প্রস্থান — ৫ম পর্ব।
রিফাত হোসেন।
৭.
ফিরোজ আর চিত্রার বিয়েটা ভাঙেনি। তবে বিয়েটা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করতে দুজনকেই গা থেকে খুব ঘাম ঝরাতে হয়েছে! হ্যাপিসে রাতে কোনোরকমে নিজের জবান নিশ্চুপ করে রাখলেও ভোর হতেই বাবা-মাকে সত্যিটা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে, কিছুতেই নিজেকে আর নির্বাক রাখতে পারে না সে। বোধ হয়, বিষয়টি যতটা সিরিয়াস, বাবা-মাকে অবগত করা তাঁর থেকেও বেশি জরুরি। পুরো ঘটনাটাই পরিষ্কার করে বলে সে। সবটা শুনে চিত্রার মা যতটা হতবিহ্বল হয়েছিলেন, চিত্রার বাবা ততটাই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। মুহূর্তেই ফোন করেন ফিরোজের বাবাকে। এমন আপত্তিকর ঘটনার জবাব চান তিনি। বলেন, “খালেদ সাহেব, ও আপনার বাড়ির ছেলে, আপনারা হয়তো মানিয়ে নিয়েছেন এইসবে, কিন্তু আমার মেয়ে এসবে অভ্যস্ত নয়। সে অত্যন্ত সরল মনের একটা মেয়ে, তাই কিছু না বলে বাড়িতে চলে এসেছে। কিন্তু আপনি একবার ভাবুন, যদি ছেলেটা সত্যি সত্যি আমার মেয়ের কোনো ক্ষতি করে দিতো, তাহলে কী হতো?”
খালেদ সাহেব বললেন, “দেখুন বেয়াই মশাই, ঘটনাটা যখন আমি শুনেছি, তখন চিত্রা মায়ের জন্য আমারও খুব আফসোস হয়েছে। ওকে আমি বউমা না, নিজের মেয়ের মতোই দেখি। তাই ওর কিছু হলে আমিও মেনে নিতে পারতাম না। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, সুব্রত অমন কিছু করবে না। ও আসলে অন্তর থেকে খুব ভালো ছেলে। ওর জন্ম থেকে আমি ওকে দেখে আসছি। বাইরে থেকে ও যতটা কঠিন, ভিতর থেকে ততটাই নরম।”
খালেদ সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে চিত্রার বাবা বললেন, “না না, আপনি ওর হয়ে আমাকে বোঝাতে আসবেন না। ওকে সাপোর্ট দিবেন না আপনি। আমি বুঝতে পারছি, ছেলেটা মানসিক ভাবে অসুস্থ। ওর চিকিৎসার প্রয়োজন।”
“ভুল ভাবছেন আপনি। আসলে আমাদের সাথে ওর সম্পর্কটা এখন মান-অভিমানের মধ্যে বিরাজ করছে। এমনিতে ও ভালো, সুস্থ ছেলে। খুব মেধাবী। ওর অফিসের বস আমার বন্ধু। উনি বলেন, সুব্রতর মতো ইন্টেলিজেন্ট ছেলে জীবনে খুব কম দেখেছেন।”
“না না ভাইজান, আপনি আমাদের কাছে অনেককিছু গোপন করেছেন। বিয়ের আগেই এত গোপনীয় ব্যাপার সামনে আসছে, বিয়ের পর হয়তো আরও কিছু জানতে পারব। তখন আফসোস করার চেয়ে এখনি এই ব্যাপারটার সমাপ্তি ঘটানো দরকার। আমার মনে হয় আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে কোনো সম্মন্ধ হওয়া উচিত না।” চিত্রার বাবা কিছুতেই শান্ত হচ্ছিলেন না। ভিতরে ভিতরে তিনি খুব ক্ষিপ্ত ছিলেন। ভদ্রতার খাতিরেই যেন কোনোরকম রূঢ় আচরণ থেকে বিরত থেকেছেন।
চিত্রার বাবার কথা শুনে খালেদ সাহেব ভীষণ মর্মাহত হয়ে বললেন, “এসব কী বলছেন ভাই? বিয়ের দাওয়াত দেওয়া হয়ে গিয়েছে। এখন বিয়েটা এভাবে ভেঙে গেলে আমাদের মান-সম্মান সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।”
চিত্রার বাবা দৃঢ় গলায় বললেন, “সবকিছুর উর্ধ্বে আমার মেয়ের নিরাপত্তা। সবদিক ভেবেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
