প্রস্থান — ২১তম পর্ব।
রিফাত হোসেন।
“তিনবার দেখা হয়েছে রুশার সাথে। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ হলো, আজ এখন পর্যন্ত রুশার নম্বরটা চাইতে পারিনি। এর মধ্যে এমন কিছু করতে পারিনি, যার মাধ্যমে ওর এটা উপলব্ধি হবে, আমি ওকে খুব পছন্দ করি না। আসলে রুশাই প্রথম মেয়ে, যার প্রতি আমি এতটা আকৃষ্ট; এতটা ব্যাকুল থাকি যার সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু আমি মেয়েদের ব্যাপারে এতটাই অনভিজ্ঞ এবং সংকুচিত যে, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না ওকে কীভাবে মনের কথা জানাবো। সারারাত অনেকে ভেবে ঠিক করেছি, রুশাকে মনের কথা না বলতে পারি, ওর পরিবারের অন্য সদস্যদের তো আমার অনুভূতি সম্পর্কে অবগত করতে পারি। যেমন ভেবেছি, তেমনই কাজ করেছি।
তখন বিকেলবেলা ছিল, বসন্তের মাঝামাঝি, প্রকৃতির সৌন্দর্য ছড়িয়ে ছিল শহরময়। যেখানে কারখানার কালো ধোঁয়ার ছেয়ে আছে সবকিছু, সেখানে এই সময়টাতে গাছে গাছে সবুজের সমারোহ, পাখিদের ডাকাডাকি-উড়োউড়ি! আমি গাড়িটা নিয়ে রুশাদের এলাকায় যাই। পরণে ছিল লাল পাঞ্জাবি, সাদা পাজাম। গন্তব্য রুশাদের বাড়ি। একাই ছিলাম আমি। যখন বাজার-মল পেরিয়ে নিরিবিলি রাস্তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখনই একটা টং দোকানে দৃষ্টি স্থির হয়, এক দেখাতে চিনে ফেলি মানুষটাকে; রুশার বড় ভাই। তাঁর পাশে আরও ক’জন ছেলে ছিল, কারোর বয়স অল্প, কারোর বেশি। আমি গাড়িটা রাস্তার পাশে থামিয়ে এগিয়ে যাই লোকটার দিকে।
লোকটার নাম আরিফ। প্রায় আমার সমবয়সী; বেশিও হতে পারে তিন-চার বছরের। গতকাল যখন রুশা আমাকে গাড়ি অব্দি পৌঁছে দিতে এসেছিল, তখন জানতে পেরেছিলাম ওর ভাই একজন রাজনীতিবিদ। পেশা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র চিন্তা ছিল না। জানা ছিল, যুবক বয়সে রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত লোকেরা একটু পাগল কিসিমের হয়। অল্পতে মাথা গরম হয় এদের। তবে এইসবে আমার ভয়ভীতি ছিল না কখনো। এমন না যে আমার জীবনের পরোয়া নেই। আবার এমনও না আমি প্রচণ্ড সাহসী। আসলে আমার ভাবনায় তখন একটা ব্যাপারই ছিল, রুশাকে নিজের করে নেওয়া। এর জন্য যা-কিছু করা প্রয়োজন আমি করব। ওর ভাই আমাকে গ্রহণ না করলে প্রয়োজনে আমিও নির্দয় হবো তাঁর প্রতি৷ তাঁর অসম্মতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করব। যা-ই হোক, জীবনে যখন একবার কাউকে ভালোবেসেছি, যেকোনো বিনিময়ে তাকে আমি নিজের করে নিবো।
আমাকে দেখে আরিফের তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। তিনি একপলক আমাকে দেখে আবার নিজের সঙ্গীদের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম তাঁর সামনে। নিজেকে স্বাভাবিক করে খুব বিনয়ের সাথে সালাম দিয়ে বললাম, “ভাই, আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।”
আরিফ এবার ভ্রুক্ষেপ করল আমাকে। বলল, “আপনিই সে-ই না, যে আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন বাড়ি ভাড়া নিতে?”
“জি।” সংক্ষিপ্ত করে জবাব দিই আমি। আড়চোখে একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে পাই, সবাই এমন নজরে দেখছে আমাকে; যেন আমি কোনো চিড়িয়া!
আরিফ এরপর বলল, “দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।” পাশের ছেলেটাকে ইশারায় সরতে বলল সে।
একটা চেয়ার ফাঁকা হতেই আমি বসে গেলাম সেখানে। আরিফ বলল, “এবার বলুন আপনার কথা। আমার কাছে কেন এসেছেন? আমি তো বাড়ি ভাডা দিই না। ওটা আমার মা দেখে।”
“আসলে আমি অন্য একটা ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি। আপনার মায়ের সাথেও কথা বলা যেতো, কিন্তু পথে আপনাকে দেখে ভাবলাম, আপনার মায়ের থেকেও এই ব্যাপারে আপনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সম্মতি থাকলে আপনার মায়ের সম্মতি নিশ্চিত।”
আমার কথা শুনে আরিফের ভুরু কুঁচকে যায় তৎক্ষনাৎ। সে বলে, “আপনি ঠিক কী বলতে চাচ্ছেন?”
