেল, এখন কোথায় খুজবো? উফফ, এই রাইশাও না।’
রিদ পড়ে গেল দুশ্চিন্তায়। হঠাৎ সে সামনে থাকা দুটো মেয়েকে দেখতে পায়। হাতে কাশফুল নিয়ে হেটে আসছে তার দিকে। রিদের বুঝতে বাকি নেই যে এরাই রাইশা আর তাহনা। রিদ দৌড়ে ওদের কাছে যায়।
আচমকাই কেউ তাদের সামনে এসে দাঁড়ালে ভয় পেয়ে যায় তাহনা আর রাইশা। তাকিয়ে দেখে রিদ তাদের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে আছে। রিদ বলে,
‘তোদের খুঁজে পাচ্ছিনা দেখে আমার কত টেনশন হচ্ছিল জানিস? এখানে কি তোদের?’
‘ভাইয়া আমরা তো এমনিই হাটছিলাম।’
‘চুপ। না বলে একা একা এখানে আসতে কে বলেছে হ্যাঁ?’
রিদের চিৎকার শুনে কেঁপে উঠে তাহনা। রিদ আইস্ক্রিম গুলো রাইশার হাতে দিয়ে এক হাত রাইশার আর এক হাত তাহনার ধরে হাটতে থাকে। রিদ সোজা ওদের গাড়ির সামনে নিয়ে আসে। ভিতরে ঢুকতে বললে রাইশা ঢুকে যায় কিন্তু তাহনা দাঁড়িয়ে থাকে। রিদ ভ্রু কুচকে তাহনা কে জিজ্ঞেস করে,
‘কি হলো? দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভিতরে ঢুকো।’
তাহনা নিচের দিকে তাকিয়ে বলে।
‘আমি রিক্সা নিয়ে চলে যাব। আপনারা যান।’
এটা শোণার পর রিদ গরম হয়ে বলে,
‘এই মেয়ে! মাথা খারাপ তোমার? গাড়ি থাকতে তুমি রিক্সায় যাবে?’
‘আমার গাড়ির পিছনে বসতে ভয় করে। ঝাকায় খুব।’
‘তাহলে সামনে বস।’
তাহনা কি বলবে এবার! ওর তো সামনে বসতে আরো ভয় লাগে। তাহনা ভয়ে ভয়ে রিদের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আপনারা যান না। আমি বললাম তো আমি রিক্সা নিয়ে যেতে পারবো।’
রিদ আর কথা বাড়ায় না। কিন্তু সে ছাড়ার পাত্র নয়। তাহনার হাত ধরে তাকে গাড়ির সামনের সিটে বসিয়ে দিল সে। তাহনা শুধু হা করে দেখছে সব। রিদ নিজে ড্রাইভিং সিটে বসলো। তাহনার দিকে ঝুকতেই তাহনা ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। রিদ তাহনার সিটবেল্ট লাগিয়ে দিল।
তাহনা আস্তে করে চোখ খুলে দেখে রিদ গাড়ি চালাচ্ছে। ইশ! কি ভাবলো তাহনা। পিছনে তাকিয়ে দেখে রাইশা আপনমনে আইসক্রিম খাচ্ছে৷ সামনে কি হচ্ছে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
তাহনা চোখ বন্ধ করে নিল। ভালোয় ভালোয় বাড়ি পৌছাতে পারলেই শান্তি।
চলবে…