খালেদ সাহেব অনুরোধ করলেন, ঠিক পায়ে পড়ার মতো করেই বললেন, “আমার উপর আর একবার ভরসা করে দেখুন, ভাই। কথা দিচ্ছি, চিত্রার একটুও অসুবিধে হবে না। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কখনোই হবে না। সুব্রতকে আমি সতর্ক করে দিবো, ও যেন চিত্রার সামনে না আসে কখনো।”
এত অনুরোধের পরও চিত্রার বাবার হৃদয় কোমল হয়নি তখন। নিজের সিদ্ধান্তে অটুট ছিলেন তিনি। কিন্তু সেদিনই খালেদ সাহেব সপরিবারে তাঁদের বাড়িতে উপস্থিত হন। এরপর অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর ভদ্রলোক নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন, অনেকটা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। কারণ এই সামান্য কারণে বিয়ে ভেঙে দেওয়ায় তাঁর বিন্দুমাত্র সমর্থন ছিল না। পাক্কা দুদিনের আলোচনার পর আবার দুই পরিবারের মধ্যে সবকিছু স্বাভাবিক হয়। পূর্বে নির্ধারিত তারিখই বিয়ে হবে, এই বলে দুই পরিবারই একে অপরকে আশ্বস্ত করেন।
এই ঘটনার চার-পাঁচদিন পর চিত্রাও সহজ হয়ে ওঠে সবকিছুতে। সেদিনকার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটা ভুলতে চেষ্টা করে। সুব্রত ভাইয়ের প্রতি যতটা ক্ষোভ ভিতরে ছিল, তা কোমল হৃদয় দিয়ে শ্রদ্ধায় পূর্ণ করে। এটা বলে নিজেকে শান্ত করে, দোষটা আসলে তাঁরই! কারোর ঘরে গিয়ে, তাঁর ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দেওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করে আরও নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন ছিল।
কেনাকাটা প্রায় শেষ। বিয়ের যখন আর তিনদিন বাকি, তখন রুটিন বা অভ্যাসগত ভাবে রাত ৯টার দিকে চিত্রার মোবাইলে ফিরোজের ফোন এলো।
চিত্রা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। খুব ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে বাইরে। বাড়ির সামনের বড় নারিকেল গাছের একটা ডাল তাঁর ব্যালকনির কাছে এসে ঠেকেছিল। বাতাসে ওটা নরছিল খুব। ৫তলা ভবনের সেকেন্ড ফ্লোরে তাঁরা থাকে। সে হঠাৎ খপ করে ডালের একটা পাতা ধরে, মুঠোবন্দি করে ফোন রিসিভ করল। কণ্ঠে একরাশ খুশি ঢেলে বলল, “তোমার কথাই ভাবছিলাম।”
“আচ্ছা!” চোখ বড় বড় করে মুচকি হাসল ফিরোজ। “ম্যাডাম তাহলে এখন ব্যস্ততাকে দূরে ঢেলে আমাকে নিয়ে ভেবে সময় ব্যয় করে।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ জবাব। তাছাড়া আমি কোথায় ব্যস্ত থাকি? ব্যস্ত তো তুমি থাকো। সারাদিনে তোমাকে ফোনে পাওয়া মুশকিল।” ঈষৎ অভিমানী ভঙ্গিতে শেষের কথাগুলো বলল চিত্রা।
“ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। কাল থেকে ছুটি।”
“সত্যি?” উৎফুল্লতা খেলে গেল চিত্রার চোখ-মুখ দিয়ে। চোখ বড় বড় ফিরোজের জবাবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
ফিরোজ ফিক করে হেসে বলল, “একদম সত্যি। মিথ্যে হলে আমার মাথা আর তোমার হাতের মুঠি।”
“হুম, মনে থাকে যেন। এর মধ্যে অফিসের কথা বললে না, মাথা ফাটিয়ে দিবো একেবারে।” হেসে কুটিকুটি হলো চিত্রা। এভাবেই কথা চলতে লাগল দীর্ঘক্ষণ। একটা সময় সে হঠাৎ গম্ভীর হলো। গলা নামিয়ে অনুমতি চাইল একটা জরুরি কথা বলার জন্য। “আচ্ছা, একটা কথা বলব, রাগ করবে না তো? আগেই সাবধান করছি, রাগ করা যাবে না কিছুতেই।”
“ধুর পাগলি! রাগ করব কেন?”
