প্রিয়দর্শিনীর খোঁজে পর্ব ২০

0
561

#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ২০ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

তাহনা সুন্দর করে রাইশাকে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে। রাইশা অন্যমনস্ক হয়ে আছে। এদিকে তাহনা নিজেই শাড়ি পড়তে পারে না ঠিক করে অথচ তাকেই রাইশাকে সাজানোর দায়িত্ব দেওয়া হলো। একটু উলোট পালোট হয়ে যাওয়ায় তাহনা ঘাবড়ে যায়। তাহনা রাইশাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘আপু আমি তো গড়বড় করে ফেললাম। মা’কে ডেকে দিচ্ছি উনিই পড়িয়ে দিবেন তোমাকে শাড়ি।’

রাইশার কোনো হেলদোল নেই। তাহনা এক দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর রাইশার মা’কে সাথে নিয়ে তাহনা প্রবেশ করলো এখানে। রাইশার মা এসে রাইশাকে সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে দিল। তাহনা হালকা করে রাইশাকে সাজিয়ে দিল। রাইশা এবার বিরক্ত হয়ে তার মা’কে বলল,

‘এতো সাজগোজ করে কি হবে মা?’

‘এক জায়গায় যাচ্ছি তোকে ওদের পছন্দ হতে হবে না?’

‘আমাকে পছন্দ হলেই হলো? আমার পছন্দের কথা একবার জিজ্ঞেস করেছ মা?’

‘চুপ কর তো। তোর বাবা শুনতে পাবে। আর আমরা শুধু যাচ্ছিই। ছেলে পছন্দ না হলে আমরা আর এগোবো না। চিন্তা করিস না।’

তাহনার খুব খারাপ লাগছে। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে রাইশাকে এভাবে দেখতে নিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?
তাহনা নিজের রুমে চলে এলো। তারপর দেখলো রিদ রেড়ি হচ্ছে। তাহনা রিদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইলো। রিদ তাহনার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘কিছু বলবে?’

‘অফিস থেকে কবে এসেছেন?’

‘অনেক্ষণ হলো। তুমি তো রাইশার রুমে ছিলে তাই তোমাকে ডাকিনি।’

‘একটা কথা বলবো?’

রিদ চুল ঠিক করতে করতে বলে,

‘হ্যাঁ বলো।’

‘রাইশার মোটেও ইচ্ছে নেই ওখানে যাওয়ার। রাইশা বোধয় চাইছে না এখন বিয়ে করতে। একটু ভেবে দেখুন না, ওর বিরুদ্ধে গিয়ে এটা করা কি ঠিক হচ্ছে?’

‘তোমার বিরুদ্ধে গিয়েও তো তোমায় আমি বিয়ে করেছি। তোমাকে কি বিয়ের পর কষ্টে রেখেছি? তবে সবার ক্ষেত্রে এমন নাও হতে পারে৷ আমরা শুধু ছেলে দেখতে যাবো। পছন্দ না হলে এখন বিয়ের চিন্তা বাদ। আমার বোনের উপর আমারও অনেক বিশ্বাস আছে।’

তাহনা আর কিছু বললো না। চুপ করে অন্যমনস্ক হয়ে রইলো। রিদ সম্পূর্ণ রেড়ি হয়ে তাহনার দিকে তাকিয়ে দেখে সে কিছু একটা ভাবছে। রিদ তাহনার কাছে গিয়ে তাহনার দুই কাঁধের উপর হাত রাখে। তাহনা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে।

‘কি ভাবছ?’

‘কিছুনা।’

‘রেড়ি হয়ে নাও। সেলোয়ার-কামিজ পড়ে উপরে বোরকা আর হিজাব পড়ে নিও।’

তাহনা রিদের কথামতো রেড়ি হতে গেল। রিদ ওখান থেকে বেড়িয়ে গেল।

*
দুপুর দুইটা। এস আই নিজাম উদ্দিন এর বাড়ির ডাইনিং টেবিলে বসে আছে শেখ ফ্যামিলি। এই মুহুর্তে নিজাম সাহেবের বাসায় নিজাম সাহেব এবং তার স্ত্রী ছাড়া আর কেউই নেই। খাওয়া শুরু করার আগে আফজাল শেখ বললেন,

‘তোর ছেলে কোথায় নিজাম? যাকে দেখতে এলাম সেই তো নেই।’

নিজাম সাহেব মুচকি হেসে বললেন,

‘ওকে একটু দরকারে বাইরে পাঠিয়েছি। চলে আসবে।’

মিসেস ফাবিহা বললেন,

‘এই দুপুরবেলায় কি কাজে পাঠিয়েছেন ভাইজান?’

