#প্রিয়তার_প্রহর
সমাপ্তি পর্ব (২০)
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
শীতল পবন ছড়িয়ে রয়েছে বসুন্ধরায়। ঘাসের বুকে শিশির বিন্দু জমে আছে। প্রিয়তা ক্ষণসময় ধরে বিমূঢ়, নিস্তব্ধ। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে প্রিয়তার কায়া। অস্থির অস্থির লাগছে। পুরুষের প্রথম আদর মাখা স্পর্শে নেতিয়ে গিয়েছে সে। নেত্রপল্লব ভিজে একাকার প্রিয়তার। পছন্দের মানুষের এই মিষ্টতা সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে প্রিয়তা। ওষ্ঠদ্বয় আর কণ্ঠ শুষ্ক হয়ে আসছে। প্রহর বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করে দিল প্রিয়তার গালে। অবাকের শেষ সীমানায় এসে প্রিয়তা নড়েচড়ে উঠল। বা হাত দ্বারা খামচে ধরল প্রহরের পিঠের শার্টের অংশ। চোখ বুজে ফেলল। প্রহর হাসল নিঃশব্দে। মুখ গোল করে ফু দিয়ে প্রিয়তার ক্ষুদ্র চুলগুলো উড়িয়ে দিল ললাট থেকে। প্রিয়তা চোখ মেলল। চেয়ে রইলো খানিকক্ষণ। প্রহরের চোখের দিকে তাকিয়ে অস্থির ঠেকল। ছেড়ে দিল শার্টের অংশ। থতমত খেল সে। নিজের এহেন কাজে লজ্জা পেল ভিষণ। অপমানিত হলো মনে মনে। নিজেকে নির্লজ্জ, বেহায়া উপাধিতে ভূষিত করে দিল। মাথা নুইয়ে প্রিয়তার দ্বন্দ কাটল। প্রহর এখনো নেশালো চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। প্রিয়তা সেই চোখের দিকে তাকিয়ে ঘোর ভাঙল। হুট করেই ভিষণ রাগ হলো তার। প্রহরের প্রতি রাগে দিক্বিদিক হারিয়ে প্রিয়তা চোখ গরম করে তাকাল। কঠিন চাহনি নিক্ষেপ করে বলে উঠল,
” আপনার সহানুভূতির আমার প্রয়োজন নেই। আমাকে ছুঁয়েছেন কেন? পুলিশ হয়েও এমন ব্যবহার?
” পুলিশ বলে কি আমাদের অনুভূতি নেই প্রিয়?
” আমাকে প্রিয়তা বলে ডাকবেন।
” যদি না ডাকি?
” আপনি কি করতে চাইছেন হ্যাঁ? লিরা আপু এসব দেখলে কি ভাববে? ছিঃ! চলে যান।
‘ লিরা কি ভাববে?
” জানি না। আপনি আমার আশপাশে ঘেঁষবেন না। আরহামের থেকেও দূরে থাকবেন। আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।
” আমি যদি তোমার থেকে দূরে থাকি তুমি খুশি হবে?
” হবো।
” কিন্তু আমি হবো না।
” আপনার কথার মানে বুঝতে পারছি না।
” কারণ তুমি বোকা।
” হ্যাঁ। চালাক হবার দরকার নেই। বোকা হওয়াই ভালো। আপনার মতো চালাক নই বলেই স্বস্তিতে আছি।
” এমন বোকা মেয়েই আমার পছন্দ। সত্যিই।
প্রিয়তা হতভম্ব। সামনে থাকা মানুষটার এমন অভিব্যক্তি কখনো দেখেনি সে। যখন দেখল তখন দুরত্ব বেড়ে গিয়েছে মাইল মাইল। চাইলেও সেই দুরত্ব মিটিয়ে কাছে আসার উপায় নেই, ভালোবাসার উপায় নেই। সবটা ভেবে প্রিয়তার ভারী রাগ হলো। চক্ষুদ্বয় শীতল হলো। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে খানিক উচ্চস্বরে বললো,
” পুলিশম্যান, আপনি আপনার লিমিট ক্রস করছেন। হ্যাভ ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড? দুদিন বাদে আমরা এখান চলে যাবো। এরপর আপনার সাথে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হবে কি না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আবার দুদিন বাদে আপনার বিয়ে। আপনি কোন সাহসে আমাকে ছুঁয়েছেন? কোন মুখে পছন্দ কথাটা উচ্চারণ করছেন?
” কার বিয়ে? আশ্চর্যিত হয়ে গেল প্রহরের অভিব্যক্তি।
‘ ঢং করবেন না। আপনি জানেন না?
” আমি জানি না। বলো প্রিয়তা।
” লিরা আপুর সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। সে কারণেই আপু এখানে এসেছে। সত্যিই জানেন না এসব?
” এখন জানলাম। এসব কথা তুমি কিভাবে জানলে?
” তা আপনার না জানলেও চলবে
প্রিয়তা পা বাড়িয়ে ঘরে ঢুকল। প্রহর তাকিয়ে রইল কয়েক পল। চোখের ভাষা বোঝার উপায় নেই। সেই চোখ প্রত্যেকবারে মতোই স্থির, দৃঢ়, তীক্ষ্ম, বাব দিতে বললো,
” এজন্যই এত দূর দূর করছো। বেশ, দূরেই যাচ্ছি। তুমি সইতে পারবে তো প্রিয়? কষ্ট হবে না?
