#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ২১ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
বিয়ের পর এই প্রথম রিদ তাহনাকে নিয়ে তাহনাদের বাড়িতে এলো। রিদের মা অনেকদিন ধরেই রিদকে বলছেন তাহনাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে গিয়ে ঘুরে আসতে। রিদ তার মায়ের কথা ফেলতে পারেনি। তাই এতো ব্যস্ততার মাঝেও সে তাহনাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে এসেছে। অবশ্য সে তাহনার কথাও ভেবেছে। অনেকদিন হলো বাবার বাড়িতে আসা হয়নি তাহনার। কিছুদিন এখানে থাকলে ওর ও মন ফ্রেশ থাকবে।
তাহনা রিদকে নিয়ে তার রুমে প্রবেশ করলো। রিদ ঘুরে ঘুরে তাহনার রুম দেখছে। তাহনার রুমের দেওয়ালের রঙ নীল। কিন্তু বাসার সব রুমের রঙই সাদা ছিল। শুধু তাহনার রুমের রঙই আলাদা। রিদ দেখলো একটু ছোট রুমটা। কিন্তু জিনিসপত্র খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। রুমের দরজাটা দক্ষিণমুখি। দরজার পাশে ওয়ারড্রব রাখা আছে। পশ্চিম দিকে পড়ার টেবিল প্লাস ডেসিংটেবিল একসাথে রাখা আছে। উত্তর দিকে উত্তর দক্ষিণ করে খাট রাখা আছে। তার পাশেই একটা ছোট্ট টি-টেবিল। সাথে ওয়াশরুমের দরজা। আর পূর্ব দিকে বারান্দার দরজা বিশাল বড় একটা জানালা আছে। আলো আসার একমাত্র অবলম্বন ওই জানালাটাই। রিদ বারান্দার দরজা পেরিয়ে বারান্দায় প্রবেশ করলো। বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই ট্রেন দেখতে পাওয়া যায়। বারান্দায় অনেকগুলো ফুলের টপ রাখা আছে। রিদ আবারও তাহনার রুমে প্রবেশ করে। কি সুন্দর সব বই টেবিলে শেল্ফ আকারে সাজিয়ে রেখেছে তাহনা। তাহনার রুমটা রিদের এক মুহুর্তেই ভালো লেগে যায়। এই এইকুটু রুমে এতোকিছু কিভাবে গোছানো হলো রিদের সেটা আশ্চর্য লাগছে।
তাহনা এতোক্ষণ ওয়াশরুমে ছিল। ফ্রেশ হতে গিয়েছিল। ফিরে এসে দেখে রিদ তাহনার বেডে বসে কি যেন চিন্তা করছে। তাহনা রিদের কাছে এসে বলে,
‘নিন আপনি এবার ফ্রেশ হয়ে নিন। আমি আপনার জামা কাপড় বের করে দিচ্ছি।’
তাহনা ট্রলি ব্যাগ থেকে রিদের শার্ট প্যান্ট বের করে দিলে রিদ সেগুলো নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।
*
বিকালের দিকে তাহনা বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল। আর ট্রেন দেখছিল। তাহনা সবসময় বিকেলে ওদের ওখানে বারান্দায় চা খেতে খেতে বিকেল উপভোগ করে। রিদ বাইরে থেকে ফিরে এসে দেখে তাহনা বারান্দায়। রিদ গিয়ে তাহনার পাশে বসে। তাহনা সেলোয়ার-কামিজ পড়ে মাথায় ঘোমটা দেওয়া ছিল। রিদের আগমনে সে একটু নড়ে বসে। রিদ বসতে বসতে বলে,
‘আমার কফি কই তাহনা? নিয়ে এসো। আমিও তোমার সাথে বসে বিকেল দেখবো।’
তাহনার মুখে খুশির ঝিলিক। সে তাড়াতাড়ি করে রান্নাঘরে যায়৷ আর পটাপট এক কাপ কফি বানিয়ে রিদের কাছে নিয়ে আসে। রিদ কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলে,