‘আপনারা চিন্তা করবেন না। এক্ষুণি এসে যাবে।’

নিজাম সাহেবের কথা শেষ হওয়া মাত্রই নিজাম সাহেবের ছেলে বাসার ভিতরে ঢুকলো। নিজাম সাহেব তাকে দেখেই সবার উদ্দেশ্যে বললেন,

‘ওই তো আমার ছেলে এসে গেছে।’

নিজাম সাহেবের কথায় রিদ,তাহনা ও রাইশার বাবা মা পিছনে তাকিয়ে দেখে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। রিদ চমকে উঠে। এই ছেলেকে তো রিদ চিনে। এদিকে সেই ছেলেটাও বিশ্ময় চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। রিদকে সে চিনে আর রিদের বাবাকেও দেখেছে। কিন্তু ওরা সবাই একসাথে হলো কি করে? নিজাম সাহেব তার ছেলেকে বললেন,

‘রাফি, এরা হচ্ছেন আমার বন্ধু আফজাল সাহেবের পরিবার। আর উনি তোমার আফজাল আংকেল আর আন্টি। এনারা ওনার ছেলে ও ছেলের বউ। আর এ তার মেয়ে।’

রাইশা একবারও পিছনে তাকায়নি। যাইহোক সে তাকাবেই না। কাউকে দেখার মাথা ব্যথা তার নেই। রাফি সবাইকে সালাম দেয়। রিদ উঠে রাফির সাথে কোলাকুলি করে৷ তারপর বলে,

‘আমিতো রাফিকে চিনি। তাহনার একটা অ্যাসিডেন্ট হয়েছিল আর তখন রাফি’ই তাহনাকে রক্ত দিয়েছে। কেমন আছো?’

রাফি মলিন হেসে বলে,

‘আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছি। উনাকে আপনি বিয়ে করেছেন?’

‘হ্যাঁ।’

রাফি রিদের বাবা মা ও তাহনাকে সালাম দেয়। রিদের বাবা রাফিকে চিনতে পারেনি। সেদিন রাইশাকে বাসায় পৌঁছে দিতে যেয়ে রাইশার সাথে সাথে রাফিকেও কয়েকটা কথা শুনান রাইশার বাবা। মাথায় হেলমেট থাকায় রাফির মুখ দেখতে পাননি তিনি। রাফি ভাবছে এরা এক পরিবারের লোক৷ তারমানে রাইশাও এসেছে এখানে? তার বাবা কি তাহলে তার জন্য রাইশার কথাই বলেছিল?

নিজাম সাহেব সবাইকে খেতে বসতে বললেন। সবাই চেয়ারে বসে পড়লো। রাফি নিজের ঘরে গেল চেঞ্জ করতে। তাদের অর্ধেক খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর রাফি ফ্রেশ হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে আসে। একটা চেয়েন টেনে তাদের সাথে বসেন। চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে খেতে শুরু করে। রাইশাও তাকাচ্ছেনা। আর রাফিও তাকাচ্ছেনা। দুজনেই একমনে খেতে লাগলো।

.
খাওয়া শেষে সবাই সোফায় বসলো। তাহনা রাইশাকে নিয়ে রাফিদের ছাদে চলে গেল। কিছুক্ষণ ওখানে ঘোরাঘুরি করার পরে তাহনাকে রিদ ডাকতে থাকে৷ তাহনা রাইশাকে রেখেই নিচে চলে যায়। রাইশা ছাদের রেলিং ধরে একপাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে।

কয়েক মুহুর্ত যাওয়ার পর রাইশার মনে হলো তার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। রাইশা পাশে তাকাতেই শকড! রাফি? ও এখানে কি করছে? এমন হাজারো প্রশ্ন রাইশার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। রাইশা কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাফি রাইশাকে বলে উঠে,

‘আ’ম স্যরি। আপনার সামনে আমি আর আসবো না বলেছি। কিন্তু কিভাবে যেন আমাদের দেখা হয়ে গেল। আমি যাইনি কিন্তু আপনিই আমাদের বাড়িতে চলে এসেছেন। কি অদ্ভুত লাগছে আমার।’

রাইশা বলে,

‘তার মানে আপনিই আমার বাবার বন্ধুর ছেলে? আপনার সাথেই আমার বিয়ের কথা চলছে?’

‘হবে হয়তো।’

‘আপনি প্লিজ এই বিয়েটা বন্ধ করুন। আমার লাইফ শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা।’

‘কিন্তু আমি কিভাবে বলবো?’

‘প্লিজ একটু ট্রাই করুন। বলবেন আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি।’

‘কিন্তু আপনাকে অপছন্দ করার তো কোনো কারণ দেখছি না।’

‘আপনি কেন বুঝতে পারছেন না? আমি চাইনা আপনাকে বিয়ে করতে। আপনি কি ভাবেন আমি বুঝিনা? আপনি আমাকে বিয়ে করবেন, তারপর আমাদের বাড়িতে যাবেন এবং সম্পর্কের জোরে আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করবেন। আমি না চাইলেও।’

রাফি কপাল ভাজ করে বলল,

‘হোয়াট! আপনি কি বলছেন এসব! আপনার মাথা ঠিক আছে?’

