‘এই যে মিস! বিয়ে থেকে পালিয়ে আসছেন নাকি? রাস্তার মধ্যে এভাবে দৌড়াচ্ছেন কেন?’
বিয়ের লেহেঙ্গা পড়ে রাস্তার মধ্যে দৌড়াচ্ছিল তাহনা। পিছন থেকে কারো কথার আওয়াজ পেয়ে থেমে যায় সে। পিছন ঘুরে একটা ছেলেকে দেখেতে পায় তাহনা। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি। ফরমাল গেটাপে, এরকম তো বড় কোনো পোস্টে থাকা অফিসারদের পড়তে দেখা যায়। চোখে কালো সানগ্লাস লাগানো। সে দ্রুত ছেলেটির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর ছেলেটির কাছে হাতজোর করে বলে,
‘প্লিজ হেল্প মি। আপনার ফোন হবে? আমি না খুব বিপদে পড়েছি।’
ছেলেটি কিছুক্ষণ তাহনার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
‘ইয়াহ। বাট আপনি এই নির্জন রাস্তায় এই পোশাকে কেন? এই রাস্তাটা ভালো না।’
তাহনা আবারও বলল,
‘আই হ্যাভ নো আইডিয়া। এই মুহুর্তে আমাকে একটা কল করতে হবে। আমার বয়ফ্রেন্ড আমার জন্য ওয়েট করছে। কিন্তু আমি ফোন টা বাড়িতে ফেলে চলে এসেছি।’
তাহনার এমন কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে ছেলেটি মনে মনে হাসলো। তারপর নিজের হাতে থাকা ফোন টা তাহনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘নিন। তবে পাঁচ মিনিটের মধ্যে কথা শেষ করবেন। এর থেকে বেশি এক মিনিট দেরি হলে আমার ফোন আমি নিয়ে নিব।’
তাহনা ছেলেটির কথা শুনে মনে মনে বলে,
‘এহহ,,ঢং। আমার ফোন আনলে কি আপনার ফোন নিতাম?’
ছেলেটি ফোন দিতেই তাহনা দ্রুত ফোন টা নিয়ে তার চেনা নাম্বারে কল দেয়। দুবার রিং হতেই ফোন টা রিসিভ হয়। কেউ ফোনের ওপাশ থেকে বলে,
‘কে?’
তাহনা বলে,
‘হ্যালো, তানভির? আমি। তাহনা। তুমি কোথায়? আমি তোমার দেওয়া ঠিকানায় এসে গেছি। মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছি। তাড়াতাড়ি আসো প্লিজ।’
‘তাহনা। দেখো। আমি তোমাকে নিয়ে আসতে পারবো না।’
তাহনা অবাক হয়ে বলে,
‘তানভির কি বলছ তুমি এসব? তুমি আমায় না নিয়ে গেলে আমি কোথায় যাবো? তোমার জন্যই তো আমি বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে এসেছি।’
তানভির একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘দেখো তাহনা। আমি তোমাকে কোনদিনই ভালোবাসিনি। আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। আর ও আমাকে ডেয়ার দিয়েছিল কাউকে প্রপোজ করে তার সাথে প্রেমের নাটক করার। তাই তোমার সাথে আমি জাস্ট ভালোবাসার নাটক করেছি। সরি তাহনা। বাসায় চলে যাও। বিয়ে করে ফেল।’
তানভির আর কিছু না বলেই ফোন কেটে দিল। এদিকে তাহনা “তানভির” “তানভির” করে কোনো সাড়া পায়নি ফোনের ওপাশ থেকে। তাহনা বারবার ফোন দিচ্ছে। কিন্তু বারবারই সুইচঅফ আসছে। তাহনা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিল। তাহনার কানে বাজতে থাকে তানভিরের বলা কথাগুলো। তাহনা হঠাৎ চিৎকার করে উঠে। চিৎকার করে কাঁদছে সে। আকাশ থেকে ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। বৃষ্টির পানিতে তাহনার চোখের জল মিলিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে এতক্ষণ ধরে তাহনার বলা কথাগুলো সব শুনছিল ছেলেটি। হঠাৎ তাহনার চিৎকার করে কান্না করে উঠায় ছেলেটি বেশ অবাক হয়ে যায়। কি হলো হঠাৎ যে মেয়েটা এভাবে কাঁদছে? ছেলেটি তাহনার কাছে গিয়ে বলে,
