#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ২৯ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
নিজের অনামিকা আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে আছে রাইশা। তার আঙ্গুলে একটা ছোট্ট ডায়মন্ড রিং। রিংটা রাফি পড়িয়ে দিয়েছে তার হাতে। সেই মুহুর্তের কথা ভাবলে রাইশা অন্য এক জগতে হারিয়ে যায়। সেদিন এস আই নিজাম উদ্দিন রাইশাকে পাশে বসিয়ে কিছু কথা বলেন। উনি রাইশাকে বুঝিয়ে বলেন,
‘আমি চেয়েছিলাম তোমার সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিয়ে আমার আর আফজালের বন্ধুত্ব আরও গভীর করতে। কিন্তু তুমি রাজি না থাকায় সেটা আর হলো না। তবে মা তুমি চাইলেই সব পারো। তোমাকে এখন বিয়ে করতে হবে না। আমি মানছি আমার ছেলেটা একটু ত্যাড়া টাইপের। কিন্তু মনটা ওর বেশ ভালো। তুমি ঠকবে না। আমার ছেলে তোমায় খুব ভালো রাখবে। বিয়ে নাহয় পরে করো। অন্তত তোমাকে আমার ছেলের বাগদত্তা হিসেবে দেখতে চাই।’
রাইশা চুপ করে ছিল। ও আসলে ভাবছিল। একজন বাবা কিভাবে তার ছেলের জন্য একটা মেয়েকে তার বৌমা হওয়ার জন্য রাজি করাচ্ছেন। রাইশার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা একটু জটিল। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। নিজাম উদ্দিন আবারও বললেন,
‘তোমার আপত্তি থাকলে আমরা আর তোমাকে জোর করবো না এ ব্যাপারে। তোমারও তো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে।’
রাইশা বলে উঠলো,
‘আপনারা যা সিদ্ধান্ত নিবেন তাই হবে আংকেল। আপনার কথাগুলো আমি বারবার ভেবে দেখলাম। এতে যদি আমার ভালো হয়, আমার পরিবারের ভালো হয়, আপনাদের বন্ধুত্ব গভীর হয় তাহলে আমার কোনো আপত্তি নেই আংকেল।’
উপস্থিত সবাই সেদিন রাইশার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। নিজাম উদ্দিন খুব খুশি হলেন। আর তারা সবাই রাফি আর রাইশার আংটি বদল করানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। রাফি বলেছিল, রাইশা যদি মন থেকে না চায় তাহলে এসব না করতে। কিন্তু রাইশা বলেছিল, সে মন থেকে এটা চাইছে।
সেদিন রাফি আর রাইশার আংটি বদল হয়ে গেল। দুই পরিবারের মধ্যে একটা নতুন সম্পর্কের সৃষ্টি হলো। রাইশা যখন চাইবে তাদের বিয়ে তখনই হবে। এর আগে রাইশাকে কেউ বিয়ের জন্য তাড়া দিবে না।
রাইশা ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো। আংটিটার উপর হাত ছোঁয়ালো। অন্য রকম একটা অনুভূতি হচ্ছে তার মনে।
*
তাহনার জন্য মেডিকেল এ অ্যাপ্লাই করলো রিদ। সব কিছু সাবমিট করে অ্যাপ্লাই করে দিল সে। এবার চান্স পেলেই হয়। তাহনা বসে বসে নখ কামড়াচ্ছে। রিদ চেয়ে আছে তাহনার মুখপানে। নখ কামড়ানো টা একটা বাজে স্বভাব রিদের তা মনে হয়।
‘দুই দিন পর মেডিকেলে পড়বে, আর এক্ষনি নখ কামড়াচ্ছো। তোমার এই স্বভাব পরিবর্তন করো তাহনা।’
‘স্যরি স্যরি। আর হবে না প্রমিস।’
‘অনিকরা আসার পর কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। ওরা কি ভাবছে কে জানে।’
‘তাহলে চলুন না কোথাও ঘুরে আসি।’
‘কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়?’
