#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ১৭ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
হীমেল হাওয়া বইছে, বাতাশে জানান দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। একটু একটু শীতও পড়ছে। সন্ধ্যা আর সকালে একটুখানি কুয়াশার দেখা পাওয়া যায়। সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে কফি খাচ্ছিল তাহনা আর রাইশা। ইতিমধ্যেই অনেক কথা বলে ফেলেছে তারা। অবশেষে রাইশা বললো,
‘তাহলে আমার ভাবি হয়েই গেলে অবশেষে তুমি। আমার ভাবি ডাকা স্বার্থক হয়েছে।’
তাহনা মুচকি হাসে। এই মেয়েটা শুরু থেকেই তাকে ভাবি ডেকে আসছে। আর এখন সে সত্যিই তার ভাবি হয়ে গেল।
তাদের কথার মাঝে রিদ এসে উপস্থিত হয় ওখানে। রিদ ওদের উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ননদ ভাবি মিলে কি কথা হচ্ছে?’
রাইশা উঠে যায় বসা থেকে। তারপর বলে,
‘তেমন কিছুনা ভাইয়ু। এই তোমার বউয়ের সাথে আগের কথাগুলো বলছিলাম।’
‘তোর রেজাল্ট কবে দিবে?’
‘আমার রেজাল্টে কি আসে যায়, তুমি তোমার বউয়ের টা দেখিও। আসছি।’
রাইশা এক দৌড়ে ওখান থেকে চলে গেল। তাহনা উঠে দাঁড়াতেই রিদ বলে,
‘তোমার রেজাল্ট কবে দিবে?’
‘এক সাপ্তাহের মধ্যে, এখন নাকি তাড়াতাড়ি রেজাল্ট আউট হবে বলেছে।’
‘কি মনে হয় তোমার? কি আসবে?’
‘জানি না। আমার রেজাল্ট নিয়ে খুব টেনশন হচ্ছে।’
‘আচ্ছা ভালো রেজাল্ট করলে কোথায় অ্যাপ্লাই করবে?’
‘আমি মেডিকেলে পড়তে চাই।’
‘অহ, তুমি সাইন্সের ছাত্রী?’
‘হুম।’
‘ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখো?’
‘অনেক বড় ডাক্তার হতে চাই।’
‘গুড।’
রিদ তাহনার দিকে এক নজর তাকিয়ে থাকে। মেয়েটার মধ্যে একটা পজিটিভ দিক আছে। সচরাচর তাহনার মতো মেয়ে খুব একটা দেখতে পাওয়া যায়না। রিদ মুচকি হেসে বলে,
‘কাল কিছু পার্নিচার এই রুমে আসবে।’
‘কি দরকার ছিল?’
‘লাগবে এখন বুঝতে পারছ না।’
রিদ বেলকনি থেকে বেড়িয়ে গেল। রাইশার সাথে রিদের আবার দেখা হলো। রাইশা বলল,
‘জানো ভাইয়া, মা তাহনাকে অনেক আদর করেছে, ওকে কাছে টেনে নিয়েছে। তাহনার খুব কষ্ট। ওর মা নেই। আমার মা বলেছে তাহনা তার আরেক মেয়ে।’
‘বাহ্। এই মেয়েটাকে একটু ভালোবাসা দিবি। দেখবি তোদের মাথায় করে রাখবে। আমি ভুল মেয়েকে নিজের বউ করিনি রাইশা। ওকে আমার ভালো লাগে। ওর পজিটিভ দিকগুলো আমার ভালো লাগে। মায়ের জন্য একদম পারফেক্ট বৌমা।’
‘আর তোমার জন্য? পছন্দ করো খুব তাইনা?’
রিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘তোর জন্য একটা জিনিস নিয়ে এসেছি।’
রাইশা বুঝলো তার ভাই কথা ঘুরাচ্ছে। সেও আর এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলো না। মুখে হাসির রেখা টেনে বলে,
‘কি জিনিস? দেখাও।’
রিদ একটা শপিং ব্যাগ রাইশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
‘এর মধ্যে একটা বোরকা আছে। যেখানেই যাবি বোরকা আর হিজাব পড়ে বের হবি।’
‘ঠিকাছে ভাইয়া। তুমি আমাকে অনেক স্বাধীনতা দিয়েছ, অনেক ভালোবাসা দিয়েছো। যখন যা চেয়েছি মুহুর্তের মধ্যেই এনে দিয়েছ। তোমার কথা আমি অমান্য করতে পারিনা। ধন্যবাদ।’
‘মাঝে মাঝে তাহনার কাছে গিয়ে গল্প করিস। ভালো লাগবে।’
‘সে আর বলতে। আমার মিষ্টি ভাবির সাথে আমার খুব ভাব জানো তুমি?’
‘হয়েছে। এখন বলতো, বাবা বললো তোকে নাকি কোন ছেলের সাথে নাইকে ঘুরতে দেখেছে? ঘটনা কি হ্যাঁ?’
রাইশা রিদকে সব ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে রিদ বলে,
‘নিজেকে ছেলেদের থেকে দূরে রাখবি। খেয়াল রাখিস নিজের।’
‘আচ্ছা ভাইয়া।’
রিদ ওখান থেকে চলে গেল। রাইশা মলিন হাসলো।
*
রাতের খাবার খেয়ে রিদ তাহনা নিজেদের ঘরে চলে আসে৷ তাহনা বিছানা গোছাচ্ছে শোয়ার জন্য। রিদ সোফায় বসে আছে ল্যাপটপ নিয়ে।
‘আপনি ঘুমাবেন না?’
তাহনার কথায় রিদ ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকালো। তাহনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
‘তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। একটা কাজ আছে, সেটা কমপ্লিট করে ঘুমাবো।’
তাহনা রিদের কথায় বিছানায় গিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে। নিজের মনে জমে থাকা হাজারো জল্পনা কল্পনা করতে করতে একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে। রিদের কাজ প্রায় শেষের দিকে। সে বিছানায় তাকিয়ে দেখে তাহনা ঘুমিয়ে পড়েছে। রিদ ল্যাপটপটা বন্ধ করে তাহনার পায়ের কাছে এসে দাঁড়ায়। তারপর একটা কাঁথা টেনে তাহনার গায়ে জড়িয়ে দেয়। তাহনা শীতে কাঁপছিল অথচ কাঁথা টেনে গায়ে দিতেও তার অলসতা। রিদ ভাবছে লাইট অফ করে দিবে কিনা। তাহনা কাল লাইট জ্বালিয়েই ঘুমিয়েছিল। অন্ধকারে নাকি তার ভয় করে। রিদ লাইট জ্বালিয়ে রেখেছে। তাহনার ওপরপাশে সেও শুয়ে পড়লো। তাহনার মুখোমুখি হয়ে তাহনাকে পর্যবেক্ষণ করছে রিদ। তাহনার চোখের পাশে দুটো তিল আছে। একটা গালে। এই তিলগুলো থাকায় তাহনাকে আরও মিষ্টি লাগে। রিদ মুচকি হাসে। ও তাহনার সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে নিমিষেই। ওর জীবনের সাথে তাহনাকে জড়িয়ে কি ভুল হলো? নাকি জীবনের একটা নবসূচনা হলো? রিদ তাহনার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিল। তারপর হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলো৷ চোখ বন্ধ করে নিজের ভাবনার অতলে চলে গেল রিদ।