“রাগ তো তোমাদের রক্তে মিশে আসে। তাই ভয় করে। অনেকদিন ধরেই ভাবছি কথাটা জিজ্ঞেস করব, কিন্তু সাহস পাচ্ছি না। আমি খুব ভীতু কী-না! সবকিছু ভুলে গেলেও এই একটা কথা ভুলতে পারছি না। প্রশ্নটা আমার মাথা থেকে সরছে না। পোকার মতো জ্বালিয়ে মারছে আমাকে।”
“তুমি কি ওর সম্পর্কে কিছু জানতে চাচ্ছ?” চিত্রার সম্ভাবনা প্রশ্নটা বুঝতে পেরে গম্ভীর হয়ে গেল ফিরোজ।
চিত্রা বলল, “ও মানে? ভাই বলতে পারো না। উনি তো তোমাদের বড় ভাই। কনাও তেমন। শুধু ‘ও’; ভাই বলবে না। কেমন মানুষ তোমরা?”
প্রসঙ্গটা ভালো লাগল না ফিরোজের। সে বিরক্তিমুখে বলল, “আমি ফোন রাখছি।”
“আহা শোনো না। এভাবে রাখছি বললেই হবে? আমি মেনে নিবো নাকি? প্রশ্নটা আগে করতে দাও।”
কিছু বলল না ফিরোজ। বিরক্তিতে একটা বড় শ্বাস ফেলল। চিত্রা শুনলো শ্বাস ফেলার শব্দ। নিজেকে কিছুটা প্রস্তুত করে, সময় নিয়ে বলল, “তোমাদের কথা শুনে এটুকু বুঝেছি, সুব্রত ভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল একবার। আমার প্রশ্ন হলো, যদি হয়েই থাকে, তাহলে উনি কোথায়?”
ফিরোজ প্রবল অনাগ্রহের সাথে সংক্ষিপ্ত করে বলল, “নেই।”
“নেই কেন? কোথায় গেছে? আর তুমি সেদিন সুব্রত ভাইকে খুনি-অপরাধী, এইসব বলেছিলে কেন? উনি কি বেঁচে নেই? উনার মৃত্যুর জন্য কী কোনোভাবে সুব্রত ভাই দায়ী? কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব?” ছবির কথাটা গোপন রাখল চিত্রা; কেন রাখল সে নিজেও জানে না।
চিত্রার প্রশ্নগুলো শুনে ফিরোজ বলল, “এখন এইসব নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো, চিত্রা। তিনদিন পর আমাদের বিয়ে। আমাদের এখন পূর্ণাঙ্গ মনোযোগ বিয়েতেই থাকা উচিত। বিয়েটা শেষ হোক৷ এরপর তোমাকে আমি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিবো।”
“কিন্তু..।”
“আমার ধৈর্যের পরিক্ষা নিও না, চিত্রা। আমার ধৈর্য কম। রাখছি ফোনটা।” এই বলে চিত্রাকে শব্দোচ্চারণের সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো ফিরোজ।
তীব্র নিরাশায় আচ্ছন্ন হয়ে বসে রইল চিত্রা। ঠোঁট কামড়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এত রাগ কারোর থাকতে আছে? আমার সাথে বিয়ে হলে আরও কতকিছু সহ্য করতে হবে। অনেক ধৈর্যশীলও হতে হবে। আল্লাহ জানে এই লোক কীভাবে আমাকে সহ্য করবে!”