আমি তখন ভিতরে ভিতরে উত্তেজিত বোধ করছিলাম। কথাগুলো বলার পর যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। হয় আমি হাসিমুখে বাড়ি ফিরব, না-হয় রক্তাক্ত হয়ে হাসপাতালে। তবে দুটোর জন্যই প্রস্তুত ছিলাম আমি। সবার উৎসুক চেহারা একবার দেখে বলতে লাগলাম, “দেখুন, আপনি একজন ছেলে; আমার অনুভূতিগুলো আপনি বুঝতে পারবেন সহজে। কখনো না কখনো এমন অনুভূতি আপনার হৃদয়েও জন্ম হয়েছিল। ছোটবেলায় আমার বাবা-মা মারা যান। মাঝে ব্যবধান ছিল মাত্র কয়টা বছর। এরপর থেকেই আমি একা হয়ে পড়ি। আমার বাড়িতে কাকা-কাকী, ভাই-বোন থাকলেও তাঁদের সাথে কখনো প্রানবন্ত হয়ে কথা বলতে পারিনি। হাসতে ভুলে গেছিলাম, কাঁদতে ভুলে গেছিলাম। গত কয়েকটা বছর পাথরের মতো জীবনযাপন করেছি। অফিস আর বাড়ির ছোট একটা ‘স্টাডি’ রুমই ছিল আমার জীবন। পেশায় একজন বিজ্ঞানী আমি। আমার যে গন্তব্য, চিন্তা-ভাবনা, তা পর্যবেক্ষণ করলে আপনিও বুঝতে পারবেন, বাকি জীবনে এমনকিছু করে ফেলব আমি, যা পৃথিবী কখনো কল্পনাও করতে পারেনি আজ পর্যন্ত। শো অফ করছি না, বাট এটা সত্যি, আমি এই মুহূর্তে এমন একটা আবিষ্কারের লক্ষে আছি, যা আমাকে বিশ্ব বিখ্যাত করে তুলতে যথেষ্ট। ইনশাআল্লাহ, আমার অর্থের কোনো অভাব হবে না। গাড়ি-বাড়ি সবই আছে আমার। এত কিছু থাকার পরেও কিছু শূন্যতা আমি অনুভব করি। যা শুধুই শূন্যতা না, আমার সফলতার বাধা। দু’মিনিটের বক্তব্যে প্রেরণা দেওয়ার অনেকেই আছে আমার জীবনে, কিন্তু সবসময় পাশে থেকে সাহস দেওয়ার মতো কেউ নেই। আমার হৃদয়টা পাথরের মতো রুক্ষ হয়েছে, আমি সেটাকে জীবন্ত করতে চাই। আর এর জন্য এমন একজনকে প্রয়োজন, যে আমার একান্ত আপনজন হবে।”
“কিন্তু আপনি এইসব আমাকে বলছেন কেন?” আমাকে হঠাৎ থামিয়ে দিয়ে আরিফ বলে উঠল।
আমি মাথা তুলে উনার দিকে তাকালাম। লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করে বৃথা হলাম। সে এক অদ্ভুত দৃষ্টি রেখে দেখছে আমাকে৷ যার ভাষা খুবই জটিল, আমার বোধগম্য হওয়ার নয়। আমি খানিক আড়ষ্ট হয়ে পড়ি হঠাৎ। মৃদু আওয়াজে বললাম, “আমি আপনার বোনকে বিয়ে করতে চাই।”
কথাটা শেষ করার সাথে সাথে ঘাড়ে একটা শক্ত থাবা অনুভব করি। আমার ঘাড়টা চিনচিন করে ওঠে সাথে সাথে। দাঁত খিঁচিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখি, একটা মোটা দেহের ছেলে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে ফুঁসছে। আমাকে তাকাতে দেখেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “শুয়োরের বাচ্চা, তোর এতবড় সাহস! ভাইয়ের সামনে ভাইয়ের বোনরে বিয়া করার কথা কস।”
ছেলেটার বয়স কম, আমার ছোট ভাই, ফিরোজের থেকেও। মাথায় রক্ত ওঠে যায় আমার৷ বেশ ওজনের হাত, সরাতে পারছিলাম না। কোনোমতে দাঁড়িয়ে অগ্নিমুখ করে হুকুমের সুরে বললাম, “হাত সরাও।”
এমন সময় আরিফ চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায়, আমার ঘাড় থেকে ছেলেটার হাত সরিয়ে ছেলেটার উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলে, “একটা থাপ্পড় মেরে গাল লাল করে দিবো। মাথা বেশি গরম, তাই না?”
