#প্রিয়তার_প্রহর (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
[ অন্যত্র কপি কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। চাইলে শেয়ার করতে পারেন]
শালা শুয়োরের বাচ্চা, মেয়ে দেখলেই গো’পন অঙ্গ দেখাস। লজ্জা করে না? এখন আবার পালাচ্ছিস? দাঁড়া। আজ তোর একদিন কি আমার একদিন। জা*নোয়ার কোথাকার। ভয় পাচ্ছিস কেন?
মাঝ রাস্তায় একটি ছেলের পিছনে ছুটতে ছুটতে রাগান্বিত কণ্ঠে বাক্যটি আওড়াল একটি মেয়ে।
একাধারে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হাপিয়ে উঠল মেয়েটি। প্রচন্ত পিপাসা পেল। তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত হলো মুহুর্তেই। থামল না মেয়েটি। যত জোর আছে সবটা দিয়ে ছুট লাগাল ছেলেটির পেছন পেছন। বাজার, অফিস পেরিয়ে, কোলাহল পেরিয়ে পাকা রাস্তায় অবস্থান করল তারা। ছেলেটি ছুটে চলেছে। মনে অজানা ভয়। আতঙ্কে বারংবার পিছু ফিরে মেয়েটিকে দেখছে। মনে মনে চাইছে মেয়েটি লুটিয়ে পড়ুক রাস্তায়, আর দৌঁড়ানোর শক্তি না পাক। কিন্তু মেয়েটি দৌঁড়াতেই থাকল পিছু পিছু। বেশ কিছুক্ষণ দৌঁড়ে ছেলেটি হাপিয়ে উঠল। টলতে থাকল ছেলেটির পা। ইটের অহর্নিশ চাপে পা মচকে গেল। মুহুর্তেই ছিটকে রাস্তায় পরে গেল ছেলেটা। ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। আবার ও উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই খপ করে ছেলেটির কলার ধরে টেনে দাঁড় করাল এতক্ষণ পিছনে দৌঁড়াতে মেয়েটি। মেয়েটির পরণে ছাই রঙের ঢিলেঢালা থ্রিপিস। কোমর ছারিয়ে গিয়েছে বেনুনী। নাকে নোস রিং, হাতে চকচকে কালো ঘড়ি। মেয়েটির কপাল বেয়ে শ্বেতজল গড়াচ্ছে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছে। ছেলেটির ভ্রূক্ষেপ নেই। পালানোর পন্থা অবলম্বন করতে চাইল সে। মেয়েটি সেই সুযোগ দিল না মোটেই। ঠাস করে কষে চড় মারল ছেলেটির বা গালে। তড়িৎ বেগে মাথা হেলে পরল ছেলেটির। চুল এলোমেলো হলো। বয়স কত ছেলেটার ? পঁচিশ কি ছাব্বিশ। ফিনফিনে রোগা চেহারা। চোখ লাল। পরণে আকাশি টি শার্ট আর কালো প্যান্ট। কোকড়া চুল। গায়ের রং শ্যামলা। নেশা জাতীয় দ্রব্যের জঘন্য গন্ধ বের হচ্ছে গা থেকে। মেয়েটি সমস্ত বল প্রয়োগ করেই বোধহয় চড়টা মেরেছে। ছেলেটির গালে দাগ বসে গিয়েছে। ঠোঁটের কোণে কেটে গিয়েছে। মেয়েটি নাকের ডগায় জমে থাকা স্বেদতজল ওড়না দ্বারা মুছে নিয়ে দু হাতে ছেলেটির কলার ধরে ঝাঁকাল। তেজী, দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠল,
” মেয়ে মানুষ দেখলে ক্ষুধার্ত হয়ে পরিস কেন রে? এত যৌ”বন জ্বালা তোর? পতিতালয়ে যা জা*নোয়ার, কু’ত্তা।
ছেলেটি আশপাশে তাকাচ্ছে। মেয়েটি চিৎকার করে উঠল পুনরায়। রাগে ফেটে পরছে মেয়েটি। কণ্ঠে ভারী রাগ। ক্ষণে ক্ষণে দাঁতে দাঁত চেপে রাগ নিবারণ করার চেষ্টা করছে। ছেলেটি বলে উঠল,
” আমি কিছু করি নাই।
” কিচ্ছু করিসনি? আমাকে দেখে শিস বাজালি কেন? জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজালি কেন? আর প্যান্টের ওই গোপন স্থানে হাত দিলি কেন কু’ত্তা? মেয়ে দেখলে হুশ থাকে না তাইনা? বাসায় মা বোন নাই তোর? শু’য়োর কোথাকার।