‘আপনাকে আমি একটুও বিশ্বাস করিনা।’

‘হঠাৎ করে এতো অবিশ্বাস আপনার মনে উদয় হলো কি করে? আমি কি এমন করেছি? আমি কি আপনার কোনো ক্ষতি করেছি?’

‘অনেক বড়ো ক্ষতি করে ফেলেছেন আপনি। আপনার সাথে দেখার পর থেকেই বাবা আমাকে সন্দেহ করছে। বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সব আপনার জন্য হয়েছে। আপনাকে আমার ঘেন্না লাগে।’

রাফি ওখান থেকে রেগে বেরিয়ে পড়লো। ওর খারাপ লাগছে। কিছু না করেও অভিযোগ এসে জমেছে তার উপর। কি এমন করলো যে ঘৃণার পাত্র হয়ে গেল? সে কি জানতো এমন হবে? রাইশার বাবা ওদের ভুল বুঝেছেন, এখানে কি রাফির দোষ ছিল?

রাফি নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। তারপর রুমে থাকে জিনিসপত্র সব ভাঙতে শুরু করলো। এদিকে রাফির রুম থেকে জিনিসপত্র ভাঙার শব্দ সবার কানে আসে। নিজাম সাহেব ও তার স্ত্রী চমকে উঠেন। নিজাম সাহেব বলেন,

‘রাফির ঘরে কি হচ্ছে?’

নিজাম সাহেবের স্ত্রী দৌড়ে ওখানে গেলেন। রাফিকে ডাকতেই সে চ্যাঁচিয়ে বলে,

‘চলে যেতে বলো ওনাদের। আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। ওই মেয়েকে আমি কিছুতেই বিয়ে করবো না।’

ওনারা সবাই রাফির চিৎকারে কেঁপে উঠেন। রাইশা ছাদ থেকে নিচে নেমে এসে দেখে রাফি নিজের রুমে বসে চিল্লাচিল্লি করছে। আর বারবার বলছে তার পরিবার যেন এক্ষুণি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়৷ সে রাইশাকে বিয়ে করতে পারবে না। রাইশার কেমন যেন লাগছে। এভাবে রাফি এতো পাগলামি করছে কেন? সুন্দরভাবে বুঝিয়েই তো বলতে পারতো তার মা বাবাকে।

অন্যদিকে রিদের মাথা বেশ গরম হয়ে আছে। সে তার মা, বাবা, বউ ও বোনকে নিয়ে রেগে রাফিদের বাড়ি থেকে চলে গেল।

*

বাসায় এসে মিস্টার আফজাল শেখ সোফায় বসে পড়লেন। এসি চলছে কিন্তু এখনো ঘামাচ্ছেন উনি। রেগেমেগে বললেন,

‘নিজাম আমাকে তার বাসায় নিয়ে এই অপমানটা না করলেই পারতো। ওর ছেলের এতো বড়ো সাহস যে ও বলে আমার মেয়েকে বিয়ে করবে না?’

রিদ বলে,

‘তোমায় বলেছিলাম বাবা রাইশার বিয়ে নিয়ে এখন না ভাবতে। যদি আমার কথা শুনতে তাহলে আর আজ এই দিন দেখতে হতো না। রাফি এমন আমি জাস্ট কল্পনা করতে পারছিনা। আরে তোর পছন্দ হয়নি তুই সুন্দর করে বুঝিয়েই তো বলতে পারতিস? এভাবে জিনিসপত্র ভেঙে, চ্যাঁচিয়ে কি প্রমাণ করতে চাইলো ও?’

রাইশা নিজের রুমে এসে চেঞ্জ করে নিল। তারপর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আজকের কথাগুলো ভাবতে লাগলো। আজ সে রাফির সাথে এমন বিহেভ না করলেই পারতো। রাইশার কথায় বোধয় রাগ উঠে গিয়েছিল রাফির, তাই একঘর লোকের সামনে চ্যাঁচিয়ে বলেছে সে রাইশাকে বিয়ে করতে পারবে না। রাইশার এখন নিজেরই খারাপ লাগছে। শুনেছে রাফির বাবা খুব রাগী মানুষ। তারউপর পুলিশ অফিসার। এখন রাফির এমন কাজে তাকে কঠিন শাস্তি না দিয়ে বসে। রাফি যা করেছে রাইশার জন্যই করেছে। রাইশার খুব চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু এখন কি হবে? বলার আগে একবারও এটা চিন্তা করেনি। শুধু নিজের কথাই চিন্তা করেছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here