ছেলেটা যেন আকাশ থেকে পড়ে আরিফের কথা শুনে। বিস্ময়ে চোখ গোল গোল করে বলে, “ভাই, হালায় কী কইছে আপনি হুনেন নাই?”
“চুপ৷ বাবা-মা পড়াশোনা করিয়েছে তোমাকে অভদ্র বানানোর জন্য? একটা শিক্ষিত, ভদ্রলোকের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হয় জানো না? উনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি। প্রচুর পড়াশোনা জানা। ভদ্রভাবে কথা বলো।”
একটা অজানা শঙ্কায় আমার বুক ঢিপঢিপ করছিল তখন। লোকটার এই ভালোমানুষীর পিছনে কতটা ভয়ংকর উদ্দেশ্য থাকতে পারে, তা ভেবে আমি ঘামতে শুরু করেছিলাম। আসলে আমি অতটাও শক্তিশালী না, যে এতগুলো লোকের বিরুদ্ধে একা লড়াই করার সাহস ভিতরে থাকবে। শুরুতে ভয় না লাগলেও ওই মুহূর্তে বেশ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। লোকটার এমন প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল আমার কাছে। আমি ফ্যালফ্যাল করে দেখছিলাম উনাকে।
আরিফ এরপর উপস্থিত সবার উদ্দেশ্যে বলে, “তোমরা এখন যাও। আমি উনার সাথে কথা বলব, একা।”
“কিন্তু ভাই।” অন্য একটা ছেলে বলে।
আরিফ তখন বলল, “আমার বোন, আমি বুঝে নেবো। প্লিজ, এখন যাও তোমরা।”
আরিফের এমন রূপ আমাকে সত্যিই ভাবাচ্ছিল সেসময়। লোকটার প্রতি আমার ধারণা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত।
টং দোকানটা ফাঁকা হলে আরিফ নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “বাড়িতে একটা বোন থাকলে ভাইদের যে কী জ্বালা, আপনাকে আর কী বলব। একটা বোন তো আপনারও আছে। যখন কাজে ব্যস্ত থাকি, তখন ওরাই আমার বোনের দেখাশোনা করে৷ ভার্সিটি পড়ুয়া বোন। বন্ধুবান্ধবের অভাব নেই। নানানজন নানানরকম উদ্দেশ্য নিয়ে বন্ধুত্ব করে। আপনি ওর আচরণে কিছু মনে করবেন না। আমারই নির্দেশ ছিল, যদি কাউকে সন্দেহপ্রবন মনে হয়, তাহলে সাথে সাথে হাড়গোড় ভেঙে দিতে। আর আপনি তো সরাসরি প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে যাচ্ছিল ওরা।” এরপর আরিফ হাসল মৃদুস্বরে। প্রথমবারের মতো উনাকে হাসতে দেখলাম আমি। আবার বলল, “আপনি দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বসুন না। প্লিজ।”
আমি দোকানীর দিকে তাকাতে তাকাতে বসলাম। দোকানীর অবস্থা ছিল বোধহয় রুদ্ধশ্বাস! কেমন থমকান চেহারা করে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে!
আমি বসলে আরিফ আবার বলল, “আচ্ছা, আমার বোনের সম্মতিতে আপনি আমার কাছে এসেছেন?”
“উনি জানেন না আমি এখানে এসেছি।”
“বলেন কী! আপনাদের কতদিন ধরে সম্পর্ক চলছে?”
“আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়নি এখন অব্দি। উনার সাথে মাত্র তিনবার দেখা হয়েছে আমার। আসলে লাভ অ্যাট ফাস্ট সাইড হয়েছিল আমার।”
“ও আপনাকে পছন্দ করে তো?”
“আমি নিশ্চিত নই এ-ব্যাপারে। আসলে আমি তাকে এখনো বলিনি। আপনাকেই প্রথম বললাম কথাটা।”
আমি মুখ শক্ত করে জাবাব দিচ্ছিলাম। মনোভাবটা এমন ছিল যে, আমি একটা রোবট; কারোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আর আমার প্রতিটি কথায় চমকাচ্ছিল আরিফ। সে ভিতরের কৌতূহলটা দূর করতে চাইল, “আচ্ছা, আপনি সত্যি সত্যিই বাড়ি ভাড়া নেওয়ার উদ্দেশ্যে আমাদের বাড়িতে গেছিলেন?”