মেয়েটির এমন চিৎকারে মানুষজন জড় হয়ে গিয়েছে। সকলেই গোল করে দাঁড়িয়েছে মাঝ রাস্তায়। ঘটনাটা আগ্রহ নিয়ে দেখতে এসেছে সবাই। গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে জ্যাম বেঁধে গেল। দর্শকে ভরে উঠল জায়গাটা। সকলের মাঝে আলোচনা চলছে। মেয়েটির এখনো রাগ কমেনি। বল প্রয়োগ করে ছেলেটির চুল সজোরে টেনে দিল সে। ব্যথায় কুকিয়ে উঠল ছেলেটি। সবার উদ্দেশ্যে মেয়েটি বলে উঠল,
‘ একে চিনে রাখুন। এই লোকটা আমাকে কু প্রস্তাব দিয়েছে। খারাপ অঙ্গভঙ্গি দেখিয়েছে। একে কি করা উচিত আপনারাই বলুন? রাস্তাঘাটে আমরা মেয়েরা আজ নিরাপদ নই শুধু মাত্র এদের কারণেই। বাবা-মা এজন্যই আমাদের মেয়েদের একা বের হতে দিতে চায় না। এদের জন্যই ভয়ে ভয়ে চলতে হয় আমাদের। কেন? আমরা এমন লুকিয়ে চলবো কেন? এদেরকেই সমাজ থেকে তাড়ানো হোক। মেয়েরা নিরাপদে চলাচল করতে পারুক এবার।
ঘটনাটি সত্যিই চমৎকার। শ্লী’লতাহানির চেষ্টা করতে চাওয়া একটি ছেলেকে মাঝ রাস্তায় এভাবে গালিগালাজ আর মারধোর করছে একটি সাধারণ মেয়ে। মেয়েটির চোখে-মুখে কাঠিন্যতা, প্রতিবাদ করার মানসিকতা। সকলেই মুগ্ধ হচ্ছে ব্যাপারটাতে। সবাই মেয়েটির কথা শুনে ছেলেটির দিকে তাকাচ্ছে। রাগে গজগজ করতে লাগল প্রায় সবাই। একজন মহিলা বলে উঠল,
” এরে এখনই পুলিশে দেওয়া দরকার।
মেয়েটি নিঃশব্দে হাসল। ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের ক্রূর হাসি তার। সকলের দিকে চেয়ে বললো,
” এই লোকটা কি এমন ভুল করেছে বলুন তো আন্টি? কাউকে খুন করেনি, চুরি-ডাকাতি করেনি, গায়ে হাত ও দেয়নি। এর শাস্তি পুলিশ কি দিবে? দু দিন জেলে আটকে রাখবে, অতঃপর লোকটার পরিবার এসে অফিসারকে দু হাজার টাকা দিয়ে একে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে। ব্যস! কেশ ডিশমিশ। পুনরায় এই লোকটা একই কাজ করে যাবে।
” তাহলে কি করবা এরে? ছাইড়া তো দেওয়া যাইবোই না।
মেয়েটি এক হাত পায়ের কাছে এনে শক্ত জুতোটা পা থেকে খুলে ফেলল। ছেলেটির চোখেমুখে এক রাশ ভয় প্রতীয়মান দেখা দিল। পালানোর সুযোগ নেই। সকলেই ঘিরে ধরেছে ওদের। সবাইকে ধাক্কা দিয়ে পালানোর বৃথা চেষ্টা করল না ছেলেটি। হাত জোর করে ক্ষমা চাইল। মেয়েটি কি সে কথা শুনল? উঁহু! গায়ের সমস্ত বল প্রয়োগ করে ইচ্ছেমতো জুতো পেটা করতে লাগল। ছেলেটির পুরো শরীরে একের পর এক প্রহার করল। অনেকে মেয়েটির এই দুর্দান্ত কাজটি লাইভে দেখাল, কেউ বা পোস্ট করলো সোশাল মিডিয়ায়। মেয়েটির রাগ না কমা অব্দি প্রহার করতে থাকল। পাশ থেকে আরেকটি মেয়ে বলে উঠল,
” এই লোকটা আমাকে দেখেও এমন করে। আমি না দেখার ভান করে চলে যাই।
প্রহার থামিয়ে মেয়েটি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। বলে উঠল,
” আমি না দেখার ভান করে থাকতে পারি না গো।
জ্যাম জনযাটে পুলিশের জিপও আটকে গিয়েছে। একটি জায়গায় গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বহু সংখ্যক মানুষ। অর্ধবয়স্ক পুলিশ এগিয়ে এলেন ঘটনাস্থলে। লোকজন সরিয়ে মেয়েটির সম্মুখে আসল। একটি ছেলেকে রাস্তায় কাত হয়ে শুয়ে থাকতে দেখল পুলিশ। ব্যথায় ছটফট করছে ছেলেটি। নেতিয়ে গিয়েছে একদম। গায়ে ক্ষতের দাগ স্পষ্ট। পুলিশটি সবার দিকে চেয়ে বললেন,
” কি হয়েছে এখানে?
