প্রিয়দর্শিনীর খোঁজে পর্ব ২৪

0
548

#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ২৪ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

সকাল আটটা বেজে গেছে। মিসেস ফাবিহা নিজের ঘর থেকে রান্নাঘরে এলেন। তাহনাকে তিনি আজ রান্নাঘরে দেখলেন না। উনি ভেবে নিয়েছেন যে হয়তো আজ তাহনার শরীর ভালো নেই তাই উঠেনি। উনি নিজেই সবার জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে লাগলেন।
.
ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাসায় ফিরে রিদ। দরজা দিয়ে ঢুকতেই তার মা তাকে দেখে বলে উঠে।

‘কিরে তুই বাইরে থেকে এলি? কোথায় গিয়েছিলিস?’

রিদের মা যেন সন্দেহ না করে তাই সে তার মা’কে বলে,

‘বাইরে হাটতে গিয়েছিলাম। তুমি একা রান্নাঘরে? তাহনা উঠেনি?’

‘তাহনাকে তো দেখছিনা। কিছু হয়েছে তাহনার? শরীর খারাপ?

‘তুমি দাঁড়াও, আমি দেখছি।’

রিদ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে তার রুমে গেল।

‘তাহনা, সকাল হয়ে গেছে উঠে পড়ো।’

রিদ এটা বলেই বিছানায় তাকাতে দেখে তাহনা নেই। রিদ তাহনাকে ডাকতে থাকে।

‘তাহনা?’

রিদ ওয়াশরুম চেক করে, তাহনা নেই। বারান্দা চেক করে, ওখানেও নেই। রিদের কপালে এবার চিন্তার ভাজ পড়ে। সে দ্রুত ছাদে চলে যায়। কিন্তু ছাদের চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে কোথাও তাহনা নেই। রিদ আবার নিজের রুমে আসে। নিজের ল্যাপটপের দিকে নজর যেতেই দেখে একটা কাগজ চাপা দেওয়া আছে৷ রিদ আস্তে করে ল্যাপটপটা উঠিয়ে কাগজটা হাতে নেয়। কাগজে অনেক কিছুই লেখা আছে। রিদ মনে মনে কাগজটা পড়তে থাকে।