এবার কিছুটা নড়ে বসলাম আমি। গলার আওয়াজ নামিয়ে বললাম, “এর জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আসলে সেদিন হুট করেই আপনাদের বাড়িতে চলে গেছিলাম। বিশেষ কারণ ছিল না। আপনার বোন যখন কারণ জানতে চাইল, তখন ‘টু-লেট’ সাইনবোর্ড দেখে আচমকাই বলে ফেলি বাড়ি ভাড়ার কথাটা। আমাদের নিজেদের বাড়ি আছে। ওখানেই থাকি আমি। এরপর যা হয়েছে সবটাই অপ্রত্যাশিত ছিল। আমার ওই মিথ্যাচারও সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত ছিল। তবে নিজের সম্পর্কে আমি এইমাত্র যেটুকু বলেছি, তা সত্য। শো অফ করছি না, বাট আমি সত্যিই মিথ্যা খুব কম বলি।”
আমার কথা শুনে হঠাৎ হেসে ওঠে আরিফ। এরপর দোকানীর দিকে তাকিয়ে বলে, “কাকা, চা দাও আমাদের।”
নির্দেশ অনুযায়ী দোকানী চা দিলে আরিফ তা খেতে শুরু করে। আমি হাতে নিয়ে বসেছিলাম। ভিতরে ভিতরে ভীষণ উত্তেজিতবোধ করছিলাম। কী হবে এরপর?
আরিফ চায়ের কাপের বার কয়েক চুমুক দেওয়ার পর বলল, “আজ পর্যন্ত আমার বোনের ব্যাপারে যা শুনেছি, সবটাই আমাকে রাগান্বিত করেছে। প্রায় সবাই আমার বোনকে উত্যক্ত করতো। ফলে আমাকেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হতো। এই প্রথম এমন একটা ঘটনা ঘটল, যেখানে একটা ছেলে আমার বোনকে কোনোরকম উত্যক্ত না করে সরাসরি আমার কাছে এসেছে। তা-ও আবার সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। সত্যিই আমি খুব মুগ্ধ হয়েছি আপনার প্রতি। খুব ইন্টেলিজেন্ট আপনি। ভেবেছেন, শুধু শুধু মেয়ের পিছনে ঘুরে সময় নষ্ট কেন করব, যেখানে ঘুরলে কাজ হবে, সেখানেই ঘুরি।”
আমি মৃদুস্বরে হাসি আরিফের কথা শুনে। এখানে আসার পর প্রথমবার আমার হাসি দেখতে পায় আরিফ। আমি বললাম, “আপনি যেভাবে ভাবছেন, আমি সেভাবে ভাবিনি। আসলে আমি চিরকাল মেয়েদের থেকে দূরে ছিলাম। একটা মেয়েকে মনের কথা জানানোর সাহসটা নেই আমার। অনেক বই পড়েছি আমি। কিন্তু সেসব পদ্ধতি বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার দুঃসাহস দেখাইনি। জীবনটা তো উপন্যাস না। এটা লেখকের সৃষ্টিও না। খোদার সৃষ্টি। আমার ধারণা, যদি আমি এভাবেই নিশ্চুপ থাকি, তাহলে একদিন রুশাকে হারিয়ে ফেলব। সেজন্যই সিদ্ধান্ত নিই, সরাসরি আপনার মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিবো। রাস্তায় আপনাকে দেখে মনে হলো, আপনার মায়ের থেকেও আপনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই ব্যাপারে। কারণ এখানে আপনার বাবা নেই। অভিভাবক এখন আপনিই।”
আরিফ সহসা আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, “আপনার চিন্তাভাবনা আমার ভালো লেগেছে। আপনি শিক্ষিত। ভালো ক্যারিয়ার। আচরণও শোভনীয়। আমার পছন্দ হয়েছে আপনাকে। যদি বলেন আমার সম্মতি আছে কী-না, তবে আমি বলব, হ্যাঁ; আমার পূর্ণ সমর্থন আছে আপনার সাথে বোনের বিয়ে দিতে। আপনি আপনার নম্বরটা দিয়ে যান। আমি বাড়িতে গিয়ে মায়ের সাথে আলোচনা করে আপনাকে তারিখ জানাবো, যেদিন আপনি সপরিবারে আসবেন আমাদের বাড়িতে।”
“বলছিলাম, রুশা..।”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে আরিফ বলল, “ওকে নিয়ে আপনি ভাববেন না। আমাদের সিদ্ধান্তই শেষ কথা।”
আরিফের দ্বারা আশ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরলাম আমি। বিদেশে আমার যে বন্ধুটি থাকতো, ওকে পুরো ব্যাপারটা জানাতেই ও বলে উঠল, “আরে ইয়ার, এটা কী করেছিস তুই?”
আমি ভড়কে গেলাম। বললাম, “কী করলাম? ভাবলাম তুই খুশি হবি সংবাদটা শুনে। অথচ এমন আচরণ করছিস, যেন আমি কেয়ামত ডেকে নিয়ে এসেছি।”
“কেয়ামত হয়তো ডাকিসনি, কিন্তু ভুল তো একটা করেছিস। আরে ভাই, এটা আধুনিক যুগ। এই যুগে বিয়ে হোক বা প্রেম হোক, মেয়ের ইচ্ছেটাই বড় কথা। তোর চিন্তাভাবনা দেখি সেই ৮০দশকের মতো। মেয়েকে না বলে আগে মেয়ের ভাইকে বললি। এখন যদি মেয়েটা তোমাকে অপছন্দ করতে শুরু করে?”
