#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ২৮ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
আধ কাপ চা টেবিলের উপর দেখে কিছুটা সন্দিহীনভাবে তাকিয়ে আছে তাহনা। কি আশ্চর্য! এক কাপ চা নিয়ে এলো খাওয়ার জন্য আর বারান্দায় যেতে না যেতেই হয়ে গেল আধ কাপ? তাহনা এদিক ওদিক তাকালো। কই কাউকেই দেখতে পাচ্ছেনা। তাহলে তার চা টা কে খেয়েছে?
তাহনা ওই আধ কাপ চা টা নিয়ে নিচে নেমে পড়লো। মিসেস ফাবিহা আর রাইশা বসে বসে চা খাচ্ছিল। তাহনা ওদের কাছে গিয়ে বলল,
‘মা আমার চা কে যেন খেয়ে নিয়েছে।’
তাহনার এমন কথায় হা করে তাহনার দিকে তাকিয়ে আছে তারা।
‘কি? তোমার চা আবার কে খাবে?’
‘চা রেখে বারান্দায় গেলাম আর এসেই দেখি অর্ধেক চা নেই।’
মিসেস ফাবিহা বলেন,
‘হয়তো রিদ খেয়েছে।’
‘উনি তো চা খান না। কফি খান।’
রাইশা বলে,
‘তুমি ভাইয়াকে জিগ্যেস করে দেখতে পারো ও খেয়েছে কিনা।’
তাহনা আবার নিজের রুমে গেল। মিসেস ফাবিহা আর রাইশা মিটমিট করে হাসছেন। রাইশা বলে,
‘ভাইয়াই খেয়েছে মা আর কেউ না।’
‘হ্যাঁ, আমিও ভাবছি সেটা। সত্যি ওদের এসব কাণ্ড দেখলে হাসি পায়। আবার ভালোও লাগে।’
তাহনা রুমে এসে দেখে রিদ হাতমুখ ধুয়ে সবে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে তাহনা কে বলে,
‘আমার কফি কোথায় তাহনা? নিয়ে এসো।’
‘আপনি আমার চা খেয়েছেন?’
রিদ ভ্রু কুচকে বলে,
‘আমি কেন খেতে যাবো?’
‘তাহলে আমার চা কে খেয়েছে? চা টা রেখে বারান্দায় গিয়েছিলাম এসে দেখি আধ কাপ পড়ে আছে।’
‘ভুত এসে খেয়ে নিয়েছে মনে হয়।’
‘আপনি আমার সাথে মজা করছেন না? আপনিই খেয়েছেন।’
‘কেন আমি খেলে সমস্যা? আমি খেয়েছি বলে কি তুমি খাবে না?’
‘আমি কি সেটা বলেছি? স্বামী স্ত্রী খাবার ভাগ করে খাওয়া সুন্নত জানেন না সেটা? আপনি খেয়েছেন আগে বললেই পারতেন। নাটক করলেন কেন?’
‘তুমি নাটকও বুঝো?’