তাহনা হঠাৎ চোখ খুলে দেখে রিদ তার হাত ধরে আছে। তাহনার অনেক আশ্চর্য লাগছে। রিদ এতো সহজে সম্পর্কটাকে মানিয়ে নিবে সেটা কল্পনাও করেনি সে। আজ রিদকে দেখে মনে হচ্ছে রিদের এই হাতটি তখন কেন ছিলনা যখন সে ভুলে অন্য কারো হাত ধরেছিল৷ তখন যদি রিদের হাত একবার ধরতে পারতো, তাহলে তাহনার জীবনে অতীত থাকতো না। আর না থাকতো বিচ্ছেদের কষ্ট। সে এখন অতীত ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে। নিজেকে সংসারী করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাহনা তার আরেকটা হাত রিদের হাতের উপরে রাখে। তারপর সেও ঘুমিয়ে পড়ে।
*
নতুন কিছু পার্নিচার এনে রাখা হলো তাহনা আর রিদের ঘরে। কয়েকজন এসে সব ঠিক করে দিও চলে গেল। তাহনা ঘুরে ঘুরে সব দেখছে। তাদের রুমটা এখন ভিষণ সুন্দর লাগছে। রাইশা এসে তাহনাকে বলে,
‘এই তাহনা ভাবি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে চলো ভিজি।’
তাহনা বলে,
‘আরে, না। এখন না। পরে একদিন ভিজবো।’
‘আরে আসো তো।’
রাইশা তাহনাকে টেনে নিয়ে চলে গেল ছাদে। টুপ টুপ বৃষ্টির ফোটা পড়ছে আর রাইশা তার মধ্যে ভিজতে শুরু করে দিয়েছে। তাহনারও ইচ্ছে হলো ভিজার। সেও রাইশার সাথে যোগ দিল। দুজন মিলে অনেক্ক্ষণ ভিজলো। একজন আরেকজনকে বৃষ্টির ফোটা হাতে নিয়ে মারছে। অনেক আনন্দ করছে।
এদিকে রিদ আজ জলদি বাসায় চলে এসেছে। হাতে একগুচ্ছ উপন্যাসের বই। রিদ সারাঘরে তাহনাকে খুঁজে যাচ্ছে। কিন্তু দেখলো না। হাতে থাকা উপন্যাসের বইগুলো ডেসিংটেবিলের উপর রেখে তাহনাকে খুঁজতে গেল সে।
নিচে এসে মায়ের কাছে শুনে রাইশা তাহনাকে নিয়ে ছাদে গেছে। এই বৃষ্টির মধ্যে ওরা ছাদে কি করছে সেটাই রিদের প্রশ্ন। রিদ সোজা ছাদে চলে গেল। আর ওখানে গিয়ে যা দেখলো, এর জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা সে। তাহনা আর রাইশা বৃষ্টিতে ভিজছে, বাচ্চাদের মতো ছোটাছুটি করছে। রিদ চিৎকার দিয়ে রাইশাকে ডেকে উঠে। দুজনেই ভয় পেয়ে যায়। রিদ রাইশাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘এক্ষুণি এখান থেকে যাবি। তোরা কি বাচ্চা? ঠান্ডা লেগে জ্বর বাধানোর জন্য এসব করছিস?’
‘স্যরি ভাইয়া।’
‘যা এখান থেকে।’
রাইশা এক দৌড়ে নিচে চলে গেল। এদিকে তাহনা ভয় পেয়ে আছে। রিদ তাহনাকে কড়া গলায় বলে।
‘তুমি দাঁড়িয়ে কি দেখছ? তুমিও যাও। সোজা ওয়াশরুমে যাবে। আমি আসছি। আমি আসার আগেই বের হবে।’
তাহনা রিদের ধমকে ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেল। তারপর তাদের ঘরে গিয়ে কাপড় নিয়ে শাওয়ারে নিতে চলে গেল।
রিদ যখন রুমে আসে তখন দেখে তাহনা চুল মুচছে। রিদ ডেসিংটেবিলের উপর রাখা উপন্যাসের বইগুলো হাতে নেয়। তারপর তাহনাকে ডেকে বলে,
‘তাহনা শোনো।’
তাহনা এখনো ভয় পাচ্ছে। কিন্তু রিদের হাতে কিছু বই দেখে ওর মনে কৌতুহল জাগলো।
‘এগুলো তোমার জন্য।’
তাহনা বইগুলো হাতে নিয়ে দেখে। ইসলামিক ও সামাজিক জনরার কিছু বই এগুলো। তাহনা রিদের দিকে তাকায়।
‘যখন কিচ্ছু ভালো লাগবে না তখন এগুলো বসে বসে পড়বে। মন ভালো থাকবে কিছু জানতেও পরবে শিখতেও পরবে।’
তাহনা যত্ন করে বইগুলো রেখে দেয় শেল্ফে। রিদের এতো কিছু কিভাবে মাথায় আসে সেটাই বুঝছে না তাহনা। তবে সবচেয়ে ভালো লাগছে আজ রিদের এউ কাজটি দেখে।
চলবে…