প্রস্থান — ২০তম পর্ব।
রিফাত হোসেন।
বিকেলে ছাদে এলো সুব্রত; অনেকদিন পর তাঁর আগমন এখানে। সময় আর ইচ্ছার অভাবে ঘর আর অফিস ব্যতীত অন্য কোনো স্থানে যাওয়া হয় না তাঁর। আজ সময় ছিল, ইচ্ছেও ছিল; সাথে বিশেষ উদ্দেশ্য!
যেখানে বাড়ির সদর দরজা, তার বরাবর উপরে দাঁড়াল সুব্রত। সামনের রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায় এখান থেকে। ডানে আর বাঁ দিকে বসতবাড়ি থাকলেও পিছন-দিকে ফাঁকা; কিছু সংখ্যক লম্বাচওড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। আম গাছ, নারিকেল গাছ, এছাড়া আরও কয়েক নামের গাছ। সবগুলোর মাথাতেই ঘন সবুজ পাতার ঘোমটা। সারাদিনের নিরলস পরিশ্রমের পর সূর্যটা ক্লান্ত হয়ে পশ্চিমে হেলেছে। উত্তাপ নেই বিন্দু পরিমাণ। প্রগাঢ় বিকেলে কিছু কোকিল পাখি বসে আছে গাছগুলোতে। ওদের ডাক শোনা যাচ্ছে। আরও কয়েক ধরনের শব্দ, যা শুনতে ভারী অদ্ভুত লাগে, কিন্তু চেনা যায় না, ওগুলো কোন পাখির ডাক। শুধু কিচিরমিচির শব্দ। কানে লাগে, তবে তীক্ষ্ণ ভাবে মনোযোগ দিলে নানান গানের সুর খুঁজে পাওয়া যায়।
সুব্রত রেলিঙ-এ হাত রেখে নিচের দিকে তাকাল একবার। ডানে তাকিয়ে দেখল তাঁর ঘরের বারান্দাটা। রুশার মুখটা সাথে সাথে সাদৃশ্য হলো। জীবনের শেষ সময়টা এখানেই কাটিয়েছিল রুশা। ওকে শেষবার এখানেই দেখেছিল সে।
রুশার কথা ভেবে সুব্রতর চোখ ভিজে এলো। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা ওই একজনকেই দিতে চেয়েছিল সে। নিজের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল একসময়, ওর জন্য নিজের জীবনটা পর্যন্ত দিয়ে দিতে দুবার ভাবনে না। কিন্তু সেই সুযোগ হয়নি ও বেঁচে থাকতে।
হঠাৎ কারোর পায়ের শব্দ সুব্রতকে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। দ্রুত চোখ মুছে সে পিছনে তাকিয়ে দেখল, খালেদ সাহেব সিঁড়ি দিয়ে ওঠে ছাদে এসে দাঁড়ালেন। হাতে সিগারেট। বাড়িতে ছেলে-মেয়ের সামনে কখনো ধূমপান করেননি তিনি। অফিসে অথবা ছাদেই এই কর্মটি করে থাকেন সবসময়। এটা জানতো সুব্রত, তাই আজ সে-ও এসেছে। ভদ্রলোক ছাদে এসে তাকে প্রথমে দেখেনি বোধহয়; যখন দেখল, তখন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
সুব্রত দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে আবার দূরের রাস্তাটায় চোখ রেখে খালেদ সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল, “আপনি ধূমপান করতে পারেন। আমার অসুবিধা নেই।”
খালেদ সাহেব সাথে সাথে বেশ ভিন্ন মনোভাব নিয়ে বললেন, “আমি ছেলে-মেয়েদের সামনে ধূমপান করি না।”
সুব্রত আবার ঘুরে, খালেদ সাহেবের চোখে চোখ রেখে দৃঢ় গলায় বলল, “আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
চমকিত হলেন খালেদ সাহেব। বিস্ময় দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর সিগারেটটা ফেলে দিয়ে, পায়ের স্যান্ডেল দিয়ে ওটাকে পিষে এগিয়ে এলেন। কাছে গিয়ে ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “বল, কী বলবি।”
সুব্রত ঘুরে আবার অন্যদিকে তাকাল। চোখে চোখ রেখে কথা বলার দুঃসাহস দেখাল না। মুখ অন্ধকার করে, নতকণ্ঠে বলল, “গতকাল রাতের ব্যাপারটা নিয়ে আমি দুঃখিত।”
কিছু না বলে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে থাকলেন খালেদ সাহেব। তাঁর ভুরু জোড়া শুধু ক্ষীণ কুঁচকাল!