‘না দুনিয়ার সব আপনি বুঝেন। আমি এখনো শিশু।’
তাহনা ভেংচি কেটে চা টা খেয়ে নিল। রিদ মুচকি হাসলো। তাহনা নিচে গিয়ে রিদের কফিটা নিয়ে আসে। রিদ সেটা খেয়ে কফির মগটা টেবিলের উপর রাখে। তাহনা চুল আঁচড়াচ্ছিল। রিদ তাহনার পিছনে গিয়ে দাঁড়ায়। তাহনা রিদের দিকে তাকিয়ে আছে। ফট করে তাহনার গালে একটা চুমু দিয়ে রিদ বেরিয়ে পড়লো। তাহনা হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে রিদের পানে। প্রথমে অবাক হলেও পরে বেশ লজ্জা পেয়েছে। লজ্জায় গালদুটো টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে।
*
সকাল দশটার দিকে কলিং বেল বেজে উঠলে দরজা খুলে দেয় রাইশা। দুজন অপরিচিত যুবক যুবতীকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় সে। তাদের হাতে মিষ্টির প্যাকেট আর কিছু শপিং ব্যাগ রয়েছে। সাথে রয়েছে একটা ট্রাভেল ব্যাগ। তাহনা পিছন থেকে রাইশাকে ডাকতে ডাকতে দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা দুটো মানুষকে দেখে তাহনা খুশিতে এক গাল হেসে উঠে৷ তাহনা দরজার গিয়ে তাদের উদ্দেশ্য করে বলে,
‘আরে, অনিক ভাইয়া। আপনারা? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিনা যে আপনারা আমাদের বাসায় আসবেন। ভেতরে আসুন।’
অনিক আর রিমি মুচকি হেসে ভিতরে ঢুকে। তাহনার হাতে মিষ্টির প্যাকেটগুলো আর শপিং ব্যাগগুলো ধরিয়ে দিয়ে বলে,
‘নাও। তোমাদের সবার জন্য।’
‘আরে এসবের কি প্রয়োজন ছিল।’
রাইশার মনে হচ্ছে এই ছেলেটাকে সে কোথায় যেন দেখেছে। আরে হ্যাঁ! তাহনার সাথে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি। আর সেই ছবি দেখে তার ভাইয়ের যা রাগ উঠেছিল। তাহনা রাইশাকে দেখিয়ে বলে,
‘এ আমার ননদ ভাইয়া।’
রিমি বলে,
‘কেমন আছো আপু?’
‘জি, আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনারা?’
অনিক বলে,
‘আমরাও আলহামদুলিল্লাহ। আমি তাহনার ভাইয়া হই।’
‘আমি বোধয় জানি। একটা ছবিতে দেখেছিলাম।’
মিসেস ফাবিহা আসতেই তাহনার ওদের সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। তাহনা ওদের সোফায় বসতে বলে নিজে কিচেনে গিয়ে ওদের জন্য শরবত আর ফল মিষ্টির ব্যবস্থা করে। মিসেস ফাবিহা আর রাইশা মিলে ওদের সাথে গল্প করতে থাকে।
খাওয়া দাওয়া শেষে তাহনা রিমিকে নিয়ে তাদের জন্য একটা রুম গুছিয়ে ওখানে নিয়ে যায়। মিসেস ফাবিহাও তার রুমে চলে যায়। রাইশা টুকটাক গল্প করতে থাকে অনিকের সাথে। রাইশা বলে,
‘জানেন ভাইয়া, আপনাকে তাহনা ভাবির সাথে ছবিতে একসাথে দেখে আমার ভাইয়া যা রাগ করেছিল।’
‘তাই নাকি? কি ভেবেছিল তোমার ভাইয়া? তাহনার সাথে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারেনা। অথচ সে একবারের জন্যেও স্বীকার করেনি যে তাহনার জন্য তার মনে ফিলিংস একটু হলেও আছে।’
‘এখন ভাইয়া তাহনা ভাবিকে ছাড়া এক মুহুর্তও থাকতে পারেনা।’
‘তুমি তো একমাত্র ননদ তাহনার তাইনা?’
‘জি, ভাইয়া।’
‘তা তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে?’
‘ভালোই।’
হুট করেই রাফি রাইশাদের বাসায় চলে আসে। আর এসেই রাইশাকে অন্য একটা ছেলের সাথে কথা বলতে দেখে তার মেজাজ বিগড়ে যায়। ছেলেটা কে? তার সাথে রাইশার কি সম্পর্ক? এতো হেসে হেসে কি কথা বলছে রাইশা? এসব প্রশ্নই রাফির মাথায় ঘুরতে থাকে। রাফি আর কিছু না ভেবে রাইশাকে বলে,
‘আন্টি কোথায়?’
রাফির গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে রাইশা। রাফির দিকে তাকিয়ে সোফা থেকে উঠে যায় সে। তারপর বলে,
‘মা তো রুমে আছে। আপনি এই সময়ে?’
‘কেন আমি আসতে পারিনা? নাকি আমি আসায় তোমার খুব সমস্যা হয়েছে? কোনটা?’
‘আপনি এভাবে কেন কথা বলছেন? আপনি বসুন। আমি মা’কে ডেকে দিচ্ছি।’
রাইশা ওখান থেকে চলে যায় তার মায়ের রুমে। এদিকে অনিক ওদের দিকে এতক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। কি চলছে সেটা সে বুঝতে অক্ষম হলো। রাফি গিয়ে অনিকের মুখোমুখি বসে৷ রাফি অনিককে জিগ্যেস করে,
‘আপনি কে?’