‘এই যে শুনছেন? বৃষ্টি পড়ছে। এভাবে রাস্তার মধ্যে না ভিজে চলুন গাড়িতে গিয়ে বসবেন।’
তাহনা ছেলেটির দিকে একবার তাকিয়ে ছেলেটিকে তার ফোন টা দিয়ে চলে যেতে নেয়। মুহূর্তেই ছেলেটি পিছন থেকে আবারও বলে উঠে,
‘আরে, কোথায় যাচ্ছেন? দেখুন। আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। রাস্তাটা ভালো না, আগেও বলেছি আপনাকে।’
তাহনা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। এক মনে ভাবতে থাকে তানভিরের বলা কথাগুলো। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না সে তানভির তার সাথে এমন করতে পারে। তাহনার অশ্রুর বেগ আরো বাড়ল। তাহনার ভাবনার মাঝেই ছেলেটি তাহনার হাত ধরে নিজের গাড়িতে বসালো। তাহনা এখনো ঘোরের মধ্যে আছে। তার শুধু মনে হচ্ছে কেন সে তানভির কে এতো বিশ্বাস করেছে? কেন ভালোবেসেছে? কেন ওর জন্য এতটা পথ ছুটে এসেছে? বিয়ে করবেই না যখন তাহলে কেন তাকে আসতে বলেছে? কিভাবে পারল তানভির ওর সাথে এতো বড় গেইম খেলতে? ওর অনুভূতির কি কোনো মূল্য নেই?
তাহনা চোখ মুছে যখন সামনে তাকালো, গাড়ির কাঁচ দেখে সে ভড়কে গেল। সে এদিকে ওদিক তাকিয়ে দেখে ওই ছেলেটি তার পাশের সিটে বসে ড্রাইভিং করছে। তাহনা ভাবতে লাগলো, সে গাড়িতে কি করে এলো? তাহনার ভাবনার মাঝেই ছেলেটি বলে উঠে,
‘এত ভাবার কিছু নেই। আপনাকে আমিই গাড়িতে উঠিয়েছি।’
তাহনা ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘কেন উঠিয়েছেন আমাকে? আমি বলেছি আপনাকে?’
ছেলেটি হতভম্ব হয়ে গেল।
‘আমি আপনাকে সাহায্য করলাম, আর আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন?’
তাহনা রেগে গিয়ে বলে,
‘দরকার নেই আমার কারো সাহায্য। আমার কারো দয়ার দরকার নেই, কারো ভালোবাসার দরকার নেই। কারো মায়ার দরকার নেই।’
কথাগুলো বলেই তাহনা হুঁ হুঁ করে কাঁদতে থাকে। যা দেখে ছেলেটি বুঝতে পারে যে, তাহনার এখন খুব মন খারাপ। ওই ফোন টা করার পর থেকেই তার মন খারাপ। আচ্ছা? ওর বয়ফ্রেন্ড ওকে কিছু বলেনি তো? যার জন্য এমন করছে মেয়েটি? এসব ভাবতে ভাবতে ছেলেটি গাড়ির ব্রেক কষে। যা দেখে তাহনা কান্না থামায়।
তাহনা বাইরের চারপাশে তাকিয়ে দেখে যে, তারা একটা বিশাল বড় বাড়ির সামনে এসে পৌঁছেছে। এতক্ষণে বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। ছেলেটি গাড়ি থেকে নেমে তাহনার জন্য গাড়ির দরজা খুলে দেয়। তাহনা চুপ করে ছেলেটির কার্যকলাপ দেখছে। ছেলেটি তাহনা কে তাড়া দিয়ে বলে,
‘নেমে পড়ুন। এটা আমার বাড়ি।’
‘আমাকে কেন নিয়ে এসেছেন? আমি আসব বলেছি?’