‘আমি আপনার জীবনে এক শিরোনামহীন অস্তিত্ব। আমি সারাজীবন অন্যের আশ্রয়েই থেকে গেলাম। আমি জানি না আমার মা বাবা কে! আমাকে কুড়িয়ে এনে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। বয়স বাড়ার সাথে মা হারিয়েছি। আবেগের বয়সে একজনের হাত ধরেছিলাম। কিন্তু সেও আমায় ঠকালো। তার জন্য বাবা আমায় আশ্রিতা উপাধি দিল। আমি আবার আস্রয় পেলাম। এক নতুন জায়গায়। নতুন পরিবেশে আমার খুব ভালো দিন যাচ্ছিল। কিন্তু ওখানেও সত্যি আমাকে থাকতে দেয়নি। আবার বাবার কাছে ফিরে গেলাম। পরিস্থিতি কোথায় গেল জানিনা, তবে আপনি আমায় বিয়ে করলেন। একটা নতুন পরিচয় দিলেন। সাথে একটা দায়িত্ব দিলেন আপনার পরিবারকে দেখার। একটা পরিচয়হীন মেয়ে হয়ে একজনের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় পেয়েছি। আমার কাছে এর চেয়ে বড়ো আর কি হতে পারে বলুন। জানেন সব কিছু থেকেই আমি বঞ্চিত। যেখানে নিজের মা বাবাই আমাকে অধিকার বঞ্চিত করে পার্কে ফেলে রেখে যায়, সেখানে আমি অন্যের থেকে কি-বা অধিকার দাবী করবো বলতে পারেন? আমি কখনও অন্য পাঁচটা মেয়ের মতো বাবার কাছে এটা সেটা চাইনি। তখন তো জানতামও না যে আমি বাবার নিজের মেয়ে নই। জানেন, আমি কারো কাছ থেকেই কিছু চাইনি। পেলে পেলাম না পেলে নেই আমার দিন কেটে গেছে। আমার এতো কিছু প্রত্যাশাও নেই। আমি আপনার কাছ থেকেও কিছু চাইনি। কিন্তু আপনি আমায় না চাইতেও যা দিলেন আমি আপনার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। আপনি আমার যেভাবে কেয়ার করেন, যেভাবে আমার ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান। বিশ্বাস করুন আমার খুব ভালো লাগে। কিন্তু আপনার আজকের ব্যবহার আমার সত্যিই খুব খারাপ লেগেছে। আমি আপনার সম্পর্কে জানতেও চাইনি কোনোদিন। আপনার অতীত সম্পর্কেও না। আপনার কোনো জিনিসেই আমি হাত দেইনি। শুধু অসাবধানতায় খামটা পড়ে গিয়েছিল। আর ওটা দেখতে গিয়েই ওসব পেলাম। আমি আপনাকে বলতে চাইছিলাম না, কিন্তু মনটা খচখচ করছিল জানার জন্য। তাই আপনাকে সাহস করে বলেছিলাম শুধু। কিন্তু আমার বোধয় অনেক বড়ো ভুল হয়েছে এটা করায়। যে কারণে আপনি আমায় কথা শোনালেন। আমাকে আমার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। সত্যি আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমি আপনার জীবনে একটা দায়িত্ব মাত্র। আপনার কোনো বিষয়ে জানার অধিকার আমার নেই। আমার এটা আগে বোঝা উচিৎ ছিল। আপনি ভাববেন না। আমি আর আপনার জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়াবো না। আমার শুধু একটা কথা, আপনি নিজেই আমাকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন। আবার নিজেই আমাকে অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললেন! আমি চাইনি আপনাকে বিয়ে করতে, আর না চেয়েছি কোনো অধিকার। আমি শুধু একটা কথা জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা আমার জানার অধিকার নেই তা বুঝিনি। আমি আশ্রিতা, আশ্রিতাই রয়ে গেলাম। আমি বোধহয় আপনার স্ত্রী হওয়ার যোগ্য নই। আমাকে ক্ষমা করবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন। আমি আপনার জীবন থেকে চলে যাচ্ছি। ভালো থাকবেন রিদ।’

রিদ চিঠিটা পড়ার পর থেকেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে। রাগের বসে তাহনাকে কত কিছুই না বলে দিয়েছে সে। চিঠিটা নিয়েই ধপ করে বিছানায় বসে পড়ে রিদ। চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। কতটা ব্যথা দিয়ে ফেলেছে তাহনাকে সে। এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তাহনা বাড়ি ছেড়েই চলে গেছে। এখন সে তাহনাকে কোথায় খুঁজবে?

রিদ অস্থির হয়ে দৌড়ে নিচে নেমে গেল। ওর মাথা কাজ করছে না। বাসা থেকে বেরিয়ে গেল কাউকে কিছু না বলে। পিছন থেকে তার মা অনেক বার তাকে ডাকে। কিন্তু রিদ মায়ের ডাক শুনতে পায়না। ওকে এখন তাহনাকে খুঁজতে হবে। গাড়ি নিয়ে হন্নি হয়ে বের হলো রিদ।

*
রিদ প্রথমে তাহনার বাসায় যায়। তাহনার বাবা মাত্র ব্রেকফাস্ট নিয়ে বসেছেন। এমন সময় রিদকে দেখে তিনি ভয় পেয়ে যান। রিদ এসেই এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। তাহনার বাবা বলে,

‘কি হয়েছে রিদ? এতো সকালে এখানে তুমি? তাহনা কেমন আছে?’

তাহনার কথা জিজ্ঞেস করতেই রিদ বুঝে যায় তাহনা এখানে আসেনি। সে দ্রুত আবার বেরিয়ে যায়। এদিকে তাহনার বাবা রিদের আচরণে অবাক হলেন। রিদ তো এমন করে না। কি জন্য আসলো আর কি জন্যই বা চলে গেল?