সুব্রত আবার বলল, “আমার ওভাবে বলা উচিত হয়নি। পরবর্তীতে আমি জানতে পারি, আসলে আমি আপনাকে ভুল বুঝেছি। কোনো মানুষই সবক্ষেত্রে ঠিক হয় না, মাঝে মাঝে ভুল হয়। আমারও তেমন একটা ভুল হয়েছিল গতকাল। সেজন্য আমি অনুতপ্ত।”
খালেদ সাহেবের চোখ-মুখ সহসা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি অভিভূত হয়ে বললেন, “এটা ভেবে আনন্দ লাগছে, তুই আমাকে মাফ করে দিয়েছিস।”
সুব্রত চমক খেয়ে বলল, “আজব কথা! আমি আপনাকে ক্ষমা করতে যাব কেন? বরং আমি নিজের অন্যায় কর্মের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি আপনার কাছে। আই অ্যাম রিয়েলি ‘সরি’।”
“হোয়াই ইউ আর সরি ? আই অ্যাম সরি।”
“কিন্তু কেন?” কৌতূহলী চোখে খালেদ সাহেবের দিকে তীক্ষ্ণ চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকল সুব্রত।
খালেদ সাহেব অকস্মাৎ নিভে গিয়ে বললেন, “এই কেন-র উত্তরই নেই আমার কাছে। আমি কখনো বলতে পারব না, যুবক বয়সে কত বড় অন্যায় করেছিলাম আমি। ভাইজান আর ভাবি বেঁচে থাকলে আমাকে এতটা অনুতপ্ত হতে হতো না। তাঁদের অনুপস্থিতিতেই আমি ক্ষণেক্ষণে টের পাচ্ছি, আমি একজন ভয়ংকর অপরাধী। হয়তো সয়ং আল্লাহ ও আমাকে ক্ষমা করবেন না।”
সুব্রত কিছু বলতে পারল না। খালেদ সাহেবের এই কথাগুলো তাঁর কাছে ভীষণ অপরিচিত!
সুব্রতকে নির্লিপ্ত দেখে খালেদ সাহেব নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “বাদ দে এইসব কথা। এগুলো পুরোনো দিনের আলাপ। সবার ভালোর জন্যই গোপন আছে। আজীবন থাকবে।”
সুব্রত কিছুক্ষণ পর বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, “আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওই হাইওয়ের পাশের জমিটা আপনার নামে লিখে দেবো।”
“মানে?” ভড়কে গেলেন খালেদ সাহেব। “এটা কেমন কথা?”
সুব্রত মুখ শক্ত করে, দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আপনার স্ত্রী ঠিক বলেছেন। জমিটা আপনারই। আপনি ওটা আমার বাবাকে দিয়েছিলেন। আমার বাবা যেহেতু এখন বেঁচে নেই, তাহলে ওটার মালিক এখন আপনি। আমি উকিলকে ফোন করেছিলাম। তিনি কাগজপত্র তৈরি করছেন। আপনি চাইলে ওটা নিজের ছেলের নামেও করিয়ে নিতে পারেন। আমি ওটা ফিরিয়ে দিবো।”
“না না, তা হয় না।” হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন খালেদ সাহেব। “আমি মরে গেলেও ওই জমির দাবি করব না কখনো। এতে আমার কোম্পানির যা ক্ষতি হওয়ার হবে।”
“কিন্তু ওটা এখন আপনার প্রয়োজন।”
“হ্যাঁ প্রয়োজন, কিন্তু সেটা নিজের নামে করানো না; ওখানে একটা ফ্যাক্টরি স্থাপন করা প্রয়োজন। জমিটা তোর নামে থাকলেও আমার অসুবিধা নেই। তাছাড়া আমি ভেবেছি ওই ফ্যাক্টরির পুরো দায়িত্ব তোকে দিবো।”
সুব্রতর বাকশক্তি থেমে গেল। কী বলছে লোকটা? নিজের ছেলেকে বাদ দিয়ে পরের ছেলেকে ফ্যাক্টরির দায়িত্ব দিতে চাচ্ছে?
