প্রস্থান — ২য় পর্ব।

0
1529

প্রস্থান — ২য় পর্ব।

রিফাত হোসেন।

৩.
একটা ঠকঠক আওয়াজ! আস্তে আস্তে বাড়ছে আওয়াজটা। কানে খুব লাগছে। কেউ যেন লোহাকে হাতুড়িপেটা করছে; এমন জোরে আওয়াজ হচ্ছে।
চোখ মেলে তাকালো সুব্রত। চারিদিকে আবছায়া অন্ধকার। নিজের অবস্থান বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল তাঁর। একটা ছোট ঘরে, টেবিলের উপরে মাথা ঝুঁকে শুয়ে আছে সে। মাথাটা বড্ড চিনচিন করছে৷ একহাতে মাথাটা চেপে ধরে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। ঘুম ঘুম চোখে দরজাটা খুঁজে বের করে, খুলে ঘরটা থেকে বেরিয়ে নিজের বেডরুমে এলো। বেডরুমে ঝকঝকে আলো। জানালা খোলা। বারান্দা দিয়ে সকালের সূর্যের আলো ঘরে এসে পড়েছে। সে আবার পিছনে ঘুরে, ঘরটার দিকে তাকালো। দরজার উপরে লেখা, স্টাডি রুম। এক মুহূর্ত মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকল সে। এরপর ভিতরে একপলক উঁকি দিয়ে দরজাটা তালা মেরে দিলো।
আবার শব্দ হচ্ছে। সেই সাথে একটা মেয়ের গলার আওয়াজ। “ভাইজান, দরজা খুলেন। আমি সুলতানা।” একটু থেমে আবার বলল, “ও ভাইজান। তাড়াতাড়ি দরজা খুলেন। আমার অনেক কাজ আছে।”
এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো সুব্রত। একটা বালতি আর ঘর মোছার কাপড় নিয়ে সুলতানা দাঁড়িয়ে আছে। চেহারাতে চাপা ক্ষোভ। বুঝাই যাচ্ছে, এতক্ষণ ধরে ডাকাডাকি করার প্রয়োজন হয়েছে বলে বেশ বিরক্ত সে।
সুব্রতকে পাশ কাটিয়ে, ১৮ বছরের সুলতানা ভিতরে ঢুকে এলো। এসেই সারা ঘরে চোখ বুলালো একবার। ড্রেসিং টেবিলের উপর মদের বোতল, গ্লাস, সিগারেটের প্যাকেট। এগুলো ছাড়া ঘরের বাকি সবকিছু একদম গোছানো। বিছানার চাদর পরিপাটি। সে “স্টাডি রুম” লেখা ঘরটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাইজান, আপনি আজকেও এই ঘরে ঘুমাইছেন?”
সুব্রত চোখ ডলতে ডলতে জবাব দিলো, “হ্যাঁ।”
“তালা দিলেন কখন? এক্ষুণি? ভাইজান, এই ঘরে কী কোটি কোটি টাকার সম্পদ আছে, যে সবসময় তালা দিয়ে রাখেন? এতদিন ধরে কাজ করছি এই বাড়িতে। আজ পর্যন্ত কখনোই এই ঘরটা খোলা দেখলাম না। পড়ালেখার ঘর এভাবে তালা দিয়ে রাখতে হয়, এটা আমি কখনো শুনি নাই।”
সুব্রত রাগী গলায় বলল, “তোমার এতকিছু জেনে কাজ নেই, সুলতানা। কেন এসেছে এখানে? তোমাকে কতবার বলেছি আমার ঘর আমি নিজেই মুছতে পারব। দুদিন পরপর তোমাকে আসতে হবে না। তাছাড়া আমি তো তোমাকে টাকা দিয়ে রাখিনি, তাই না?”
সুলতানা মুখ বাকিয়ে বলল, “আমার যেন এই ঘরে আসার জন্য মন উথাল-পাতাল করে! হুহ, খালুর হুকুম বলেই আসি৷ নাইলে আপনার এত বকা খাওয়ার পরেও এদিকে আমি মুখ তুলে চাই? এমন নির্লজ্জ এই সুলতানা না, ভাইজান।”
সুলতানাকে ইশারায় থামার নির্দেশ দিয়ে বিরক্তিমাখা গলায় সুব্রত বলল, “তোমার খালুকে বলবে, আমাকে নিয়ে এত ভাবতে হবে না। উনার এই ভালোমানুষীর পিছনের উদ্দেশ্য আমার জানা বাকি নেই। এই বাড়ির অর্ধেক মালিক আমি। দাদার সম্পত্তির অর্ধেক মালিকও আমি। আমি যদি এইসব বিক্রি করে বিদেশে চলে যাই, তাহলে উনার অনেক বড় ক্ষতি হবে। আমার জায়গায় কারখানা করে উনারা ব্যবসা করছে না! এগুলো হাতছাড়া যাতে না হয়, সেজন্য এত দরদ। উনাকে বলে দিও, এইসব আমার জন্য নয়। আমি নিজেকে নিজে সামলে রাখতে পারি; নিজের ঘরও। তাই তোমাকে পাঠানোর কোনো প্রয়োজন নেই।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে সুলতানার দিকে তাকালো সুব্রত। সে নির্বিকার। বালতি থেকে পানি ঢালছে মেঝেতে। এইসব কথা প্রতিবারই শুনতে হয় ওকে। খালুকে গিয়ে রিপোর্টও করে। কিন্তু লাভ হয় না। লোকটার যেন লজ্জা-শরম বলতে কিছু নেই, এমনটাই মনে হয় ওর। নাহলে বড় ভাইয়ের ছেলের কাছে এত অপমানিত হওয়ার পরেও তাঁর ভালো-মন্দ নিয়ে এত ভাবে!