একটু আগে রেগে থাকা মেয়েটি এখন নির্মল, শান্ত। পুলিশের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল সে। পুলিশকেই খুঁজছিল মেয়েটা। মেয়েটার হাসিতে ছিল প্রাপ্তি। সালাম দিয়ে সে বলে উঠল,
” এই লোকটা রাস্তায় মেয়ে দেখলেই নিজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখায়, শিষ বাজায়, বাজে ভাবে টিজ করে। আমাকে ও করেছিল। তাই মেরেছি। না মারলে এতক্ষণে পালিয়ে যেতো।
” পুলিশকে ডাকলেই তো হতো। এইভাবে রাস্তায় সিনেমা দেখানোর কি প্রয়োজন? ভিড় বাড়িয়েছেন কেন সবাই? যে যার কাজে যান
” প্রয়োজন নেই বলছেন? আমার রাগটা ওর উপর ঝেরেছি। এখন আপনাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। নিয়ে যান ওকে।
সকলের সমর্থন ছিল মেয়েটির কথায়। তারাও পুলিশকে উদ্দেশ্যে করে বিচার চাইল। দু একজন বিচার দিল ছেলেটার বিরুদ্ধে। বয়স্ক পুলিশ ছেলেটাকে উঠিয়ে জিপে বসাল। জিপ স্টার্ট করার পূর্বে মেয়েটি বলে উঠল,
‘ আমি রোজ থানায় গিয়ে লোকটাকে দেখে আসবো। জিডি করতেও যাবো। একে তো আমি দেখে নিবো।
______________
দুপুরের তীব্র রোদ। গরমে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। কয়েকদিন আগেই শীত কমেছে, তবুও গরম প্রচুর। মেয়েটি বাড়ি পৌঁছে নির্দিষ্ট ঘরের দরজায় টোকা দিল। ওরনা দিয়ে পুনরায় ললাট মুছে নিল। হাতে তার বাজারের ব্যাগ। হাত ব্যথা করছে ব্যাগ ধরে রাখায়। মৃদ্যু স্বরে ডেকে উঠল সে,
” আরহাম, দরজা খোলো।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দরজা খুলল আরহাম। ছেলেটার মুখে প্রাণবন্ত হাসি। গোলাকার বড় বড় চোখ ও যেন হেসে উঠল। পলক ঝাপটাল বারবার। প্রিয়তাকে দেখে তার হাত থেকে বাজারের একটা ব্যাগ নিজের দু হাতে নিল আরহাম। প্রিয়তা ঘরে ঢুকে ফ্যানের নিচে বসল। ওড়না সরিয়ে পাশে রাখল। আরহাম বোনের এহেন অবস্থা দেখে পাশেই বসে রইল। এগিয়ে এসে বললো,
” আন্টি ঘর ভাড়া দিতে বলেছে।
প্রিয়তা থমকাল। আজ মাসের পাঁচ তারিখ। এত দ্রুত ঘর ভাড়া কে চায়? স্টুডেন্টদের বাবা-মা রা চাকরি করে। বেতন পায় সাত তারিখে। প্রিয়তার হাতে সেই টাকা পৌঁছাতে আট তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। অনেক গার্ডিয়ান আরো দেরিতে বেতন পায়। প্রিয়তা বাড়ি নেই এই সুযোগে মহিলা আরহামকে এসে টাকা চাই বলে কথা শুনিয়েছে। প্রিয়তা ফোস করে শ্বাস টানল। আরহামের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
” দিয়ে দেবো।