খালেদ সাহেব সুব্রতর দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, “হ্যাঁ। একা আর পারছি না। তাছাড়া দুদিক তো একা সামলানো মুশকিল। তুই তো এখন সাধারণ চাকরিই করছিস। শুধু শুধু পরের চাকরি কেন করবি? নিজের জন্য কিছু কর। তুই নিজের মতো করে বিদেশী অর্ডারগুলো হ্যান্ডেল করবি। আমি পুরোনো অফিসে বসব।”
ভাবছিল সুব্রত, কিছু সময়ের জন্য ঘোরের মধ্যে চলে গেছিল সে, হঠাৎ মাথায় একটা ব্যাপার আসতেই হেসে দিলো সে।
খালেদ সাহেব অবাক হয়ে বললেন, “হাসছিস যে?”
সুব্রত ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি রেখে বলল, “এ-কথা আপনার স্ত্রী-সন্তানরা শুনলে বাড়িতে তুফান বয়ে যাবে।”
“আমার এই সফলতার পিছনে ওদের কনট্রিবিউশন কতটা? অফিসের যে প্রথম ইটটা, সেটা তোর বাবা নিজের হাতে লাগিয়েছিল। উনি আমাকে সবরকম ভাবে সাহায্য করেছেন। যখন আমি ব্যর্থ হয়েছি, আমাকে সাহস দিয়েছেন।”
সুব্রত বলল, “কিন্তু আমি এইসব দিয়ে কী করব? আমার তো অত টাকার প্রয়োজন নেই। অত সফলতার প্রয়োজন নেই। আমার এই জীবন ক্ষণিকের। আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছি আমি। আপনার ধারণা, আমি আপনার দেওয়া দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করতে পারব?” এরপর হাসি থামিয়ে মুখটা কঠিন করল সুব্রত। “শুনুন, আমি আপনাদের পরিবারের কেউ না। আমার শরীরও আগের মতো সুস্থ না। এই বয়সে আপনার যেটুকু মনোবল আছে, আমার তা নেই। আমার ভবিষ্যত আর কখনোই উজ্জ্বল হবে না। সুতরাং আমার কথা চিন্তা করে নিজের পরিবারের সাথে সম্পর্কটা খারাপ করবেন না। ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছি আমি। হয়তো আপনার আগেই চলে যাব।”
খালেদ সাহেব কিছু বলবেন বলে ঠিক করলেন, কিন্তু কিছু বলার অবকাশ রইল না। তাঁর সামনে থেকে হুট করে চলে গেল সুব্রত।
২৫.
বেশ কিছুক্ষণ ধরে সুব্রত ভাইয়ের ‘স্টাডি’ রুমে বসে আছে চিত্রা। তাঁর পরণে একটা লাল টকটকে জামা। অনেকদিন পর বাবার বাড়িতে যাবে আজ। ফিরোজ এখনো আসেনি। তৈরি হয়ে দেখল, হাতে সময় আছে বেশ। এই সুযোগে সে এসেছিল সুব্রত ভাইয়ের ঘরে, তাঁর সাথে দেখা করতে। হয়তো অনেকদিন আর দেখা হবে না। কিন্তু ঘরে এসে দেখল, সুব্রত ভাই কোথাও নেই। তখনই নজরে আসে ‘স্টাডি’ রুমের তালা বিহীন দরজা। চট করে ভিতরে ঢুকে যায় সে। এরপর ডায়েরি খুঁজে পড়তে শুরু করে।
এই ক’দিনে চিত্রা এইটুকু বুঝতে পেরেছে, যে যা-ই বলুক, রুশা ভাবিকে সুব্রত ভাই প্রচণ্ড ভালোবাসতো। বিয়ের আগে তো বটেই। বিয়ের পরের কথা জানতেই সে প্রথমে ডায়েরির শেষ পাতা খুলে! আসলে তীব্র কৌতূহল থেকেই এমনটা করেছে সে, আগে যা-ই হোক, শেষ পাতা পড়লেই জানা যাবে রুশা ভাবির মৃত্য রহস্য!