“আজব তো! অপছন্দ করবে কেন?”
“সেটা যদি বুঝতি, তবে এমন বোকামি করতি না। সবচেয়ে ভালো হতো, যদি আগে মেয়েটার সম্মতি নিতি। যদি এমন হয়, মেয়েটার আগে থেকেই কোনো প্রেমিক আছে?”
“রুশাকে দেখে কিন্তু ওইরকম মেয়ে মনে হয়নি।”
“চেহারা দেখে কী সব বোঝা যায়? তাছাড়া তোকে কেন বলবে ও? মাত্র তিনবার দেখা হয়েছে তোদের। বন্ধুত্বও হয়নি। তুই যে একটা মেয়েকে পছন্দ করিস, সেটা তোর বাড়ির কাউকে বলেছিস? বলিসনি তো। যখন তুই নিজের বাড়ির কাউকেই কথাটা বলতে পারিসনি, তো ভাবলি কীভাবে তোর মতো অপরিচিত একটা লোককে মেয়েটা নিজের সব গোপন কথা বলে দিবে?”
“দেখ, তুই কিন্তু আমাকে সাহস দেওয়ার থেকে ভয়টাই বেশি দেখাচ্ছিস। আমি এই আশায় তোকে ফোন করিনি কিন্তু।”
“আহা! এভাবে বলছিস কেন? আমি তো বলছি না এইরকম কিছুই হবে। আমি জাস্ট সম্ভবনাময় কথাটুকু বললাম। প্রেম করেছি অনেক। অভিজ্ঞতা আছে। তোর মতো আনাড়ি না। তাই সতর্ক করলাম আরকি। তোর উচিত ছিল আগে মেয়েটার ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা জানা। যাক-গে, যখন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছিস, এখন তো আর এইসব ভেবে লাভ নেই। সবচেয়ে ভালো হয় বিয়ের আগে মেয়েটার সাথে কথা বল।”
“তোকে কিন্তু আসতে হবে বিয়েতে। না করবি না। আমার একমাত্র দোস্ত তুই।”
“সেটা বোধহয় সম্ভব হবে না রে। জানিসই তো আমার অবস্থা। মা-কে নিয়ে এলাম বিদেশে। বিয়ে করেছি। এখানেই সেটেল্ড। নিজে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেছি। আমি আর আমার স্ত্রীই সামলাচ্ছি সব। আমি দেশে গেলে এখানকার কারবার কে দেখবে?”
“তাই বলে আমার বিয়েতেই আসবি না?” খুব মন খারাপ হয়ে গেল আমার।
ও বলল, “ব্যবসাটা দাঁড় করিয়ে নেই, এরপর নিশ্চিত যাব।”
আমার ফোন আসছিল একটা অপরিচিত নম্বর থেকে, তাই বন্ধুর থেকে বিদায় নিয়ে ওই কলটা রিসিভ করলাম। সাথে সাথে ওপাশ থেকে আরিফ বলল, “আমি আরিফ বলছি। রুশার ভাই।”
“হ্যাঁ, বলুন।”
“আমি আমার মায়ের সাথে আলোচনা করলাম। বাবাকেও বললাম আপনার কথা। উনারা রাজি।”
আমি উৎফুল্ল কণ্ঠস্বরে জানতে চাইলাম রুশার কথা। আরিফ বলল, “ও রাজি। বলেছিলাম তো আমাদের কথার অমান্য করবে না ও।”
আরিফের কথাটা আমাকে এতটা আনন্দিত করল যে, আমার ইচ্ছে করছিল এক্ষুণি বন্ধুকে ফোন দিয়ে গালাগাল করি। শালা যতসব বাজে দুঃশ্চিন্তা করে! কিন্তু নিজেকে সংযত করলাম আমি।
আরিফ আবার বলল, “তবে একটা শর্ত আছে, বিয়ের তারিখটা খুব তাড়াতাড়ি হতে হবে। এই যেমন সাতদিনের মধ্যে।”
আমি আঁতকে উঠলাম, “সাতদিন? এত তাড়াতাড়ি কীভাবে সম্ভব? আয়োজনের ব্যাপার আছে।”
“সুব্রত সাহেব, আপনি তো জানেন আমাদের বাবা বাহিরে থাকেন। এই মুহূর্তে উনি আসতে পারবেন না। তাই তেমন আয়োজন করে বিয়ে হওয়া সম্ভব না। বাবা এলে তখন নাহয় ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান করা হবে। আপাতত রেজিস্ট্রি করে বিয়েটা হোক। সামান্য আয়োজন থাকবে সেদিন। রুশাকে আপনাদের বাড়িতে নিয়ে যাবেন। তবে আপনারা চাইলে বউ ভাতের অনুষ্ঠান করতেই পারেন। আমরা যাব আপনাদের আনতে।”
“সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু সাত দিনের মধ্যে বিয়ে, আমার বাড়ির লোকদের কীভাবে মানাবো?”