” ডিশ বিল নিতেও এসেছিল। আমি বলেছি আপু দিবে।
” বেতন পেলেই দিয়ে দিবো। এক দিন টিভিতে ডিশ থাকলে দু দিন ডিশ থাকে না। দু দিন আবার ঝিরঝির করে। আসুক ওই ব্যাটা। আগে কয়েক কথা শুনিয়ে দেবো, তারপর টাকা দিবো। আর বাড়িওয়ালি যে টাকা চায়, কোন মুখে চায়? ঘরের টিন তো ছিদ্র। বৃষ্টি আসলে হুরহুর করে পানি পরে। হাঁড়ি-পাতিল মেলে ধরতে হয়। তোষক ভিজে যায়। জুবুথুবু হয়ে বসে থাকতে হয় সারা রাত।
আরহাম কিছুই বললো না। তাকিয়ে রইল ক্লান্ত বোনের মুখের দিকে। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকাল। আরহাম আজকাল পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। কিছু একটা ভাবে। প্রিয়তা ব্যাগ হাতরে দশ টাকার ডেইরি মিল্ক বের করল। আরহামের হাতে গুঁজে দিল চকলেটটা। আরহামের চোখ-মুখ উজ্জল হলো। প্রিয়তা বললো,
” একটু পানি আনো তো। পিপাসা পেয়েছে।
” লেবুর শরবত বানিয়ে দেই?
” তুমি পারবে বানাতে? থাক, লেবু কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলবে। দরকার নেই। পানি আনো শুধু।
” আমি পারবো আপু। দাঁড়াও তোমার সামনেই বানিয়ে দেখাই।
আরহাম ঘরের কোণে গেল। একটি গ্লাস এনে রাখল প্রিয়তার কাছে। খাটের নিচ থেকে একটা লেবু বের করে বটিও বের করল। মেঝেতে পা মোছার ন্যাকড়া রাখল। প্রিয়তা হাসল মনে মনে। সে নিজেই বলেছিল লেবু কাটতে হলে নিচে কিছু একটা দিয়ে রাখবে। নইলে মেঝে সাদা হয়ে যাবে। আরহাম সেই কথা মনে রেখেছে। ধীরে ধীরে ছেলেটা অতি উৎসাহের সাথে লেবু কাটল। বোনকে দেখাতে চাইল সে পারে এটা, সে আর ছোট নেই। লেবু চিপে রস বের করল আরহাম। জগ থেকে পানি ঢেলে তাতে লবণ দিল। সবটা প্রিয়তা পর্যবেক্ষণ করল সূক্ষ্ম চোখে। ছেলেটাকে আজকাল বড় বড় লাগে। এখন আর তেমন একটা বায়না করে না, প্রিয়তাকে কাজেকর্মে সাহায্য করতে চায়। আরহাম ডাম থেকে বয়াম বের করল। বয়ামে চিনি নেই। প্রিয়তার দিকে তাকাল সে। মুখটা মলিন করে বললো,
” চিনি তো নাই আপু।
” লেবু আর লবণ দিয়েই দাও।
আরহাম গ্লাসটা এগিয়ে দিল। প্রিয়তা গাল টেনে দিল আরহামের। ঢকঢক করে শরবত পান করল। তৃপ্তিতে মুখে হাসি ফুটল প্রিয়তার। ভাইয়ের এহেন যত্নে নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করল।
শরবতটুকু খাওয়া শেষ হলে আরহাম গ্লাসটা নিচে রেখে বললো,
” আপু জানো কি হয়েছে?
” কি হয়েছে?
” তিহা আপু নাকি বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেছে।
” সে কি? এসব কে বললো তোমায়?