কিন্তু ডায়েরির শেষ পাতা খুলে সে হতাশই হয়েছে।
শেষ পাতায় শুধু লেখা,
“আজ আমাদের বিয়ে। এই মুহূর্তে বরবেশে ‘স্টাডি’ রুমে বসে আছি আমি। আমার হাতে ডায়েরি-কলম, আর বুকে হাজার স্বপ্ন, যা গত ক’দিনে বুনেছি আমি। আমি বারবার বলতে চাই, ‘এই পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে বেশি রুশাকেই ভালোবাসি’।”
যখন নিরাশ হয়ে ডায়েরি বন্ধ করল, তখনই তাঁর মনে হলো, এর আগের ঘটনা জানতে হবে। যদি সেখান থেকে কিছু উদঘাটন করা যায়! এরপর সে পূর্বে ফিরে গেল, যেখান থেকে অজানা রয়ে গেছে ঘটনা।
ডায়েরিতে লেখা ছিল,
“দ্বিতীয়বার রুশার সাথে দেখা হওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম, এবার আমার জীবনের মোড় ঘুরে যাবে। আমাকে আর গোলচক্রের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে হবে না। আমার একাকী জীবনে একজন সঙ্গী আমি খুঁজে পেয়েছি। আমার প্রথম ভালোবাসা, যে এক পশলা বৃষ্টির মতো আমার জীবনে এসে, আমার জীবনটাকে শীতল করে দিয়েছে; নদীর স্রোতের মতো সরলরেখায় আবদ্ধ করেছে আমাকে।
সেই ঘটনার পরদিনই আমি রুশার বাড়িতে উপস্থিত হই। একটা চারতলা বাড়ি। গেইটে দারোয়ান দেখে আমি এগিয়ে যাই।
দারোয়ান প্রথমেই ভালো করে দেখল আমাকে। এরপর খুব বিনয়ী হয়ে জানতে চাইল, “ভাইসাব, কার কাছে যাইবেন?”
আমার জানা নেই রুশা কোন ফ্লোরে থাকে। উপরের দিকে তাকিয়ে দারোয়ানকে বললাম, “আপনার মালিকের নাম কী?”
দারোয়ান জবাবে বলল, “আল্লাহ।”
আমি চমকে গেলাম কথাটা শুনে। এরপর দারোয়ানকে ধমক সুরে বললাম, “আমি এই বাড়ির মালিকের নাম জানতে চাইছি।”
দারোয়ান এবার বাড়ির মালিকের নাম বলল। আমি আবার বললাম, “রুশা কোন ফ্লোরে থাকে?”
প্রশ্নটা করার সাথে সাথে উপর থেকে আওয়াজ এলো, “আরে আপনি! আমাদের বাড়ি?”
কণ্ঠটা পরিচিত মনে হলো। আমি সাথে সাথে মাথাটা তুলে দেখলাম, তিন তলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রুশা। ওর পরণে আকাশী রঙের সেলোয়ার-কামিজ। আমার বুকের ভিতর ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল সাথে সাথে। এটা এমন একটা অদ্ভুত অস্থিরতা, যা খুব ভেতরে ভেতরে খুব জ্বালায়, অথচ ভালো লাগে!
আমাকে নীরব দেখে রুশা বলল, “দাঁড়ান, আমি আসছি।”
এরপর কয়েক মুহূর্ত; দ্রিমদ্রিম অনুভূতি হচ্ছিল আমার বুকে। হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছিল। রুশা যখন সামনে এসে দাঁড়াল, তখন আমার অবস্থা এমন হলো যে, আমি ছুটে পালাতে পারলে বাঁচি!
আমাকে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুশা বলল, “কী হলো, চুপ করে আছেন যে? হঠাৎ আমাদের বাড়ির সামনে?”
আমি ইতস্ততভাবে বললাম, “না মানে, এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম তো, সেজন্য। আমি জানতাম না এটা আপনাদের বাড়ি।”
আমি আড়চোখে দারোয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখি, ব্যাটা ফ্যালফ্যাল করে দেখছে আমাকে। রুশা তখন মিটমিট করে হেসে বলল, “হুম, আজকাল এদিকে খুব বেশিই চলাফেরা হচ্ছে আপনার। আপনি জানতেন না এটা আমার বাসা? গতকাল তো বললাম, ১৫২ নম্বর বাড়িটা আমাদের। এই দেখুন এটা ১৫২ নম্বর বাড়ি।” রুশা আঙ্গুল দেখি দেখাল নম্বর প্লেটটা।
আমি তাকালাম সেদিকে, পাশেই আরও একটা নোটিশ বোর্ড নজরে এলো। সেদিন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে উঠলাম, “আমার মনে ছিল না।”
রুশা হেসে বলল, “সাইন্টিস্ট মশাই, আপনি এত মনভুলো হলে তো দেশের সর্বনাশ! কোনদিন উল্টো পাল্টা জিনিস আবিষ্কার করে আমাদের মেরে দিবেন।”
উনার কথা শুনে আমি মৃদুস্বরে হাসলাম। এরপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আসলে এদিক দিয়েই আমি বাড়িতে যাই। আজ যাওয়ার সময় দেখলাম নোটিশ দেওয়া হয়েছে, ‘বাসা ভাড়া দেওয়া হবে’। কিছু সমস্যার কারণে আমিও বাসা চেঞ্জ করব ভাবছিলাম। সেজন্যই গাড়িটা থামিয়ে কথা বলতে এলাম।”
“ওহ্। আপনি বাসা ভাড়ার জন্য এসেছেন? আসুন, ভিতরে আসুন।”
আমি কোনোকিছু না ভেবে ভিতরে ঢুকে গেলাম। রুশার পিছু নিলাম। হাঁটতে হাঁটতে রুশা বলল, “আপনারা ক’জন থাকবেন? আপনার বাচ্চা ক’জন?”