সুলতানার দিক থেকে চোখ সরিয়ে বাথরুমে গেল সুব্রত। ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলো। সুলতানা তখনও ঘর মুছছে। সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। নিজের মুখটা দেখল এক দৃষ্টিতে। চুলগুলো চোখ ঢেকেছে। হাত দিয়ে চুলগুলো পিছনে এলিয়ে দিতেই চোখ জোড়া দেখা গেল। সাদা-সাদা, একেবারে বেলে মাটির মতো চোখ তাঁর। অনেক আগেই শুনেছিল, এই বংশের কারোরই কখনো এইরকম চোখ ছিল না। তাঁর গায়ের রংটাও একেবারে ভিন্ন। এই বাড়ির কারোর সাথেই তাঁর মুখের মিল নেই; এমনকি তাঁর বাবা-মায়ের সাথেও না। অপরিচিত কারোর সাথে পরিচিত হওয়ার সময় প্রথমেই তাঁর দিকে যে প্রশ্নটা তীব্র গতিতে আসতো, সেটা হলো, ‘আপনি কোন দেশি?’ যখন শুনতো বাংলাদেশি, তখন খানিক বিস্ময় নিয়ে তাকাতো! বাংলা ভাষার স্পষ্ট উচ্চারণ ব্যতীত আর কোনো কিছুতেই নাকি তাঁর মধ্যে বাংলাদেশীয় ব্যাপার খুঁজে পায় না কেউ। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ায় ইংরেজি ভাষাতেও তাঁর দারুণ দক্ষতা ছিল ছোট থেকেই। এমনকি ইংরেজি বলার সময় সেই ব্রিটিশ সুরটাও বিরাজ করতো তাঁর কণ্ঠে। তবে বড় হওয়ার পর যখন ভিতরে ভিতরে কিছু একটা উপলব্ধি হতো, তখন থেকে খুব চেষ্টা করতো ইংরেজি ভাষাকে এড়িয়ে যেতে। যেন কেউ বিদেশি বলতে না পারে।

