প্রদীপের নিচে আমি পর্ব ১

0
860

বিয়ের দিন জানতে পারি যে ছেলের সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে সে আমার থেকে আট বছরের ছোট। ছেলের সাথে আগে পরিচয় নেই, বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে হচ্ছে। ছেলের বাড়ির লোকজন আমাকে দেখে পছন্দ করেছে, আমার পক্ষের কয়েকজন গিয়ে ছেলের বাড়িঘর দেখে এসেছে।

এইতো গত শুক্রবার বাবা আর মামারা গিয়েছিল ছেলের বাড়িঘর দেখতে। ফিরে এসে বাবা বললো, ” বুঝলে রেণু ছেলেদের বিশাল বাড়ি, বাড়ির পিছনে মস্ত পুকুর। নিজেদের ধান-পান সবকিছু আছে। বাড়িতে লোকজনও তেমন নেই। শুধু ছেলের বাবা মা আর ছোট ভাই। ছেলে অবশ্য এখনও কিছু করে না, পড়াশোনা করছে। চাকরি-বাকরির দরকার হবে না, যে সম্পত্তি আছে তা সাত পুরুষ খেয়েও শেষ করতে পারবে না। ”

বাবার কথায় মা খুব খুশি হয়েছিল, আমি ছিলাম নির্বিকার। এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাইনি, সবে অনার্স শেষ করেছি। পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবো, তারপর বিয়ে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা। কিন্তু মা-বাবার কাছে আমার মতামতের কোন গুরুত্ব ছিল না, এক প্রকার জোর করেই তাঁরা এই বিয়েতে রাজি করেছে।

বিয়ের কয়েকদিন আগে ছেলের সাথে মোবাইলে কথা হয়েছিল। উনি বলেছিলেন, ” তুমি চাইলে বিয়ের পরেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারো। আমরা দু’জন মিলেই না হয় কলেজে গেলাম। আসলে আমার একান্ত নিজের একজন বন্ধু দরকার, তাই মা বাবা বিয়ের কথা বলেছি। ”

সেদিন বেশ কিছুসময় কথা হয়েছিল। উনার কথায় সন্তুষ্ট হয়েছিলাম বিধায় বিয়ে নিয়ে খুব বেশি ঝামেলা করিনি। কিন্তু এখন যেসব দেখছি তাতে কিছু বুঝতে পারছি না। মা বাবা কি করে এতো কম বয়সী একজন ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিতে পারে? আবার ছেলে পক্ষই বা কেমন! আজকাল ছেলের বয়স বেশি আর মেয়ের বয়স কম হয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বিপরীত।

ঘরোয়া আয়োজনে বিয়ে হচ্ছে, যেহেতু ছেলের বিয়ের বয়স হয়নি তাই ধুমধাম করে বিয়ে হবে না। নানান চিন্তায় মাথা ছিঁ”ড়ে যাচ্ছে, কোন হিসাব মিলাতে পারছি না। চিরচেনা বাড়িটাও আজ অদ্ভুতভাবে অচেনা হয়ে গেছে। মা বাবাকে দেখেও চিনতে পারছি না। এতো বেশি বিচলিত হওয়ার হয়তো অস্বাভাবিক। চাইলেই পু”লি”শ ডেকে সবকিছু এলোমেলো করে দিতে পারি কিন্তু পারছি না। আমার হাত-পা, কণ্ঠনালীসহ সমস্ত শরীর কোন অশরীরী শক্তি চেপে ধরে আছে, শরীর অবশ হয়ে আসছে। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না, যেন সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছি।

রাত একটা। ফুলে সাজানো বিছানায় বসে আছি। বিয়েটা আইনি ভাবে অনৈতিক তাই রাতে সম্পন্ন হয়েছে। বিয়ে শেষে শশুর বাড়ি আসতে আসতে রাত এগারোটা, তারপর নানান আচার-অনুষ্ঠান শেষে এখন ঘরে এসে বসেছি। বর নামক মানুষটা এখনো আসেনি, তাঁকে দেখিনি এখনও। বিয়ের সময় কয়েক পলক দেখেছিলাম বটে কিন্তু অস্পষ্ট। তাছাড়া নিজের থেকে এতো ছোট ছেলের সাথে বাসর সম্ভব! কিভাবে? ভেবে ভেবে অস্থির। গায়ে ভারী গহনা, মোটা শাড়ি, মেকাপ, সবকিছু মিলে পা’গল পা”গ”ল অবস্থা আমার।

” এই মেয়ে শোনো। ”

মেয়েলি গলায় সামনের দিকে তাকলাম, অল্প বয়সী একটা মেয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে বিয়ের পোশাক। যেন আজ এই মেয়েরও বিয়ে হয়েছে। মেয়েটার কথায় ভদ্রতা বলে কিছু নেই। বয়সে আমি ওর থেকে অনেক বড়। তবুও কেমন চামারের মতো কথা বললো। মেয়েটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবুও কি বলতে এসেছে জানা প্রয়োজন।

” কিছু বলবে?”