_________
প্রীতিলতার সুখের সংসার। শ্বশুর আর স্বামী যথেষ্ট ভালো। শাশুড়ি বয়স্ক মানুষ। সারাক্ষণ খিটখিটে মেজাজে থাকে। ছোট ছোট কারণেও চিল্লাপাল্লা করার স্বভাব মহিলার। মাঝে মাঝে প্রীতিলতার তর্ক হয় শাশুড়ির সাথে। যুদ্ধ বেধে যায়। পরিস্থিতি জটিল হয়ে আসে। তবুও স্বামী ভালো বলে প্রীতিলতার যায় আসে না। আজিজ মোর্শেদ উচ্চবিত্ত পরিবারের বড় সন্তান। সুখ শান্তি সবটাই দেওয়ার চেষ্টা করে সে।
প্রীতিলতা ঘুমিয়ে আছে। বেশ কয়েকদিন ধরে ঘুমটা বেড়েছে। আজ রবিবার বলে অফিস নেই। দুপুর অবধি ঘুমানোর ইচ্ছে নিয়ে রাতে ঘুমিয়েছিল সে। কিন্তু সেই সাধের ঘুম তার হলো না। শাশুড়ি সকাল আটটা বাজতেই কড়া নাড়ল প্রীতিলতার ঘরে। অসম্ভব তেজী মহিলা খাইরুন নাহার। তার ছেলে আজিজের কয়েক বছর আগে বিয়ে হয়েছিল অসম্ভব রূপবতী এক মেয়ের সাথে। মেয়ের যেমন রুপ, তেমনই গূণ। হাতে কর্মে নিপুণ মেয়েটার কি যে এক রোগ হলো? বিয়ের ছ মাসের মাথায় মারা গেল মেয়েটা। এরপর থেকে খাইরুন নাহার আরো বেশি খিটখিটে হয়ে গিয়েছেন। পছন্দের বউমার এহেন মৃত্যুতে শোকাহত তিনি। পরবর্তীতে তিনি ভেবেছিলেন ছেলের জন্য সংসারী, কম বয়সী মেয়ে নিয়ে আসবেন। কিন্তু সেগুড়ে বালি, ছেলে পছন্দ করলো এমন একটি মহিলাকে যার দু দুটো ছেলেমেয়ে আছে। ছেলের বয়স ব্যাপার না। “সোনার আংটি বাঁকাও ভালো” এই কথাটা খুব মানে খাইরুন। ঠিক সময়ে প্রিয়তা নামের মেয়েটার বিয়ে দিলে এখন নাতি-নাতনি নিয়ে খেলতে পারতো প্রীতিলতা। যদিও প্রীতিলতা দেখতে আহামরি সুন্দর, রুপ সৌন্দর্যে ভরপুর তার নারীদেহ। শরীরে এক ফোঁটা মেদ নেই। দেখে মনে হয় না বয়স এত বেশি। তবুও মন মানে না খাইরুনের। ছেলের এহেন পছন্দে নিরাশ তিনি।
বারবার দরজা ধাক্কানোর ফলে রেগে বেরিয়ে আসল প্রীতিলতা। বড়সড় হাই তুলে তেজী কণ্ঠে তাকাল। দাঁত চিবিয়ে বললো,
” এত সকালে ডাকছেন কেন মা? আজ ছুটির দিন। আপনাকে বলেছিলাম অনেকক্ষণ ঘুমাবো। শুনতে পাননি?
শাড়ির আঁচল টেনে ভেংচি কাটলেন খাইরুন। তিনিও রাগী কণ্ঠেই বললেন,
” ঘুমাইলে রান্দাবান্দায় কেডায় করবো? না খাইয়া থাকুম নাকি সবাই?
” আমি তো কাজের লোক রেখেই দিয়েছি। আপনার মাথা খারাপ হয়েছে? আমাকে রান্না করতে ডাকছেন কেন?
” ওই কাজের ছেড়িরে আমি ছুটি দিছি। প্রত্যেকদিন যদি ওর রান্দা খাইতে হয় তাইলে পোলারে বিয়া করাইছি কিসের লাইগা?
” আমি তো বসে বসে খাই না। চাকরি করি। মাস শেষে মোটা অঙ্কের টাকা সংসারে দেই। আমাকে কিভাবে কাজ করতে বলেন? আশ্চর্য।
” ব্যবহার ভালো করো। শাশুড়ির লগে ক্যামনে কথা কইতে হয় জানো না। চিবাইয়া কথা কউ ক্যান? আগের ঘরের তো শাশুড়ি ছিল না। বুঝবা ক্যামনে শাশুড়ি কি জিনিস।
” আপনার সাথে কথা বলে মেজাজ নষ্ট হচ্ছে। কাজের লোককে ছুটি দিয়েছেন যখন তখন রান্না করুন। আমি এসবে নেই। আমাকে ঘুমোতে দেন।
আজিজ ঘুম থেকে উঠে মা আর স্ত্রীর এমন তর্কাতর্কি দেখে ভ্রু কুঁচকাল। মায়ের প্রতি অবাধ ভালোবাসা আজিজের। আজিজের একটি মাত্র বোন আছে। বোনটা চায় মাকে নিজেদের কাছে রাখতে। কিন্তু আজিজ তাতে রাজি নয়। মাকে ছাড়া দুদণ্ড থাকতে পারে না সে। এক কথায় আজিজকে সবাই ঠাট্টা করে বলে “মাম্মাস বয়”।
আজিজ উঠে শার্ট গায়ে জড়াল। ঘুম ঘুম চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
” কি হইছে মা?