সুব্রতর সম্বিৎ ফিরল সুলতানার কথায়।
সুলতানা বলল, “ভাইজান, শুনেছেন, সামনের মাসে ছোট ভাইজানের বিয়ে। সেদিন যে লোকগুলো এলো, তাঁদের মধ্যে বউও ছিল। কী সুন্দর দেখতে বউকে! অনেকদিন পর এই বাড়িতে উৎসব হবে। ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে আমার। আবার এটা ভেবে ভয় হচ্ছে, আমার কাজটা খুব বেড়ে যাবে। মনে আছে, আপনার বিয়ের সময়, তখন তো একেবারে ছোট ছিলাম আমি, নতুন নতুন, খালু আমাকে এই বাড়িতে আশ্রয় দিলো, খালাম্মা আমাকে দিয়া কী কাজটাই না করিয়েছিল! বাপরে বাপ!”
সুলতানার কথা শুনে সুব্রতর সারা শরীর পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেল। প্রতিবাদ ছিটকে পড়ল মেয়েটার বিরুদ্ধে; গর্জে উঠল সে, “সুলতানা, তোমাকে বা কতবার বলেছি এইসব কথা কখনো মুখেও আনবে না। তবুও বললে। গেট আউট অফ মাই রুম। এক্ষুণি।”
জিবে কামড় দিলো সুলতানা। ভেজা কাপড় নামিয়ে, দুই হাতে কান টেনে বলল, “সরি ভাইজান। আর হবে না। আসলে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।”
সুব্রত আগের মতোই রুক্ষ গলায় বলল, “তুমি বেরিয়ে যাও এখন। আর কখনো আমার ঘরে আসবে না।”
অপরাধীর মতো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে, কাতর গলায় সুলতানা আবার বলল, “মাফ চাই, ভাইজান। আর হবে না। এইতো আর একটু বাকি আছে, এরপরই চলে যাব। দুদিনে আর আসবো না, কথা দিচ্ছি।”
মায়া হলো সুব্রতর। খানিক শান্ত হয়ে সিগারেটে প্যাকেটটা নিয়ে বিছানার উপর বসল। একটা সিগারেট ধরাল।

ঘর মুছা শেষ করে, ড্রেসিং টেবিলের উপর থাকা মদের বোতলটা সুব্রতর ব্যক্তিগত ফ্রিজের ভেতরে রাখতে রাখতে সুলতানা আবার বলল, “ভাইজান, রোজ রোজ এত নেশা খাবেন না। খালু বলেছে, আপনার অসুখ হবে খুব তাড়াতাড়ি। বেশিদিন বাঁচবেন না।”
সুব্রত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “আমার টাকায় আমি খাই, উনার তাতে কী? আমি বুঝি না, উনি ঠিক কোন কারণে আমাকে নিয়ে এত ভাবে!”
“এভাবে বলবেন না, ভাইজান। উনি আপনার বাবার মতো।”
“বাবার মতো, বাবা তো না।” একটু থেমে সুব্রত ঈষৎ উদাস গলায় বলল, “এই পৃথিবীতে বাবা-মা ছাড়া আর কেউ আপন হয় না। শুধুমাত্র বাবা-মা-ই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সন্তানের আপনজন থাকে। বাকি যারা আপনজন হওয়ার চেষ্টা করে, এরা আসলে অভিনয় করে; স্বার্থ লুকিয়ে আছে এর পিছনে; কিন্তু বাবা-মায়ের ভালোবাসায় কোনো স্বার্থ থাকে না।”
কথাগুলো শুনে নিশ্চুপ হলো সুলতানা। খানিকক্ষণ ভেবে আবার বলল, “ভাইজান, এই বাড়ির কেউই আপনাকে দুই চোখে দেখতে পারে না। খালাম্মা তো খালুকে আপনার কাছে ঘেষতে দিতে চায় না। আপনার নিজের বাপ-মাও নেই। আপনি যদি নিজের যত্ন না নেন, তাইলে তো আপনি অকালে মরবেন। একজন তবুও এসেছিল; কিন্তু তাকে তো আপনি নিজের হাতে..।” থমকে গেল সুলতানা। ভয়ার্ত চোখে তাকালো সুব্রতর দিকে।
এক পশলা আগুন যেন সুব্রতর হৃদয়কে জ্বালিয়ে দিয়ে গেল অকস্মাৎ! সুলতানার দিকে চিতা বাঘের মতো তেড়ে এসে ভয়ংকর গলায় বলল, “আমি নিজের হাতে কী? মেরে ফেলেছি তাকে? বেশ করেছি। এক্ষুণি তুমি ঘর থেকে বের না হলে তোমাকেও জ্যন্ত রাখব না।”
কেঁপে ওঠে, পিছিয়ে গেল সুলতানা। ফ্রিজের সাথে পিঠ ঠেকতেই চমকে উঠল। গলা শুকিয়ে এলো। ভেতরটা ঢিপঢিপ করতে লাগল। সুব্রত নড়েনি। আগের মতোই কঠিন চোখে তাকিয়ে থেকে, ফুসতে লাগল। তখনই দৌড়ে পালাল সুলতানা। ময়লা পানি ভর্তি বালতি, ভেজা কাপড়, সবই পড়ে রইল মেঝেতে। সে নিজেকে শান্ত করে সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।

