প্রিয়দর্শিনীর খোঁজে পর্ব ১৬

0
620

#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ১৬ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

বাইরে থেকে আজানের ধ্বনি কানে বাজতেই ঘুম ভেঙে যায় তাহনার। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে সে। পাশে তাকিয়ে দেখে রিদ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রিদকে ডাকবে কি ডাকবে না এই সংকোচ নিয়ে সে ভসে রইলো। একটুপর নিজেই বিছানা থেকে নেমে গেল৷ ওয়াশরুম গিয়ে টেপ ছেড়ে অজু করে নিল। রুমে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়তে লাগলো।

.
কোরআন তেলোয়াতের শব্দে ঘুম ভাঙলো রিদের। ঘুমুঘুমু চোখে তাকিয়ে দেখে তার সদ্য বিয়ে করা বউ ঘোমটা টেনে জায়নামাজের উপর বসে কোরআন তেলোয়াত করছে। রিদ হাতে মোবাইল নিয়ে দেখে ৫:২০। এখন কি নামাজের সময় আছে কিনা সেটাও জানে না রিদ। রিদ উঠে বসে৷ তাহনাকে ডাক দিয়ে বলে,

‘তাহনা? আমাকে নামাজ পড়ার জন্য ডাকলে না কেন?’

তাহনা পড়া আয়াত পর্যন্ত নিয়ে রিদের কথার জবাব দেয়।

‘আপনি আপনার রবকে ভালোবাসলে নিজে থেকেই তার ডাকে সাড়া দিবেন। অন্য কেউ কেন আপনাকে ডেকে দিবে? আপনি কি আপনার রবকে ভালোবাসেন না? আমি প্রথমে ডেকে দিব ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে ভাবলাম যে আপনিও বুঝুন, আপনার জীবনে সবার আগে রবের গুরুত্বই অপরিসীম।’

রিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,

‘বাহ্। অনেক ভালো কথা বলতো তুমি। আচ্ছা এবার থেকে নিজে নিজেই উঠবো। দরকার পড়লে সঠিক সময়ে এলার্ম দিয়ে রাখবো। কিন্তু তাহনা? নামাজের জন্য ডেকে দেওয়ার কিন্তু একজন স্ত্রী/স্বামীর কর্তব্য। তুমি আগে উঠলে তুমি আমাকে ডেকে দিবে, আর আমি আগে উঠলে আমি তোমায় ডেকে দিব৷ এখন তোমার জীবন আমার সাথে জড়িয়ে গেছে। আমার সবকিছু তোমার আর তোমার সব কিছুই আমার। এবংকি গুন্নাহ্ ও।’

তাহনা ভেবে দেখলো রিদের কথাগুলো মিথ্যে নয়। তাহনা তাই সেই বিষয়টি পাল্টে জিজ্ঞেস করলো।

‘কয়টা বাজে?’

‘৫:২১।’

‘সময় আছে, নামাজ পড়ুন আপাতত ঘরে। এরপর থেকে মসজিদে যাবেন৷ আর কার্টুন আঁকা এসব টি-শার্ট পড়বেন না আর কখনো।’

রিদ উঠে ওয়াশরুমে গেল৷ তাহনা তার পড়ায় মনোযোগ দিল। রিদ তাহনার পাশে বসে নামাজ আদায় করে নিল।

*
সকাল আটটা। তাহনা শোয়া থেকে উঠে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলো। কিচেনে গিয়ে সবার জন্য চা আর রিদের জন্য কফি বানিয়ে নিল। রিদের মা এবং বাবা দুজনেই নিচে নেমে এলেন। নিচে আসতেই রিদের মা দেখলেন শাড়ি পড়া তাহনাকে। উনি কিছু বললেন না। তারা ডাইনিং টেবিলে বসতে লাগলো। তাহনা চা নাস্তা বানিয়ে ঘোমটা টেনে ওনাদের চা দিল। রিদের বাবা অনেক খুশি মনে চা খাচ্ছেন। কিন্তু রিদের মা অন্যদিকে মুখ করে আছেন। রিদের বাবা জিজ্ঞেস করলেন,

‘কি হয়েছে? খাচ্ছ না কেন?’