‘ দ্যাখ তোর বউরে কইছি একটু রানতে। তোর বউ কতডি কথা শুনায় দিল। কি হ্যার ব্যবহার দ্যাখ।
প্রীতিলতা চেতে গেল। ভয়ঙ্কর চাহনী নিক্ষেপ করে বলে উঠল,
” মিথ্যা বলবেন না। আপনিই সকাল সকাল ঝগড়া করতে এসেছেন। সপ্তাহে দুটো দিন বাড়ি থাকি। এই দুদিনে জীবনটাকে দুর্বিসহ বানিয়ে দেন। সমস্যা কি আপনার?
আজিজ মোর্শেদ রেগে গেল ভিষণ। মায়ের সাথে এমন করে কেউ কথা বললে তার রাগ হয়। আজিজের বাবা ছিলেন সুদখোর। টাকা পয়সার কারবার করতে গিয়ে ধরা খেয়ে তিন বছর জেলে ছিল। এই তিন বছর খাইরুন-ই সংসারের হাল টেনে নিয়ে গিয়েছেন। তখন আজিজ খুব ছোট ছিল বলে তখন উপার্জন করতে পারেনি। সে কথা আজও স্মরণ করে আজিজ। মায়ের সাথে প্রীতিলতার এমন ব্যবহার দেখে চোখ পাকাল আজিজ। ক্ষুদ্ধ হয়ে বললো,
” তোমার সাহস বাড়ছে প্রীতি। মায়ের সাথে এমন ব্যবহার করছো কেন? আমি বিয়ের আগে বলিনি আমার মায়ের সব কথা শুনতে হবে?
” তোমার মা ও তো বিয়ের আগে ভালো ছিল। বিয়ের পর রঙ পালটেছে কেন?
খাইরুন নাহার বলে উঠল,
‘ কি করুম? বিয়া করার লাইগা ছটফট করতাছিলা। বাধ্য হইয়া বিয়াতে রাজি হইছি। এখন বুঝতে পারতাছি তোমার ব্যবহার কেমন।
প্রীতিলতা আজিজের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
” এমন মহিলাকে কিভাবে তুমি সহ্য করো? এমন ব্যবহার করলে আমি কিন্তু থাকবো না।
” এমন মহিলা মানে?
” ডাইনি।
ঠাসস করে প্রীতির গালে থাপ্পড় মারল আজিজ। রাগে মগজ টগবগ করে ফুটছে তার। লাল রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। চোখ পাকিয়ে ভয়ঙ্কর ভাবে তাকাল আজিজ। তেতে উঠল ততক্ষণাৎ। ক্রোধে ফেটে পরল। প্রীতির চুলের মুঠি ধরে সে বলে উঠল,
” যাবেই তো। ফুটফুটে একটা ছেলে আর অত ভালো একটা মেয়েকে যখন এক মিনিটে ছেড়ে আসতে পেরেছো তখন আমি আর এমন কী? তোমার কাছে নিজের স্বার্থই তো সব।
প্রীতিলতা গালে হাত দিয়ে হা করে তাকিয়ে রইল স্বামীর সম্মুখে। চোখ গোলাকার হলো। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আজিজের এমন আচরণ মানতে কষ্ট হলো প্রীতিলতার। যার জন্য ফুটফুটে একটা বাচ্চাকে ছেড়ে দিল, সুখের সংসার ছেড়ে দিল, নিজের মেয়েকে দিনের পর দিন মানসিক অত্যাচার করল, সেই লোকটাই প্রীতির গায়ে হাত তুলল? এত কিছু ছেড়ে কি পেল সে? মা ভক্ত ছেলেকে বিয়ে করে জীবনকে দুর্বিসহ করে তুললো? জীবনের কঠিন পরিস্থিতিতে আজিজ তার পাশে থাকবে এই ভেবেছিল প্রীতিলতা। পরকিয়ার সময়ে আরিফের মতো ভালো স্বামীকে তখন ভালো মনে হয়নি। ভালোবেসেছিল আজিজ কে। প্রেমে অন্ধ হয়ে অনেক মানুষকে ছেড়ে এসেছিল। সেই আজিজের এমন পরিবর্তন কেন হলো?