৪.
মায়ের ডাক শুনে খাবার টেবিলের কাছে এলো রশ্মি। টেবিলে খাবার সাজানো। একটা চেয়ারে বসে আছে মা। খাবারগুলোতে চোখ বুলালো সে। ডাল, আর শুধু আলু ভাজি। ব্রেকফাস্ট-এ কে খায় এইসব? নিজেকে কোনোরকমে শান্ত করল সে।
রুমানা বেগম মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, “কী হলো, বসছিস না কেন? আজ মাংস রাঁধতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ঘড়ি দেখে মনে হলো, রান্না শেষ করতে পারব না। তাই ভাত আর ডাল গ্যাসে বসিয়ে আলু কেটেছি, এরপর আলু ভাজি করেছি।”
চেয়ারে বসতে বসতে রশ্মি বলল, “কোনদিন সময় হয় তোমার? শুধু শুক্রবারে?”
“পরশুই তো শুক্রবার। সেদিন তোকে বিরিয়ানি রেঁধে খাওয়াবো।”
কিছু বলল না রশ্মি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্লেটটা কাছে টেনে নিলো। রুমানা বেগমেরও মন খারাপ গত কয়েকদিন ধরে। সেদিন মেয়েটাকে অনেক করে বলার পরেও পিকনিকের টাকা জমা দেয়নি। এরপরে বাড়ি থেকেও বের হয়নি ও। সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকে। আগের মতো কথায় কথায় রেগে যাওয়াটাও অনুপস্থিত ছিল ওর মধ্যে। আগে যেসব ব্যাপারে রাগ হতো, এখন সেসব ব্যাপারে যেন নিজেকে সামলে নেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে ও। এটা যেমন আনন্দের, তেমন ভয়ের। মেয়ের উদাসীনতা তাঁর পছন্দ নয়, চিল্লাফাল্লা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল কী-না!

