প্রস্থান — ৩১তম পর্ব। রিফাত হোসেন।

0
500

প্রস্থান — ৩১তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

দীর্ঘক্ষণ পর খালেদ সাহেব তীব্র গম্ভীর গলায় বললেন, “সুব্রত, আমরা ঠিক করেছি তোর বিয়ে দিবো। আর পাত্রী হিসেবে রশ্মিকেই আমাদের পছন্দ!”
“কীহ্!” সুব্রতর থতমত খেয়ে গেল খালেদ সাহেবের কথায়। বিস্ফারিত চোখে, চিত্রার পাশে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রশ্মির মুখের দিকে তাকাল।
রশ্মি যেন ভয়ে আরও কুঁকড়ে গেল! আড়চোখে সুব্রতকে একবার দেখে খপ করে চিত্রার হাত খামচে ধরল।
সুব্রতর প্রতিক্রিয়ার জবাবে খালেদ সাহেব বললেন, “হ্যাঁ, ওকেই ঠিক করেছি আমরা। ওর মায়ের পূর্ণ সমর্থন আছে এখানে।”
“আপনারা কি পাগল হয়ে গেছেন?” সুব্রত ফোঁস করে উঠল সাপের মতো! গজগজ করে বলল, “আমার বিয়ে! তাও আবার রশ্মির সাথে!” এরপর সে এমনভাবে সবার দিকে তাকাতে লাগল, যেন তাঁর বিশ্বাসই হচ্ছে না মুহূর্তটা!
খালেদ সাহেব দাঁড়ালেন এবার। দুই হাত পিছনে নিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “বিয়ে ঠিক করার জন্য পাগল হতে হবে কেন? তাছাড়া এখানে খারাপ কি আছে? সবারই সমর্থন আছে এই সম্মন্ধে।”
সুব্রত দাঁত খিঁচিয়ে এগিয়ে গেল রশ্মির দিকে; চিত্রার পাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ও; সামনে গিয়ে ক্ষুব্ধ গলায় বলল, “তোমারও সমর্থন আছে এখানে? এত সাহস!”
ধমকে উঠল সুব্রত, সাথে সাথে কেঁপে উঠল রশ্মি; চিত্রার হাতটা আরও প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরল।
রশ্মির থেকে জবাব না পেয়ে আরও ক্ষেপে গেল সুব্রত। খপ করে ওর একটা হাত ধরে হ্যাঁচকা টানা দিলো। সাথে সাথে চিত্রাকে ছেড়ে দিলো রশ্মি, নয়তো হাতটাই ভেঙে যেত!
রশ্মিকে মাঝখানে দাঁড়িয়ে করিয়ে সামনে দাঁড়াল সুব্রত; দুই কাঁধে হাত রেখে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “চুপ করে আছো কেন?” সাথে সাথে রশ্মির শরীরটাকে ঝাঁকাতে লাগল সে। আরও বলল, “বলো, এই সম্মন্ধে তোমার সমর্থন আছে? তোমারও কী মনে হয় আমার সাথে বিয়ে হলে তুমি ভালো থাকবে? নীরব না থেকে এদের সত্যিটা বলে দাও। এদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।” রশ্মিকে ছেড়ে দিলো এবার। খালেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার এতই অধঃপতন হয়েছে, যে আমি ওকে বিয়ে করতে যাব?” এরপর জবাবের আশায় আবার ঘুরল রশ্মির দিকে। কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকল।
সবাই হতভম্ব সুব্রতর এমন আচরণে! রশ্মি মাথাটা সামান্য তুলে সুব্রতকে আবার দেখল, আবার টুপ করে মাথা নুইয়ে ফেলল।
সুব্রত গর্জে উঠল আবার, “কী হলো, বলো সবাই।”
রশ্মি শিউরে ওঠে বলল, “বলেছি তো। মা-কে বলেছি।”
“কী বলেছ?”
“বলেছি, আপনাকে আমার সহ্য হয় না। দেখলেই গা জ্বলে!”
“মানে?” সুব্রতর ভুরু কুঁচকে গেল সহসাই!
রশ্মি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল, “না মানে, মা-কে বলেছি, আপনাকে আমার পছন্দ না।”
“এইসব কী বলছ তুমি?