আমার মুখটা ‘হা’ হয়ে গেল। কোনোরকমে জবাব দিলাম। “আমার বাচ্চা নেই কোনো।”
“তাহলে কি শুধু দুজন। মা-বাবা আছে?”
“আসলে আমি একা। মা-বাবা, বউ, কেউই নেই।”
আমার এ-কথা শুনে থমকে গেল রুশা। পিছন ঘুরে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে বলল, “এখনো বিয়ে করেননি?”
লজ্জাবোধ হচ্ছিল আমার। মুচকি হেসে বললাম, “আজ্ঞে না।”
রুশা মিটমিট করে হেসে বলল, “ভালো করেছেন। সবাই বিয়ে করে ফেললে চিরকুমার ট্যাগটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে না? তবে আপনার জন্য দুঃসংবাদ হচ্ছে, এই বাড়িতে ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়া হয় না। আসলে বাবা দেশের বাইরে থাকেন তো, তাই মা রিস্ক নিতে চান না। ঘরে অবিবাহিত মেয়ে আছে কী-না!”
আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। চোয়াল ঝুঁকে পড়ল যেন। বললাম “কী বলছেন? কত আশা নিয়ে এসেছিলাম আমি। সবাই ফ্যামিলি চাইলে আমরা ব্যাচেলররা কী মরে যাব? আপনার বাবা-মা ও তো একসময় ব্যাচেলর ছিল, তাই না?”
আমার কথা শুনে যেন রুশা আপ্লুত হলো। সে ঠোঁট টিপে, মাথাটা মৃদু ঝাঁকিয়ে বলল, “আপনার কথায় যুক্তি আছে। তবে আপনার জন্য সুসংবাদ হলো, আপনাকে বাসা ভাড়া দেওয়ার জন্য রেকমেন্ড করব আমি।” এই বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল রুশা।
আমি পিছন থেকে বললাম, “কেন করবেন? আপনি আমাকে কতটা চেনেন?”
“জানাশোনা হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। তবে আগে আপনাকে একটা অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। আমাকে ‘আপনি-আজ্ঞে’ বলা চলবে না। আমার থেকে অনেক সিনিয়র আপনি।”
এই প্রথমবার আমার অনভিজ্ঞ মন বুঝতে পারল, শুধু আমার না, রুশারও খুব ইন্টারেস্ট আছে আমার প্রতি! তাই তো তুমি বলে সম্মোধন করতে বলছে, যেন সম্পর্কটা আরও কাছের হয়। মেয়ে মানুষের মন, সরাসরি তো বলতে পারে না। তাই এভাবে বোঝাচ্ছে।
বাড়িটা রুশার বাবার। রুশা-ই বলল, বাড়ি ভাড়া নিতে হলে তাঁর মায়ের সাথে কথা বলতে হবে। আমি যখন ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলাম, তখন থেকে একটাও কথা বলার সুযোগ পাইনি। সব কথা রুশা নিজে বলছে। আর আমার সম্পর্কে এমন কথা বলছে, যা আমি নিজেও বলতে পারতাম না। সে যেন আমাকে আমার থেকেও বেশি চেনে!