‘ইচ্ছে করছে না।’

‘ইচ্ছে করছে না নাকি তাহনা বানিয়েছে বলে খাচ্ছ না।’

রিদের মা রাগ দেখিয়ে ওখান থেকে উঠে গেলেন। তাহনা অনেক কষ্ট পেল। কিন্তু কিচ্ছু বললো না। রিদের বাবা তাহনাকে শান্তনা দিয়ে বললেন,

‘মন খারাপ করবে না তাহনা। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ, চা টা খুব ভালো হয়েছে।’

তাহনা মুচকি হেসে বলে,

‘ধন্যবাদ আংকেল।’

‘এই আংকেল কি? বাবা ডাকবে। নয়তো আব্বু।’

‘আচ্ছা, আমি আপনাকে আব্বু বলেই ডাকবো।’

‘রিদ কোথায়? নামাজ পড়েছে?’

‘জি।’

‘মসজিদে যেতে দেখলাম না তো।’

‘একটু দেরিতে উঠায় ঘরে পড়েছেন।’

‘এখন কি ঘুমুচ্ছে?’

‘জি।’

‘তোমাদের রিসিপশনের ব্যপারে কিছু কথা ছিল ওর সাথে।’

তাহনা কাচুমাচু হয়ে বলে,

‘বলছিলাম যে, অনেক লোকজন আসবেন। এতো লোকের সামনে আমি নিজেকে রাখতে পারবো না।’

‘তুমি কি চাওনা রিসিপশন হোক?’

‘বেশি লোকজন পছন্দ না।’

‘বেশ তাহলে এটা বাদ দেই। আচ্ছা আমি যাই। একটু পর অফিসে যাব। তুমি খেয়ে নাও।’

‘আচ্ছা আব্বু।’

.
তাহনা চায়ের ট্রে নিয়ে এক কাপ চা রাইশার ঘরে দিয়ে রাইশাকে ডেকে তুলে। আর এক কাপ চা নিয়ে রিদের মা’কে দিয়ে আসে। তিনি তখন কিছু বললেন না। রিদের জন্য গরম কফি ও নাস্তা নিয়ে রুমে আসে তাহনা। রিদকে ডাকতে থাকে। রিদ উঠে হাত মুখ ধুয়ে নেয়। তারপর কফি খেতে খেতে বলে,

‘মা বাবা খেয়েছেন?’

‘জি।’

‘আর তুমি?’

‘নাহ্।’

রিদ কফির কাপটা টেবিলের উপর রেখে বলে,

‘তোমার চা নিয়ে এসো। একসাথে খাবো।’

রিদের কথায় তাহনা নিচ থেকে তার জন্য রাখা এক কাপ চা নিয়ে উপরে তাদের রুমে আসে। রিদ তাহনাকে তার পাশে বসতে বলে। তাহনা রিদের পাশে বসে। এদিকে রিদের হাবভাব কিছুই বুঝতে পারছে না তাহনা। একসাথে দুজন চা কফি খেয়ে নিল।

*
অফিসে যাওয়ার জন্য রেড়ি হচ্ছিল রিদ। তাহনা রিদের সব জিনিস গুছিয়ে দিল। রিদ রেড়ি হতে হতে বলল,

‘এখানে থাকতে তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে তাহনা?’

‘কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো৷ কেন?’

‘তোমার জামা কাপড় যা আছে সব গুছিয়ে রেখেছো তো? আমার রুমে বেশি জিনিস নেই। ভাবছি তোমার জন্য একটা ডেসিং টেবিল আনিয়ে রাখবো। তোমার যা জিনিসপত্র আছে সব সাজিয়ে রেখো।’

‘আরে, তার প্রয়োজন নেই। আমি আলমারি তে সব রেখেছি।’

রিদ তাহনার সামনে এসে দাঁড়ালো। একটা মুচকি হাসি দিয়ে তাহনাকে কাছে টেনে নিল রিদ। তারপর পরম আবেশে তাহনার কপালে একটা চুমু এঁকে দিল। তাহনা বিস্ময় চোখে তাকিয়ে রইলো রিদের দিকে। রিদ তাহনার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বলল,

‘প্রত্যেক স্ত্রীই চায় তার স্বামী তার জন্য এমন কিছু করুক যা তার দায়িত্ব থেকে ভিন্ন হোক।’

তাহনা রিদের কথার মানেই বুঝেনি। তাদের মাঝে নেই কোনো ভালোবাসার সম্পর্ক। তাহলে এটা কি একটা দায়িত্ব মাত্র? কিন্তু এটা তো দায়িত্বের মধ্যে পড়েনি। ভালোবাসা ছাড়া তো কিছুই সম্ভব নয়।

রিদ তাহনার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেল। এদিকে তাহনা হিসেবে মিলাচ্ছে। রিদ তার কথার মাঝে কি বুঝালো?