ঘরে এসে ভাবতে লাগল চিত্রা, ফিরোজের কথা না, সুব্রত ভাইয়ের কথা। লোকটার প্রতি তাঁর কৌতূহলের শেষ নেই। তাঁর মন চাচ্ছে আরও একবার ওই ‘স্টাডি রুমে’ যেতে। ওখানেই কৌতূহল দূর করার মন্ত্র সংরক্ষিত আছে!
বিয়ের দিন উপস্থিত হলো। চিত্রাদের সাড়া বাড়ি লোকজনে পরিপূর্ণ। হৈচৈ, আনন্দোৎসব লেগে আছে। দুপুরের পর ঘরে ছোট ভাই-বোনদের রসিকতার পাত্রী হয়ে বসে ছিল সে; নানান জনের নানান কথা! কেউ কেউ বাসর রাত নিয়ে হাসি-তামাশা করছে। চিত্রার ভাই-বোনেরা ফিরোজের সরকারি চাকরি নিয়ে নিজেদের জানা-অজানা হাজারটা সম্ভাবনা কথা বলে যাচ্ছে; সরকারি কর্মকর্তারা এমন হয়, ওরা এটা করতে জানে না, রোমান্টিকতায় ঢ্যাঁড়স হয় ওরা। এইসব শুনে হাসি পাচ্ছিল চিত্রার। কিন্তু সেভাবে হাসতে পারছিল না, দুষ্টু বোনেরা বলেছে, এইসময় এত হাসলে মেকাপ নষ্ট হবে। বর ফিরেও তাকাবে না। কথাটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য চিত্রা জানে না, তবে সে হাসছে না। নিজেকে সংযত রেখে প্রাণপণে চেষ্টার মধ্যে দিয়ে। আসলে মেয়েরা নিজেদের রূপের ব্যাপারে রিস্ক নিতে একদম পছন্দ করে না। এইক্ষেত্রে এরা কুসংস্কারও মেনে নেয়।
এভাবেই চলছিল সবকিছু, হঠাৎ চারিদিক থেকে আওয়াজ আসতে লাগল, হৈচৈ, চিল্লাফাল্লা বেড়ে গেল; বর এসেছে! মুহূর্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সবাই, একা বসে অস্থির হয়ে পড়ল চিত্রা। অকস্মাৎ একটা ভয়, এক শঙ্কা তাকে আকড়ে ধরল। ভেতরটা ঢিপঢিপ করতে লাগল। আজ তাঁর জীবনের সাথে আরও একটা জীবন গভীর ভাবে জড়াতে যাচ্ছে। এমন একটা জীবন, যে জীবন তাঁর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে। তাকে যেকোনো কাজে অনুমতি দেওয়া না দেওয়ার ক্ষমতা আছে যার, সেই জীবন। সেই জীবন, যার সাথে এক ঘরে, এক বিছানায় পাশাপাশি থাকতে হবে। মন, শরীর, সবখানেই যার স্পর্শ থাকবে, চলাফেরা থাকবে। তাকে পুরোপুরি ভাবে অন্য একটা মানুষের উপর নির্ভরশীল হতে হবে। এ যেন একটা পরিক্ষা। আজকে বধূবেশে, এই বিয়ের পূর্ব মুহূর্তে চিত্রার মনে হলো, এই পরিক্ষা মোটেই সহজ হয়, ভয়ংকর কঠিন! আর মাত্র কিছুটা সময়, এরপরই সে সম্পূর্ণ অন্য একজনের হয়ে যাবে। এতদিন বাবা-মায়ের তাঁর উপর যতটা অধিকার ছিল, আজ থেকে ওই মানুষটারও তাঁর উপর ততটা অধিকার থাকবে। এটা এমন কোনো বন্ধন নয়, যেখান থেকে ইচ্ছে করলেই বেরিয়ে আসা যাবে। এক স্কুলে মন না টিকলে যেমন অন্য স্কুলে যাওয়া যায়, এই বৈবাহিক বন্ধনে মন না টিকলে তেমন চট করে অন্য কোনো সম্পর্কে যাওয়া যাবে না। এই সম্পর্কে প্রয়োজনে নিজেকে এডজাস্ট করে থাকতে হবে। একটা বন্ধন, একটা মায়া, একটা দায়িত্ববোধের সম্পর্ক এটা। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক হলো পৃথিবীর অন্যতম এক মধুর সম্পর্ক। খুব শীঘ্রই এই সম্পর্কে প্রবেশ করতে যাচ্ছে সে। এই মুহূর্তে, একাকী ঘরে বসে যেন হঠাৎ করেই তাঁর অন্তত বিচলিত হয়ে উঠল, ব্যাকুল বনে গেল সে! রুদ্ধশ্বাস শুরু হলো উত্তেজনায়!