__________
তানিয়ার আজকাল ভারী সুখ সুখ লাগে। নতুন মানুষের আগমনে নিয়াজ শেখ উৎফুল্ল হয়ে উঠেছেন। সারাক্ষণ এটা ওটা নিয়ে তাসলিমা খাতুনের সাথে মান অভিমানের পর্ব চলছে তাদের মাঝে। এইতো সকালেই, সকালে তানিয়া ভাবল আজ রান্না করবে। তাসলিমা খাতুনকে এত দ্রুত সবটা ধরিয়ে দেবে না বলে ভেবেছিল। কিন্তু তানিয়া উঠে দেখে সে ওঠার আগেই তাসলিমা খাতুন উঠে গিয়েছেন। তানিয়া রান্না ঘরে গিয়ে দেখে তাসলিমা চা বানাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে রান্নাঘরে ঢুকল সে। জিজ্ঞেস করল,
” আপনি এত সকালে উঠেছেন কেন আন্টি? রান্নাঘরেই বা এসেছেন কেন? আমিই তো আসছিলাম চা বানাতে।
তাসলিমা খাতুনের সৌন্দর্য দ্বিগুন হয়েছে নাকের ফুল পরায়। অন্য রকম লাগছে। মুচকি হেসে তিনি বললেন,
” নিজের সংসার নিজেকে গুছিয়ে নিতে হবে না? ভাবলাম আজ থেকেই স্টার্ট করি। তোমার বাবা আমাকে আসতেই দিবে না রান্নাঘরে। নিজেই নাকি রান্না করবে। তুমি নাকি খেয়ে তারপর থানায় যাবে। তাইতো আমি উনাকে বসিয়ে নিজেই নাস্তা আর চা বানাতে এলাম।
” বাবা উঠেছে?
” হ্যাঁ।
” আমি কোনো সাহায্য করবো আন্টি?
” আমাকে আন্টি বলেই ডাকবে? আড়চোখে কাপে চা ঢালতে ঢালতে মিষ্টি হেসে বলে উঠলেন তাসলিমা।
” আপনাকে আমি পছন্দ করি আন্টি। ভালোও বাসি। আমি আপনাকে আমার মায়ের জায়গা কখনো দিতে পারবো না। তাই বলে এমনটা নয় আপনার স্থান আমার হৃদয়ে নেই, আপনাকে ভালোবাসি না। আমার জীবনে আপনাদের দুজনের অবস্থান রয়েছে দু স্থানে। আপনি যেমন আমার মায়ের মতো হতে পারবেন না তেমনি। আমার মা ও আপনার মতো হতে পারবে না। দুজন দু দিক থেকে সেরা। কেউ কারো জায়গা দখল করতে পারবে না। আপনি আমার আন্টি হয়েই থাকুন। দেখবেন অমর্যাদা করবো না।
তাসলিমা খাতুন হাসলেন। রান্না করতে করতে তানিয়ার সাথে গল্প আরম্ভ করলেন। মাঝে মাঝে খিলখিল করে হাসলেন। রান্না টেস্ট করালেন তানিয়াকে দিয়ে। একসাথে খেতে বসে তানিয়া আজ পুরো পরিবার সামনাসামনি খেতে পেল বহু বছর পর। এই সুখ এতদিন দেখা যায়নি। ধরা ছোঁয়া যায়নি। পলকহীন ভাবে কেটে গিয়েছে বিধ্বস্ত সময়। রঙ বেরঙের মিছিল ঘুরে বেরিয়েছে সমতলে।
খেতে বসে নিয়াজ শেখ বললেন,
” আপনাকে বলেছিলাম রান্না বান্না করবেন না। সেই রান্না ঘরে ঢুকলেন-ই।
” স্বামী সন্তানের খেয়াল রাখতে হবে না? এর আগেও তো স্বামীর ঘর করেছি। এটা নতুন তো নয়।
নিয়াজ শেখ গম্ভীর হলেন। বিয়ের পরেরদিন বোধহয় প্রথম বিয়ের আলাপ শুনতে খারাপ লেগেছে উনার। অল্প ভাত খেয়েই উঠে পরলেন তিনি। বললেন,
” নতুনত্ব অনুভব করুন, দেখবেন ভালো লাগবে।
—
তানিয়া আপাতত বসে আছে কফিশপে।গতকাল আবিরকে বিয়েতে নিমন্ত্রণ করা হলেও আবির আসেনি। আবিরের বাবা-মা তখন ব্যবসায়ের কাজে শহরের বাইরে। হুট করেই কাজ পরায় চলে যেতে হয়েছে তাদের। তানিয়া ভেবেছিল আবির আসবে বিয়েতে। কিন্তু তানিয়ার ভাবনা ভুল প্রমাণিত করে গতকাল আবিরের পা তানিয়াদের বাড়িতে পরেনি। গতকাল একবার ও কথা হয়নি আবিরের সাথে।আজ থানায় পৌঁছানোর পূর্বে আবিরের কল এসেছে। তানিয়া কলটা ধরেছে ইচ্ছে না থাকলেও। তখন আবির এ কফিশপে আসতে বলেছে। খুব জরুরী কথা আছে বোধহয়। তানিয়াকে অপেক্ষায় রেখে দেরি করছে আবির। তানিয়া আর পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করবে ভাবল। আর তার ঠিক দু মিনিট মাথায় আবির প্রবেশ করল কফিশপে। তানিয়া নড়েচড়ে বসল। মন বলছে একটি ঝামেলা হবে তাদের মাঝে। আবির কোনো সুখবর দিতে আসছে না। আসলে গত কয়েকদিন ধরে আবিরের ব্যবহার মার্জিত ঠেকছে না তানিয়ার কাছে। এজন্য সবকিছুতেই নেগেটিভ চিন্তাভাবনার উদয় হচ্ছে।
আবির কফিশপে ঢুকল। পরণে তার জন্য সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট। চোখে ব্যান্ডের সানগ্লাস। চুলগুলো বেশ গোছালো। তানিয়াকে দেখে আবির সানগ্লাস খুলে শার্টের পকেটে রাখল। ক্রূর হাসল ছেলেটা। হাবভাব নিয়ে বসল তানিয়ার সম্মুখের চেয়ারে। টেবিলে দু হাত রেখে আবির খানিক গম্ভীর হয়ে বলে উঠল,
” আঙ্কেলের বিয়ে তবে দিয়েই দিলে।
তানিয়ার ললাটে ভাজ প্রতীয়মান হল। সম্মুখে অবস্থান করা যুবকের প্রতি বিতৃষ্ণা জেগে উঠল। এই বিষয়টা নিয়ে আবির কথা বলবে বুঝতে পারলে তানিয়া এখানে মোটেই আসতো না। গতকাল নিয়াজের বিয়েতে যায়নি বলে এমনিতেই তানিয়া রেগে আছে আবিরের উপর। তার পর এখানে ডেকে এ ধরনের কথা শুনে তিক্ততায় ছেয়ে গেল তার হৃদয়। আবিরের চোখে চোখ রাখল সে। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে উঠল,
” হ্যাঁ দিলাম।
” তুমি পুলিশ অফিসার বলে আমি খুব প্রাউড ফিল করতাম। কিন্তু তুমি যা করলে তার পর তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার গভীরতা কমছে। তা কি তুমি বুঝতে পারছো না?