‘আমি তাহনার ভাইয়া।’
‘অহ।’
রাফি আর কিছু জিগ্যেস করে না। তাহনার ভাই তাই এতো ভাব দেখাচ্ছে তার সাথে রাইশা। কই তার সাথে তো ভালোভাবে কথা বলে না। সে কি খারাপ নাকি?
মিসেস ফাবিহা এলেন তাদের সামনে। এসেই রাফিকে বললেন,
‘কি হয়েছে রাফি? সব ঠিক আছে তো? তোমরা ভালো আছো তো?’
‘হ্যাঁ আন্টি। সবাই ঠিক আছি। বাবা আপনাদের এখানে আসতে বললেন। আপনাদের আজ রাতে আমাদের এখানে যেতে বলেছেন। কি যেন বলবেন উনি।’
‘অহ আচ্ছা। রাফি, এ হচ্ছে তাহনার ভাই অনিক। স্ত্রীসহ আমাদের এখানে এসেছে বেড়াতে। থাকবে কিছুদিন।’
রাফি অবাক হলো। সাথে মনও হালকা হলো। যাক! ছেলেটা তাহলে বিবাহিত।
‘হ্যাঁ, আমি পরিচিত হয়েছি ওনার সাথে।’
‘কিন্তু আপনি কে তা তো জানি না।’
মিসেস ফাবিহা বলেন,
‘তোমার আংকেল এর বন্ধুর ছেলে।’
‘অহ আচ্ছা।’
‘ঠিকাছে আন্টি। তাহলে এনাদের নিয়ে আপনারা সবাই আজ আমাদের বাসায় আসবেন।’
রাফি এদিক ওদিক তাকাতে থাকে৷ মিসেস ফাবিহা বলে উঠলেন,
‘রাইশা কে খুঁজছো?’
রাফি থমথমে খেয়ে গেল। কাশি দিয়ে উঠলো সে। তাড়াহুড়ো করে বললো,
‘কই, কিছু না আন্টি আমি আসছি।’
এই বলেই বেড়িয়ে গেল সে। মিসেস ফাবিহা মুচকি মুচকি হাসছেন। অনিক জিগ্যেস করলো,
‘ব্যাপারটা কি হলো আন্টি?’
‘ছেলেটার সাথে রাইশার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু রাইশা এখন বিয়ে করতে চায়না। তবে আমার মনে হয় ছেলেটা আমার মেয়েটাকে পছন্দ করে।’
‘বাহ্। তাহলে তো বিয়ের দাওয়াত পাচ্ছি।’
‘অবশ্যই। দেখি মেয়ে কবে রাজি হয়। ছেলেটা অনেক ভালো।’
*
সন্ধ্যার দিকে রিদ বাসায় এলে অনিকদের দেখে অবাক হয়ে যায়। অনিকরা আসবে সেটা কল্পনার বাইরে ছিল তার। অনিকের কাছে জানতে পারলো তাহনার বাবার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে তারা এখানে এসেছে। রিদ বেশ খুশি হয়।
ফ্রেশ হয়ে রিদ বেডরুমে চেঞ্জ করছিল। এমন সময় তাহনা ওখানে প্রবেশ করে। রিদকে দেখে সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। রিদ চেঞ্জ করার পর পিছনে তাকিয়ে দেখে তাহনা চোখ বন্ধ করে আছে। রিদ ভ্রু কুচকে জিগ্যেস করে,
‘কি হলো?’
তাহনা চোখ খুলে বলে,
‘কই কিছুনা। আব্বু বললেন রেড়ি হয়ে থাকতে। নিজাম আংকেল এর বাসায় আজকে ডিনারের দাওয়াত পড়েছে আমাদের সবার।’
‘আমি রেড়ি প্রায়। তুমি রেড়ি হয়ে নাও।’
তাহনা রিদের কথায় রেড়ি হতে থাকে। রিদ বেডে বসে তাহনার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটা কে যতই দেখে ততই ভালো লাগে তার। বোকাসোকা সরল মনের মায়াবী চেহারার অধীকারিনী সে। উপরটা যতটা সহজ, ভেতরটা ঠিক ততটাই নরম। আর বড্ড অভিমাননী। রিদের এমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাটা তাহনার মনে প্রশ্নের ঝড় তুলছে। সে জিগ্যেস করে,
‘কি দেখছেন ওভাবে?’
