#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ২৩ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
বিকেলের ঠান্ডা আবহাওয়ায় একটা জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে গেল রিদ, তাহনা ও রাইশা। তাহনা রাইশার হাত ধরে রিদের পিছনে ঘুরছে। রিদ একে একে সব জায়গা দেখাচ্ছে আর জায়গার সম্পর্কে তাহনাকে ধারণা দিচ্ছে। তাহনার এমন মুক্ত পরিবেশে এসে খুব ভালো লাগছে। তাহনা চেষ্টা করছে রাইশাকে হাসানোর। সেজন্য মজার মজার কথা বলছে যাতে রাইশা একটু হলেও হাসে। আর রাইশা হেসেছেও।
রিদ ওদের দুজনকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে যায়। সেখানে গিয়ে রিদ কিছু খাবার অর্ডার করে। রাইশা যা যা খেতে পছন্দ করে সেগুলোই অর্ডার করে। এদিকে তাহনা বারণ করে দেয় রিদকে সে কিছু খাবে না। কিন্তু রিদ চোখ গরম করে তাকাতেই বলে একটা কিছু দিলেই হবে। আর যাইহোক, রিদের চোখ গরম করে তাকানোকে তাহনা ভিষণ ভয় পায়।
খেতে খেতে তারা অনেক কথা বলে আর প্রচুর মজা করে। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে রিদ বিল দেওয়ার জন্য উঠে যায়। এদিকে তাহনাও ওয়াশরুমে যাবে বলে রিদের সাথে উঠে যায়।
একা একটা টেবিলে বসে আছে রাইশা। চকলেট শেক খাচ্ছিল সে। এমন সময় হুট করেই তার সামনের চেয়ারে কেউ বসে পড়ে। রাইশা তাড়াহুড়ায় তাকাতেই দেখে আর কেউ নয় ওটা রাফি। রাফি রাইশার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দেয়। রাইশা ভাবতে থাকে রাফি কি ওকে ফলো করছে? যেখানেই যায় ওখানেই রাফি এসে পৌঁছে যায় কিভাবে? রাফি রাইশার হাত থেকে এক টানে তার চকলেট শেকটা নিয়ে নেয়। আর নিজেই ওটা খেতে থাকে। রাইশা শুধু অবাক হয়ে দেখছে। এক্ষুণি তার ভাই এসে পড়বে। রাইশা বিল কাউন্টারের দিকে তাকালো। দেখলো তার ভাই ওখানে নেই। তার মানে সে তাহনার জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
রাইশা রিকুয়েষ্ট করে রাফিকে বলে,
‘প্লিজ চলে যান এখান থেকে। আমার ভাইয়া এসে পড়বে এক্ষুণি। আপনার আমাকে যা শাস্তি দেওয়ার পরে অন্য কোথাও দিয়েন কিন্তু আপনি এখান থেকে চলে যান প্লিজ। আপনাকে ভাইয়া দেখে ফেললে সিনক্রিয়েট করবে। আমি তা চাইছি না। আপনি প্লিজ বোঝার চেষ্টা করুন।’
‘কথাটা মনে রেখো। তোমাকে আমি এতো সহজে ছাড়বো না। প্রতি পদে পদে তোমায় শাস্তি দিব। আর এটা বোঝাবো যে রাফিকে রিজেক্ট করলে কি হয়।’
রাইশার চোখের পানি গাল বেয়ে পড়ছে। রাফি ওখান থেকে চলে গেল। রাইশা তাড়াতাড়ি তার চোখের পানি মুছে ফেললো। রিদ আর তাহনা একসাথে রাইশার কাছে এসে উপস্থিত হয়। রিদ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেই রাইশা ওকে থামিয়ে দেয়। রাইশা তাদের দুজনকেই বসতে বলে। তারা কৌতূহল নিয়ে বসে।
রাইশা বলে,
‘ভাইয়ু, আমি চাইনি এতো তাড়াতাড়ি আমার বিয়ে হোক। তাই তোমরা যখন আমার বিয়ে নিয়ে আলোচনা করছিলে তখন আমার মন পুরো ভেঙে পড়েছিল। আর যখন আমি ওই ছেলেটার বাসায় গেলাম তখন দেখলাম এটা সেই ছেলে যার কথা তোকে সেদিন বলেছিলাম। ও আমার কোনো ক্ষতি করেনি, তবে ওর কাজে বাবা আমাকে ভুল বুঝেছে। তারপর আমি ওই ছেলেটাকে বলি আমি তাকে বিয়ে করতে পারবো না। আর সব দোষ ওই ছেলেটাকে দিয়ে বসি। রুড বিহেভ করে বসি। আর সেজন্যই ছেলেটা রেগে যায় আর বিয়ে করবে না বলে চ্যাঁচায়। ছেলেটার দোষ নেই। আমিই তাকে বারবার বিয়ে করবো না বলে চ্যাঁচামেচি করেছিলাম।’
রিদ আর তাহনা এসব শুনে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে৷ রিদ রাইশার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘এসব আমাকে আগে জানাসনি কেন? তুই কি এসবের জন্যই আপসেড ছিলিস?’