” ভালোবাসা কি নিতান্তই তুচ্ছ জিনিস আবির? যে একটু কিছু হলেই ভালোবাসা কমে যাবে? গভীরতা মিলিয়ে যাবে? ভালোবাসা ঠুনকো নয় আবির। আপনি অযথাই মোহ কে ভালোবাসা বলে আখ্যায়িত করছেন।
” ইনস্টাতে তুমি আঙ্কেল আর আন্টির ছবি পোস্ট করেছো। আমার কলিগরা সেই পোস্ট দেখেছে। আমাকে নিয়ে হাসছে রীতিমত। এটা আমার জন্য কতটকু অসম্মানের তা তুমি জানো না? কেন আমার অবাধ্য হলে?
” বাবার খুশির দিনটা সবার সাথে ভাগ করেছি। এতে অন্যায় কিছু দেখছি না। শুনে রাখুন আজ যারা এই বিষয়টা নিয়ে হাসছে তারা নোংরা মস্তিষ্কের মানুষ। এদের কাছে ভালোবাসা মানে শুধু যৌবনের তারনা।
” তানিয়া। রেগে চিৎকার করে নামটা বলে উঠল আবির।
” চিৎকার করবেন না। এটা আপনার বাড়ি নয়। ম্যানার্স জানেন না?
” ওয়েল আমার ম্যানার্স নেই। শোনো, আমি তোমাকে বিয়ে করছি না। আঙ্কেলকে আমি গতকাল রাতে কল করে বলে দিয়েছি। আঙ্কেলকে বোঝাবে কেমন?
” বাবাকে এইসব বলেছেন কেন? বাবা কি ভাববে? বাবা ভাববে তার বিয়ের কারণেই আমার বিয়ে ভেঙেছে। বাবা খুব কষ্ট পাবে। কেন সবটা বলেছেন?
” কারণ তুমি আমায় বাধ্য করেছো। আমি বি রক্ত তোমার কাজকর্মে।
” আর বিরক্ত হতে হবে না। আজ এখানেই সম্পর্কের ইতি টানছি আমরা। আল্লাহ্ হাফেজ।
তানিয়া ফোস করে শ্বাস টানল। জটিলতা আর ভালো লাগছে না। ভাগ্যিস এ সময় বাবার বিয়ে দিয়েছিল সে। নয়তো আবিরের এমন মন মানসিকতার সাথে পরিচিত হতে সময় লাগতো। হয়তো ততদিনে একটা বৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়ে কষ্ট পেত সে। তানিয়া পার্স হাতে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো। আর কাউকে আটকাবে না সে। জীবন যেদিকে নিয়ে যাবে সে দিকেই এগোবে। অনেক মানুষের মুখোশ দেখবে জীবনে। তবেই কিছু অর্জন করতে পারবে।
________
প্রিয়তা প্রস্তুত হচ্ছে। নিজের বাসায় আবার ও পা রাখবে প্রিয়তা। আগের বার প্রহর সাথে ছিল বলে প্রিয়তার কোনোরূপ ভয় হয়নি। কোনো খারাপ লাগা কাজ করেনি। আজ খুব নার্ভাস লাগছে প্রিয়তার। আবারো কতদিন পর আরিফের মুখোমুখি হবে সে। সম্পত্তি ভাগ বাঁটোয়ারা করার জন্য দাবি জানাবে। আচ্ছা আরিফ হোসাইন কি ভাববে? প্রিয়তাকে খুব লোভী ভাববে উনি? ভাববে প্রিয়তা তার দয়া ছাড়া সমাজে টিকে থাকতে পারছে না?