“সেটা আপনার দায়িত্ব।”
“কিন্তু এত তাড়াহুড়ো কীসের?”
আরিফ একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, “কেন এত তাড়াহুড়ো, তা যদি আপনাকে বোঝাতে পারতাম, তবে আমি সত্যিই খুব খুশি হতাম। বাড়িতে বিবাহযোগ্যা বোন। সারাক্ষণ চিন্তায় থাকতে হয়। রাজনীতি করি আমি। বেশ শত্রু তৈরি হয়েছে। বোনটাকে একজন যোগ্য ছেলেটা হাতে তুলে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত হই। আপনি বুঝতে পারছেন আমি কী বলতে চাচ্ছি?”
আমি বুঝতে পেরেছি রুশার ভাইয়ের চিন্তার কারণ। উনার ভয়, বিয়েকে কেন্দ্র করে যেন কোনো অঘটন না ঘটে। অনেকেই হয়তো রুশাকে চায়, যখন শুনবে ওর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তখন তো অনেকে নিজেকে সামলাতে পারবে না। ডেস্পারেট হয়ে রুশার যেন কেউ কোনো ক্ষতি না করে বসে, সেজন্যই এত তাড়াহুড়ো। আমি উনাকে আশ্বস্ত করলাম, “যেভাবেই হোক পরিবারের লোকদের রাজি করিয়ে ফেলব আমি। এবং কালকেই আমরা আসছি।”
আরিফ বলল, “না না, আপনাদের আসতে হবে না। আমি কালকে সকালে একজন ঘটক পাঠাব আপনাদের বাড়িতে। সে যা বলার বলবে।”
“আচ্ছা।”
উনাকে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে আমি ফোন রেখে দেই।
ঠিক পরদিন সকালেই বাড়িতে ঘটক আসে রুশার ছবি নিয়ে। আমার ভাই-বোনেরা আমাকে ডেকে নিয়ে যায়। আমি গিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিয়ে এলাম, আমি বিয়েতে রাজি। ঘরে গিয়ে সাথে সাথে ফোন দিলাম আরিফকে। ঘটক আসার কথা জানিয়ে বললাম, “আমারও একটা শর্ত আছে।”
আরিফ বোধহয় খুব অবাক হয়েছিল আমার মুখে শর্তের কথা শুনে। উনি বলল, “সব ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ। সব ঠিক আছে। শর্তটা হলো, আমার পরিবারের কাউকে জানানো যাবে না যে, আমি আগে থেকেই রুশাকে চিনতাম। এবং ওকে পছন্দ করি।”
“কেন?”
আসলে এই ব্যাপারে আমার বড্ড অনীহা ছিল। আমার ধারণা ছিল, যখন ওরা জানবে আমিও কাউকে ভালোবাসতে পারি, তখন ওরা খুব অবিশ্বাসের চোখে তাকাবে আমার দিকে। যা আমাকে ভীষণ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলবে। সম্মন্ধটা এমনভাবে হওয়া চাই যে, আরিফ আমার পরিচিত। সেই জানাশোনা থেকেই ও আমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
আরিফ আমাকে একটা শর্ত দিয়েছিল, বিনিময়ে আমার শর্ত ওকে মানতেই হতো।
আমার কাকা-কাকী, সবাই রাজি হয়েছিল। তাঁদের সম্মতিতেই পরদিন আরিফ আর উনার মা ঘটকসহ এলো আমাদের বাড়িতে। আমার কাকা-কাকীর সাথে কথা বলল। আমাকে বোঝাতে হয়নি, আরিফ আর উনার মা-ই বলল, মেয়েকে নিয়ে তাঁরা খুব চিন্তিত। ছেলে রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত। ভালো লোকদেরই অনেক বেশি শত্রু থাকে। সবাই মুখিয়ে আছে ক্ষতি করার জন্য। সেজন্যই চুপিচুপি বিয়েটা সাড়তে হবে। মেয়ের বিয়ে হলে তাঁরা চিন্তামুক্ত হয়।
সবাই সুনিশ্চিত হয়েছিল, আমি সংসার বিমুখী। তাই এবার যখন রাজি হলাম, কেউ আর দেরি করতে চাইল না; এই ভেবে, চট করে যদি আমি মন বদলে ফেলি। সেদিনই তারিখ ঠিক বলো। পাঁচদিন পর শুক্রবার, সেদিনই রেজিস্ট্রি করে বিয়ে। বিয়েটা হবে তাঁদের বাড়িতেই। আমার সম্মতি থাকায় কেউ আর প্রশ্ন করল না।