” তিহা আপুকে পাওয়া যাচ্ছে না। খালা কান্নাকাটি করছিল। আমি গিয়ে দেখলাম সবাই কি সব বলছে। বাড়িওয়ালী আন্টি বললো যে তিহা আপু নাকি বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে গেছে। একটা ছেলে নাকি বাড়ির সামনে এসে ঘুরঘুর করতো। তিহা আপু নাকি কথা বলতো।
অবাক হলো প্রিয়তা। না জেনে এসব কথা রটার জন্য দুঃখ ও পেল। বলল,
” এসব কথা কাউকে বলার দরকার নেই। তিহা ভালো মেয়ে। ওর সম্পর্কে এসব বলবে না।
” বয়ফ্রেন্ডের সাথে চলে যাওয়া কি খারাপ আপু? দেখিও, আমিও একদিন গালফ্রেন্ডের সাথে চলে যাবো।
প্রিয়তা হকচকিয়ে গেল। হাসি পেল খুব। এই ছেলেটা বলে কি? ওর বয়স তো মাত্র পাঁচ। এখনই গালফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে আরহাম? ততক্ষণাৎ প্রশ্ন করলো প্রিয়তা,
” বয়ফ্রেন্ড, গালফ্রেন্ড মানে তুমি বোঝো?
” বুঝি তো। বয় মানে বালক আর ফ্রেন্ড মানে বন্ধু। দুটো মিলিয়ে হলো ছেলে বন্ধু। আর গালফ্রেন্ড মানে বালিকা বন্ধু।
” আচ্ছা জানো দেখছি। তা তুমি পালাবে কেন?
” তুমি তো আমাকে সময়ই দাও না। সারাদিন একা একা ভালো লাগে না বাড়িতে। তাই তো বন্ধুর সাথে ঘুরতে যাবো। আবার ফিরেও আসবো।
” এসব কথা আর যেন না শুনি।
” তোমার ও তো বয়ফ্রেন্ড আছে।
” মানে? কে?
‘ তন্ময় ভাইয়া আর..
” আর?
” প্রহর ভাইয়াও তো তোমার বালক বন্ধু। নত মুখে কথাটা বললো আরহাম।
প্রিয়তা থমকাল কিছু সময়ের জন্য। হৃদয়ে তোলপাড় শুরু হলো। প্রহর! প্রিয়তার প্রহর। কতদিন এই নামের মানুষটার থেকে দূরে আছে প্রিয়তা। প্রহরের খবর টাও নেয়না সে। কোথায় আছে প্রহর? কেমন-ই বা আছে? কি করছে এখন? আচ্ছা প্রহরের কি মনে পরে প্রিয়তার কথা? অস্থির অস্থির লাগে? প্রিয়তার জন্য পরান পুড়ে না প্রহরের? যন্ত্রণা হয় না বুকে? নাকি বিয়ে করে ছেলেটা সুখেই আছে? ভুলে গিয়েছে তথাকথিত বন্ধুকে? এইযে প্রিয়তার মনে যে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে, প্রতিক্ষণ যে দহনে জ্বলে একাকার হয়ে যায় প্রিয়তা, এটা কি প্রহরের সাথেও হয়? জানতে ইচ্ছে হয় প্রিয়তার। দেখতে ইচ্ছে হয় পুলিশম্যানকে। কিন্তু উপায় নেই। দুরত্ব এখন মাইল মাইল। সিলেট শহর ছেড়ে এখন ঢাকায় এসেছে তারা। সিলেটের মানুষ বলতে শুধু তন্ময়ের সাথেই যোগাযোগ আছে প্রিয়তার। নিজের সিমটাও সে বদলে ফেলেছে। অতিত মুছে ফেলতে চেয়েছে অনবরত। কিন্তু পেরেছে কি? সেই তিন ভবন বিশিষ্ট বাড়ি, বাড়ির সাথের মাঠ, খোলামেলা পরিষ্কার ছাদ, আর সেই বাড়ির বাড়িওয়ালার ছেলে। এদের কি ভুলতে পারবে প্রিয়তা? কখনোই না।
___
তানিয়ার ঘুম ভেঙেছে নয়টায়। গতকাল থানায় ছোটখাটো একটা কেস এসেছে। সেই বিষয়টা নিয়েই ঘাঁটাঘাঁটি করছে তানিয়া। ল্যাপটপ টা বিরক্তির সাথে খুললো সে। ভিক্টিমের ডিটেইলস সব রেখেছিল ল্যাপটপে। সেসব যাচাই-বাছাই করতে হবে। তানিয়া চশমা আটকে নিল চোখে। পুনরায় হাই তুললো। গতকাল রাতে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ইনফরমেশন গুলো কালেক্ট করেছিল তানিয়া। ল্যাপটপ অন করে কোনো ডিটেইলস দেখতে না পেয়ে ললাটে ভাঁজ পরল। বিস্ময়ে হা হয়ে গেল তানিয়ার মুখ। দ্রুত খটখট শব্দে টাইপিং করে তথ্য খোঁজার চেষ্টা করল। কোথাও তথ্যগুলো নেই। তানিয়ার ভারী মন খারাপ হলো। রাত জেগে সবটা কালেক্ট করল, আর এখন সেসব নেই? তানিয়া সেভ করেছিল তো? কনফিউসড হলো তানিয়া। এসময় ইহানের কথাটা সর্বপ্রথম মনে পরল তার। বালিশের নিচ থেকে মুঠো ফোন হাতে নিল তানিয়া। নির্দিষ্ট নম্বরে ডায়াল করল। দু বার রিং বাজার পরই কল ধরল ইহান। তানিয়া সালাম জানাল। জিজ্ঞেস করল,
“কি করছেন আপনি?
ইহান হাঁচি দিল। তার এক হাতে ময়দা লেগে আছে। অপর হাতে থুনতি ধরে আছে। ঘাড় বাঁকিয়ে ফোনটা কাঁধে রেখে কানে চেপে ধরল ইহান। পুনরায় হাঁচি দিল। রক্তিম নাক ডলে দিল। বললো,
” রান্না করছি। রুটি আর ডিম ভাঁজা।
” আপনার সর্দি লেগেছে নাকি?
” হ্যাঁ একটু লেগেছে।
” একটু তো মনে হচ্ছে না। নাকে পলিথিন বেঁধে রাখুন।
” ইয়াক, এসব কি কথা তানিয়া? ফোন রাখো। ফাজিল মেয়ে। আজেবাজে কথা।
” আরেহ্ শুনুন। মজা করেছি। সর্দি তো মনে হচ্ছে ভালোই লেগেছে। ঔষধ খেয়েছেন?
” হ্যাঁ একটু বেশিই। ওয়েদার চেঞ্জ হয়েছে সেজন্য। রান্না হলেই খেয়ে নিবো।
” আপনি ফ্রি আছেন? মানে কথা বলতে সমস্যা নেই তো?
” এই রান্নাটা হলেই ফ্রি আছি।
” দেখা করতে পারবেন একটু?
ইহান ভড়কাল। এই মেয়েটার থেকে যতই দূরে থাকতে চায় মেয়েটা ততই কাছে আসার বায়না ধরে। অপ্রস্তুত করে ইহানকে। মেয়েটা রোজ ফোন করে খবর নিচ্ছে। হুটহাট বাড়ি চলে আসে সমস্যা সমাধান করতে। বন্ধুত্বটা বলতে গেলে তানিয়াই টিকিয়ে রেখেছে। শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় জিভ দ্বারা ভিজিয়ে নিয়ে ইহান বললো,
” কেন?
” আমার ল্যাপটপের কিছু ইনফরমেশন রিকভার করতে হবে। কি করে ডিলিট হলো বুঝতে পারছি না।
” আশেপাশে টেকনোলজি সার্ভিসের তো অভাব নেই। আমাকে বলছো কেন? পুলিশ স্টেশনেও তো এসবের জন্য দক্ষ অফিসার আছ।
” আপনার কি আমার সাথে দেখা করতে সমস্যা আছে?