প্রিয়তা বিবেকের কথা শুনল। এখন আবেগাপ্লুত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। আরহামের একটা ভবিষ্যত আছে। কেন ছেলেটা বাবার সম্পত্তি ছেড়ে এমন অসহায় জীবনযাপন করবে? আজ দাবি না জানালে সেই সম্পত্তি ভোগ করবে অন্য মানুষজন। আরহাম এমন দুর্বল ভাবে থাকবে এমনটা ভাবতে চায়না প্রিয়তা। আরহামর জীবন টা তাকেই গুছিয়ে দিতে হবে। সবার সাথে লড়তে হবে। নিজের আর আরহামের জায়গা পাকাপোক্ত করতে হবে।
আরহাম প্রিয়তার সাথে অভিমান করেছে। প্রহরদের বাড়ির সামনের রাস্তার বা পাশের ফুতপাতে একটা মুদি দোকান তৈরী হয়েছে। সেখান থেকে প্রিয়তা আরহামের জন্য কেক, বিস্কিট কিনে আনে। আরহাম বায়না ধরেছে দোকানে গিয়ে কেক খাবে। প্রিয়তা আপত্তি জানিয়েছে। ভাংটি যে টাকা আছে তা গাড়ি ভাড়াতে লাগবে। তারা এখন নিজেদের বাড়িতে ফিরবে। একটু আগেই ভাত খেয়েছে আরহাম। এখন কিসের কেক খাওয়া? প্রিয়তা সাফসাফ জানিয়েছে দোকানে যাবে না সে। ও বাড়িতে যাবে। কথাটা শুনেই আরহাম অভিমান করে ছাদে চলে গিয়েছে। প্রিয়তা পুরোপুরি তৈরী হয়ে ছাদে উঠল। ছাদে আরহাম নেই। প্রিয়তা নিচের ফ্ল্যাটে সব জায়গায় খুঁজল আরহাম কোথাও নেই। কি ভেবে প্রিয়তা প্রহরদের বাড়ির কলিং বেল চাপল। ফোন টিপতে টিপতে বেরিয়ে এলো একজন অর্ধবয়স্ক লোক। প্রিয়তা বুঝতে পারলো লোকটা প্রহরের বাবা। প্রিয়তা সালাম দিল। জিজ্ঞেস করল,
” আমার ভাই এসেছে আঙ্কেল?
লোকটা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। বললো,
” ঘরে তো আমাদের পরিবারের লোক ব্যতিত কেউ নেই। দেখো ঘরে গিয়ে। পাও কি না।
” আচ্ছা, থাক।
মলিন মুখে চলে আসতে উদ্যত হতেই পিছন থেকে প্রহর ডেকে উঠল প্রিয়তাকে। প্রহরের গা উন্মুক্ত। পুরুষালি অঙ্গ স্পষ্ট। সুঠাম দেহের ভাঁজে ভাঁজে মাধুর্য মিশে আছে। প্রহরের চাহনি অন্যরকম। মাদকতা মেশানো কণ্ঠ। প্রিয়তার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। দু দিন পর প্রহরকে সামনাসামনি দেখতে পেল সে। ভিষণ অগোছালো লাগছে নিজেকে। প্রহরের হাতে ফোন। প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে প্রহর বলে উঠল,
” তুমি এখানে? কি মনে করে?
” আরহামকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। চিন্তিত স্বর প্রিয়তার।
প্রহরের মুখ ফ্যাকাশে হলো। চিন্তা হলো তার ও। আরেকটু এগিয়ে এসে বললো,
” কোথায় আর যাবে? বাড়িতেই আছে। ভালো করে খুঁজে দেখো।
“সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। আরহাম কোথাও নেই।
” একটু অপেক্ষা করো। আসছি।
প্রহর ঘরে ঢুকে দিল। জলপাই রঙের শার্ট হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে শার্ট গায়ে জড়াল। দু দিকে দুজন গেল আরহামকে খুঁজতে। পুরো বাড়ির প্রত্যেকটা রুমে আরহামকে খুঁজল ওরা। মাঠে গিয়েও চক্কর কেটে আসল। কোথাও আরহামের অস্তিত্ব নেই। হঠাৎই প্রিয়তার ভয় লাগল। অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠল বুক। আরহাম তাকে না বলে কোথাও যায় না। এই সময় কোথায় যাবে? প্রিয়তা দোকানে গেল খুঁজতে। শেষমেশ হতাশ হয়ে ফিরে এলো। প্রহরের চোখমুখ গম্ভীর হলো। ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে চেহারা। সব জায়গায় খুঁজেছে আরহামকে। কোথাও পায়নি। একটা সময় প্রহরের মনেও ভয় ঢুকে গেল। প্রিয়তার অবস্থা নাজেহাল। মাঠের মাঝখানে বসে পরেছে সে। কান্না করে যাচ্ছে অনবরত। চোখের পানি গাল থেকে গড়িয়ে মাঠের ঘাসে পরছে। প্রহর তার টিমকে কল করল। বাড়ির আশপাশের সব জায়গায় লোক লাগিয়ে দিল। প্রিয়তার ফোনে কল এলো। আননোং নাম্বার দেখে প্রিয়তা প্রথমে কেটে দিল। পুনরায় একই নম্বর থেকে কল আসলে চোখ মুছে প্রিয়তা কল ধরল। হেচকি উঠছে তার। কান্না দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। বুক কাঁপছে বারংবার। চিন্তা চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে স্বাভাবিক করে প্রিয়তা বললো,
” হ্যালো, কে বলছেন?
” তুমি প্রিয়তা?
” জি।
‘ ভাইকে খুঁজছো?
” হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?