.
রিদের মা মিসেস ফাবিহা তাহনার হাত ধরে তাকে ওনার রুমে নিয়ে আসেন। তারপর তাহনাকে বিছানায় বসিয়ে আলমারি খুলতে থাকেন। তাহনা ভয় পাচ্ছে রেগে কিছু বলবে না তো তাকে? রিদের মা আলমারি থেকে একটা স্বর্ণের নেকলেস বের করলেন। তারপর তাহনার গলায় ওটা পড়িয়ে দিয়ে বললেন,

‘এটা কখনো খুলো না তাহনা। এটা আমার মায়ের শেষ স্মৃতি।’

তাহনা বিস্ময় চোখে তাকিয়ে থাকে রিদের মায়ের দিকে।

‘আপনি এটা আমায় কেন দিচ্ছেন মা? আমি যদি এটা যত্ন করে রাখতে না পারি?’

‘তোমার উপর আমার বিশ্বাস আছে। বসো এখানে কিছু কথা বলি তোমাকে।’

তাহনা আর রিদের মা বিছানার উপর বসলেন। তারপর রিদের মা বললেন,

‘দেখো তাহনা আমার বিহেভিয়ারে তুমি কষ্ট পেও না। আমি নিজেও বুঝতেছিনা আমি এটা কেন করছি? যেখানে আমিই তোমাকে আমাদের এখানে থাকতে দিয়েছিলাম। আমিই তোমাকে মেয়ের মতো দেখতাম। সেখানে হঠাৎ করে তোমাকে নিয়ে খারাপ চিন্তা আমার মাথায় চলে এলো। সে-ই থেকেই তোমার উপর রেগে কথা বলেছি। তোমাকে অনাথ বলেছি। কিন্তু আমার এটা করা উচিৎ হয়নি। তুমিও আমার মেয়ে। আমার ছেলের বউ হিসেবে তোমার মতো ঘরোয়া মেয়েই আমার পছন্দ ছিল। কিন্তু হুট করেই কেন জানি আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। আমি তোমাকে মানতেই পারছিলাম না। কিন্তু তুমি চিন্তা করো না আর এমন হবে না। মনে কষ্ট নিবে না প্লিজ।’

‘আমি কি একটু আপনাকে জড়িয়ে ধরতে পারি মা?’

তাহনার চোখ টলমল করছে। রিদের মায়ের সম্মতি পেয়ে তাহনা ঝাপটে জড়িয়ে ধরে রিদের মা’কে৷ কাঁন্না শুরু করে দিয়েছে।

‘আমাকে আজ পর্যন্ত কেউ বলেনি তুমি আমার মেয়ে। আপনিই প্রথম নারী যিনি আমাকে বলেছেন আমি তার মেয়ে। জানেন অনেক মিস করতাম মা’কে। কিন্তু মায়ের ভালোবাসা কখনোই পাইনি। আমার বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছেন। কিন্তু মেয়েরা তার মা’য়ের ভালোবাসা পেতে বড্ড আশাবাদী। বাবারা মেয়েদের এমনিতেই ভালোবাসেন। মেয়েরা চায় মায়ের আচলের সুগন্ধ নাকে নিতে। মাকে জড়িয়ে ধরে তার শরীরের ঘ্রাণ নিতে। আমার কেউ নেই মা। আমার সেই সৌভাগ্য হয়নি। তাই আমি আপনাকে মা বলেই ডাকবো।’

মিসেস ফাবিহা তাহনার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,

‘আরে বোকা মেয়ে, কাঁদছ কেন? আমিই তো তোমার মা। আজ থেকে আমার দুটো মেয়ে। কাঁন্না থামাও।’

দরজার পাশ থেকে তাহনা আর মা’য়ের ভালোবাসা দেখছে রাইশা। তাহনার মনে কতটা কষ্ট। কিন্তু কখনো প্রকাশ করেনা। তাহনার জন্য রাইশার অনেক খারাপ লাগছে। কিন্তু অনেক ভালো লাগছে তার মা তাকে মেয়ে হিসেবে বরণ করে নিয়েছেন বলে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here