তাহনা মনে মনে সমুদ্রের কথা বলছে। কিন্তু রিদ সমুদ্রের কথা কানেই নিতে পারেনা। তাই সে আর কিছু বলে না। চুপ করে রিদের দিকে তাকিয়ে আছে। রিদ বলে,
‘এক কাজ করি, আমরা কুমিল্লায় ঘুরতে যাই। সকালে যাবো যতটুকু সময় লাগে পৌঁছানোর। এরপর ঘুরাঘুরি, খাওয়া দাওয়া করে একেবারে বিকেলের দিকে রওনা হবো।’
তাহনা রিদের কথায় মাথা নাড়ায়৷ ওর মন সমুদ্রের দিকে টানছে। কিন্তু রিদের কথা ভেবে তা মাথা থেকেই ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে সে। মানুষটা ভালো থাকুক।
অনিক আর রিমি এসে নক করে তাহনাদের রুমে। তাহনার তার চোখের কোণে চিকচিক করতে থাকা পানিটুকু মুছে নিল। অনিক এসে জিগ্যেস করলো,
‘কি করো তোমরা?’
রিদ বলে,
‘এইতো তোমাদের নিয়ে কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় সেটাই প্ল্যান করেছি।’
‘নিশ্চয়ই সমুদ্রের কথা ভাবছ? চট্রগ্রাম মানেই তো প্রথমে মাথায় আসে সমুদ্রের কথা।’
রিদ বলে,
‘না, আমরা কুমিল্লায় যাবো। কোটবাড়ি, বিশ্ববিদ্যালয়, মহাস্থানগড় এগুলোতে যাবো।’
‘ইশ! কই ভাবলাম সমুদ্রে যাবো। সমুদ্রে গেলে কি সমস্যা?’
তাহনা এগিয়ে এসে বলে,
‘আ..আসলে ভাইয়া উনি সমুদ্রকে ভয় পান।’
‘হোয়াট? এই তুমি ছেলে হয়ে সমুদ্রকে ভয় পাও?’
তাহনা রিদের দিকে তাকিয়ে আছে। রিদের মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাহনা অনিককে বুঝিয়ে বলে,
‘দেখুন ভাইয়া। আপনি আর যেখানেই যেতে চান সেখানেই আমরা যাবো। কিন্তু সমুদ্রে না। ওনার সমস্যা আছে ওখানে।’
‘তাহনা তুমি সিরিয়াসলি বলছো? রিদের সমস্যা ওখানে গেলে?’
‘হুম। আমি বিষয়টা পরে বুঝিয়ে বলবো আপনাকে। দেখুন উনি মন খারাপ করে আছেন।’
‘তাহনা তুমিও তো সমুদ্রে যাওনি। তোমার কি ইচ্ছে করেনা?’
‘প্লিজ ভাইয়া, বাদ দিন না। আমি আসছি।’
তাহনা ওখান থেকে বেরিয়ে গেল। অনিক আর রিমিও ওখানে থাকলো না। এদিকে রিদ বসে বসে ভাবছে, সবার সমুদ্র পছন্দ। শুধু তার জন্যই তাহনা যেতে চাইছে না। তাহনা ওকে একবার বলেছিল সে সমুদ্রে যেতে চায়। কিন্তু রিদই বারণ করে। আর রিদের বারণ করার পর তাহনা আর একবারও সমুদ্রে যাওয়ার কথা তুলেনি। আর এখন সবটা এড়িয়ে গেছে। রিদ উঠে তাহনার কাছে গেল।
তাহনা ছাদে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। রিদ তাহনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তাহনা রিদকে বলে,
‘কিছু বলবেন?’
‘আমরা কাল পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে যাচ্ছি তাহনা।’
তাহনা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। সে কি ঠিক শুনছে? এটা কি রিদ? তাহনা কৌতুহল নিয়ে জিগ্যেস করে।
‘স..সমুদ্র? কিন্তু আপনি তো..’
তাহনার কথা শেষ হওয়ার আগেই রিদ বলে,
‘তোমার সমুদ্র খুব পছন্দ তাইনা? তোমার জন্য যাবো। তোমাকে মন খারাপ হতে দেখতে পারিনা।’
‘আপনার খারাপ লাগলে আমি যাবো না ওখানে। আমার কোনো অসুবিধে নেই।’
‘আমার আছে। তুমি অনিকদের আর রাইশাকে জানিয়ে দাও আমরা কাল সমুদ্রে যাচ্ছি।’
‘আপনি ভেবে বলছেন?’