” আমাকে চিনবে না। আরহাম এখন নর্দমায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। রক্ত গড়াচ্ছে শরীর বেয়ে। পারলে বাঁচিয়ে নাও। সময় নেই হাতে।
প্রিয়তার বুকটা ধক করে উঠল। মুচরে উঠল শরীর। বাকরুদ্ধ হয়ে পরল। প্রাণপ্রিয় ভাই সম্পর্কে এমন কথা শুনে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। বিধ্বস্ত আর রুগ্ন দেখাল প্রিয়তাকে। উঠে দাঁড়াল সে। প্রহরের সাথে এসে দাঁড়াল। ফোনের ভলিউম বাড়িয়ে রেকর্ড করলো কথোপকথন। ওপাশের ব্যক্তি হাসল উচ্চস্বরে। প্রিয়তা বলে উঠল,
” আমার ভাইকে কি করেছেন আপনি? কি আবোল তাবোল বলছেন? আমার ভাইকে ফিরিয়ে দিন প্লিজ। আমি মরে যাবো। ও বাচ্চা। ও কোথায়? আপনি কে?
” তোমার ভাইয়ের এই ক্ষতির জন্য তুমি দায়ী নও। দায়ী তোমার ওই পুলিশ অফিসার। ওর জন্যেই নিষ্পাপ এক বাচ্চার প্রাণ নিতে হলো। পুলিশ এবার বুঝুক কাছের মানুষ হারালে কেমন লাগে।
” কি সব বলছেন? আপনি মিথ্যে বলছেন। আমার ভাই ঠিক আছে। আরহাম কোথায়? বলুন এক্ষুণি। আমি আপনাকে ছাড়বো না।
” তোমাদের বাড়ির আশপাশের নর্দমায় খুঁজে দেখো। পেয়ে যাবে। এতক্ষণে হয়তো কুকুর খুবলে খেয়েও নিয়েছে।
প্রহর ফোনটা নিজের হাতে নিল। রেগে উঠল সে। কপালের রগ ফুলে ফেপে উঠল। প্রিয়তার মাথা ভনভন করছে। অস্থিরতায় শরীর থরথর করে কাঁপছে। বেঁচে থাকার ইচ্ছে মরে যাচ্ছে। আরহামের এমন অবস্থা কি করে দেখবে সে? ছেলেটাকে বড্ড ভালোবাসে প্রহর। রেগে গিয়ে প্রহর বললো,
” তোকে আমি ছাড়বো না জানোয়ার। সাহস থাকলে আমার সামনে এসে আমার সাথে লড়াই কর। ওই ছোট্ট ছেলেটার সাথে এমন করছিস কেন?
লোকটা হেসে কল কেটে দিল। প্রিয়তা বিমূঢ়। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে তার। লোকটার কথা বারবার ভেসে আসছে কানে। অসহায় লাগছে প্রিয়তার। এত দুঃখ আর সইছে না।
__________
শহরের বড় একটি হাসপাতালের করিডোরে বসে আছে প্রহর আর প্রিয়তা। প্রিয়তার কান্না আহছে না এখন। দুঃখে চোখ এখন বেইমানি করছে তার সাথে। অবশ লাগছে নিজেকে। রোবট বলে মনে হচ্ছে। কষ্টে জর্জরিত হচ্ছে হৃদয়, হাহাকার করে উঠছে। প্রহর প্রিয়তার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে পুড়ছে প্রহর। বাইরের কাউকে বোঝাতে পারছে না। আরহামের জন্য কষ্ট হচ্ছে ভিষণ। কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু প্রহর তা করছে না। প্রিয়তাকে সাহস যোগাচ্ছে পাশে থেকে। আরহামকে বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে একটা ডাস্টবিনে পরে থাকতে দেখতে পেয়েছে তারা। আরহামের মাথায় বড়সড় আঘাত লেগেছে। হাতে-পায়ে গভীর ক্ষত। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল ছেলেটার শরীর। এতটাই আঘাত পেয়েছে যে মারা গিয়েছে বলে সবাই ভুল করছে। আরহামের শরীর নড়ছিল না। নিস্তেজ ছিল শরীর। প্রিয়তা আরহামকে এমন অবস্থায় দেখেই লুটিয়ে পরেছিল। এখন সে ঠিক আছে। তবে ডাক্তার রা আরহামের ব্যাপারে নিশ্চিত নয়। চেষ্টা করে দেখছে শুধু। বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা তেমন নেই বললেই চলে। আশা দিতে পারছে না কোনোমতেই।
প্রহর প্রিয়তাকে রেখে থানায় ছুটল। আরহামের যে এমন ক্ষতি করেছে তাকে খুঁজে বের করতে হবে। শাস্তি দিতে হবে। প্রহরের খারাপ লাগছে খুব। তার কারণেই আরহাম এত কষ্ট পাচ্ছে, মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। নিষ্পাপ ছেলেটার কতই না কষ্ট হয়েছে সেসময়। কেদেছে অনেক। প্রহরের বুক ভার হলো। চোখের কার্ণিশে অশ্রু জমল। বারবার আরহামের রক্ত মাখা শরীর স্মরণ হলো। প্রহরের চিৎকার করতে ইচ্ছে হলো। এ কয়েকদিনে আরহামের প্রতি আলাদা টান সৃষ্টি হয়েছে প্রহরের। বাচ্চাটার দিকে তাকালে কেমন মায়া মায়া লাগে। জাপটে ধরে রাখতে ইচ্ছে হয়। ছেলেটা বাঁচবে তো?প্রহরের ভয় হচ্ছে। ভিষণ ভয়। এত ভয় প্রহরের আগে হয়নি কখনো।