এরপর পাঁচদিন আমাকে খুব ব্যস্ত থাকতে হলো। বিয়ের পর ক’দিন ছুটিতে থাকবো, তাই অফিসের পেন্ডিং কাজ দ্রুত শেষ করছিলাম। এর মধ্যেও আমি ক্ষণেক্ষণে ভাবছিলাম রুশার কথা। ওর নম্বর নেই আমার কাছে। চাইবো যে, এমন কেউ নেই। উদ্বিগ্নতা কাজ করছিল আমার ভিতরে। কিন্তু কারোর কাছে শেয়ার করতে পারছিলাম না। আসলে সেরকম কেউ ছিল না। বন্ধুকে এইসব বলিনি। ও আমাকে প্রতিনিয়ত নিরুৎসাহিত করছিল, সেই ক্ষোভে। বাড়িতে আয়োজন চলছিল। আমি সারাদিন কাজ করতাম অফিসে, বাড়ি ফিরতাম খুব রাতে। এভাবে কেটে গেল ওই পাঁচটা দিন।”
চিত্রা পরবর্তী পৃষ্ঠা উল্টিয়েই দেখতে পায় বিয়ের তারিখটা।
ডায়েরিটা পড়ার পর থেকে স্তম্ভিত হয়ে বসে আছে চিত্রা। নির্লিপ্ত সে। সে ভাবছে, “এইসব কী ঘটেছিল? সবকিছুতেই যেন বড্ড লুকোচুরি। কী ছিল রুশা ভাবির পরিবারের মনে? সুব্রত ভাইও তাঁর রূপে এতটাই মোহিত ছিল যে, তাকে পাওয়ার পর উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল।”
চিত্রা ডায়েরির আরও পাতা উল্টায়। আশ্চর্য! সব ফাঁকা। এরপর কী ঘটেছিল? কিচ্ছু লেখা নেই এখানে। আশেপাশে তাকায় সে। ধোঁয়াশা ঠেকে চোখে। মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। আর কিছু লেখেনি সুব্রত ভাই। তবে কীভাবে জানা যাবে, এরপর কী হয়েছিল?
হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হলো। দ্রুত ‘স্টাডি’ রুমের লাইট অফ করে দিলো চিত্রা। ডায়েরিটা নিঃশব্দে রেখে দিলো ড্রয়ারে। এরপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
ঘরের দরজা খোলা হয়েছে। সুব্রত ভাই এসেছে বোধহয়। এরপর সবকিছু নিস্তব্ধ।
কয়েক মিনিট কেটে যাওয়ার পর আস্তে আস্তে, অন্ধকার হাতড়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল চিত্রা। দরজাটা ভিড়িয়ে রেখেছিল। খুবই ক্ষুদ্র ফাঁকা করে একচোখ দিয়ে দে ঘরটা। কেউ নেই। আশ্চর্য! দরজাটা আর একটু ফাঁকা করে আস্তে আস্তে মাথাটা বের করল সে। বারান্দায় চোখ যেতেই দেখল, সুব্রত ভাই সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। এই সুযোগ!
চিত্রা খুব সাবধানে ঘর থেকে বেরোলো। সুব্রত ভাই বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ঘরে তাঁর মনোযোগ নেই। সে যেভাবে দরজা খুলেছিল, সেভাবেই আস্তে আস্তে দরজাটা লাগিয়ে দিলো পা টিপে টিপে পিছিয়ে যেতে লাগল। তখনই হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল।
অন্যমনস্ক ছিল সুব্রত, আকস্মিক রিংটোনের শব্দ তাকে চমকে দিলো। সে দ্রুত ঘরে আসতেই দেখল, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রা। বিস্মিত গলায় সে জানতে চাইল, “আরে চিত্রা, কখন এলে?”
ভীতসন্ত্রস্ত চিত্রা, কাচুমাচু হয়ে জবাব দিলো, “এইতো, এক্ষুণি। আপনাকে একটা সংবাদ দিতে এলাম?”
সুব্রত আরও এগিয়ে গিয়ে বলল, “তোমাকেও একটা সংবাদ দিই। আমি এইমাত্র খালেদ সাহেবকে গতকালের ঘটনার জন্য ‘সরি’ বলে এলাম।”
চিত্রা ঠোঁট টিপে বলল, “শুনে ভালো লাগল।”
“খুশি হওনি?” ভুরু কুঁচকে তাকাল সুব্রত। বলল, “তোমার কথাতেই সাহস পেলাম। খুব দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলাম কাল থেকে।”
চিত্রা মলিন গলায় বলল, “আমি আজ বাপের বাড়িতে যাচ্ছি, সুব্রত ভাই। এক্ষুণি।”
“এক্ষুণি?” সুব্রত বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। “হঠাৎ যে? আগে তো বলোনি।”
“আমিও জানতাম না। ফিরোজই হঠাৎ বলল। যেতেই হবে। না যাওয়ার পিছনে কোনো কারণ নেই।”
“তবে তোমাকে এত বিমর্ষ লাগছে কেন?”
