প্রিয়দর্শিনীর খোঁজে পর্ব ২৭

0
536

#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ২৭ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

গম্ভীর হয়ে সবাই বসে আছে রিদদের বাসায়। রাইশার এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাহনা অসুস্থ শরীর নিয়ে এক কোণে বসে আছে। রাইশার জন্য বড্ড খারাপ লাগছে তার। গোটা একটা রাত পেরিয়ে গেল। রাইশার কোনো খোঁজই পাওয়া গেল না। কি আশ্চর্য। মানুষ কিছু টাকার জন্য একজনের জীবন নিয়ে এভাবে টানাটানি করে?

রিদ সব জায়গায় লোক পাঠিয়েছে খোঁজ নেওয়ার জন্য। টেনশনে কেউ খাবারও খায়নি। সবার চিন্তার মাঝে বাসায় প্রবেশ করলেন এস আই নিজাম ও তার ছেলে রাফি। রিদ ওদের দেখেই কাছে গিয়ে জিগ্যেস করে,

‘কোনো খোঁজ পেলেন আংকেল?’

এস আই নিজাম সোফায় বসতে বসতে বললেন,

‘খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম রাইশাকে কিড*ন্যাপ হতে একজন দেখেছে। তার থেকে শুনলাম, রাইশা কলেজ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে কারো জন্য অপেক্ষা করছিল অনেক্ক্ষণ যাবত। কিন্তু সে না আসায় বিরক্ত নিয়ে ওখান থেকে চলে যাচ্ছিল। আর ঠিক ওইসময় দুটো লোক এসে রাইশার হাত মুখ বেধে তাকে একটা বড়ো গাড়ি করে নিয়ে গিয়েছিল।’

রিদ গরম হয়ে বলে,

‘লোকজন কি ওখানে ঘাস খাচ্ছিল? একটা মেয়ে কিড*ন্যাপ হয়ে যাচ্ছে দেখেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল?’

‘লোকগুলো মাস্ক পড়া ছিল তাই চেহারা দেখতে পায়নি সে। আর ও ভয় পেয়েছিল তাই কাছে যায়নি।’

‘অন্তত পুলিশে একটা কল দিতে পারতো, তাও তো করেনি।’

রিদের এমন কথায় এস আই নিজাম বলেন,

‘শান্ত হও, আমরা খুঁজে পাবোই। তাছাড়া ওরা নাম্বার পরিবর্তন করে ফেলেছে। যেই নাম্বার থেকে কল এসেছিল সেটা এখন বন্ধ তাই লোকেশন জানতে পারিনি। আফজাল? তোকে না মেসেজ দিবে বলেছে? পাঠিয়েছে?’

‘না, এখনো পাঠায়নি।’

মিসেস ফাবিহা আঁচলে চোখ মুছছেন। আর কেঁদে কেঁদে বলছেন।

‘আমার মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিন।’

এস আই নিজাম বলেন,

‘কি আজিব লাগছে, একবার তাহনা বাসা থেকে চলে যাচ্ছে তো আর একবার রাইশা কিড*ন্যাপ হচ্ছে।’

রিদ চমকে উঠে বলল,

‘তাহনা চলে গেছে ওটা আপনি কিভাবে জানেন? আমার জানা মতে বাবা আপনাকে বলেনি এটা।’

‘ও তো আমাদের বাড়িতেই ছিল তিন দিন। রাস্তায় এলোমেলো ভাবে হাটছিল। রাফি ওকে দেখতে পায়। তখন বুঝিয়ে ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। আর ও বলে আমাদের ওখানে ও কয়েকদিন থাকবে। কি হয়েছিল তা তো জানি না। ও বলেছে ও যে আমাদের এখানে আছে সেটা যেন তোদের না বলি।’

সবাই তাহনার দিকে তাকালো। তাহনা মাথা নিচু করে রইলো। এস আই নিজাম বলেন,

‘আমি এখনো জানি না ও কেন তোদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে।’

‘সে বিষয়টা এখন বাদ দিতে চাই আংকেল। এখন আমাদের রাইশার কথা ভাবতে হবে।’

আফজাল শেখ এর ফোনে একটা মেসেজ আসলো। উনি মেসেজটা এস আই নিজামকে দেখালেন। এস আই নিজাম বললেন,

‘আমাদের এক্ষুণি বের হতে হবে। আফজাল? ওরা যেমনটা বলেছে টাকা নেওয়ার জন্য, তুই একটা ব্রিফকেসে টাকা নে।’

রাফি বলে,

‘তোমরা যে যাবে পুলিশ সেজে যেও না। সাধারণ মানুষের মতোই যাও, যেন ওরা সন্দেহ না করতে পারে।’

‘হ্যাঁ, সেভাবেই যাবো।’

‘আংকেল শুধু আপনিই যাবেন?’