‘তোমার নিয়ে আমার কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। বিশেষ করে বিয়ের পর। তোমার সব দায়িত্ব যখন নিয়েছি, তখন তোমার আবদারগুলোও পূরণ করার দায়িত্ব আমায়।’
‘আমার সমুদ্রে যেতে ইচ্ছে করছে।’
হুট করেই রিদের মুখ কালো হয়ে গেল। সে মুখ ভার করে বলল,
‘সমুদ্র ছাড়া আর যেখানেই যেতে চাও নিয়ে যাবো। কিন্তু সমুদ্রের নাম নিবে না।’
‘কিন্তু আমি কখনো সমুদ্রে যাইনি। আমি খুব ইচ্ছে করছে ওখানে যেতে।’
‘বললাম তো সমুদ্রে যেতে পারবো না।’
রিদের ধমকে তাহনা কেঁপে উঠে। হঠাৎ করে কি হলো তার? নিজেই বলল কোথায় ঘুরতে যাবে বলতে আর এখন নিজেই ধমকাচ্ছে? তাহনা রিদের পাশ থেকে উঠে রুমে চলে আসে। রিদের ব্যবহার ওর খুব খারাপ লেগেছে। তাহনার কাঁন্নাও চলে এসেছে, কিন্তু সে চেপে রেখেছে। তাহনা স্বাভাবিক হয়ে তার বাবার কাছে চলে যায়।
*
মন খারাপ করে বাবার কাছে বসে আছে তাহনা। এহসান সাহেব অনেক্ক্ষণ ধরে দেখছেন তাহনার মন খারাপ। কোনো কথা বলছে না তার সাথে। এখন কিছু জিজ্ঞেস করা প্রয়োজন। তাহনার বাবা তাহনার মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘কোনো সমস্যা তাহনা? মন খারাপ কেন তোর? রিদ কিছু বলেছে?’
তাহনা তাড়াতাড়ি জবাব দিয়ে বলে,
‘আরে না না। উনি কেন আমাকে কিছু বলতে যাবেন। এমনি কেন জানি না ভালো লাগছে না।’
‘তোর আর রিদের মধ্যে সব ঠিকঠাক তো মা?’
‘হ্যাঁ বাবা। আমার এই ব্যর্থ জীবনে ওনার মতো একজনকে আমার খুব প্রয়োজন ছিল। আর আমি তাই পেয়েছি বাবা। ওনার কথা বলে শেষ করা যাবে না। উনি আমার এতো কেয়ার করেন, আমার কথা এতো ভাবেন যে মাঝে মাঝে আমার মনে হয় কেন আমি ওই ভুল করলাম। কেন উনি আমার জীবনে আগে এলেন না।’
তাহনার বাবা বলেন,
‘ওই ভুলের কারণেই তো তুই রিদের দেখা পেলি। ওই ছেলেটা যদি তোকে না ঠকাতো তাহলে তুই রিদের সাথে আজ একসাথে থাকতিস না।’
তাহনা চুপ হয়ে যায়। সে ভাবছে অন্যকিছু! কেন রিদ সমুদ্রের কথা শুনে রেগে গেল? সমুদ্রে কি রিদের ভয় হয়? রিদ তো তাকে কিছুই বললো না। তাহনা তার ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে তার বাবাকে বলে,
‘বাবা, এখন তো জলপাই এর সিজন তাইনা? তুমি আমার জন্য বাজার জলপাই নিয়ে আসো না প্লিজ। খুব খেতে ইচ্ছে করছে।’
‘আচ্ছা আমি যাচ্ছি এক্ষুণি। তুই রিদের খেয়াল রাখিস। ওর যেন কোনো অসুবিধে না হয়।’
তাহনা মুচকি হাসে। তার বাবা উঠে চলে যায় বাজারে।
*
এক বাটি জলপাই নিয়ে লবন মরিচ মেখে একটার পর একটা জলপাই খেয়েই চলেছে তাহনা। তাহনা টক খেতে খুব ভালো লাগে। আজ জলপাই পেয়ে সে মহাখুশি হয়ে যায়।
রিদ বাইরে থেকে এসে দেখে তাহনা ইচ্ছেমতো জলপাই খাচ্ছে। ফ্লোরে জলপাইয়ের বিচিগুলো পড়ে আছে। এতগুলো বিচি দেখে রিদের মাথা ঘুরছে। তাহনা এতোগুলো জলপাই খেয়েছে? রিদ তাহনাকে ডাক দেয়।
‘তাহনা!’