অপ্রস্তুত হগে পড়ল রশ্মি। মাথা তুলে কাঁদোকাঁদো ভঙ্গিমায় তাকালো সুব্রতর দিকে।
সুব্রত নিষ্পলক ভাবে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর হাল ছেড়ে দিয়ে, বিরক্তিমাখা গলায় বলল, “সবাই শুনেছেন ওর কথা?” বিশেষ করে খালেদ সাহেবকে ইঙ্গিত করে কথাটা বলল সে, ওদিকেই কাঠিন্য দৃষ্টি স্থির করে বলল, “যখন আমরা দুজনেই দুজনের জন্য প্রস্তুত না, তখন আপনারা কীভাবে আমাদের বিয়ে নিয়ে আলোচনা করেন? তাছাড়া আমি এতটা নির্বোধ হয়ে যাইনি যে, নিজের থেকে প্রায় অর্ধেক বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করব। আমি তো ওর সাথে এভাবে কল্পনাও করিনি কখনো।”
সবাই স্তব্ধ! এমনসময় খালেদ সাহেব সুব্রতর এগিয়ে এগিয়ে এসে বলল, “তোর রশ্মিকে নিয়ে সমস্যা, না বিয়ে নিয়ে সমস্যা, সেটা আমাকে পরিষ্কার কর আমাদের কাছে।”
সুব্রত শক্ত গলায় বলল, “এইতো মেইন পয়েন্টে এসেছেন। আসলে আমি বিয়েই করতে চাই না। আমি কখনো ভাবিইনি আবার বিয়ে করব।”
“এভাবেই জীবনটা শেষ করবি?”
“আমার জীবন তো অনেকদিন আগেই শেষ!” তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসল সুব্রত। ধীর পায়ে হেঁটে বলল, “আমি এখন শুধু পুড়ছি! একদিন ছাঁই হয়ে যাব। এই মুহূর্তে বিয়ে নিয়ে ভাবা মানে জেনেশুনে নিজের সাথে সাথে আরও একটা প্রাণকে হত্যা করা। আমি আর পাপ করতে পারব না।”
“নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাববি না? সারাজীবন একা থাকা যায়? তোর খেয়াল রাখবে কে? তুই নিজের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত না থাকলেও আমি চিন্তিত। আমার দায়িত্ব আমি পালন করছি। রশ্মির যেমন তোকে দরকার, তেমনি তোর রশ্মিকে দরকার। তোরা একে অপরের পরিপূরক!”
সুব্রত ব্যাঙ্গ করে বলল, “খুব দায়িত্ব পালন করেছেন আপনি। আপনার দায়িত্বশীলতাই তো আমাকে এত উচ্চ মর্যাদা দিয়েছে।” এরপর সে অত্যন্ত সিরিয়াস হয়ে বলল, “দয়া করে আর চিন্তিত হবেন না আমাকে নিয়ে। আর রশ্মি।” রশ্মির দিকে তাকাল সে। “আমি জানি তুমিও চাও না, আমার মতো একজনের সাথে তোমার বিয়ে হোক। সত্যি এটাই সে, তোমাকে নিয়ে ভাবার মতো সময় আমার নেই। ইনফ্যাক্ট, এই পৃথিবীর কাউকে নিয়েই আমি আর ভাবি না। তাই বলছি, অন্যের প্ররোচনায় প্রভাবিত হয়ে নিজের বিপদ ডেকে এনো না। নিজের মনের কথা শোনো।”
সুব্রতর কথা শুনে মাথা ঝাঁকাল রশ্মি, নির্লিপ্ত ভাবে!
আরও একবার সবার দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল সুব্রত; আর পিছনে তাকাল না।

সুব্রত চলে যাওয়ার পর আবার নীরবতা নেমে এলো ড্রয়িংরুমে। বাতাসটাও থমথমে হয়ে এলো পূর্বের ন্যয়। কয়েক মিনিট নির্বিকারে বসে থাকার পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুমানা বেগম বললেন, “আমরা তাহলে আসি, ভাইসাব। ভাবি, এলাম।”
খালেদ সাহেব কাতর গলায় বলে উঠলেন, “আর একটু বসে যান, ভাবি।”
মৃদু হাসলেন রুমানা বেগম। বললেন, “আর বসে থেকে কী হবে? আমাকে আবার বেরোতে হবে। চাকরির খোঁজ করতে হবে। আমি তো ব্যাস, মাফ চাইতে এসেছিলাম। আপনি মাফ করেছেন, এটাই অনেক। বাকিটা তো ভাগ্যের খেলা!”