” হ্যাঁ, বলবো বলেই এখানে এসেছি। নয়তো তোমার মুখ দেখার কোন ইচ্ছে ছিল না। নিরব আজ এ ঘরে আসবে না। তুমি ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ো বা যা খুশি কর। ”

” নিরব কে?”

” ও মা! নিরব কে জানো না নাকি? নিরবের গলায়ই তো ঝুলে পড়েছ, যত্তসব ন্যাকামি। ”

মেয়েটা দরজা টেনে দিয়ে চলে গেল। কথায় বুঝলাম মেয়েটার আমার প্রতি রাগ রয়েছে। কিন্তু কেন? অপরিচিত কারো সাথে কিসের রাগারাগি? আবার এমনও হতে পারে মেয়েটা আমার কাছে অপরিচিত কিন্তু সে আমাকে খুব ভালো করে চেনে। নানান চিন্তায় অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাতে পারিনি। ছোট থেকে খুব কড়া শাসনে বড় হয়েছি, হাতে গোনা দুই-একজন মেয়ে ছাড়া কোন বন্ধু-বান্ধব নেই। স্কুল জীবন বেশ ভালো কাটলেও কলেজে উঠার পর বড্ড ভিতু হয়ে গিয়েছিলাম, এর অবশ্য কারণ আছে। ক্লাস থ্রিতে বাবা গালর্স স্কুলে ভর্তি করে দিলেন, নিজে থেকে পছন্দ করে একজন বান্ধবীও ঠিক করে দিল। ওই মেয়ের সাথে ছাড়া অন্য কারো সাথে কথা বলা নিষেধ। সবার সাথে মিশলে নাকি আমি খারাপ হয়ে যাব। স্কুল ছুটি হলে আমি কি করেছি, কার সাথে কথা বলেছি সবকিছু মেয়েটা বাবাকে বলে দিত। একদিন নতুন একটা মেয়ের সাথে অনেক সময় কথা বলেছিলাম, মেয়েটা বেশ ভালো। নিজে থেকে আমার সাথে পরিচিত হতে এসেছিল। কিন্তু আমার একমাত্র বান্ধবী ছুটির পর বাবাকে সব বলে দিল, সেদিন রাতে বাবা ঘরে দরজা বন্ধ করে ইচ্ছে মতো মা”র”লো। এরপর আর কারো সাথে কথা বলার সাহস দেখায়নি। স্কুল শেষে কলেজে ভর্তি হলাম। বাবার সাথে কলেজে যেতাম, সামনের বেঞ্চে বসে স্যারদের কথার নোট তৈরি করে আবার বাবার সাথে বাসায় ফিরে আসতাম। সম্পূর্ণ কলেজ জীবনে হয়তো দুইদিনও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাইনি। কেন আমাকে এতোটা বন্দি করে বড় করেছে জানি না, তবে এর প্রভাবে কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস করতে পারি না।

বিয়ের দু’দিন যেতেই বুঝলাম এ বাড়িতে আমাকে বিনা পয়সার চাকর করে নিয়ে আসা হয়েছে। কেন আমার সাথে এমন হলো খুব জানতে ইচ্ছে করতো কিন্তু জিজ্ঞেস করার মতো কাউকে পেতাম না। শশুর বাড়ির আশেপাশে কোন বাড়ি নেই, শুধু নিরবের এক চাচার বাড়ি আছে। সেখানে নিরবের চাচি আর উনার এক মেয়ে থাকে। বিয়ের রাতে যে মেয়েটা আমার কাছে এসেছিল সে নিরবের চাচাতো বোন। এই দু’দিনে নিরবের সাথে কোন কথা হয়নি। দেখাও হয়নি তেমন, শুধু গতকাল রাতে খাবার টেবিলে দেখা হয়েছিল। সে আলাদা ঘরে থাকে, বাসর রাতের পরদিন আমার ঘর আলাদা করে দিয়েছে শাশুড়ি মা। নিরব কোন কথা বলেনি। অবশ্য কি কথাই বা বলবো ওর সাথে!