” ধুরর। তা নয়।
” আমি এই কেসটা নিয়ে কারো সাথে আলোচনা করিনি। আপনি তো সব দায় আমাকে দিয়ে রেখেছেন। আপনাকেই রিকভার করতে হবে।
” বাড়িতে আছি।
” আমি আসছি তাহলে। আপনি বাড়িতেই থাকুন।
” আচ্ছা।
_________
প্রহর থানায় বসে আছে নির্বিকার চিত্তে। ফাইলগুলো উল্টেপাল্টে দেখছে। ইহান অন্য থানাতে ট্রান্সফার হতে চেয়েছিল। অফার পেয়েছিল বড় অফিসারের কাছ থেকে। কিন্তু ইহানকে অনেক জোর জবরদস্তি করে সিলেটের থানায় রেখে এখানে ট্রান্সফার হয়েছে প্রহর। ইহানের পরিবর্তে প্রহর নিজে চলে এসেছে ঢাকায়। তানিয়া আর ইহান আছে সিলেটে। তানিয়া আর ইহানের সাথে প্রায়ই যোগাযোগ হয় প্রহরের। দু-তিন মাস পর আবার সিলেটে ফিরবে প্রহর। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এসেছিল এখানে। প্রহর ফিরতে চায়নি, ইহান আর তানিয়া অনুরোধ করেছে অনেকবার। প্রিয়তা চলে যাওয়ার পর ওরাই প্রহরের পাশে ছিল। তাই ওদের অনুরোধ রাখতে হবে। একই থানায় থাকতে চাইছে তিনজন। অগত্যা রাজি হয়ে দু-তিন মাস পরে ফিরবে বলে কথা দিয়েছে প্রহর। এজন্য দরখাস্ত জমা দিয়েছে উপরমহলের অফিসারের কাছে।
প্রহর ফোন বের করল। প্রিয়তার নম্বরে ডায়াল করল। প্রত্যেকবারের মতো এবার ও সিম বন্ধ দেখাল। ওপাশ থেকে নারী কণ্ঠে কেউ বলে উঠল, “এই মুহুর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে”। হতাশায় ভুগল প্রহর। গত চার মাসে একই নম্বরে লাগাতার কল দিয়ে যাচ্ছে সে। একটা দিন ও সিমটা অন পায়নি। প্রিয়তা যে প্রহরের জন্যই সিম কার্ড খুলে রেখেছে, এটা প্রহর বুঝে। তবুও রোজ কয়েকবার করে কল করে নম্বরে। যদি প্রিয়তা সিম অন করে? ফোন ধরে?মেয়েটাকে বড্ড মিস করে প্রহর। খুঁজে বের করার উপায় নেই। যাওয়ার আগে মেয়েটা একটা চিঠি লিখে সেথায় বলেছিল ” আমাকে খুঁজবেন না প্লিজ। আমার কসম। আমাকে দূরে থাকতে দিন। আমরা হারাইনি। সেচ্ছায় চলে যাচ্ছি। তাই খুঁজবেন না আমায়”। আরো অনেক কথাই বলেছিল। সেসব মনে করতে চায় না প্রহর। ভাবতে চায় না।
ঢাকার একটি বড় কসমেটিক্স-এর দোকানে সেলসম্যানের কাজ করে প্রিয়তা। দুপুর তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সেখানেই কাজ করে। সকাল নটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ভার্সিটিতে থাকে প্রিয়তা। এরপর দুইটা পর্যন্ত টিউশন করায়। আটটায় ফিরে নয়টা থেকে পাড়ার কয়েকটা বাচ্চাকে পড়ায়। ব্যস্ততায় কাটে সারাদিন। আরহামকে সময় দিতে পারে না বলে প্রায়সই অভিমান করে বসে থাকে আরহাম। আবার মাঝে মাঝে ছেলেটা বুঝতে পারে এত পরিশ্রমের কারণ। এখানকার একটা ভার্সিটিতে নতুন বছরে ভর্তি হয়েছে প্রিয়তা। দু দিন পর পর ভার্সিটিতে যায়। আরহামকেও শিশু শ্রেনীতে ভর্তি করেছে। রাতে বাড়ি ফিরে দুই-ভাই বোন খেয়ে পড়তে বসে। এটাই মূলত প্রিয়তার রুটিং। রোজ একই নিয়মে চলছে সে। আজ দুপুরে দোকান থেকে ফেরার পথে প্রিয়তা থানার পথটা ধরল। জিডি করা দরকার দ্রুত। থানায় একবার না গেলেই নয়।