খালেদ সাহেব বললেন, “আমি যদি চাকরির একটা বন্দব…!”
লজ্জাপূর্ণ ভঙ্গিতে রুমানা বেগম বললেন, “না না ভাই, প্রথম থেকেই অনেক করেছেন আপনারা। আমি নিজে একটু চেষ্টা করি। এরপর না-হয়৷”
খালেদ সাহেব মাথা নুইয়ে নিলেন। আফসোসের সাথে বললেন, “কী করব আমি এই ছেলেকে নিয়ে? ভাইজান বেঁচে থাকলে আর এইসব হতো না।”
রুমানা বেগম আবারও বড় করে শ্বাস নিয়ে সোফা থেকে ওঠে দাঁড়ালেন। মেয়ের কাছে গিয়ে বললেন, “চল, মা।”

চিত্রাদের বাড়ি থেকে বেরিয়েই মায়ের প্রতি রূঢ় হলো রশ্মি, “তোমাকে কে বলেছে এখানে আসতে? আমাকে না জানিয়ে তুমি আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলতে এসে এসেছ এখানে? কীসের এত তাড়া তোমার?”
রুমানা বেগম ভার গলায় বললেন, “যেদিন আমার জায়গায় এসে দাঁড়াবি, সেদিন বুঝতে পারবি, আমার এত তাড়া কীসের!”
“বোঝার জন্য তোমার বয়সে যাওয়ার দরকার নেই। এখনি বুঝি আমি। আমি তোমার বোঝা হয়ে কাঁধে চেপে বসেছি কী-না। ভয় নেই, অনার্সটা শেষ হোক শুধু। এরপর চাকরি নিয়ে শহর ছাড়ব। তখন থেকো একা একা।”
“আহা! এইসব কী কথা?”
“ঠিক কথা।” আরও রাগান্বিত হলো রশ্মি। “আমি কখনো বলেছি, আমার উনাকে বিয়ে করতে মন চাইছে? শুধু অপমানিত হতে হলো আমাদের। এমনভাবে বলল, যেন আমি ফেলনা। তুমি আমাকে উনায় গলায় ঝুলিয়ে দিতে চাচ্ছ। উনার অধঃপতন হলে নাকি আমাকে বিয়ে করবে! বিয়ের গুষ্টিরপিণ্ডি! আর যদি তুমি বিয়ে বিয়ে করো, তো এখনি আমি বাড়ি ত্যাগ করব।”
এভাবেই মা-কে শাসাতে শাসাতে বাড়িতে ঢুকল রশ্মি, এরপরেও থামল না, চলতেই থাকল।

৩৯.
ঘরে এসে আলমারি থেকে রুশার ছবিটা বের করল সুব্রত। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দীর্ঘক্ষণ। কয়েক মিনিট এভাবেই কেটে যাওয়ার পর অকস্মাৎ সে বলে উঠল, “রুশা, তুমি কোথায়-কী অবস্থায় আছো আমার জানা নেই। জানি না, এই পৃথিবীর কোনো খবর তোমার কাছে পৌছায় কী-না। যদি পৌছায়, তবে আমি বলতে চাই, এই জীবনে আমি তোমার মতো আর কাউকে ভালোবাসতে পারব না। আজকাল কিছু নির্বোধ লোকজন আমার ভবিষ্যতের কথা ভাবে! কী আশ্চর্য! অথচ যেদিন তুমি আমার জীবন থেকে চলে গেছ, সেদিন থেকেই আমার ভবিষ্যতের পথ অন্ধকারাচ্ছন্নে পরিনত হয়েছে। এই দুর্গম পথে হাঁটা সহজ কাজ? আমার জীবনের সমস্ত উজ্জ্বলতা তো হারিয়ে গেছে তুমি হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে। ওরা আমাকে বারবার ‘ভবিষ্যৎ’ নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আমি যদি নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে এতটাই উৎকণ্ঠিত থাকতাম, তবে সেদিন কী তোমার সুখের কথা ভেবে নিজের দুঃখ কুড়াতাম? অথচ আমি নিশ্চিত ছিলাম, তোমার মুখের একফালি হাসিতেই আবদ্ধ আছে আমার সর্বনাশ!”

সেদিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সুব্রত, রুশার সাথে দীপ্তর দেখা করিয়ে দিয়ে মুখ লুকাবে সে! নয়তো লজ্জায় বাঁচা মুশকিল হতো।
সেদিন বউভাতের অনুষ্ঠানের বেশ কিছুক্ষণ আগে যখন রুশা আর সুব্রত একই ঘরে অবস্থান করছিল, তখন সহসা জানতে চেয়েছিল, “আচ্ছা, তোমার যে বিয়ে হয়েছে, এ-কথা দীপ্ত জানে না?”
পূর্বের মতোই দুই হাঁটুর মাঝে মুখ লুকিয়ে রেখেছিল রুশা; তখনই তাঁর চোখ দুটো ছিল অশ্রুসিক্ত। সুব্রতর প্রশ্ন শুনে মাথাটা সামান্য তুলে বলল, “হয়তো জানে। ভাইয়া তো আমাকে ঘরে প্রায় বন্দী করে রেখেছিল।
“আর ওকে?” সুব্রত বুকে কষ্ট চেপে জানতে চেয়েছিল।
রুশা বলে, “হয়তো ওকে মেরেছে। গুণ্ডামি ছাড়া আর কী করতে পারবে? আমি জানি না দীপ্ত এখন কী অবস্থায় আছে। নিশ্চয়ই ভালো নেই ও। থাকবে কীভাবে? আমাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল ও। শুধুমাত্র আমার জন্যই রাজনৈতিক হওয়ার স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়েছিল নিজের হাতে। অথচ দেখুন। সব হয়েছে আপনার জন্য। আমি আপনাকে কক্ষনো ক্ষমা করতে পারব না।”
সুব্রতর বুক কেঁপে ওঠেছিল রুশার অতন কঠিন আক্রমণে! আপনমনে ভাবছিল, “আমি এতটা খারাপ রুশার চোখে? এই জনমে ও কী আমাকে ভালোবাসবে? ওর যে হৃদয়ে আমার প্রতি শুধুই ঘৃণা, সেখানে কী কখনো ভালোবাসা জন্মাবে?”
প্রশ্নের জবাব পাচ্ছিল না সুব্রত, দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিল খুব। এরপর যখন বউভাতের অনুষ্ঠানে রুশার পাশে বসল সে, তখন হঠাৎ জানতে চাইল, “আচ্ছা, দীপ্তর বাড়ি কোথায়?”
সুব্রতর কথা শুনে আকস্মিক চঞ্চল হয়ে রুশা বলল, “কেন? আপনি দীপ্তর খোঁজ করবেন?”
সুব্রত চমকে ওঠে। “আস্তে। কেউ শুনলে?” এরপর স্বাভাবিক হয় সে। ফিসফিস করে বলে, “আজ তো ওই বাড়িতে যাবে তুমি। ওই বাড়িতে এত লোকজন নেই। তোমার ভাই তো এখন আটকেও রাখবে না তোমাকে। নিশ্চয়ই ওখান থেকে পালানোর চেষ্টা করবে।”
রুশা দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “মরে গেলেও ওই বাড়িতে যাব না আমি। ওটা কোনো বাড়ি না। একটা দোযখ।”
রুশার কথা শুনে আরও শিহরিত হয় সুব্রত। তখন আর কিছু বলেনি।
দুপুরের দিকে যখন লোকজন আসতে শুরু করল বাড়িতে, তখন তাঁদের মধ্যে আরিফকেও দেখতে পেলো সুব্রত। ওইসময় থেকেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। খাওয়াদাওয়া শেষে লোকজন একটু কমে এলে দুতোলায় আরিফকে একা পেলো সে। হাত ধরে, অনেকটা জোর করে একটা ফাঁকা করে নিয়ে গেল।
আরিফ গর্জে উঠল সঙ্গে সঙ্গে, নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “ছাড়ো বলছি। কী করছ তুমি?”