‘ম্যাম। আগে আপনি ভিতরে চলুন। আমি এরপর আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসব আপনার বাসায়।’
‘আপনার সাহস দেখে আমি অবাক হই। আপনি ভাবলে…’
তাহনার কথার মাঝেই একটা মেয়ে এসে ছেলেটিকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। মুখে এক ঝিলিক হাসি নিয়ে বলে,
‘ভাইয়ু? তুমি এসে গেছ? আম…’
কথায় মাঝেই মেয়েটির চোখ গেল গাড়িতে বসে থাকা তাহনার দিকে। পড়নে লেহেঙ্গা, গা ভর্তি গয়না আর বউয়ের সাজ দেখে মেয়েটির চোখ বড় বড় হয়ে গেল। কথা যেন তার গলায় আটকে গেল। তাহনা মেয়েটির তাকানো দেখে ঠোঁট চেপে সরু চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটি মুখে অস্থিরতার ছাপ নিয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ভাইয়ু? তুমি বিয়ে করেছো? মা?’
মেয়েটি “মা” “মা” বলতে বলতে দৌড়ে বাড়ির ভিতরে চলে যায়।
এদিকে ছেলেটি তাহনার দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলে,
‘আপনি আর কতক্ষণ ভিজে কাপড়ে থাকবেন? ভিতরে চলুন। আমার বোন আপনাকে পড়ার জন্য ড্রেস দিবে। চেঞ্জ করে নিবেন।’
তাহনা কিছুক্ষণ ভেবে তারপর গাড়ি থেকে নেমে যায়। ছেলেটি আগে আগে আর তাহনা ছেলেটির পিছনে হাটতে থাকে। গেইট দিয়ে ঢোকার সময় দারোয়ান মুচকি হেসে ছেলেটিকে বলেন,
‘রিদ বাবা? বউ নিয়া আইছো?’
ছেলেটি পড়লো মহা ঝামেলায়। সবাই ভাবছে সে বিয়ে করে ফেলেছে। কিন্তু সত্যি টা যে অন্য কিছু। তাহনা হতবিহ্বল চাহনিতে তাকিয়ে আছে দারোয়ানের দিকে।
বাড়ির ভিতরে ঢুকে যখন ছেলেটি তাহনা কে নিয়ে ড্রয়িংরুমে গেল, তখন তাদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে এক ভদ্রমহিলা আর সেই মেয়েটি। ভদ্রমহিলা ছেলেটির কাছে এসে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর ছেলেটি কে উদ্দেশ্য করে বলেন,
‘রিদ? তুই বিয়ের দাওয়াতে গেছিলি। এখন তুই নিজেই বিয়ে করে ফেললি?’
তাহনা ছেলেটির নাম এখন জানলো। রিদ!
রিদ বিরক্ত নিয়ে বলল,
‘মা। আমি বিয়ে করিনি। আমি বিয়ে বাড়িতেও যাইনি। ওনাকে আমি রাস্তার মধ্যে পেয়েছি। আসলে উনি বিয়ে থেকে পালিয়ে এসেছেন। নিজের প্রেমিকের সাথে চলে যাবেন বলে। কিন্তু ওনার প্রেমিক আসেনি বোধয়। হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় উনি ভিজে যাচ্ছিলেন। তাই ওনাকে আমি আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। বনু? ওনাকে তোর রুমে নিয়ে যা। তোর একটা ড্রেস পড়ার জন্য দিস। আমি ওনাকে সন্ধ্যায় ওনার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবো।’
বাড়ির কথা শুনে তাহনার বুক কেঁপে উঠল। এতক্ষনে নিশ্চই বাড়িতে শোরগোল হচ্ছে? বাবা কে কি জবাব দিবে সে। সে দ্রুত রিদ কে বলল,
‘প্লিজ আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসবেন না। আমি বাড়ি যাব না। ও,,ওই আ,,আমার বান্ধবীর বাসায় যাব। আমাকে ওখানে দিয়ে আসলেই হবে।’
রিদের মা কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললেন,
‘তোমার সাথে কি হয়েছে ঠিক বলবে?’