‘হুম।’
‘তাহলে আমি তাদের বলি কেমন? আর আমাদের সাথে রাফি ভাইয়াকেও নিয়ে যাই?’
‘আচ্ছা।’
তাহনা খুশি মনে নিচে গিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয় তারা কাল সমুদ্রে যাচ্ছে। সবাই শুনে খুব খুশি হয়।
*
পরদিন সকালে সবাই রেডি হয়ে পতেঙ্গার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। রিদ ড্রাইভ করছে, আর তাহনা তার পাশের সিটে বসেছে। ওদের পিছনের সিটে অনিক, রিমি, রাইশা ও রাফি বসেছে। রাফি পাশে বসায় রাইশার অস্বস্তি হচ্ছে বেশ। রাফি তা বুঝতে পেরে বলে,
‘আমি কি নেমে যাবো?’
রাইশা অবাক হয়ে বলে,
‘আপনি নেমে কোথায় যাবেন আবার?’
‘আমি চাইনা আমার জন্য কারো অসুবিধা হোক।’
রাফি রিদকে বলে গাড়ি থামানোর জন্য। রিদ গাড়ি থামায়, তারপর রাফি তাহনার সিটে বসে পড়ে আর তাহনাকে রাইশার সাথে বসতে বলে। সবাই বুঝতে পারে রাইশার সাথে কিছু হয়েছে রাফির তাই এমন আচরণ করছে রাফি। তাহনা রাইশার সাথে বসার পর রিদ গাড়ি স্টার্ট দেয়।
.
চট্রগ্রাম শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে পতেঙ্গা সি বিচ। অপরুপ এই সমুদ্র সৈকতে সূর্য উদয় থেকে শুরু করে সূর্যাস্তের দৃশ্য মন ভুলিয়ে দেয়। রিদ, তাহনা, অনিক, রিমি, রাফি ও রাইশা সবাই তাদের গন্তব্যে পৌঁছায়। রিদ গাড়ি পার্কিং করে রাস্তা পার হয়ে সবাইকে নিয়ে ওখানে আসে।
সমুদ্রের পাড়ে এসে সবার মন ভালো হয়ে যায়। ফুরফুরে হাওয়া গায়ে মাখতে থাকে। প্রথমে সবাই স্প্রিড বোডে উঠে সমুদ্রে ঘুরতে থাকে। এরপর ঘোড়ায় চড়ে জনপ্রতি বিশ মিনিট। কিছুক্ষণ ওখানে ঘোরাঘুরি করে চলে যায় সমুদ্রের তীরে ঘেঁষে উঠা রেস্টুরেন্টে। দুপুরের খাবার ওখানে খেয়ে কিছুটা সময় রেস্ট নেয়। তারপর আবার বেরিয়ে পড়ে সমুদ্রের তীরে।
সাধারণত বিকেল গড়াতে থাকলে জোয়ার আসতে শুরু করে। জোয়ার শুরুর আগে বাঁধ অনেকটা তলিয়ে যায়। তীরে এসে পড়ে ঢেউ। তাহনা, রাইশা ও রিমি সমুদ্রের ঢেউ দেখতে থাকে। পা ভিজাতে থাকে ওখানে। ঢেউ আসার সাথে সাথে লাফ দেয়।
সমুদ্র সৈকতের সাথেই ঝাউবনের ছায়াতলে গড়ে উঠেছে খাবারের দোকানসহ অনেক দোকান-পাট। ঝাউবন ঘেঁষে উত্তর দিক বরাবর হেঁটে গেলে বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলি নদীর মোহনার দেখা পাওয়া যায়। খুব কম খরচে সুস্বাদু, জিভে জল আনা স্ট্রিট ফুডের জন্য পতেঙ্গা সবচেয়ে ভাল জায়গা।
হাটতে হাটতে সব কিছু দেখছে তারা৷ রাইশা একটা ছোট্ট ফুটপাতের দোকানে আসে। ওখানে বাহারী রকমের জিনিসপত্র রাইশার মন কাড়ে। রাইশা কিছু চুড়ি হাতে নিয়ে দেখতে থাকে। চুড়িগুলো রাইশার বেশ পছন্দ হয়। সে তার ভাইয়াকে ডেকে বলে,
‘ভাইয়া আমি এগুলো নিব..’