“হ্যারে, তোর বন্ধুরা কী সবাই চলে গেছে কক্সবাজার?” খেতে খেতে প্রশ্ন করলেন রুমানা বেগম।
রশ্মি খাচ্ছে না কিছুই। ভাতে ডাল ঢেলে শুধু নাড়াচাড়া করছে। মায়ের প্রশ্নের জবাবে মলিনভাবে ‘হ্যাঁ’ বলল শুধু।
রুমানা বেগম অবাক চোখ করে বললেন, “তোকে রেখেই চলে গেল? কেমন বন্ধু এরা!”
“ওরা আমার ততটা কাছের বন্ধু নয়, যতটা কাছের হলে আমাকে রেখে যেতে কারোরই মন চাইবে না। ওরা আমার শুধুই ক্লাসমেট। ভালো বন্ধু নয়।”
“তোর কোনো ভালো বন্ধু নেই? বাড়িতেও কোনো বন্ধু-বান্ধবকে আনিসনি কখনো।”
“ছোট থেকে একা থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়েছি৷ তাই কারোর সঙ্গ খুব একটা ইনজয় করি না৷ কেউ খুব একটা আগ্রহ নিয়েও আমার সাথে মিশে না। গায়ের রঙ কালো, মাসে একদিনও কাউকে ট্রিট দিতে পারি না। সেজন্যই বোধহয় কেউ আমার সাথে ভালো বন্ধুত্ব সৃষ্টি করতে উৎসাহিত নয়৷ আরও অনেক কাজ আছে তাঁদের।”
রুমানা বেগম হাতবিহ্বল হয়ে বললেন, “ওমা! এত বড় মেয়ে, তাঁর মুখে এ কেমন বাচ্চাদের মতো কথা? ভালো মানুষ কখনো এইসব কিছু দেখে বন্ধুত্ব করতে আসে নাকি? আর তাঁরা কখনো ভালো বন্ধুও হতে পারে না।”
মায়ের কথা শেষ হতেই রশ্মি বলল, “আমি তোমার জ্ঞান শুনতে আগ্রহী নই, মা। তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। কেউ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। তাড়াতাড়ি যাও৷ আর সন্ধ্যায় ওই মোরের মাথা থেকে অত হুড়োহুড়ি করে ঘরে আসার প্রয়োজন নেই। আমি জানি তুমি খুব ব্যস্ত মানুষ। বাইরে অনেক কাজ তোমার। তাই রিল্যাক্স-এ বাইরের কাজটা সেড়ে আসো।” রশ্মির গলা জড়িয়ে এলো, আর কিছু বলতে পারল না সে। মাথাটা নুইয়ে প্লেট থেকে হাত সরিয়ে নিলো।
রুমানা বেগম সচকিত হয়ে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে মেয়ের কাছে এলেন। একটা হাত মেয়ের মাথায় রেখে আদুরে গলায় বললেন, “কী হয়েছে তোর, মা? ক’দিন ধরে এমন আচরণ করছিস কেন আমার সাথে?”
“কিছু না।” ভেজা কণ্ঠে অস্বীকার করল রশ্মি। তাঁর চোখ জোড়ায় বর্ষাকালের ডোবা নদী বইছে!
রুমানা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, “আচ্ছা, আমি খাইয়ে দিচ্ছি। আজ নাহয় একটু দেরি করে গেলাম অফিসে।” এই বলে মেয়ের মুখে ভাত তুলে দিতে গেলেন তিনি, তখনই অঘটন ঘটল। প্লেটটা কয়েক টুকরো হয়ে মেঝের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিলো, আর ভাত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যা-তা একটা অবস্থা হলো।
গর্জে উঠলেন রুমানা বেগম, “এটা কী করলি তুই? ভাতের প্লেট এভাবে ফেলি দিলি কেন? তুই জানিস এই ভাতের দাম কত? কত মূল্য এই ভাতের? এই দেশে রোজ কত মানুষ এই ভাতের জন্য কান্না করে, সেটা জানিস তুই?”
জবাব না দিয়ে ফুসতে লাগল রশ্মি। তাঁর ইচ্ছে করছে কড়া গলায় মা’কে জবাব দিতে; মা যা করে বেড়াচ্ছে, সেটা নিজের চোখে দেখার পর আর যে উনাকে ‘মা’ বলে ডাকতেও ঘৃণা করছে, সেটা মুখের উপর বলে দিতে। কিন্তু সেই কেউ একজন গলাটা টিপে ধরে আছে। বলতে দিচ্ছে না কথাগুলো। কেন, কে জানে? শুধু তো সেদিনকার ঘটনা না, এর পরেও লোকটার সাথে মা’কে দেখেছে সে; লোকটা মা’কে রোজ অফিসে নিয়ে যায়, আবার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়; গাড়ি থেকে নেমে কত কথা বলে হেসেহেসে! এইসব সব দেখার পর তাঁর মরে যেতে ইচ্ছে করেছে!
রুমানা বেগম কিছুক্ষণ ক্রোধ ভরা চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। আজ তাঁর উচিত ছিল সাথে সাথে মেয়েকে একটা থাপ্পড় দেওয়া। কিন্তু তিনি পারছেন না; কেউ একজন তাঁর হাত ধরে আছে। যেন বলছে, এখন শাসন করো না, বিপরীত হবে। তিনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাত ধুয়ে নিজের ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে।

ওদিকে নিজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুব্রত রুমানা বেগমকে দেখলেন। ভদ্রমহিলা চোখ মুছছেন বারবার। বড্ড মায়া হলো তাঁর!

বেলা হতেই ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হলো রশ্মি। উদাসীনতায় ডুবে আছে সে। চোখগুলো ফোলা ফোলা। বাবা যখন মারা যায়, তখন তাঁর বয়স কম ছিল। তবুও মনে আছে, তখন তাঁর দিনগুলো সুখের ছিল, শান্তির ছিল, আনন্দদায়ক ছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই যেন মাথার উপর থেকে সুখের ছায়া উধাও হয়ে গেল! মা চাকরি নিলেন। ব্যাস, একাকীত্ব তাকে সঙ্গী করে নিলো। নিকট আত্বীয় না থাকায় প্রথমে একজন বুয়া রাখা হলো তাঁর জন্য, কিন্তু মাস শেষে সবকিছু মিলিয়ে কুলোতে পারছিল না মা, পরে ঠিকঠাক বেতন না পেয়ে বুয়া চলে গেল। এরপর থেকে আরও একা হয়ে পড়ল সে। মা অফিসে চলে যাওয়ার পর বাড়িতে একা থাকতো সে। বয়সটা তখন কত হবে, ১০ কি ১২; এর বেশি না! সকাল থেকে সন্ধ্যা যেন ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে বিরাজ করতো সে!
এভাবেই বেড়ে ওঠা! আজও যেন ভীষণ নিঃসঙ্গ সে; মরুভূমিতে হঠাৎ বৃষ্টির মতো মায়ের সঙ্গ পেতো, তবুও যেন সেখানে খুব তাড়াহুড়ো ছিল। ভোরবেলা নিজ হাতে করে দুটো ভাত খাইয়ে দিয়েই ছুটতো মা। মায়ের এই ব্যস্ততা শেষ হয়নি। আজও ব্যস্ত সে। হঠাৎ যখন দেখল মায়ের এই ব্যস্ততার জীবনে আরও একজন মানুষ আছে, একজন পুরুষ, তখন যেন তাঁর বড় হিংসে হলো! কিছুতেই লোকটাকে সহ্য করতে পারছে না সে। যে সময়টা মা ওই লোকের সাথে হেসে হেসে, অত আনন্দ দিয়ে আলাপ করে, সেই সময়টা যদি মা তাকে দিতো, তাহলে কী তাঁর জীবনটা এমন নিঃসঙ্গ, এমন অন্ধকার-ছন্ন হতো!