তাহনা সব বলতে শুরু করে।
‘আমি আসলে একজন কে খুব ভালোবাসতাম। বাড়ি থেকে হুট করেই বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। বাবা কেও বলতে পারিনি কিছু। তাই সিদ্ধান্ত নেই বিয়ের দিন পালিয়ে যাব। আমি আমার প্রেমিকের কথামতো তার দেওয়া ঠিকানায় আসলেও তার আসার কোনো নাম গন্ধই পাইনি। ওখান থেকে সামনের দিকে দৌড়ে যেতে নিলেই ওনার ডাকে পিছন ফিরি। তারপর আর কিছু না ভেবেই ওনার কাছে হেল্প চাই ফোন দেওয়ার জন্য। আমার ফোন টা বাড়িতে ফেলে এসেছিলাম। উনি আমাকে ওনার ফোন দিলে আমি আমার প্রেমিকের কাছে ফোন দিই। কিন্তু…’
এইটুকু বলেই তাহনা নিচের ঠোঁট চেপে ধরলো, চোখে তার অশ্রু নামার প্রস্তুতি। যা চোখ এড়ায়নি রিদের। রিদের মা আগ্রহ নিয়ে নিয়ে তাহনা কে জিজ্ঞেস করে,
‘তারপর কি হয়েছে? তোমার প্রেমিক আসেনি?’
তাহনা বলতে থাকে।
‘নাহ্ আসবে না বলেছে। সে নাকি আমাকে কোনোদিন ভালোইবাসেনি। তার গার্লফ্রেন্ড আছে। এটা নাকি একটা ডেয়ার ছিল তার কাছে। কারো সাথে ভালোবাসার অভিনয় করার। আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে বলেছে। আমি যেন বিয়ে করে নেই।’
কথাগুলো বলেই কেঁদে উঠলো তাহনা। কাঁদতে কাঁদতে আবারও বলল,
‘আমাকে বাড়ি যেতে বলবেন না প্লিজ। বাড়িতে গেলে আমি আমার বাবাকে মুখ দেখাতে পারবো না।’
রিদের মা একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে মেয়েকে বললেন,
‘রাইশা ওকে তোর রুমে নিয়ে যা। মেয়েটা ভিজে গেছে।’
রাইশা মুচকি হেসে মা’কে বলে,
‘ঠিকাছে মা। আসো।’
তাহনা রাইশার পিছু পিছু তার রুমে চলে যায়।
এদিকে রিদের মা তার হাত ধরে সোফাতে বসায় তাকে। তারপর নিজেও বসে পড়েন।
‘আমি কি কোনো ভুল করেছি মা?’
রিদের কথায় রিদের মা মুচকি হেসে তার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলেন,
‘নাহ্। কিন্তু তোর বাবা জানলে কি হবে আল্লাহই জানেন। অফিস থেকে ফেরার সময় হয়ে গেল।’
‘চিন্তা করো না মা। বাবাকে আমি সামলে নিব।’
‘তা বুঝলাম। কিন্তু তুই বিয়ে বাড়িতে যাসনি কেন?’
‘যাচ্ছিলামই তো। তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য শর্টকাট রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন চারপাশের সৌন্দর্য দেখে গাড়ি থেকে নেমে পড়ি। পরিবেশ টা দেখতে উপভোগ করি। তখনই ওনার সাথে দেখা।’
রিদের মা মন খারাপ নিয়ে বললেন,
‘একটা গেইমে জেতার জন্য মেয়েটার মন নিয়ে খেললো ওর প্রেমিক? বাচ্ছা মেয়েটা বেশ ভেঙে পড়েছে রে।’
রিদ কিছু বলে না। দাঁড়িয়ে যায় সে। নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়। মেয়েটা কে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারলেই তার শান্তি।
চলবে….
#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ১ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
(শব্দ সংখ্যা – ১৪৬৪)
[আসসালামু আলাইকুম। অনেক দিন পর নতুন গল্প দিলাম। সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।]