সুব্রত ফোঁসফোঁস করছিল আরিফের দিকে তাকিয়ে। ওর অমন হম্বিতম্বি শোনার পর আরও ক্ষিপ্ত হয়ে শার্টের কলার চেপে ধরে বলল, “শালা! কী করছি মারাচ্ছিস! আমার সাথে গেইম খেলে এখন আমাকে ধমকাচ্ছিস।”
আরিফের কপালে ভাজ পড়ে সাথে সাথে। বলে, “কী বলতে চাচ্ছ তুমি? আমি কীসের গেইম খেলেছি তোমার সাথে?”
“খেলিসনি? রুশার সাথে যে দীপ্ত নামের ছেলেটার প্রেম আছে, সেটা গোপন করে আমাদের বিয়ে দিসনি?”
আরিফ মাথা নুইয়ে ফেলে এবার। গম্ভীর গলায় বলে, “হ্যাঁ, গোপন করেছি এটা। নিজের বোনের ভালোর জন্যই এমনটা করেছি। ছেলেটা আমার বোনের সাথে সম্পর্ক গড়েছিল, যেন ভবিষ্যতে ওর দ্বারা আমাকে দুর্বল করতে পারে। আমার বোনকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছে ও। আমার মাসুম বোন সেটা বুঝতে না পারলেও আমি পারি। আমি যে রাজনীতি করি, সেটা যেমন সুস্থ না, তেমনি ওরটাও সুস্থ না। গেইম ও খেলতে চেয়েছে, আমি শুধু আমার বোনকে বাঁচিয়েছি।”
“এইসবের মধ্যে আমাকে টেনে আনলি কেন? আমাকে কেন ব্যবহার করলি?” রাগে গজগজ করে জানতে চায় সুব্রত।
“আমি তোমাকে ব্যবহার করিনি। তোমার মধ্যে আমার বোনের প্রতি সত্যিকারের প্রেম দেখেছি আমি। তুমি মন থেকে ওকে ভালোবাসো। এখানে কোনো চাল ছিল না। আমার বোনের সুখের কথা ভেবেই তোমার সাথে রুশার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলাম।”
“আর আমার সুখ?” তীব্র ঘৃণার সাথে আরিফকে সামনে থেকে সরিয়ে দেয় সুব্রত। অঅন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, “জীবনে প্রথমবার কাউকে পাশে চেয়েছিলাম। অথচ তাকে পেয়েও যেন পাইনি। কাল রাতে আমি যন্ত্রণায় ছটফট করছিলাম, যখন শুনে ওর মনে আমার প্রতি শুধুই ঘৃণা আছে। ও ভালোবাসে অন্য কাউকে। একবার ভাবো, তখন আমার মনের উপর দিয়ে কী বয়ে যাচ্ছিল! রুশা আমাকে যমের মতো ভয় পায়। আমি যখন ওর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন ও থরথর করে কাঁপছিল। আমার জায়গায় যদি অন্য কেউ হতো, তবে আজ নিজের বোনকে জীবিত দেখতে পেতে?” সুব্রতর চোখ ভিজে আসে কথা বলতে বলতে। গলা ভারী হয়ে ওঠে।
আরিফ এগিয়ে আসে সুব্রতর দিকে। কাঁধে হাত রেখে বলল, “সেজন্যই আমি তোমার সাথে ওকে বিয়ে দিয়েছে। তুমি ওকে মন থেকে ভালোবাসো। ও যে মন থেকে ভালোবাসে, সে ভালোবাসার মানুষের ক্ষতি করতে পারে না। ওর সুখটাই বড় হয়ে দাঁড়ায় তখন। আমি জানি, আমার বোনকে তোমার থেকে বেশি, কেউ ভালো রাখতে পারবে না।”
অশ্রুসিক্ত চোখে হাত ডলতে ডলতে আরিফের দিকে তাকায় সুব্রত, সামান্য বিনয়ী হয়ে বলে, “নিজের বোনের সুখের জন্য আমাকে পাপী বানালে? রুশা না-হয় ওর ভালোবাসা বন্ধু হয়েই অনুভব করতাম।”
আরিফ ধরা গলায় বলে, “আমি মাফ চাচ্ছি তোমার কাছে। কিন্তু বিশ্বাস করো, এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমার হাতে। বোনটাকে নিয়ে সারাক্ষণ টেনশনে থাকতে হয় আমাকে। একটা নোংরা রাজনীতির প্রতিযোগিতা চলছে এই শহরে। কে কতটা নিকৃষ্ট হতে পারে, সেই খেলা। মুখোশ পড়ে আছে সবাই। আমার বোন সেই মুখোশটারই মোহতে আছে।”
“আমি কী করব এখন? তুমিই বলে দাও।”
“যা ইচ্ছা করো, শুধু আমার বোনটাকে কষ্ট দিও না।”
আরিফের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসে সুব্রত। রুশাকে খুশি করার একটাই উপায় আছে। আর উপাই-এ আছে তাঁর সর্বনাশ!