কিন্তু পিছনে তাকিয়ে তার ভাইয়াকে দেখতে পেলো না সে। তাহনা আর তার ভাইয়া কথা বলতে বলতে অনেক দূরে চলে গেছে। রাইশার মন খারাপ হয়ে যায়। কারণ ওর কাছে টাকা নেই তাড়াহুড়োয় নিজের পাস আনতেই ভুলে গেছে সে। তখন রাফি রাইশার পাশে এসে বলে,
‘শখের জিনিস, নিয়ে নাও। আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি।’
রাইশা বলে,
‘আপনি টাকা দিবেন কেন? আপনি কে?’
রাফি চুপচাপ দোকানদারকে টাকা দেয়। তারপর রাইশাকে বলে,
‘কেউ না।’
এ কথা বলেই রাফি ওখান থেকে চলে যায়। রাইশার খারাপ লাগে। মুখে এসব কি চলে আসে ও নিজেই জানে না। রাফি বোধহয় কষ্ট পেয়েছে। সে চুড়িগুলো নিয়ে দৌড়ে রাফির কাছে যায়।
‘স্যরি।’
‘না রাইশা, তুমি ঠিকি বলেছ, বিয়ের আগ পর্যন্ত আমি তোমার কেউ নই। তোমার কোনো বিষয়ে নাক গলানো আমার উচিৎ না।’
‘বললাম তো স্যরি।’
রাফি হাটা থামিয়ে রাইশার দিকে তাকায়৷ রাইশার হাত থেকে চুড়িগুলো নিয়ে রাইশার হাতে পড়িয়ে দিতে দিতে বলে,
‘রাইশা আই লাভ ইউ। আমি তোমাকে প্রতি মুহুর্তে অনুভব করি। অনুভব করি তোমার অস্তিত্ব। অনুভব করি তোমার কাঁন্না মিশ্রিত মুখমণ্ডল। অনেক আগেই তুমি আমার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছো। তাই তোমাকে না ভালোবেসে পারলাম না।’
এ কথা বলেই রাফি হনহন করে ওখান থেকে চলে যায়। আর একটু থাকলে হয়তো সেও শুনতে পেতো রাইশার মুখে ভালোবাসার কথা। রাইশা বলে,
‘আমিও আপনাকে অনুভব করি রাফি। আমিও হয়তো আপনাকে ভালোবাসি। কিন্তু বুঝতে পারিনা।’
*
একটা সুন্দর ক্রাউন কিনে এনে তাহনার মাথায় পড়িয়ে দিল রিদ। তারপর মুচকি হেসে বলে,
‘আমার মনের রাণী। আমার প্রিয়দর্শিনী।’
তাহনা খুশিতে রিদকে জড়িয়ে ধরে। রিদ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। রিদ কিছুক্ষণ পর বলে,
‘এই নিয়ে তোমার আমাকে দ্বিতীয়বার জড়িয়ে ধরা।’
তাহনা লজ্জা পেয়ে যায়৷ রিদ তাহনার মুখটা উচু করে তাহনার কপালে একটা চুমু দেয়।
‘ভালোবাসি তাহনা।’
‘আমিও ভালোবাসি৷ অনেক ভালোবাসি। প্রচন্ড ভালোবাসি।’
.
সবাই যখন একসাথে হয় স্ট্রিট ফুড খেতে খেতে খোশগল্প করতে থাকে।
পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে সন্ধ্যার দিকে সূর্যাস্তের দৃশ্য খুবই মনোরম। সবাই সন্ধ্যার সূর্যাস্ত দেখতে থাকে। এতো সুন্দর দৃশ্য দেখে ওদের খুশির শেষ নেই। এই সমুদ্র তাদের জীবনের এক নবসূচনা হয়ে থাকবে।
সূর্য ডোবার পর আকাশে কিছু রক্তিম মেঘ দেখা যায়। ওগুলো সমুদ্রের পানিতে ভেসে উঠলে অনেক সুন্দর লাগে। ওরা সবাই এই মুহুর্তেকে উপভোগ করে তারপর বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
চলবে…