বেলা গড়িয়েছে। সন্ধ্যার পূর্বমুহূর্ত আর বিয়ের পূর্বমুহূর্ত একত্র হয়েছে। চিত্রাকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসা হলো। সোফায় বসে ঘোমটা সামান্য উঁচিয়ে আড়চোখে পাশে তাকালো সে। চোখাচোখি হলো। তৎক্ষনাৎ বিদ্যুৎ বয়ে গেল সারা শরীরে। বরবেশে ফিরোজকে যেন ভিনদেশী কোনো রাজপুত্রের মতো দেখতে লাগছে! লজ্জা আর উদ্বেগ মিশে একাকার হলো তাঁর মধ্যে। ছড়িয়ে পড়ল দেহের প্রতিটি অঙ্গে, ভিতরে ভিতরে থরথর করে কাঁপতে লাগল সে। ফিরোজেরও একই অবস্থা। বড় একটা দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে সে। যেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়াবে, অপর মানুষটিকে খুশি রাখা, সবসময় সঙ্গ দেওয়া, নিজেকে আস্থাশীল হিসেবে প্রমাণ করা; যাতে ওই মানুষটা জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়েও বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন না হয়, ঘাবড়ে যায় না। একজন তাকে ঘিরে আছে, ঠিক যেন ব্যক্তিগত-একান্ত আপন পাহারাদার হয়ে, এমনটা মন থেকে বিশ্বাস করাতে হবে; যে সুখে-দুঃখে সবসময় সাথ দেবে। হাত ছাড়বে না কখনো।
কাজী সাহেব ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন। চারিদিকে এতক্ষণ যে হাসির কলরব শোনা যাচ্ছিল, এখন সেটা ক্ষীণ হয়েছে। সবাই মনোযোগ দিয়েছে পাত্র-পাত্রীর দিকে। তাঁদের মুখে একে অপরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কথা শোনার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কবুল বলার আগে চিত্রা সহসা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “সুব্রত ভাই আসেনি?”
ফিরোজ মাথাটা সামান্য কাত করে, ফিসফিস করে বলল, “তুমি আবার ওর কথা জিজ্ঞেস করছ। কাজী সাহেব এক্ষুনি কবুল বলতে বলবে। এখানে মনোযোগ দাও।”
চিত্রা মলিন সুরে বলল, “কিন্তু আজকের দিনে তাঁর এখানে থাকা উচিত ছিল। ছোট ভাইয়ের বিয়ে, দায়িত্ব আছে না। অথচ উনি নেই।”
ফিরোজ ক্ষীণ রাগ করে বলল, “আজকের দিনে অন্তত আমাকে একটু হাসিখুশি থাকতে দাও। মুড খারাপ করো না।”
আর কথা বাড়ালো না চিত্রা। বিমর্ষচিত্তে বসে রইল। ফিরোজও স্বস্তিতে বসল। কিছুক্ষণ পর কাজী সাহেবের নির্দেশে কবুল বলে, রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করল দুজনে।