রুশা বলছে, “বুঝলে মা, উনি খুব ভালো মানুষ। খুব বড় বিজ্ঞানী। উনাদের অফিস অনেক বড়। বাংলাদেশের নামকরা গবেষণা কেন্দ্র। আগে যে বাড়িতে থাকতো, সেটায় নানান সমস্যা। এত এত নিষেধাজ্ঞা। রাত ১০টার পর বাতি অফ করে দিতে হবে। পানি খরচ করতে হবে হিসেবে করে। আরও কত সমস্যা। উনি খুব সমস্যায় পড়েছেন। সেজন্য এখানে এসেছেন। আমরা তো ভাড়াটেদের মেহমান মনে করি, তাই না? তাছাড়া উনি উচ্চ বংশের ছেলে। খুব নম্র-ভদ্র।”
মেয়ের মুখে ভাড়াটের এত এত প্রশংসা শুনে ভদ্রমহিলা যেন সংকুচিত হলেন। তিনি প্রবল অনীহার সাথে বললেন, “সবই তো ঠিক আছে। কিন্তু ব্যাচেলর যে। জানিস তো আমরা ব্যাচেলর ভাড়া দেই না।”
রুশা রাগ করে বলল, “উফ, মা। তুমিও না। সারাজীবন পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়েছেন। কত পরিশ্রম করে বিজ্ঞানী হয়েছেন। এর মধ্যে বিয়ে করার সময় কই?”
“তবুও..।”
“তুমি এত ভেবো না তো, মা। আমি উনাকে চিনি। উনার অফিসেও গিয়েছিলাম। সবাই কত সম্মান করে উনাকে। উনার কথা আরও বড় বড় কর্তকর্তারা মান্য করে। আমি বাস্তব দেখেছি।”
রুশা বলছিল আমার সম্পর্কে ভালো ভালো কথা, এমনসময় রুশার ভাই ভিতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, শার্টের হাতা কাচাতে কাচতে বলল, “কেন গেছিলি?”
“হ্যাঁ?” কিছুটা থতমত খেয়ে রুশা ভাইয়ের দিকে তাকাল।
রুশার ভাই আবার বলল, “উনার অফিসে তুই কেন গেছিলি?”
“ওই আমার এক বন্ধুর ইন্টারভিউ ছিল। ওকে ফোনে পাচ্ছিলাম না, তাই ওখানে চলে গেছিলাম।” এরপর রুশা ওঠে দাঁড়ায়, এগিয়ে যায় ভাইয়ের দিকে। অনুনয় করে বলল, “দেখো, একদিন ঠিক বড়সড় কিছু আবিষ্কার করে ফেলবেন উনি। তখন উনার সাথে সাথে আমাদের বাড়িরও নাম হবে। খবরের কাগজে লেখালেখি হবে। টিভিতে দেখাবে। প্লিজ ভাইয়া, না করো না।”
রুশার ভাই এরপর আমার দিকে তাকিয়ে নাম জিজ্ঞেস করে। বাবা-মায়ের কথা জিজ্ঞেস করতেই বললাম, “আমার বাবা-মা নেই। অনেক আগে মারা গেছেন অসুস্থ হয়ে। আমি আগে কাকার বাসায় থাকতাম।”
যুবকের তাড়া ছিল বোধহয়; চলে যাওয়ার পর রুশার মা বললেন, “দেখো বাবা, আমরা আগে কখনো ব্যাচেলর ভাড়া দিইনি। তুমি যেহেতু রুশার পরিচিত, তাই তোমার ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখব। তবে আমাকে সময় দিতে হবে। রুশার বাবা যেখানে থাকেন, এখন সেখানে মাঝরাত। উনি যখন ফ্রি হয়ে আমাদের ফোন করবেন, তখন আমি তোমার ব্যাপারটা বলব। উনি অনুমতি দিলে তোমার বাসা পাওয়া নিশ্চিত। ততক্ষণ আমি নোটিশ উল্টিয়ে রাখব না-হয়।”
আমি খুশি মুখে বলল, “ধন্যবাদ, আন্টি। আজ তাহলে আসি।”
এরপর আমি বেরিয়ে আসি রুশাদের বাড়ি থেকে।”
চিত্রা পাতা উল্টায়। উপরে একটা তারিখ দেখতে পায়। সেই ঘটনার পরদিন। সময়টা বিকেল দেওয়া। মাঝখানে শিরোনামের মতো লেখা, “আমার জীবনের অন্যতম আনন্দের দিন।”
চিত্রা, বিয়ের তারিখ আর এই দিনের তারিখটা এক করে দেখে, মাঝখানে ব্যবধান মাত্র ৭দিনের! সে দ্রুত ফিরে যায় সেই পৃষ্ঠায়। তাঁর চোখ-মুখ উত্তেজনায় চকচক করছিল! বোধহয় এবার কিছু জানা যাবে।
২০তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।
গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=836866310591404&id=100028041274793