‘না, আমার সাথে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা যাবে। আর রাফি তো আছেই।’

‘শুধু রাফি না আমিও যাবো।’

‘তাহলে চলো, আর দেরি করা যাবে না’

ওরা সবাই বেরিয়ে পড়লো রাইশাকে উদ্ধার করতে।

শুনশান একটা একলা। চারদিকে ইট, বালি আর পাথর আলাদাভাবে জড় করে রাখা হয়েছে। কয়েকটি বিল্ডিং এর কাজ চলছে। দুটি এখনো আধ কাঁচা। এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছেন মিস্টার আফজাল শেখ। বাকিরা আড়ালে লুকিয়ে আছে।

মিস্টার আফজাল শেখ ভয়ে ভয়ে ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে বললেন,

‘কেউ আছেন?’

কারো কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা। আফজাল সাহেব আবারও জিগ্যেস করলেন,

‘কেউ আছেন? আমি টাকা নিয়ে এসেছি। প্লিজ আমার মেয়েকে ছেড়ে দিন।’

দু মিনিট পর একটা লোক এলো। মুখে মাস্ক লাগানো। সে আফজাল শেখ এর কাছে এসে খপ করে টাকার ব্রিফকেসটা নিয়ে নিল। তারপর চেক করতে লাগলো ওখানে টাকা আছে কিনা। এবং এটা নিয়েই চলে যেতে লাগলো। তার হাতে একটা ধারালো ছুরি ছিল। মিস্টার আফজাল শেখ জিগ্যেস করলেন,

‘আমার মেয়ে? আমার মেয়ে কোথায়?’

লোকটা বলল,

‘তোমার মেয়েকে সঠিক সময়েই ফেরত দেওয়া হবে।’

এটা বলেই কিছুদূর চলে গেল ওই লোকটা। মিস্টার আফজাল শেখ কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে তাকিয়ে আছেন লোকটার দিকে। ওদিকে রাফি আর রিদ লোকটার পিছু নিয়েছে। ওদের পিছনে আসছেন এস আই নিজাম উদ্দিন। লোকটা যেতে যেতে একটা গলির মোড়ে গিয়ে থামলো। সেখানে আরও দুটো লোকের সাথে কথা বলতে লাগলো। টাকাগুলো অন্য একজনকে দিয়ে দিল। ওরা তিনজন তিনদিকে চলে গেলো। এদিকে রাফিরাও তিনজন তিনজনের পিছু নিল। ওদের হাতেও রিভালবার দেওয়া হয়েছে।

*
একটা অন্ধকার ঘরে চেয়ারে হাত মুখ বাধা অবস্থায় বসে আছে রাইশা। সে জানে না কারা ওকে এখানে আটকে রেখেছে। মেয়েটা শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। মা বাবা আর ভাই ভাবির কথা ভিষণ মনে পড়ছে তার। কোথায় এসে পৌঁছালো বুঝতে পারছেনা। আসার পর শুধু দুটো রুটি খেতে দেওয়া হয়েছে তাকে। ও রুটিগুলো দূরে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। আর একটা লোক এসে ওকে শাশিয়ে গেছে। রাইশার কানে লোকগুলোর কথা আসতে লাগলো। কিছু বলছে তারা।

‘কি ব্যাপার! ওরা টাকা নিয়ে আসছে না কেন?’

‘লোকটা কি টাকা নিয়ে আসে নাই? তাহলে কি করবো?’

‘কি আর করবো। অন্য ব্যবস্থাও আছে। ও টাকা নিয়ে না আসলে এই মেয়েটাকে বিক্রি করে দিব। আমাদের কাস্টমারের কি অভাব পড়েছে? আমার মনে হয়না মেয়েটার বাবা আসেননি। মেয়ের জন্য উনি টাকা নিয়ে আসবেনই।’

‘তাহলে টাকা নিয়ে আসলেই মেয়েটাকে ছেড়ে দিবি?’

‘আরে, পাগল নাকি! সোনার ডিম পাড়া হাস কি কেউ ছেড়ে দেয়? মেয়েটার বাপের কাছ থেকেও টাকা নিব, আবার মেয়েটাকেও অন্য কারো কাছে বিক্রি করে দিব।’

‘তাইলে তো ডাবল লাভ।’