বিদায়বেলা সবার জন্যই বেশ কষ্টদায়ক হলো। এমনকি প্রতিবেশীরাও অশ্রু ঝরালো। সবার কাছেই চিত্রা ভারী লক্ষ্মী মেয়ে ছিল, পছন্দ করতো সবাই। খালাতো ভাই, মাহিমকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল চিত্রা। অথচ ছেলেটা কী শক্ত মনের, একটুও কাঁদল না, বরং রসিকতা করে বলল, “বর পেয়ে আমাকে ভুলে যেও না যেন।”
অশ্রুসিক্ত চেহারা নিয়েই ফিক করে হাসল চিত্রা। ভাইয়ের পিঠে আলতো করে কিল বসিয়ে বলল, “চুপ হারামি।”
চিত্রার বোনেরা ফিরোজের উদ্দেশ্যে বলল, “এই যে দুলাভাই, আমার বোনের খেয়াল রাখতে হবে কিন্তু। একটুও কষ্ট দেওয়া যাবে না। যত্নে রাখতে হবে।”
ফিরোজ হেসে বলল, “খুব রাখব।”
অন্য একজন বলল, “আর যখন মন চাইবে, বাড়িতে আসতে দিতে হবে। একদম বাঁধা দেওয়া যাবে না।”
“শালিকাগন, আপনাদেরও যখন মন চাইবে, তখন চলে যাবেন। আপনাদেরও খুব যত্ন করব।”
চিত্রার ফুফাতো বোনটা চোখ পাকিয়ে বলল, “বাব্বাহ! দুলাভাই দেখি খুব কথা জানে। সে দেখা যাবে, এমন জ্বালাবো না, শেষে কান ধরে শালিকাদের কাছে মাফ চাইতে হবে।”
সবাই হেসে উঠল বিদায় মুহূর্তেও। চিত্রাও ঘোমটার আড়ালে মিটমিট করে হাসতে লাগল।
সবচেয়ে কঠিন আর বেদনাদায়ক দৃশ্য হলো বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেওয়া। চিত্রার চোখ জোড়া যেন বাধাহীন হয়ে পড়ল। অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরতে লাগল তাঁর দুই নয়ন থেকে। বাবা-মাকে এমনভাবে ঝাপটে ধরে রাখল, তাকে ছাড়াতে বেশ বেগ পেতে হলো সবাইকে।
গাড়ি চলে যাওয়ার পরে প্রতিবেশীরা আস্তে আস্তে স্থান ত্যাগ করতে লাগল। কিন্তু চিত্রার বাবা-মা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন সেখানে। চিত্রার বাবা গোপনে, এবং চিত্রার মা প্রকাশ্যে কাঁদতে লাগলেন। তাঁদের মনে হলো, দেহের ভিতর থেকে কেউ যেন কলিজাটা খুলবে নিয়ে চলে গেল এক মুহূর্তে! বিধ্বস্ত হয়ে পড়লেন দুজন।
গাড়ি হাইওয়ে ধরে ছুটছে দ্রুতবেগে। আকাশে চাঁদের আলো বিরাজ করছে। ঘড়িতে রাত ৮টা বাজতে চলল। চিত্রা বেশ অনেকটা শান্ত হয়েছে ইতোমধ্যে। জানালার কাচ নামিয়ে দিয়ে, বাইরের দিকে মুখ করে বসে আসে সে। শোঁ শোঁ আওয়াজ করে বাতাস ঢুকছে গাড়ির ভিতরে। চিত্রার বাধা চুলগুলো এলোমেলো হয়েছে। এলোপাতাড়ি উড়ছে সেগুলো। ঢেউ খেলছে। ফিরোজ সহসা বলল, “বিয়ের দিন পার্লারে যাওয়া সবচেয়ে বড় বোকামি। সেই চোখের জলের সাথে সব পাউডার মিলিয়ে যায়। শুধু শুধু টাকা নষ্ট!”
কথাটা আচমকা শুনে বিস্ফারিত হলো চিত্রা৷ ভুরু কুঁচকে তাকালো ফিরোজের দিকে। চোখ কঠিন করে বলল, “খুব কিপ্টে তো তুমি। আমার বোনেরা একদম ঠিক বলেছিল।”
হো হো করে হেসে উঠল ফিরোজ। ড্রাইভিং সিটের পাশে বসে থাকা কনাও হেসে উঠল উচ্চস্বরে। চিত্রা অভিমান করে, মুখে ভেংচি কেটে আবার জানালার দিকে মুখ ফেরাতে গেলে বাধাপ্রাপ্ত হলো। ফিরোজ তাঁর হাত মুঠো করে নিয়েছে। সে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে ফিরোজের দুই চোখের দিকে তাকালে ফিরোজ ইশারায় বলল, তাঁর কাধে মাথা রেখে শুতে। তাই করল চিত্রা। কাঁধে মাথা রেখে পরম শান্তিতে শ্বাস নিলো এবং ছাড়ল। সামনের সিট থেকে কনা কেশে কেশে বলল, “ড্রাইভার ভাই, গাড়িটা আস্তে চালাও৷ এই পথ যেন সহজে শেষ না হয়।”
ড্রাইভার মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিলে সে পিছনে ঘুরে বলল, “ভাইয়া, একটা ছবি তুলি? ঠিক এভাবেই। দারুণ হবে।”
চিত্রা আঁতকে উঠল, “না না, এখন না। দেখো চেহারার কী অবস্থা! খুব ক্লান্ত লাগছে। ছবি মোটেও ভালো হবে না।”
ফিরোজ বলল, “আহা, তুলতে দাও। ছবিটা কেমন হবে, সেটার থেকেও স্বরণীয় হবে এই মুহূর্তটা। একটা নির্দিষ্ট সময় পর এই রূপটা থাকবে না। কিন্তু এই মুহূর্তটা, যেমন আজ এটি মহামূল্যবান থাকবে, তেমন সেদিনও থাকবে। আমাদেরকে আজকের মুহূর্তটা মনে করিয়ে দিবে এই ছবি। স্মৃতি হয়ে থাকবে।”
ফিরোজের এমন কথার পর আর ‘না’ করার সাধ্য কোথায়? অতঃপর ছবিটা নিয়ে নিলো কনা। সে ছবি তুলে নিজেই নিজের খুব প্রশংসা করল; সে ছাড়া নাকি এমন সুন্দর ছবি আর কেউ তুলতে পারবে না!
৮.
জানালা দিয়ে একবার দুতোলা বাড়িটা দেখল রশ্মি। গত দু’দিন ধরেই দেখে আসছে সে। খুব ধুমধাম আয়োজন। এইসব তাঁর ভালো লাগে না। এই উৎসব মুখরিত পরিবেশ তাঁর কাছে বিষাক্ত মনে হয়। আজকাল কিছুই ভালো লাগে না তাঁর।
নতুন বউ এসেছে গতকাল। আজ বউভাত। কাল গভীর রাতে একপলক বধূকে দেখেছিল সে! রাত তখন আনুমানিক ২টা। জ্যোৎস্না ভেজা রাত ছিল ওটা। পুরো শহর জ্বলজ্বল করছিল চাঁদের আলোয়। সে জানালার পাশে বসে ছিল তখন। হঠাৎ দেখল, নববধূ দোতলার একটা ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাকৃতিক বাতাস উপভোগ করছিল বোধহয়! পাশে বরও ছিল। ওরা দু’জনে দাঁড়িয়ে জ্যোৎস্না স্নান করছিল, আর সে জানালার পাশ ঘেষে দাঁড়িয়ে, মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। ওই মুহূর্তটুকু তাঁর ভালো লেগেছিল কেন জানি! অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছিল অন্তরে। প্রকৃতিও যেন ওই মুহূর্তে তাঁর পাশে ছিল। সারারাত জ্যোৎস্না ছিল। আর ওরা যতক্ষণ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল, ততক্ষণ তাঁর সময়টা আরামদায়ক ছিল।
দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। রশ্মি তাকিয়ে দেখল, মা দাঁড়িয়ে আছে। জানালার পাশ থেকে সরে এসে বিছানায় বসল সে। মাথাটা নিচু করে মৃদুস্বরে বলল, “আসো।”
ভিতরে ঢুকলেন রুমানা বেগম। হাতে একটা গোলাপি রঙের শাড়ি। কাছে এসে তিনি বললেন, “নে, এটা তোর জন্য।” মেয়ের দিকে শাড়িটা এগিয়ে দিলেন তিনি।
মায়ের কথা শুনে তাজ্জব বনে গেল রশ্মি! বিস্ময়কর চোখে তাকিয়ে বলল, “আমার জন্য মানে? এটা দিয়ে আমি কী করব?”
“শাড়ি দিয়ে কী করে মানুষ? পরবি। আজ বিয়ে বাড়িতে যাবি। কাল তো কত করে বললাম, গেলি না। আজ যেতেই হবে।”
“ধুর!”