“সে আপনি বুঝবেন না, সুব্রত ভাই। এই বাড়ির প্রতি, বাড়ির মানুষদের প্রতি এতটা অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, এখন কেমন যেন শূন্যতা অনুভব করছি। খুব মায়ায় পড়ে গেছি সবকিছুতে।”
সুব্রত হেসে বলল, “সেজন্যই বলেছিলাম, মায়া বড্ড সাংঘাতিক নেশা!”
চিত্রা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নতকণ্ঠে বলল, “যাই, সুব্রত ভাই। ভালো থাকবেন। নিজের যত্ন নেবেন। আর এই বোনের কথা ভুলে যাবেন না যেন। আপনি তো আমাদের বাড়িতে যাননি এখনো। একদিন যাবেন। আমার ভালো লাগবে।”
সুব্রত কথা দিতে পারল না। মৃদু হাসল শুধু।
সুব্রত ভাইয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে চিত্রা দেখল, ফোনটা করেছিল ফিরোজ। নিশ্চয়ই কাছাকাছি এসেছে। বলেছিল বাড়ির কাছে এসে ফোন করবে।
বাড়িতে দীপালি বেগম আর কনা ছিল। ওদের থেকে বিদায় নিয়ে সদর দরজার দিলে এগোলো চিত্রা। বেরোনোর সময় সে লক্ষ করল, তাঁর শাশুড়ির ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি লেগে আছে!
বাড়ি থেকে বেরোতেই ফিরোজকে দেখতে পেলো চিত্রা, বাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আর একটু অপেক্ষা করো প্লিজ, রশ্মির সাথে দেখা করে আসি।”
ফিরোজ হাতের ঘড়ি দেখে বলল, “আর সময় কই? আমাকে যে আবার ফিরতে হবে। খুব রাত হয়ে যাবে না? ফোন করে বলে দিও।”
চিত্রার মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল ফিরোজের কথা শুনে। সে করুণ চাহনিতে তাকিয়ে বলল, “কিন্তু তুমি বলেছিলে আজকে থাকবে ওখানে।”
ফিরোজ আফসোসের সুরে বলল, “কী আর বলব, তোমায়; হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হলো। রাতে আমাকে বাবার অফিসে যেতে হবে। হাইওয়ের জমিটা পাওয়া গেছে। এখন অনেক কাজ। আমার থাকা জরুরী। সবদিকেই শুধু কাজ আর কাজ। মাথা নষ্ট হওয়ার জো।”
ফিরোজের কথাগুলো যেন তীরের মতো বিঁধছে চিত্রার হৃদয়ে। সে কাঁদোকাঁদো ভাবে বলল, “আজকাল তোমার সিদ্ধান্তের সাথে সাথে তুমিও খুব পাল্টে যাচ্ছ।”
ফিরোজ ঠোঁটের কোণে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি ফুটিয়ে বলল, “সময়ের সাথে সাথে মানুষকে পরিবর্তন হতে হয়।”
“শুরুতে তো এমন ছিলে না। বাসর রাতে কথা দিয়েছিলে সারাজীবন পাশে থাকবে। আজ এভাবে একা ছেড়ে দিচ্ছ?”
“এই দুনিয়ায় গোটা একটা জীবন কাউকে পাশে পাবে না তুমি। সেজন্য প্রতিটি মানুষকে একা থাকতে শিখতে হয়। নাহলে জীবনটা খুব কষ্টের হয়।”
“তোমার রাগ তো আমি হাসিমুখে সহ্য করে নিতাম। কিন্তু তোমার এই নিষ্ঠুরতা আমি কীভাবে সহ্য করব? এত কঠিন হতে কে শেখাল তোমায়? কে আমার এতবড় শত্রু? প্রয়োজনে আমি হাতজোড় করে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইবো।”
চিত্রার কথা শুনে ফিরোজ অপলক চোখে তাকিয়ে থাকল কয়েক সেকেন্ড। এরপর সহসা বাইকে ওঠে, বাইকটা স্টার্ট দিলো।জবাবের অপেক্ষা করে আর যে লাভ হবে না, তা বুঝতে পেরে নির্বিকার ভাবে বাইকে ওঠে বসল চিত্রা। বাইক চলতে শুরু করেছে, সেই সাথে সংসার থেকে ধীরেধীরে দূরত্ব বাড়ছে। তাঁর ভেতর থেকে কান্না বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। আর্তনাদ এসে জমা হয়েছে গলার কাছে। দমবন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে এটা এমন এক প্রস্থান, যা সারাজীবন তাকে যন্ত্রণা দিয়ে যাবে।
২১তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।
গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=837433127201389&id=100028041274793
বি:দ্র: দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত।