প্রস্থান — ১৫তম পর্ব।
রিফাত হোসেন।
ফিরোজ ব্যালকনিতে এসে দেখল, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে চিত্রা। সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ওর দিকে। কিছু সময় তাকিয়ে থাকলেই মেয়েটার প্রতি কেমন মায়া জন্মে যায়। মুখে হাসি ফোটে। ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
রাত গভীর হচ্ছে। ঠাণ্ডার পরিমাণ বাড়ছে সেই সাথে। ফিরোজ আর দেরি না করে চিত্রাকে কোলে তুলে নিলো। ব্যালকনিতে থেকে ঘরে আসার সময়ে হেসে দিলো সে! এটা ভেবে, এইটুকু একটা মেয়ে, অথচ ওজন কম নয়! চিত্রাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সে বলল, “বাপরে! কত ভারী!”
ফিরোজের কথা স্পষ্টই শুনতে পেয়েছে চিত্রা। তাঁর মন চাচ্ছে প্রতিবাদ করতে। রাগী গলায় কিছু বলতে। কিন্তু কাজটা সে করল না। নীরবতাই যদি সমাধান হয়, তাহলে এক রাত কথা না বললে কোনো ক্ষতি হবে না।
চিত্রাকে শুইয়ে দেওয়ার পর আলো নিভিয়ে ফিরোজ নিজেও শুয়ে পড়ল।
সকালে ফিরোজের আগে চিত্রার ঘুম ভাঙল। চোখ ডলতে ডলতে বিছানা ছেড়ে এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে। সেখান থেকে যখন বের হয়ে, ভেজা হাত-মুখ মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তখনই হঠাৎ মনে পড়ল গতকাল রাতের কথা! ফিরোজের সাথে ঝগড়া, এরপর ব্যালকনিতে চলে যাওয়া, সুব্রত ভাইয়ের ডায়েরি পড়া। সে এক মুহূর্ত বিছানার দিকে তাকাল। ফিরোজের নিঃশ্বাসের শব্দ খুব ভারী। এখান থেকেই শোনা যাচ্ছে। তবুও সাবধানে ব্যালকনিতে গেল সে।
দরজার চিপায় বইটা পাওয়া গেল। দরজা বন্ধ থাকলে জায়গাটা ফাঁকা হয়, আর দরজা খুললে আড়াল হয়। সে দরজাটা ভিড়িয়ে ডায়েরি হাতে তুলে নিলো আবার। তাঁর মাথায় ভেজা। চুলে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝুলে আছে। মাঝে মাঝে পড়ছে টুপ করে। সূর্যের আলো এখনো চারিদিক উজ্জ্বল করেনি। ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে৷ হালকা একটা অনুভূতি, যা হৃদয়ে প্রশান্তি এনে দেয়। সে তোয়ালেটা গলায় জড়িয়ে ডায়েরির পাতা উল্টাল।
সুব্রত ভাই লিখেছেন,
“সেদিন ছেলেটার চাকরি হয়নি। আমি স্যারের কাছ থেকে জানতে পারি, ছেলেটা তাঁর মন জয় করে পারেনি। সহজ প্রশ্নের জবাব পর্যন্ত দিতে পারেনি। অথচ সার্টিফিকেট-এ রেজাল্ট ততটা খারাপ ছিল না। স্যারের মতে, ‘এই ধরনের ছেলেরা সারাজীবন মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে রেজাল্ট করেছে। প্রকৃত অর্থে এরা মূর্খ। নির্বোধ।’ তবে আমার ধারণা ছিল, ছেলেটা প্রথমবার যে কনফিডেন্স নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল, দ্বিতীয়বার একই কনফিডেন্স সে ধরে রাখতে পারেনি। নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। এমন অবস্থায় তো অনেকে বাংলাদেশের রাজধানীর নাম বলতে কয়েকবার হোঁচট খায়। পাকিস্তানের রাজধানীর নাম জানতে চাইলে সর্বপ্রথম তাঁদের মাথায় আসে ‘কারাচি’র নাম! ছেলেটার এই পরিনতির জন্য অবশ্য পরোক্ষভাবে আমি দায়ী। আসলে আমি জানি না কাজটা কেন করেছিলাম। ঠিক না ভুল, সেটা তো আরও জানি না। শুধু মনে হয়েছিল, এমন কিছু করা দরকার, যার প্রভাব সরাসরি মেয়েটার উপর পড়ে, এবং সে ভিন্ন নজরে আমাকে পর্যবেক্ষণ করে। এইরকম দুষ্টু বুদ্ধি আমার মাথায় আসার কথা ছিল না। কীভাবে যে চলে এসেছিল, সেটা এক আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না! তবে আমি আনন্দিত তখনই হয়েছিলাম, যখন ছেলেটা চলে যাওয়ার পর মেয়েটা আমার প্রতি নিজের অভিভূত দৃষ্টি ঢেলেছিল। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি টেনেছিল। সেখানে কোনো জড়তা ছিল না। ছিল শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা। মনেমনে আমি এটাই চেয়েছিলাম। বইতে পড়েছি, মেয়েদের মন জয় করতে চাইলে প্রথমে তাঁদের কাছে নিজেকে সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করো। তাঁর বিশ্বাস অর্জন করতে চাইলে এমন কিছু করো, যাতে সে তোমাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করে৷ তাঁর দৃষ্টিতে তুমি একজন ভালো মনের মানুষ হও। আমার চেষ্টার নিমিত্ত ছিল এটিই। তাই ঠিক ভুল নিয়ে ততটা ভাবিনি তখন। ‘লাভ অ্যাট ফাস্ট সাইড’ কথাটা বইয়ে পড়েছি সমসময়। নিজের জীবনে কখনো অনুভব করিনি। রুশাকে দেখার পরই প্রথম অনুভব করি এটি। সাথে আমি এই কথাটিকে প্রবলভাবে বিশ্বাস করে ফেলি।”
হঠাৎ ফিরোজের ডাক কানে আসতেই ঠাস করে ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেলল চিত্রা। সে বইটা আগের জায়গায় রেখে দিলো। তখনই দরজা ঠেলে ব্যালকনিতে উঁকি দিলো ফিরোজ। বইটা ততক্ষণে দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে! চিত্রা ফিরোজের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে। ফিরোজ ভুরু উপরে তুলে বলল, “তুমি এখানে? ভেবেছিলাম সকালে নিজেকে বিছানায় দেখে রাগ করে বাপের বাড়িতে চলে গেছ।”
ফিরোজের পাশ দিয়ে ঘরের ভিতরে চলে এলো চিত্রা। আবার তোয়ালেটা হাতে নিয়ে, ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “যদি এমনটাই ভাবতে, তাহলে আর ব্যালকনিতে খোঁজ করতে না। তাছাড়া ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বাইরে থাকার কোনো সম্ভবনাই ছিল না। এত বোকা তুমি নও।”
“বাবাহ্, বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছে! হঠাৎ এত গাম্ভীর্যতা? কারণ কী? রাতের ঘটনার প্রভাব?” জানার জন্য এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফিরোজ।
চিত্রা মৃদু হেসে বলল, “রাতের ঘটনা রাতেই শেষ। আমি মনে করি তুমি সাময়িক সময়ের জন্য নিজের মধ্যে থেকে হারিয়ে গেছিলে। তাই নিজের ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলে। আশা করি এখন তোমার সচেতন মন এটা উপলব্ধি করেছে, সুব্রত ভাই আমারও ভাই। তোমার আর কনার মধ্যে যে সম্পর্ক, আমার আর সুব্রত ভাইয়ের মধ্যে ঠিক তেমনই সম্পর্ক। তোমার পরিবার যেমন আমার পরিবার, তেমনই সেই পরিবারের সকল আপনজন আমারও আপনজন।”
গালের ছোট ছোট দাড়িগুলো চুলকাতে চুলকাতে বিছানায় বসল ফিরোজ। বিদ্রুপের সুরে বলল, “মনে হচ্ছে তোমার সুব্রত ভাই তোমার মাথাটা খেয়ে দিয়েছে। আমি যেই চিত্রাকে জানতাম, তাঁর সাথে সামনে দাঁড়িয়ে থাকার চিত্রার বিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করছি। এত গুরুগম্ভীর, কথায় এত তেজ, এত দৃঢ়তা; চিত্রা এমন ছিল না।”
ফিরোজের কথাটা চিত্রাকে ভাবাল। সত্যিই সে এমন ছিল না আগে। যতই খারাপ সময় থাকুক, কথা বলার সময় মৃদু হাসি আঠার মতো লেগে থাকতো তাঁর ঠোঁটের কোণে। ক্ষীণ মুচকি হাসি, রসিক সুর!
চিত্রা ফিরোজের পাশে বসল। কয়েক সেকেন্ড পর বড় একটা শ্বাস ফেলে, ওর হাতের উপর হাত রাখল। এরপর তীব্র আবেগময় কণ্ঠে বলল, “দেখো, তোমার পায়ে পড়ি, রাগ হলে তুমি আমাকে মারো-বকো, যা খুশি করো। কিন্তু আমাকে এড়িয়ে যেও না। তুমি যখন আমাকে ইগনোর করো, তখন আমার ভিতরে ভিতরে খুব কষ্ট হয়। মৃত্যু যন্ত্রণা হয় আমার।”
নির্বাক থাকল ফিরোজ। শুধু চিত্রার হাতটা মুঠোয় আবদ্ধ করল আলতো করে। কোনো এক আশ্বাসের ইঙ্গিত এটি। প্রশান্তি অনুভব করে চিত্রা আবার বলল, “রাতে যা হয়েছে, তা মাথায় বয়ে নিয়ে সারাদিন আমার থেকে নিজেকে দূরে রেখো না৷ আমার কষ্ট হয়। তুমি হয়তো জানো না আমি এই মুহূর্তে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি তোমাকেই ভালোবাসি। তুমি আমার জীবনসঙ্গী। তোমার সাথে থেকেই আমি জীবনের বাকি দিনগুলো বাঁচতে চাই।”
ফিরোজ বলল, ” আমি জানি, চিত্রা।”
“কিচ্ছু জানো না তুমি। জানলে আমাকে অবিশ্বাস করতে না। আমার উপর থেকে আস্থা হারাতে না।” চিত্রার ভেতর থেকে তীব্র অভিমান ঝরে পড়ল, টপটপ করে অশ্রু পড়ার মধ্যে দিয়ে। সে বলতে লাগল, “আমাকে বোঝা উচিত ছিল তোমার। আমি যেটা করছি, এই পরিবারের সুখের কথা ভেবে করছি। আমি একা সুখী হতে শিখিনি। সবাইকে নিয়ে সুখে বাঁচতে শিখেছি।”
চিত্রার চোখ মুছে দিয়ে ফিরোজ বলল, “আমি তোমাকে যতটা বিশ্বাস করি, ওকে ঠিক ততটাই অবিশ্বাস করি।”
জবাব দিতে পারল না চিত্রা। একজন অন্ধকে পথ বলে দিলে সে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারে। কিন্তু যে চোখে দেখেও অন্ধের ন্যায় আচরণ করে, হাজার চেষ্টা করেও তাঁর গন্তব্য সুস্পষ্ট করা যায় না।
ফিরোজ যখন খাওয়াদাওয়া শেষে করে বেরোলো, তখন আবার একা হয়ে পড়ল চিত্রা। ইদানীং এই একাকীত্ব তাঁর ভালো লাগে না। একা হলেই সে ক্ষণেক্ষণে উপলব্ধি করে, খুব দ্রুতই ফিরোজের সাথে তাঁর দূরত্ব সুদীর্ঘ হচ্ছে। এসব ভাবলে তাঁর অস্বস্তি হয়৷ হৃদয় অশান্ত হয়ে পড়ে।
তখন সকাল পেরিয়ে বেলা ১১টা। সবেমাত্র ড্রয়িংরুম থেকে ঘরে এসেছিল চিত্রা, ডায়েরিটা পড়বে বলে, এমন সময় সুলতানা এসে জানাল, প্রতিবেশী রশ্মি এবং তাঁর মা এসেছে। শুনে সে তো অবাক! মুহূর্তেই ছুটে গেল নিচে।
রশ্মি মায়ের সাথে কথা বলছেন ফিরোজের মা। দুজনেই সোফায় বসে আছেন। রশ্মি দাঁড়িয়ে আছে পাশে। চিত্রাকে দেখে প্রশস্ত হাসি দিলো সে। ঠোঁট টিপে তাকিয়ে রইল।
চিত্রা ড্রয়িংরুমের মাঝখানে গিয়ে রশ্মির মা-কে সালাম দিয়ে বলল, “এখন আপনার শরীর কেমন, আন্টি?”
রুমানা বেগম জানালেন, “অনেকটাই ভালো, মা। সেজন্যই তো আসতে পারলাম। শুনেছি সুব্রতর খুব জ্বর হয়েছে।”
চিত্রা বলল, “সুব্রত ভাই-ও এখন অনেকটা সুস্থ। জ্বর কমেছে।”
চিত্রার কথা শেষ হতেই দীপালি বেগম একপ্রকার ধমকের সুরে বললেন, “চিত্রা, যাও, উনাদের জন্য জল-খাবারের ব্যবস্থা করো।”
রুমানা বেগম বলে উঠলেন, “সেসবের প্রয়োজন নেই, ভাবী। কিছুক্ষণ আগেই সকালের খাবার খেয়েছি। পেট খুব ভরা।”
“তা কী করে হয়? খালি মুখে যেতে দিবো আমি?”
“আচ্ছা৷ চা খেয়ে যাব না-হয়। এখন সুব্রতকে দেখে আসি। আচ্ছা, ওর ঘরটা কোনদিকে? বাইরে থেকে তো দেখেছি, পশ্চিম আর দক্ষিণের কোণার ঘরটা।” বলে হাসিমুখে ওঠে দাঁড়ালেন রুমানা বেগম। তিনি যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলেন।
চিত্রা, রুমানা বেগমকে পথ দেখানোর প্রস্তুতি নিলে, তা বুঝতে পেরে আচমকাই দীপালি বেগম দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, “আমি নিয়ে যাচ্ছি, চলুন আমার সাথে।”
রুমানা বেগম আর দীপালি বেগম চলে গেলে চিত্রা রশ্মির হাত ধরে সোফায় বসল। চঞ্চল হয়ে বলল, “রাতের জ্যোৎস্না সকালে উদয় হলো যে! ব্যাপার কী?”
রশ্মি বিস্মিত হলো। মুখ ‘হা’ করে বলল, “ওমা! কে জ্যোৎস্না?”
“তুমি জ্যোৎস্না। আবার কে?”
রশ্মি লজ্জা পেয়ে বলল, “তাই বুঝি? তুমিও না! সবসময় অদ্ভুত কথা লেগেই থাকে তোমার মুখে। আমার চেহারা যেমন অন্ধকার, তা আবার জ্যোৎস্না! হুহ।” নিজেকে নিজেই উপহাস করল রশ্মি।
চিত্রা মুখ শক্ত করে বলল, “তা জ্যোৎস্না কোথায় দিনের আলোর মতো পরিষ্কার? সে-ও তো অন্ধকার, আবছায়া। তবুও তো মানুষ তাকে পছন্দ করে। তাঁর সাথে সময় কাঁটাতে চায়। সেই সময় কাঁটানোর স্মৃতি মনে রাখে সারাজীবন।”
রশ্মি মিনমিনে গলায় বলল, “তা আমাকে কে পছন্দ করে শুনি?”
“আমি করি।”
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে রশ্মি বলল, “সে তো তুমি আমার বন্ধু বলে। আর কে আমাকে পছন্দ করে?”
চিত্রা মিটমিট করে হেসে বলল, “আরও একজন আছে, যে তোমাকে খুব পছন্দ করে।”
“কে?” অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে থাকল রশ্মি।
চিত্রা ঠোঁটের কোণে সেই দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলল, “কে আবার, সুব্রত ভাই। খুব পছন্দ করে। মনে মনে ভালো-টালো বাসে হয়তো।”
“ধুর!” রশ্মির সারা শরীর আকস্মিক শিউরে উঠল। স্বপ্নে তো এমন কিছুই দেখে সে! তবে চিত্রাকে তা বুঝতে না দিয়ে বলল, “তোমার সব বাজে কথা।”
“বাজে না। সত্যি বলছি। একেবারে তিন সত্যি। এই দেখো, চোখে চোখ রেখে বলছি।” চোখ বড় বড় করে রশ্মিকে দেখাল চিত্রা। “চোখে চোখ রেখে কেউ মিথ্যা বলতে পারে?”
“পারে। বাস্তবে জীবনে চোখে চোখ রেখেই সবাই মিথ্যা বলে। যেন অপরপক্ষের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়। এবং সে সফলও হয় এতে। তুমি এইরকম কিছুর চেষ্টা করছ।”
মৃদু হাসল চিত্রা। সহসা নিরাশ ভঙ্গিতে বলল, “বাদ দাও! কেউ বিশ্বাস করতে না চাইলে তাকে জোর করে কীভাবে বিশ্বাস করাবো? তুমি নিজের কথা বলো। সব কেমন চলছে?”
রশ্মি উদাস! ‘সব কেমন চলছে?’ এই প্রশ্নটা সে যেন শুনতেই পায়নি। অন্য জগতে বিরাজ করছে সে। এদিকে গোপনে হাসছে চিত্রা। বোধহয় কাজ হয়েছে!
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ রশ্মি আড়ষ্ট হয়ে বলল, “তুমি সত্যি বলছ? আচ্ছা, উনি যে আমাকে পছন্দ করেন, তা তোমাকে কে বলল?”
“কে আবার বলবে? আমি দেখেছি নিজের চোখে। আমি তো আর বাচ্চা নই, যে মানুষের মনের কথা একটুও বুঝতে পারবো না।”
“কী বুঝেছ তুমি?” রশ্মি জানতে চাইল, তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে। ভীষণ উদগ্রীব সে।
চিত্রা সোফায় হেলান দিয়ে বলতে লাগল, “আমি প্রায়ই লক্ষ্য করি, তুমি যখন আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া-আসা করো, তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে রোজ সুব্রত ভাই তোমাকে দেখে। উনি ঠিক ঘড়ি ধরে ওই সময়েই বারান্দায় উপস্থিত হন। আমি দেখি, উনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তোমার দিকে। সেসময় উনার চোখ-মুখ সূর্যের কিরণের মতো ঝলমল করে। সমুদ্রে সূর্যের আলো পড়লে যেমন চমকায়, তাঁর চেহারাও তখন সেরকম চমকায়।”
“ধ্যাৎ!” ঘটনা কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না রশ্মির। সে বলল, “তুমি বোধহয় সারাক্ষণ সুব্রত ভাইয়ের পাশে বসে থাকো? যার কারণে উনি কখন কোথায় দেখেন, সেসব লক্ষ করো।”
“পাশেই তো থাকি। তবে উনার পাশে না, উনার বারান্দার পাশে। আমাদের ঘরের ব্যালকনি দেখে উনার ঘরের বড় বারান্দাটা স্পষ্ট দেখা যায়।”
রশ্মির কাছে কথাগুলো তবুও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। সুব্রত ভাইকে সে এমন চরিত্রে মানতে পারে না। লোকটা চিরকালই তাঁর সাথে মুরুব্বিটাইপ আচরণ করেছে। এখনো করে। তাছাড়া বয়সটাও প্রায় দিগুণ! রশ্মি বলল, “তুমি বললেই আমি বিশ্বাস করে নেবো? এত সোজা? সুব্রত ভাই স্পষ্ট কথা বলেন। যদি তাঁর মনে এমন কিছু থেকে থাকতো, তাহলে এতদিনে বলে দিতো।”
“বয়স হয়েছে না? বলে দেওয়া এত সোজা? তাছাড়া এটা প্রেম বিষয়ক ব্যাপার!”
রশ্মি ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “তুমি বলতে চাইছো, সুব্রত ভাই আমাকে ভালোবাসেন?”
মুখ টিপে ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা ঝাঁকাল চিত্রা। রশ্মি সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া জানাল, “তুমি না, একেবারে পাগল হয়ে গেল। সুব্রত চাই আমাকে ভালোবাসবেন? কত সুন্দর দেখতে উনি! আর আমি?”
রশ্মি বলছে বটে, তবে ওর চেহারাতে যে পরিবর্তন এসেছে, তা চিত্রার চোখে ধরা পড়েছে ঠিকই। মেয়েটার মাটির মতো মসৃণ গাল দুটো যেন আস্তে আস্তে লাল হতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে শরীরের সমস্ত রক্ত ওখানটাতে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে!
চিত্রাই প্রস্তাবটা দিলো। “যাবে নাকি একবার, সুব্রত ভাইকে দেখতে?”
“হু, আমার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। মা বলল সাথে আসতে, তাই এলাম। আমিও ভাবলাম, যদি মাথা ঘুরে পড়ে যায়। নাহলে আসতাম না।”
“কেন আসতে না?”
“ভালো লাগে না আসলে। সুব্রত ভাইকে আমার এমনিতেও দেখতে ইচ্ছে করে না। কেমন ভয় ভয় করে। কী ভয়ংকর চেহারা! বড় বড় চুল, বড় বড় দাড়ি। চোখগুলো দেখলেই তো গা শিউরে ওঠে। সাদা বেড়ালের মতো চোখ! তাছাড়া উনার ইতিহাস ভালো না।”
হাসি চেপে রাখতে খুব কষ্ট হলো চিত্রার। একটু আগে যাকে সুন্দর বলে প্রশংসা করল, এখন তাকেই ভয়ংকর বলছে! চিত্রা নিজেকে সংযত রেখে বলল, “সত্যিই যাবে না?”
“না।”
“আর একবার বলব। যাবে?”
“বললাম তো না।” এবার রাগ দেখিয়ে, বেশ জোর গলায় ‘অসম্মতি’ জানাল রশ্মি।
চিত্রা আর কিছু বলল না। অপেক্ষায় থাকল রশ্মির সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের। কিছুটা সময় কেটে গেল এর মধ্যে। হঠাৎ রশ্মি বলে উঠল, “তোমার বাড়িতে এলাম, তোমার ঘর দেখাবে না?”
চিত্রা অবাক হয়ে বলল, “আমার ঘর দেখবে?”
“হ্যাঁ। চলো যাই, কেমন ঘর সাজিয়েছ, দেখে আসি।” কথাটা বলে নিজেই ওঠে বসল রশ্মি।
চিত্রা মুচকি হেসে বলল, “ওকে।”
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল চিত্রা আর রশ্মী। চিত্রা ভাবল, রশ্মিকে সরাসরি সুব্রত ভাইয়ের ঘরে নিয়ে গেলে কেমন হয়? মন্দ হয় না বোধহয়!
সুব্রতর ঘরে এসে ওর জ্বরের খবর জানার পর একটা টুলে বসলেন রুমানা বেগম। দীপালি বেগম তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। রুমানা বেগম বললেন, “দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, ভাবী? বসুন।”
“না। আপনি কথা বলুন।” সংক্ষেপে, গম্ভীরমুখে বললেন দীপালি বেগম।
রুমানা বেগম আবার সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাকে এখন বেশ সুস্থ দেখে ভালো লাগছে। যখন শুনলাম তোমার শরীরের এমন অবস্থা, তখন খুব অপরাধবোধ হচ্ছিল। আমার জন্যই তো..।”
“না না।” ভদ্রমহিলাকে থামিয়ে দিলো সুব্রত। “আন্টি, আপনি এভাবে ভাবছেন কেন? আমার ভাগ্যে যা লেখা ছিল, তা-ই হয়েছে। বরং এই মুহূর্তে আপনি ভালো আছেন দেখে আমারও ভালো লাগছে।”
“হ্যাঁ। আল্লাহর রহমতে ভালো আছি এখন পর্যন্ত। ক’দিন থাকবো, কে জানে? রোগটা যা মারাত্মক! একবার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তো মৃত্যুর দরজা দর্শন করিয়ে ছাড়ে।”
সুব্রত মৃদু শব্দ করে হাসল।
রুমানা বেগম আবার বললেন, “ব্যাস আমার শুধু ওই এক মেয়েকে নিয়ে চিন্তা। একটা ভালো ছেলের হাতে মেয়ের দায়িত্ব দিতে পারলেই স্বস্তি।”
কিছু বলল না সুব্রত। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইল।
রুমানা বেগম ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বিস্মিত হয়ে বললেন, “বেশ গুছিয়ে রেখেছ ঘরটা। নিজেই এভাবে গুছিয়ে রাখো?”
“জি।” সংক্ষিপ্ত করে জবাব দিলো সুব্রত।
“ঘরটার মতো তোমার জীবনটাও এইরকম গোছানো হতে পারতো৷ কিন্তু তা হয়নি। প্রথমে আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু যখন দেখলাম তোমার পরিবারই তোমার বিরুদ্ধে কথা বলছে, তখন তো চমকে গেছিলাম। তোমার মতো ছেলে এইরকম করবে? এরপর তোমার জেল হয়ে গেল। তখন বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিলাম। আহা! কী জীবন, কোথা থেকে কোথায় চলে গেল!” কথাগুলো বলে খুব আফসোসের সাথে শ্বাস ত্যাগ করলেন রুমানা বেগম।
সুব্রত কিছু বলতে পারল না। উদাস হয়ে বসে রইল বিছানায় উপর। সে-ও তো ধাক্কাটা খেয়েছিল, যখন সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছিল। সে তো পূর্বে কল্পনাও করেনি, তাঁরই পরিবারের লোকজন তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলে তাঁর জীবন থেকে পাঁচটা বছর কেড়ে নিবে, তাঁর জীবনটাকে কলঙ্কিত করবে। কিন্তু এমনটাই তো হয়েছিল।
রুমানা বেগম আর দীপালি বেগম যখন সুব্রতর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, তখনই মুখোমুখি হলো চিত্রা আর রশ্মির সাথে। দীপালি বেগম চিত্রার উদ্দেশে বললেন, “কোথায় যাচ্ছ, মা?”
চিত্রা বলল, “রশ্মিকে বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি।”
দীপালি বেগম এগিয়ে গিয়ে বললেন, “এদিকে তো আর কিছু নেই। ওদিকে দেখো তোমরা।”
“কিন্তু মা..।” চিত্রা থেমে গেল হঠাৎ, অজানা কারণেই।
দীপালি বেগম মৃদু হেসে বউমার আরও কাছে গিয়ে বললেন, “মেহমান এসেছে বাড়িতে। বাড়ির বউ নিজের হাতে চা করে খাওয়াবে না, তা কী হয়? চলো চলো।”
অগত্যা সুব্রত ভাইয়ের ঘরে যাওয়া হলো না। চিত্রার মনে যে দুষ্টু বুদ্ধির জন্ম হয়েছিল, তা দমে গেল হঠাৎ করে! তাঁরা বাধ্য হলো দোতলা থেকে একতলায় নেমে আসতে।
১৫তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।
গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=832448701033165&id=100028041274793
বি:দ্র: দুঃখিত, সঠিক সময় দিতে পারিনি।