“তা বললে আজ আর মানছি না।” কথায় জোর দিলেন রুমানা বেগম। নিজের যে অধিকারটুকু আছে, সেটুকু খাটানোর একটা চেষ্টা করলেন।
রশ্মি দাঁড়িয়ে বলল, “আমি যাচ্ছি না। এইসব অনুষ্ঠান আমার ভালো লাগে না। তোমার মন চায় তো যাও।”
“আরে আমার একার যাওয়ার হলে কালই যেতাম। তাছাড়া কিছুক্ষণ আগে ফিরোজের মা এসেছিল, বারবার বলে গেছে আজ ওই বাড়িতে যেতে। কনাও এসেছিল। তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।”
“মা, প্লিজ। জোর করো না তো।” মুখটা বিরক্তিতে পূর্ণ করে ঘর থেকে বেরোনোর জন্য পা বাড়াল রশ্মি।
রুমানা বেগম সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “আমার একটা অনুরোধ অন্তত রাখ। আমি ওদের কথা দিয়েছি, আজ তোকে নিয়ে যাব। না গেলে খুব লজ্জায় পড়ব। কেউ দাওয়াত দিলে সেটা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।”
হাল ছেড়ে দিলো রশ্মি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “আচ্ছা যাব। কিন্তু এইসব পরতে পারব না। প্রতিদিন যা পরি, সেগুলোই পরব। থ্রিপিস।”
“ধুর! তা হয় নাকি? আজ বউভাত। শাড়িই পরতে হবে। তাছাড়া তুই জানিস, শাড়ি পরলে তোকে কত সুন্দর দেখায়?”
মায়ের দিকে ফিরল রশ্মি। বলল, “তুমি জানো?”
“হ্যাঁ, জানি তো।” উজ্জল হেসে জবাব দিলেন রুমানা বেগম।
রশ্মি বলল, “কী-করে জানো? তুমি মনে হয় আমাকে বেশ ক’বার শাড়ি পরতে দেখেছ?”
“দেখেছি না? অবশ্যই দেখেছি। ছোটবেলায় নিজের হাতে তোকে কতবার শাড়ি পরিয়েছি৷ তখন তো তুই খুব শাড়ি পরতে চাইতি। অনেক পছন্দ করতি শাড়ি।”
“তাই নাকি?” চোখ বড় করে তাকালো রশ্মি, যেন এই গোপন সত্যটা তাকে খুব অবাক করে দিয়েছে।
রুমানা বেগম সস্নেহে স্বীকার করে বললেন, “জানিস, তোর বাবা যখন শাড়ি আনতো, তখন তাকে একই রঙের, একই ডিজাইনের দুটো করে শাড়ি আনতে হতো। কারণ তুই আমার শাড়ি নিয়ে টানাটানি করতি৷ আর আমার সাইজের শাড়ি তো তোর হতো না। ছায়া-ব্লাউজ কিছুই হতো না। সেজন্য সব ডাবল আনতে হতো। দুটো ভিন্ন সাইজের।”
মায়ের কথা শুনে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে চোখ জোড়া অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো রশ্মি। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে মুখে একটা শব্দ করে বেরিয়ে গেল।
রুমানা বেগম পিছন থেকে চেঁচিয়ে বললেন, “কিন্তু যাচ্ছিস কোথায়?”
ড্রয়িংরুমে এসে মা’কে জবাব দিলো রশ্মি। “বিড়ালগুলোকে খাবার দিয়ে আসি।”
বাইরে এসে অনেক লোকজন দেখতে পেলো রশ্মি। দুপুর হয়েছে। লোকজন সব বিয়ে বাড়িতে আসতে শুরু করেছে। সে দেখল, প্রায় সবার পরণেই শাড়ি। হঠাৎ উপরে তাকিয়ে দেখল, সুব্রত ভাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শাড়ি পরিহিত সুন্দরী মেয়েদের দেখছে। কী হলো জানা নেই, আচমকা তাঁর বড় হিংসে হলো! সে নিজের মনেমনে বলল, “প্রত্যেক নারীর অন্তত একবার শাড়ি পরিধান করা নৈতিক দায়িত্ব!”
৫ম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।
গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=824338735177495&id=100028041274793