‘সেদিনের পর থেকেই আমার ঘুম উধাও হয়ে গেছে ভাইয়া। আমি কি করবো কিছুই বুজতে পারছিলাম না।’
‘আমি উল্টো রাফিকে ভুল বুঝেছিলাম।’
‘কিন্তু ভাইয়া, এর জন্য উনি আমার উপর অনেক রেগে আছেন। আমাকে সেদিন পানি উনিই ঢেলেছিলেন। আমি কি বলতাম? সব তো আমারই দোষ।’
‘কিহ? রাফিই এ কাজ করেছে?’
‘ভাইয়া এখন এটা ছাড়ো।।আমার জন্য বাবা আংকেলকে ভুল বুঝলেন। কত কথা শোনালেন। তুমি একটু বাবাকে বলে দিও দোষটা আমারই। ওনাদের নয়।’
‘ঠিকাছে, এখন বাসায় চল।’
রিদ রাইশা আর তাহনাকে নিয়ে বাসায় চলে গেল। যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাসায় পৌঁছে অজু করে নামাজ পড়ে নিল তাহনা। রিদ চলে গেল মসজিদে।
*
রাতের দিকে রিদ তার বাবাকে রাইশার ব্যাপারে সব খুলে বলে। রাইশার বাবা তার ভুলের জন্য এস আই নিজাম উদ্দিনকে কল দিয়ে তার মেয়ের হয়ে ক্ষমা চেয়ে নেন। তাদের মধ্যে একটা ভুল বুঝাবুঝি হওয়ায় এস আই নিজাম এর সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন মিস্টার আফজাল শেখ। এখন সব ঠিক হয়ে গেছে। মিস্টার আফজাল শেখ রাইশাকে ডেকে পাঠালেন। রাইশা এসে তার বাবার পাশে বসলো। মিস্টার আফজাল শেখ মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘রিদ আমাকে সব বলেছে রাইশা। আমি তোকে অকারণেই ভুল বুঝেছিলাম। বিয়ের জন্য চাপ দিয়ে ছিলাম। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, রিদ যেমন অন্যায় কাজ করবে না; ঠিক তেমনই তুইও অন্যায় কাজ করবি না। তোদের তো ভুল শিক্ষা আমি দেইনি। তোকে আর বিয়ের কথা বলবো না মা। তুই যা করছিলিস তা-ই কর। আমি কথা দিচ্ছি, তুই না চাওয়া পর্যন্ত তোর বিয়ে নিয়ে আমি মাথা ঘামাবো না। শুধু একটাই অনুরোধ সাবধানে থাকবি আর অন্যায় কাজে লিপ্ত হবিনা। তোর যদি কাউকে ভালো লাগে আমাকে বলবি। মেয়ের ভালোর জন্য আমি সব করবো। বাবার মাথা নত হতে দিস না। বাবার সম্মান তো তোদের হাতেই।’
রাইশা তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘থ্যাঙ্কিউ বাবা। আমি তোমার সম্মান নষ্ট হতে দিবনা। কথা দিলাম।’
মিস্টার আফজাল শেখ খুব খুশি হলেন।
*
রিদ রুমে বসে ল্যাপটপ চাপছিল। তাহনা রিদের জন্য এক মগ কফি নিয়ে আসে। রিদের হাতে দিয়ে তাহনা রিদের পাশে সোফায় বসে পড়ে। রিদ তাহনার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘কিছু বলবে?’
‘না, কি বলবো!’
‘তুমি কিভাবে বুঝলে যে আমার কফি খেতে ইচ্ছে করছে?’
‘আমার মনে হলো আপনি কাজ করতে করতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছেন, তাই আমি ভাবলাম আপনার প্রিয় কফি খেলে হয়তো মন মেজাজ ভালো থাকবে তাই নিয়ে এলাম। আপনার ইচ্ছের কথা আমি কিভাবে বলবো বলুন?’
‘আমার ইচ্ছের কথা তুমি খবর রাখবে না?’
‘না মানে আপনি না বললে কিভাবে বুঝবো আপনার কি ইচ্ছে করছে।’
রিদ একটু বিরক্ত হয়ে বলে,
‘এই, কথায় কথায় এতো না মানে বলো কেন?’