প্রিয়তা ভিন্ন পথ ধরল। কিছুটা সময় নিয়ে থানায় পৌঁছাল। থানার সামনে দুজন কনস্টেবল দাঁড়ানো। প্রিয়তা তাদের সালাম গিয়ে ভিতরে ঢুকল। অফিসার নাকি মাত্র লাঞ্চ করতে বসেছে। আধ ঘন্টা বসতে হবে। প্রিয়তা বসল বাইরের একটা বেঞ্চে। সকালে রান্নাবান্না করে দোকানে যেতে হয় বলে ঘুম তেমন হয় না প্রিয়তার। ভেবেছিল বাড়ি গিয়ে আজ একটু ঘুমোবে। কিন্তু অফিসার ব্যস্ত জেনে রাগ হলো খানিক। বসে রইল সেখানেই। ঘড়িতে তখন বারোটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট। প্রিয়তা ভাবল ঘুমোবে। কিন্তু তা আর হলো না। থানায় কেউ এসেছে জেনে অফিসার নাকি লাঞ্চ শেষ করে ফেলেছে দ্রুত। প্রিয়তার রাগ গায়েব হলো। পুলিশটার বিবেক আছে বুঝতে পেরে ভালো লাগল। পা বাড়িয়ে অফিসারের ডেস্কে পৌঁছাল প্রিয়তা। ভিতরে ঢোকার অনুমতি চাইল,
” স্যার আসতে পারি?
গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠে ভেতর থেকে উত্তর এলো,
” আসুন।
প্রিয়তা কেবিনে প্রবেশ করল। মাথা উঁচু করল। অফিসারের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হলো প্রিয়তা। ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল কয়েক পল। ব্লু রঙের শার্ট পরিহিত লোকটা। গায়ের রঙ উজ্জ্বল। সেই একই রকম সৌন্দর্য। নেইমপ্লেটে দেওয়া পরিচিত নাম। আজ কতগুলো দিন পর মানুষটাকে সামনাসামনি দেখল প্রিয়তা? অনেকদিন। পরিচিত কণ্ঠ শুনতে পেল বহুদিন পর। প্রিয়তার চোখের কার্ণিশ অশ্রুতে ভরে গেল। ওষ্ঠদ্বয় কাঁপতে লাগল। জোয়ার বইল হৃদয়ে। পা দুটো টলতে লাগল। অস্থির ঠেকল প্রিয়তার। প্রিয় মানুষের সামনে আসায় ছটফটানি শুরু হলো। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে প্রিয়তা এগিয়ে এলো। প্রহর নির্বিকার। গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
” বসুন।
প্রিয়তা চেয়ারটা টেনে বসল। কণ্ঠে তার জড়তা। সম্মুখে বসে থাকা মানুষটাকে দেখে অন্তরাত্মা জুড়াল প্রিয়তার। বলতে পারল না সেসব। প্রহর তাকিয়ে রইল প্রিয়তার দিকে। প্রহরের এমন একটা মুহুর্ত নেই যে মুহুর্তে প্রিয়তার কথা মনে পরেনি। প্রিয়তাকে দেখে হৃদয় কাননে পুষ্প সতেজ হলো প্রহরের। প্রেমের উত্তাপে জ্বলে যাওয়া বুক শীতল হলো খানিক। তীক্ষ্ম চোখ দ্বারা পর্যবেক্ষণ করল প্রিয়তাকে। প্রিয়তার পরণে কালো রঙের কামিজ। চুল এখন পিঠ ছাড়িয়ে কোমড় ছড়িয়ে পরেছে। প্রিয়তার আদল বদলেছে। খানিক ওজন এসেছে শরীরে। গুলুগুলু লাগছে মেয়েটাকে। মায়া মায়া নজরে এপাশ ওপাশ তাকালে বুকটা ধক করে উঠছে প্রহরের। পুলিশ ইউনিফর্মের নিকট এ অনুভূতি অগোচরেই রইল। জিজ্ঞেস করলো,
” আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?
চলবে?
লেখনীতেঃ #বৃষ্টি_শেখ
আসসালামু ওয়ালাইকুম। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ নিয়ে ফিরলাম। সকলেই রেসপন্স করবেন। প্রথম পরিচ্ছেদ যারা পড়েননি তারা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পড়ে কিছুই বুঝবেন না। তাই প্রথম পরিচ্ছেদ পড়ে নিবেন।