নিজেকে সামলে নিয়ে সুব্রত বলে, “আমার ক্ষতি তো করেই ফেলেছ। এবার দয়া করে একটা উপকার করো।”
“বলো। আমি সব করব।” আরিফ দৃঢ় কণ্ঠে বলল।
সুব্রত বলল, “আমি চাই রুশাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। অন্তত কিছুদিনের জন্য। এই ক’দিনে আমি যথাসম্ভব চেষ্টা করব রুশার মাথা থেকে দীপ্তকে সরাতে।”
আরিফ অবাক হয়ে বলে, “আজ তো আমাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা।”
“রুশা কখনোই ওই বাড়িতে যাবে না।”
“কিন্তু?”
“ওখানে না গেলেই রুশা ভালো থাকবে। যদি চাও ও ভালো থাকুক, তবে নিজের মা-কে বুঝাও, এই মুহূর্তে আমরা তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছি না। যদি সব ঠিক হয়ে যায়, তবে কথা দিচ্ছি, আমি নিজে রুশাকে তোমাদের কাছে নিয়ে যাব।”
আরিফ নিরুপায় হয়ে বলে, “ঠিক আছে।”
সুব্রত বলে, “আমি সবাইকে বলব, আমার এক বন্ধু বিয়েতে উপহার হিসেবে দুটো প্লেনের টিকিট দিয়েছে। দেশেরই কোনো জায়গার নাম বলব।”
আরিফ সংকুচিত হয়ে বলে, “কিন্তু আসলে তোমরা যাবে কোথায়?”
“সেটা এখনো ঠিক করিনি। গিয়ে জানাব।”
সুব্রতর এমন উদ্ভট আচরণও পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে মেনে নিতে বাধ্য হয় আরিফ।

পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়ে সুব্রত আর রুশা। অনেক কষ্টে বাড়ির সবাইকে রাজি করাতে হয়েছে সুব্রতকে। কাজটা ছিল অসাধ্যসাধন! বিয়ের পরদিনই হানিমুন; ব্যাপারটা কারোরই স্বাভাবিক ঠেকছিল না। কিন্তু আরিফ জোর দেওয়াতেই সুব্রতর বাড়ির আর কেউ তেমন বাধা সৃষ্টি করেনি।

গাড়িতে বসে বারবার রুশার দিকে তাকাতে লাগল সুব্রত। রুশা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে ওকে সামান্য প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে। গতকাল রাতেই সে অবগত হয়েছে, পরদিন সকালে সে দীপ্তর কাছে ফিরছে। এরপর থেকেই ওর মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেখে। কিছুটা বিষণ্ণতাও। কী জবাবা দিবে দীপ্তকে, এই টেনশনে সারারাত নির্ঘুমে কাটিয়েছে সে।
গাড়ি এগোচ্ছে দ্রুত গতিতে। সহসা সুব্রত জানতে চাইল, “এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছ, রুশা?”
সুব্রতর কথা শুনে ফিরে তাকাল রুশা। নিচের দিকে তাকিয়ে মিহি সুরে বলল, “ভাবছি।”
“কী ভাবছ?”
“আপনি আমাকে বিয়ে করলেন। অথচ এখন আবার আমাকে দীপ্তর কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। কেন? কী উদ্দেশ্য আপনার?”