তাহনা চুপ হয়ে যায়। অভিমান করে সোফা থেকে উঠে শেল্ফ থেকে একটা বই নিয়ে বেডে বসে। মনোযোগ দিয়ে সে বই পড়তে থাকে। রিদ বুঝে তাহনার মন খারাপ হয়েছে। রিদ ভেবে পায়না এইটুকুতে কেউ গাল ফুলিয়ে বসে থাকে? রিদ নিজের কাজে মনোযোগ দিল।
.
তাহনা কিছুতেই স্থির হয়ে থাকতে পারছেনা। ওর চোখের সামনে শুধু সেই মেয়েটির ছবি ভাসছে। রিদ সবে ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। সে বের হয়ে দেখে তাহনা কিছু একটা নিয়ে বেশ চিন্তায় আছে। রিদ তাহনাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কি নিয়ে এতো ভাবছ তুমি?’
তাহনা চমকে উঠে রিদের কথা শুনে। সে ভাবে, মেয়েটির কথা কি জিজ্ঞেস করবে রিদকে? রিদ যদি কিছু বলে? কিন্তু না বলেও তো শান্তি পাচ্ছেনা সে। তাহনা রিদের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলো। তাহনাকে কেমন যেন অস্থির দেখাচ্ছে। রিদ তাহনার সাথে অন্য একটা চেয়ার টেনে বসে। এবং সে বলে,
‘তোমাকে এমন অস্থির দেখাচ্ছে কেন? কি হয়েছে বলবে তো।’
‘আপনি রাগ করবেন?’
‘কিসের জন্য রাগ করবো?’
‘আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করার আছে। কিন্তু দ্বিধায় আছি।’
‘যা জিজ্ঞেস করার সোজাভাবে বলো।’
‘শুভ্রা কে? আপনার সাথে তার কি সম্পর্ক?’
তাহনার মুখ থেকে শুভ্রার বাম শুনতেই রিদের চেহারা কেমন যেন হয়ে যায়। মুখটা মলিন হয়ে যায়। তাহনা ঢোক গিলে। ভুল করে ফেললো না তো আবার? রিদ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। রিদের দু চোখ লাল হয়ে গেছে। চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেছে। তাহনা ভয় পেয়ে সেও চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। রিদ শক্ত মুখে তাহনার উপির চ্যাঁচিয়ে বলে,
‘তোমার সাহস কি করে হয় তাহনা? কোন অধিকারে তুমি আমার ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দাও? তোমাকে বিয়ে করেছি মানে কি এই, আমার সব বিষয়ে তুমি নাক গলাবে? আমার সব কিছুতে হাত দিবে? তাহলে তুমি ভুল ভাবছ তাহনা। তোমার কোনো অধিকার নেই আমার ব্যক্তিগত জিনিস ধরার, কোনো অধিকার নেই আমার অতীত সম্পর্কে প্রশ্ন করার। বুঝেছ তুমি? আর কখনো আমার সামনে আসবে না তুমি।’
রিদ এসব বলেই রাগ করে ধুপধাপ পা পেলে বাসার বাইরে চলে যায়। তাহনার হৃদয় সমদ্বিখণ্ড হয়ে যায়৷ রিদ এসব কি বলে গেল তাকে? সামান্য একটা কথায় অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললো সে? তাহনার চোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে। তাহনা ফ্লোরে বসে বেডের সাথে হেলান দিয়ে ফুপিয়ে কাঁন্না করতে থাকে।
.
রাত তখন গভীর। তাহনা যে কখন কাঁন্না করতে করতে ঘুমিয়ে যায় বুঝতেই পারেনা। তাহনা উঠে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। রিদকে সে কোথাও দেখতে পায়না। তাহনা আস্তে করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। নিচে গিয়ে রিদকে খুঁজতে থাকে সে। তাহনা ভেবেছিল রিদ হয়তো ড্রয়িংরুমের সোফায় ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু নিচে এসে কাউকেই দেখতে পায়নি সে। এদিকে বাসার সবাই ঘুমিয়ে আছে। তাহলে কি রিদ এখনো বাসায় আসেনি? তাহনার মন আরও ভেঙে যায়। নিজের রুমে এসে সে খাতা কলম নিয়ে বসে। সিদ্ধান্ত নেয় ভোঁরের আলো ফুটতেই বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে সে। তার আগে রিদকে কিছু কথা লিখে যেতে চায়। তাহনা লিখছে। চোখে পানি নিয়ে হৃদয়ে যে ব্যথাটা পেয়েছে সে বিষয়য়েই লিখছে। সে আর আসবে না রিদের সামনে। রিদ এমনটা করতে পারলো ওর সাথে? তাহনার লিখা শেষ হলে সে অপেক্ষা করতে থাকে ভোঁরের। আকাশের চাঁদটার দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে থাকে সে।
চলবে…