*
সারা রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঘোরাঘুরি করে রিদ তাহনাকে খুঁজতে লাগলো। রিদ পুরো উন্মাদ হয়ে গেছে। কত বড়ো একটা অন্যায় করে ফেলেছে সে তাহনার সাথে। কতোটা আঘাত পেলে একটা মানুষ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারে। রিদ নিজেকে শান্ত রাখতে পারছেনা। নিজেকে নিজে বলছে,

‘একবার তোমাকে খুঁজে পাই তাহনা। আর হারাতে দিবনা আমি। অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমায় বুঝতে পারিনি এর ফল কি হবে। তুমি আশ্রিতা নও তাহনা। তোমাকে আমি আশ্রিতা হিসেবে আনিনি। তুমি আমার স্ত্রী তাহনা। আমার উপর তোমার অধিকার সবচেয়ে বেশি। স্যরি তাহনা। অতীত জিনিসটাকে আমি দূরে রাখতে চেয়েছি বারবার। অতীত আমার একটা দুঃস্বপ্ন। আর সেটা মনে হলেই মাথায় রক্ত উঠে যায় আমি স্থির থাকতে পারিনা। তাই তো তোমায় ওসব বলেছি। তোমায় আমি হারাতে দিব না তাহনা।’

রিদ এসব বলে ড্রাইভ করতে করতে শহরের সব জায়গায় তাহনাকে খুঁজতে থাকে। সারাদিন একটু পানিও খায়নি সে। তার শধু একটাই প্রশ্ন, তাহনা কোথায় চলে গেল একা একা।

*
ভারক্লান্ত শরীর নিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে রিদ। বাসায় ফিরতেই বাবা মা আর বোনের সম্মুখীন হয় সে। সবাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিদের দিকে। রিদের মা বললেন,

‘তাহনা কোথায় রিদ? তাহনা বাসায় নেই কেন? কোথায় গিয়েছে মেয়েটা? কি বলেছ তুমি ওকে?’

রিদের বাবা বলেন,

‘কাল রাতে তোমাদের ঘর থেকে চ্যাঁচামেচির আওয়াজ শোনা গেছে। তুমি তাহনাকে কি এমন বলেছ যে ও একেবারে বাসা থেকেই উধাও হয়ে গেছে? কি হলো? উত্তর দিচ্ছো না কেন?’

রিদ চিৎকার করে বলে,

‘আমি জানি না। আমি জানি না তাহনা কোথায় গেছে।’

রিদের বাবা বলেন,

‘ছিঃ রিদ ছিঃ। তাহনা না তোমার স্ত্রী? ও কোথায় আছে সেটাও তুমি জানো না? তুমি না সেদিন বললে যে তুমি ওকে জোর করে বিয়ে করেছ? তাহলে কোন সাহসে ওর উপর চ্যাঁচামেচি করো তুমি? কেমন স্বামী তুমি যে তোমার কথায় তোমার স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে চলে যায় আর তুমি জানোই না।’

‘আমি ওকে খুঁজে চলেছি বাবা। বিশ্বাস করো সারাটাদিন ওকেই খুঁজে চলেছি। কিন্তু কোথাও পাচ্ছিনা। খুব বড়ো একটা অন্যায় করে ফেলেছি বাবা। অনেক বড়ো একটা ভুল হয়ে গেছে আমার।’

রিদের বাবা বলে,

‘তুমি জানো এহসান সকাল থেকেই আমাকে কল দিয়ে তাহনার খোঁজ নিচ্ছেন। তুমি নাকি ওখানে গিয়েছিলে? আমি এহসানকে কি জবাব দিব বলতে পারো? ওকে এখনো জানায়নি। ও যদি এটা জানতে পারে তাহলে কতোটা ভেঙে পড়বে জানো? তোমাকে ভরসা করে ওর মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছিল। আর তুমি ওর ভরসার মান রাখতে পারোনি। যেভাবেই হোক তাহনাকে খুঁজে বের করো তুমি।’

রিদ নিজের ঘরে চলে যায়। তাহনার লেখাটা চিঠিটা পড়ে বারবার। মন খারাপ আরও বেড়ে যায়। কি করলো সে। অনেক বড়ো অন্যায় করে ফেলেছে নিজের স্ত্রীর সাথে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here