রিদের ডাক শুনেই তাহনা ভয় পেয়ে যায়, তখনই তাহনার হাত লেগে কাচের বাটিটি পড়ে ভেঙে যায় ফ্লোরে। তাহনা আরও বেশি ভয় পেয়ে যায়। তাহনা উঠে কাচগুলো উঠাতে যাবে তখনই নিচে পড়ে থাকা জলপাইয়ের বিচিগুলোর সাথে পাড়া লেগে কিভাবে যেন তাহনার পায়ে কাচ ঢুকে যায়। তাহনা নিচে বসে যায়। তাহনার পা থেকে রক্ত বের হচ্ছে। রিদ সাথে সাথেই তাহনার কাছে যায়। এক হাত দিয়ে তাহনার পা ধরে অন্য হাত দিয়ে তাহনার পা থেকে কাচটা বের করে। তাহনার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। রিদ তাহনাকে কোলে নিয়ে বেডে গিয়ে বসায়। তারপর তাহনার পায়ের রক্ত মুছে ব্যান্ডেজ করে দেয়। তাহনা চুপ করে থাকে।
রিদ উঠে কাচগুলো হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে ফেলে দেয়। এরপর জলপাইগুলো রান্নাঘরে রেখে আসে। ওখান থেকে একটা ঝাড়ু নিয়ে এসে রুমটা ঝাড়ু দিয়ে দেয়। তারপর আবারও রান্নাঘরে গিয়ে ঝাড়ুটা রেখে আসে। এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে এসে তাহনাকে খাওয়ায়। তাহনা শুধু হতবাক হয়ে রিদের কাজ দেখছে। রিদকে সে এখনো বুঝে উঠতে পারছেনা। রিদ তাহনার এতো কেয়ার করবে তাহনা সেটা কল্পনায়ও ভাবেনি। হুট করে অশ্রুসিক্ত নয়ন নিয়ে তাহনা রিদকে জড়িয়ে ধরে। অশ্রু ছেড়ে দিয়ে বলে,
‘আপনি আমার পাশে এভাবেই সারাটি জীবন থাকুন। আমার আর কিচ্ছু লাগবে না। আমি এতেই খুশি। এতেই সুখী।’
রিদ মলিন হেসে তাহনার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। একটু কেয়ার করতেই তাহনা কিভাবে মানুষকে আপন ভেবে নেয় রিদ এখন তা বুঝতে পারলো।
রিদ বলে,
‘তাহনা, এতো সহজে মানুষকে আপন ভাববে না। কে বলতে পারে, তুমি যাকে আপন ভাবছ সে-ই তোমাকে একদিন কষ্ট দিবে। যেমনটা তানভির দিয়েছিল।’
‘আমি তানভিরকে ভুলতে চাই। পুরোপুরি ভুলতে চাই। ওর নামও যেন আমার মস্তিষ্কে না থাকে।’
‘চেষ্টা করো তুমি পারবে। অতীত ভুলে যাওয়াই শ্রেয়। মনে করো ওটা একটা অ্যাকসিডেন্ট। একদম মুছে দাও মন থেকে। দেখবে অনেক হালকা লাগছে। আমি তো তোমার পাশেই আছি।’
রিদ আবারও বলে,
‘তুমি আমার এক অভ্যাসে পরিণত হয়েছ। যে অভ্যাস আমাকে এক মুহুর্ত তোমার থেকে দূরে থাকতে দেয়না।’
তাহনা যেন তার মাথার উপর একটা ভরসার হাত পায়।
চলবে…