‘তোমাকে।’
‘আমাকে দেখার কি আছে এতো?’
রিদ উঠে তাহনার সামনে আসে। তারপর তাহনাকে আয়নার ঘুরিয়ে দেয়। তাহনার নিজেকে আয়নায় দেখছে। রিদ পিছন থেকে তাহনাকে জড়িয়ে ধরে। তাহনার শরীরে কম্পন সৃষ্টি হয়। রিদ আয়নায় তাহনাকে দেখে বলে,
‘তুমি আমার প্রিয়দর্শিনী। তোমাকে দেখার অধিকার হাজারবার আমার আছে।’
তাহনা একটুখানি হাসে। সেও আয়নায় রিদকে দেখে বলে,
‘আপনি আমার পাশে থাকলে, আমি আমার শত অতীত ভুলতে রাজি আছি।’
*
রাফিদের বাসায় সবাই বসে আছে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর এস আই নিজাম বলেন,
‘আমরা বড়োরা কিছু কথা বলবো, তোমরা ছাদ থেকে ঘুরে আসো।’
রিদ তাহনার হাত ধরে ছাদে চলে যায়। এদিকে অনিকও রিমির হাত ধরে অন্য জায়গায় চলে যায়। রাইশার মন খারাপ হয়ে যায়। সবাই সবার মতো করে সময় কাটাচ্ছে। আর তাকে একা একা ঘুরতে হচ্ছে।
রাইশা ঘুরে ঘুরে বাসার সবগুলো রুম দেখছিল। হঠাৎ একটা রুমের সামনে এসে সে থেমে যায়। ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখে এটা রাফির রুম। রাফি বিছানায় শুয়ে আছে। রাইশার ভিষণ ইচ্ছে হলো রুমটা দেখার। বাইরে থেকে যতটুকু দেখতে পাওয়া যায়, রুমটা ভারী সুন্দর। কিন্তু রাফি সেখানে থাকায় আর সাহস হলো না যাওয়ার। রাইশা ওখান থেকে মন খারাপ করে চলে গেল। এদিকে রাফি রাইশার উপস্থিতি ঠিকি খেয়াল করলো। কিন্তু তবুও চুপ করে রইলো রাইশা কি করে তা দেখার জন্য। রাইশা তো চলে গেল৷ রাফিও আর ওখানে থাকলো না।
রাইশা একটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। রাইশার পিছনে রাফিও এসে দাঁড়ালো। রাইশা রাফিকে দেখে বলে,
‘আপনি? আপনি এখানে কি করেন?’
‘আমার বাসা, আমি যেখানে সেখানেই আসতে পারি।’
রাইশা চলে যেতে নেয়। রাফি পিছন থেকে রাইশার হাত ধরে ফেলে। রাইশা চমকে যায়। তারপর রাফি রাইশার হাত ধরে ওখান থেকে তাকে তার রুমে নিয়ে আসে।
‘এটা আমার রুম। দরজার আড়াল থেকে নয়। সামনে থেকে দেখো।’
রাইশা লজ্জা পেয়ে যায়। রাফি কিভাবে বুঝলো যে সে আড়াল থেকে রাফির রুমে উঁকি দিচ্ছিল? রাফি রাইশাকে তার রুম দেখিয়ে অনেক কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। রাফির পড়ার টেবিলে অনেক বই রাখা আছে। একটা খাতায় তার লেখা দেখে রাইশা বেশ মুগ্ধ হয়। রাফির হাতের লেখা মারাত্মক সুন্দর। রাফি রাইশার দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
‘ফ্রেন্ডস?’
রাইশা হাত বাড়াতে গেলেই রাইশার ডাক পড়ে। আর সে দৌড়ে ওখান থেকে চলে যায়। রাফি নিজের হাতটা গুটিয়ে নেয়। বেচারা!
চলবে…