প্রহর পুনরায় ডাস্টবিনে গেল তদন্ত করতে। আশপাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করলো এই ঘটনা নিয়ে। কেউই কিছু বলতে পারল না। প্রহর স্তব্ধ হলো। দাঁড়িয়ে রইল তদন্তের স্থানে। হঠাৎ প্রহরের মনে হলো কেউ তার কোমরে হাত রেখেছে। পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্বেই নারীর কোমল হাত প্রহরের কোমরে থাকা রিভলবার টেনে নিজের হাতে নিল। প্রহর দু হাত উঁচু করে ধীরে ধীরে পিছু ফিরল। অবাক হলো ভিষণ। সামনে প্রিয়তা দাঁড়িয়ে। দু হাতে রিভলবার ধরে রেখেছে। প্রহরের বুকে তাক করে ধরে রেখেছে রিভলবার। প্রহর বিস্ময় নিয়ে হাত নামাল। প্রিয়তা উচ্চস্বরে হাসল। এলোমেলো লাগছে তাকে, ভয়ঙ্কর লাগছে। দৃষ্টিতে প্রতিশোধের নেশা জেগে উঠেছে। উন্মাদের মতো আচরণ করল প্রিয়তা। বললো,
” আপনার জন্যই। শুধুমাত্র আপনার জন্য আমার ভাই আজ মৃত্যুর মুখে। আমি জানি, আরহাম বাঁচবে না। যার জন্য আরহাম এত কষ্ট পেল তাকে আমি কি করে ছেড়ে দেই? আপনিও বাঁচবেন না। আপনাকে আমি খুন করবো প্রহর। যন্ত্রণা দিয়ে খুন করবো। আপনার মৃত্যু হবে আমার হাতে। আমরা কি চেয়েছিলাম বলুন? আমি আর আরহাম একটা সহজ-সরল জীবন চেয়েছিলাম। সুখে-শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছিলাম সৎ ভাবে। আপনি আমাদের এই অন্ধকার দুনিয়ায় নিয়ে এলেন। আমাকে জায়গা দিলেন আপনাদের বাসায়। আপনার শত্রুরা আমার শত্রুতে পরিণত হলো। আমার ভাইকে হারাতে চলেছি আমি। এত সহজে আপনাকে ছাড়বো? আমার যে কষ্ট হচ্ছে। বুক পুড়ছে খুব। আরহাম ছাড়া আমার কেউ নেই। এই এত বড় পৃথিবীকে আমি আর আরহাম বড্ড একা। ছেলেটাকে আমাকে একা রেখে চলে যাচ্ছে। আমি মানতে পারবো না। আপনাকে শেষ করতে এসেছি।
প্রহর এমন এক মুহুর্তেও হাসল। তার অঙ্গভঙ্গিতে ভয়ের রেশ দেখা গেল না। আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রহর বললো,
” প্রিয়, আমার প্রিয়। তোমার চোখে আমি আমার প্রতি ভালোবাসা দেখেছি। তুমি আমাকে শেষ করতে পারো না। তুমি আমায় ভালোবাসো। বড্ড বেশিই ভালোবাসো। আরহাম হারাবে না। আমি আরহামকে ভালোবাসি। ওর ক্ষতি যারা করেছে তাদের আমি শেষ করবো। আমাকে সময় দাও।
” উঁহু। সময় নেই। আরহাম কষ্ট পাচ্ছে। আপনিও পাবেন। ইউ আর ফিনিশড মিস্টার আজওয়াদ ইশতিয়াক প্রহর।
প্রিয়তা গুলি ছুড়ল। শব্দ বের হলো না গুলি থেকে। রিভলবারে সাইলেন্সার লাগানো। বন্দুকের নল থেকে গরম ধোঁয়া বের হলো। প্রিয়তা হাসল গাঢ় চোখে। সামনে থাকা বলিষ্ঠ দেহের সুদর্শন পুরুষ লুটিয়ে পরল মাটিতে। ধপ করে শব্দ হলো। চোখ থেকে টপ করে অশ্রু ঝরল। চিনচিন ব্যথা হলো বুকে। চোখ বুজে ফেলল সে। শান্ত গলায় প্রহর বললো,
” প্রিয়, আমার প্রিয়। তোমার এমন রুপ আমি চাইনি। আমার সত্যিই কষ্ট হচ্ছে না, আমি সুখ পাচ্ছি। আমার প্রিয় মানুষের থেকে পাওয়া বিষাক্ত এ ভালোবাসা আমি স্মরণে রাখবো।
প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি।
( আসসালামু ওয়ালাইকুম। এতদিন যারা সাইলেন্ট রিডার ছিলেন তারাও মন্তব্য করবেন। তবেই দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ দ্রুত আসবে। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে প্রিয়তা হবে একদম ভিন্ন রকম। তখন শুধু প্রিয়তার জীবনে নতুন নতুন ঘটনা দেখবেন। তানিয়া-ইহান ও থাকবে সেখানে। সবাইকে তুলে ধরবো ইন শা আল্লাহ্। এটা আমি লিখবো অফলাইনে। পুরোটা শেষ করে পোস্ট করবো একে একে। যাতে আপনাদের ধৈর্য ধরতে না হয়।)