কয়েকবার হর্ণ দেওয়ার পরেও রশ্মির কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখল না সুব্রত। আস্তে আস্তে, একেবারে গুটিগুটি পায়ে হাঁটছে রশ্মি। এতটা উদাস হয়ে আছে, পিছন দিয়ে যে একটা গাড়ি আসছে, সেটা দেখতে পাচ্ছে না। সময়টা দেখে নিলো সুব্রত। এরপর ব্রেক কষে, গাড়িটা থামিয়ে নেমে গেল। এর আগে সানগ্লাসটি চোখে পরে নিলো।
“রশ্মি।” পিছন থেকে ডাকল রশ্মিকে, তবুও সাড়া না পেয়ে দ্রুত হেঁটে সামনে গিয়ে দাঁড়াল সুব্রত।
মাথা নুইয়ে হাঁটছিল রশ্মি, আচমকা সামনে একটা লম্বাচওড়া দেহ দেখে আঁতকে উঠল; একটুর জন্য ধাক্কা লাগেনি! ভুরু কুঁচকে মাথাটা উপরে তুলে তাকাতেই দেখল সুব্রতকে। হকচকান গলায় বলল, “সুব্রত ভাই আপনি। কিছু বলবেন?”
সামনে থেকে পাশে এসে দাঁড়াল সুব্রত, যেন রশ্মির সাথে সাথে হাঁটতে চাইছে সে। মুখে বলল, “কেমন আছো রশ্মি?”
ইতস্ততভাবে জবাব দিলো রশ্মি, “ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?” আবার আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল, সুব্রতও হাঁটছে তাঁর সাথে।
সুব্রত দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “ভালো আছি।” গলাটা নরম করল সে, ” কী ব্যাপার, তোমার কী মন খারাপ?”
“না। মন খারাপ হবে কেন?”
“সেটাও ঠিক। এই শহরের কারোর তো মন খারাপ হতে নেই।”
বিস্ময় কাটেনি রশ্মির, এবার বেড়েছে বরং। এই মানুষটার সাথে তাঁর কথা খুবই কম হয়। আগে হতো। কিন্তু গত ৫-৬ বছরে তেমন হয়নি। মানুষটাকে তাঁর বড্ড ভয় করে!
রশ্মিকে নির্লিপ্ত দেখে সুব্রত বলল, “ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছ নিশ্চয়ই?”
‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা ঝাঁকিয়ে রশ্মি প্রশ্ন করল, “আপনি আজ হেঁটে যাচ্ছে যে? আপনার গাড়ি কই?”
সুব্রত মৃদু হেসে বলল, “তুমি যেভাবে রাস্তার মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছ, আমি কীভাবে গাড়ি নিয়ে যাব বলো? হর্ণ দিলাম এত করে; শুনতে পাওনি বোধহয়।”
রশ্মি পিছনে তাকিয়ে গাড়িটা দেখে লজ্জা পেলো৷ কতটা বেখেয়ালি ছিল সে! আবার সুব্রতর দিকে তাকিয়ে অপরাধীর মতো করে বলল, “সরি সুব্রত ভাই, একদম খেয়াল করিনি। আসলে কিছু ভাবছিলাম।” কথাটা হলে ঢালাই করা রাস্তাটা থেকে নেমে ঘাসের উপর এসে দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই থাকল চুপচাপ।
সুব্রত আর কিছু না বলে ফিরে গেল গাড়িতে। গাড়িটা আবার এগিয়ে এনে ব্রেক চাপল রশ্মির সামনে। কাচটা নামিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সময় নেই হাতে। নাহলে তোমাকে চমৎকার একটা গল্প বলতাম। আপাতত এইটুকু বলছি, মা থাকতে মায়ের মর্ম বুঝো। যখন থাকবে না, তখন বুঝার জন্য অপেক্ষা করো না।”
খোঁচাটা ধরতে পারল রশ্মি। ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসি টেনে বলল, “আপনার মতো?”
“মানে?” সুব্রতর কপালে ভাজ পড়ল।
আগের মতোই রশ্মি বলল, “রুশা ভাবী। তিনি থাকতে কী আপনি তাঁর মর্ম বুঝেছিলেন?”
সুব্রতর চোখ-মুখ কঠিন হয়ে গেল কথাটা শুনে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে কাচটা আবার উঠিয়ে দিয়ে, গাড়ি এগিয়ে নিয়ে গেল। প্রথমে অল্প অল্প গতি বাড়ালো, এরপর আরও, আরও..! রশ্মির মনে হলো, গাড়িটা যেন চোখের পলকেই হাওয়া হয়ে গেল। সে উপরের দিকে তাকিয়ে, চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শুধু। আহা জীবন! প্রতিটি মানুষের জীবনে এমনকিছু সত্য থাকে, যা তাকে বোবা করে দেয়!

দ্বিতীয় পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=822566148688087&id=100028041274793

বি:দ্র: পর্বটা কেমন হয়েছে জানাবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here