লোক দুটো জোরে জোরে হাসতে লাগলো।

রাইশার বুক কেঁপে উঠল। এসব কি শুনছে ও? ওকে ওরা বিক্রি করে দিবে? এই লোকগুলোর হাত থেকে কি ও মুক্তি পাবে না? যে করেই হোক ওকে এখান থেকে বের হতে হবে। রাইশা তার হাতের বাঁধনটি চেয়ারের সাথে ঘেঁষতে থাকে। ঘেঁষতে ঘেঁষতে একসময় তা খুলে যায়। রাইশা দ্রুত তার মুখের বাঁধনটি খুলে পেলে। তারপর কেউ আসছে কিনা দেখতে থাকে৷ এই ঘরের একটু উপরে একটা ছোট জানালা আছে। রাইশা তার চেয়ারটা নিয়ে জানালা বরাবর রাখে। তারপর খুব সাবধানে ওখানে পা দিয়ে জানালা সোজা উঠে দাঁড়ায়। এই মুহুর্তে ওখানে কাউকেই দেখতে পারছেনা সে। আর একটু ভালো করে নিচে তাকাতেই দেখে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয় কাউকে খুঁজে চলেছে সে। রাইশা তাকে কিভাবে ডাকবে তা ভেবে পাচ্ছেনা। আশেপাশে তাকিয়ে কিছুই সে দেখতে পারছেনা। নিজের পায়ের জুতো একটা খুলে নিল। তারপর ওই জুতোটাই লোকটার গায়ে ফেললো৷ লোকটা উপরের দিকে তাকাতেই রাইশাসহ লোকটা হা করে আছে।

.
রাফি একটা লোকের পিছে আসতে আসতে দেখে লোকটা হাওয়ার মতো গায়েব হয়ে গেল। লোকটা কোথায় গেল সেটাই ভাবছিল রাফি। এমন সময় উপর থেকে কিছু একটা ওর মাথায় পড়তেই উপরের দিকে তাকায় সে। সে দেখে যাকে খুঁজতে সে এসেছিল সে-ই ওখানে। রাইশা রাফিকে দেখে হাত জোর করে ইশারা দিয়ে বলল,

‘প্লিজ বাঁচান আমাকে।’

রাফি আর কিছু না ভেবে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ে। একদম অন্ধকার একটা বাড়ি৷ এখানে মানুষ থাকে কিভাবে? ভিতরে ঢুকতেই কয়েকজনের কথা শোনা গেল। রাফি ওখানে যেতেই ওরা চমকে উঠে। তারপর রাফির উপর হামলা করতে আসে। রাফি তার রিভালবারটা বের করে ওদের দিকে ধরে। ওরা ওখানেই থেমে যায় ভয়ে৷ রাফি একটা একটা করে ওদের বুকে হাত পায়ে লাথি, ঘুষি যা পারছে দিয়ে যাচ্ছে। একজন এসে রাফির হাতে ছুরি চালিয়ে দিল। রাফির হাত থেকে গড়গড় করে রক্ত বের হতে থাকে। রাফি ওই লোকটার মুখ বরাবর একটা ঘুষি দিল।
লোকগুলোর সাথে ফাইট করে সবাইকে জড়ো করে রাখে রাফি। তারপর তার বাবাকে কল দিয়ে জানায় সবকিছু। লোকেশন চেক করে তাদের আসতে বলে সে।

কল কেটেই রাইশাকে সে খুঁজতে থাকে। এতোগুলা ঘরের মধ্যে সে জানবে কি করে রাইশা কোথায়৷ একটা ঘর তালা দেওয়া দেখতে পায় রাফি। ওখানে গিয়ে একটা ইট নিয়ে ওই তালা ভেঙে ফেলে। তারপর ভিতরে ঢুকে দেখে রাইশা এক কোণে ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাফিকে দেখেই রাইশা দৌড়ে এলো। রাফিকে জড়িয়ে ধরলো। হুঁ হুঁ করে কাঁন্না জুড়ে দিল৷ রাফি বলল,

‘আর ভয় নেই মিস। আমরা সবাই চলে এসেছি। তোমায় এভাবে দেখতে আমার ভালো লাগছে না। বাসায় চলো।’

রাইশা রাফিকে ছেড়ে দিয়ে বলে,

‘আপনি কি করে এখানে এলেন?’

‘শুধু আমি নই। তোমার বাবা, আমার বাবা, তোমার ভাইও এসেছে। আমরা এতোজন থাকতে তোমার ক্ষতি আমরা কিছুতেই হভে দিব না।’

‘আপনি না আমার উপর রেগে ছিলেন?’

‘সেটা তো কবেই সমাপ্ত করে দিয়েছি৷ ওই যে তোমার ভাই আর বাবা চলে এসেছে। চলো এখান থেকে।’

রাফি রাইশার হাত ধরে ওখান থেকে ওকে বের করে নিল।

সব গুণ্ডাগুলো কে পুলিশ গ্রেফতার করলো। রাইশা দৌড়ে তার বাবা আর ভাইকে একসাথে জড়িয়ে ধরে। এদিকে রাফির হাত কেটে রক্ত পড়ছে ওটা রিদের নজর এড়ায়নি। সে তার পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে রাফির হাতে বেঁধে দিল।

‘ধন্যবাদ রাফি৷ তুমি তাহনাকেও বাঁচিয়েছো আবার রাইশাকেও আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছ। আমরা অনেক ঋণি তোমার কাছে।’

‘এসব কি বলছেন ভাইয়া। আমি যা করেছি একজন মানুষ হিসেবেই করেছি। বাসায় চলুন। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকবেন না আন্টি চিন্তা করছেন।’

তারপর তারা সবাই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here