মৃদু হাসল সুব্রত। বলল, “আমি তোমাকে এটা বলতে চাই, জেনেশুনে আমি তোমার সর্বনাশ করিনি। তোমার পরিবারের গোপনীতার স্বীকার আমি। আমি জানতাম না তুমি কাউকে ভালোবাসো। এইরকমটা গল্পে হয় জানি। বাস্তবেও হয়, তা অজানা ছিল। আর আজকের যুগে তো। আমি শুধু পাপ মুক্ত হতে চাই। তোমার ঘৃণার পাত্র হয়ে সারাজীবন বাঁচতে পারব না।”
সুব্রতকে থামিয়ে দিয়ে রুশা বলল, “হঠাৎ আমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন কেন?”
বিষণ্ণ মুখে সুব্রত বলল, “বাড়িটা?”
“হ্যাঁ?” ভুরু কুঁচকে তাকাল রুশা।
সুব্রত বলল, “এই ঠিকানাই দিয়েছিলে। এরপর কোথায় যাবো? কোন বাড়িটা?”
রুশা বিস্মিত হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। দীপ্ত যে এলাকায় থাকে, সেই এলাকায় এসে গেছে তাঁরা। সে বলল, “একটু ভেতরে। গাড়ি যাবে না ওদিকে। হাঁটা পথ। দু’মিনিট।”
সুব্রত অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, “এবার?”
জবাব না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে থাকল রুশা। কিছুক্ষণ পর সুব্রতই বলল, “যাও তবে, যেখানে তোমার সুখ নিবদ্ধ, সেখানেই ফিরে যাও।”
রুশা নির্বিকার ভাবে গাড়ি থেমে নামল। ঝুঁকে, জানালা দিয়ে ভিতরে চোখ রেখে বলল, “আপনি নানবেন না?”
সুব্রত অন্যদিকে মুখ রেখেই বলল “উঁহু! সহ্য হবে না। তুমি যাও। সুখি হও। এইটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি, আমি কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াব না তোমাদের জীবনে।”
রুশা মৃদু হাসে। আজ ভীষণ আনন্দিত সে। গত সপ্তাহ মৃতপ্রায় হয়ে বেঁচে ছিল। আজ হৃদয় তাঁর প্রাণ ফিরে পেয়েছে! সুব্রতর কথার জবাবে বলল, “জানি না কীভাবে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাব। শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আপনার জীবনে এমনক কেউ আসুক, যে শুধুই আপনার।”
সুব্রত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে বলল, “এবার যাই তাহলে।”
“সবাইকে কী বলবেন? আমার ভাই যদি আপনার ক্ষতি করে?”
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি আর বাড়িতে ফিরব না।”
“তবে?” চমকে যায় রুশা।
“আপাতত কোনো হোটেল। এরপর বিদেশ। বাকি জীবন ওখানেই থাকব।”
রুশা মুখ কালো করে বলল, “আমার জন্য আপনি পরিবারের থেকে এভাবে হারিয়ে যাবেন?”
সুব্রত কিছু বলতে পারে না রুশাকে। শুধু মনেমনে ভাবে, “আমি তো হারাতেই চেয়েছিলাম; তোমাকে নিয়ে, গহীন রাজ্যে; যা একটু একটু করে তৈরি করেছিলাম আমি!”
জবাব না দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় সুব্রত। এরপর এগিয়ে চলে। মিররে যতক্ষণ রুশাকে দেখা যায়, সে এক দৃষ্টিতে দেখে। ক্রমশ ছলছল হয়ে যায় চোখ, রুশাকে ঝাপসা দেখায়। আর একদম দূরত্ব এসে তাঁর দৃষ্টির প্রখরতা রুদ্ধ করে নেয়। রুশা অদৃশ্য হয়ে যায়।

৩১তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=846134799664555&id=100028041274793

বি:দ্র: আজকেও চেক দিতে পারিনি। বিকেলে ঢাকা থেকে ফিরে লিখতে শুরু করেছি। মাত্রই শেষ হলো। পর্বটা কেমন হয়েছে জানবেন। শুধুমাত্র আপনাদের গঠনমূলক পর্যালোচনার আশাতেই এই পরিশ্রম। আপনারা চান বলেই রোজ ৩-৪ ঘণ্টা সময় নিয়ে লিখি। এই উপন্যাসটা কোনো এক সময় বই আকারে আসবে। অনেক চেঞ্জও হবে। তাই আপনাদের মতামতের বিশেষ প্রয়োজন। ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here