এ বাড়িতে আসার পর থেকে বেশিরভাগ কথা হয়েছে শাশুড়ি মা’য়ের সাথে। বউমা এটা করো, ওদিকে যাবে না, নিরবের সাথে বেশি কথা বলবে না, বাড়ির কাজ সব তোমাকেই করতে হবে আমার বয়স হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ বাড়িতে আসার পর মা বাবা কেউ কল দেয়নি, দেখা করতেও আসেনি। শুধু মা আসার আগে বলে দিয়েছিল কারো মুখে মুখে তর্ক করবি না, যা বলে সব কথা শুনবি।

স্বভাবত ভীতু হওয়ার কারণে সবকিছু নিয়ে বেশ ঘাবড়ে আছি। কি করবো না করবো বুঝে উঠতে পারছি না৷ বিয়ের অযুহাতেও এ বাড়িতে বাইরের লোক নেই, শুধু নিজেরা নিজেরা, নিবরের চাচির সাথে দেখা হয়নি আর চাচাতো বোনটা আমাকে সহ্যই করতে পারে না। তাই আমার সাথে কথা বলার মতো কেউ নেই। ছোট বেলা থেকে কম কথা বলি বলে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না, চুপচাপ সবার হুকুম মেনে চলছি। কাজ করতে হলেও এখানে মা’য়ের পি”টা”নি নেই। বাড়িতে কিছু ভুল করলেই মা- বাবা খুব মা”র”তো। জানালার পাশে বসে আকাশ পাতাল ভেবে চলেছি, হঠাৎ পুরুষালি গলায় সামনে দিকে তাকালাম। ঠিক পুরুষের গলা বলা চলে না, ১৫-১৬ বছর বয়সী কোন ছেলের গলা। সামনে তাকিয়ে দেখি নিরব দাঁড়িয়ে আছে। উত্তর না পেয়ে নিরব আবারও বলে উঠলো,

” এই যে শুনছেন। ”

” হ্যাঁ। ”

” আমাকে একটু কষ্ট করে নুডলস রান্না করে দেন তো। দুইজনের মতো রান্না করবেন। ”

” আচ্ছা। ”

বাড়তি কথা না বলে রান্নাঘরে চলে এলাম। ঝামেলা করার কোন ইচ্ছে আমার নেই, ঝগড়া অশান্তির থেকে চুপচাপ সবকিছু মেনে নেওয়াই ভালো মনে হচ্ছে। বেশ খানিকটা নুডলস রান্না করলাম, খেতে ইচ্ছে করছে হঠাৎ। এ বাড়িতে আসার পর কোন বেলাতে ভালো মত খেতে পারিনি, ডিপ্রেশনে ভুগছি বোধহয়। রান্না শেষে নিরবকে ডেকে বললাম রান্না শেষ।

“দুইটা প্লেটে বেড়ে দেন, আর ফ্রিজে সসের প্যাকেট আছে নিয়ে আসুন। ”

ছেলেটার গলায় হুকুমের সুর। ভাবতেই অবাক লাগে এতো ছোট একটা ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে, এই সম্পর্কের আদো কি কোন ভবিষ্যৎ আছে? আর মা বাবাই বা কেন এমন বিয়ে দিল!

দুটো থালায় নুডলস বেড়ে ফ্রিজ থেকে সস আনতে গেলাম। যদিও এ বাড়িতে এসেছি মাত্র দু’দিন হয়েছে তবুও সবকিছু চিনে ফেলেছি। শাশুড়ি মা নিজে সাথে নিয়ে সবকিছু চিনিয়ে দিয়েছে পাছে কাজ করতে অসুবিধা না হয়। সস নিয়ে এসে দেখি নিরব প্লেটে নিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। সসের প্যাকেট দিতে আমিও ওর পিছন পিছন গেলাম কিন্তু নাগাল পেলাম না। এ প্রকার দৌঁড়ে ওর কাকিদের ঘরে ঢুকে গেল এবং দরজা লাগিয়ে দিল। হয়তো চাচাতো বোনের সাথে গল্প করবে নয়তো অন্যকিছু। এ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামালাম না, ঘরে চলে এলাম। ঘরে ঘরে আসতে আসতে শশুর শাশুড়ির কথপোকথন কানে এলো। শশুর মশাই বেশ বিরক্ত সুরে শাশুড়ি মা’কে বলছে, ” আচ্ছা পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে এই মেয়েকে ছেলের সাথে বিয়ে করিয়ে কি লাভ হলো? তুমি ঘরের কাজ করতে না পারলে কাজের লোক রেখে নিতে, শুধু শুধু তোমার যত বাড়াবাড়ি। ”

” আহ্, তুমি রাগ করছো কেন? আমি সব বুঝেশুনে করেছি। ”

শশুর মশাই হয়তো আরো কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু আমাকে দেখে চুপ হয়ে গেল। শাশুড়ি মা হেসে বললো, ” বউমা এলে, কোথায় গিয়েছিলে? তোনার শশুর আব্বুকে এক কাপ চা বানিয়ে দেও তো। ”

শাশুড়ি মা’য়ের কথা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম না, মা-বাবাকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে আমাকে ছেলের বউ করছে এরা! কিন্তু কেন? নাকি ভুল বুঝলাম। হয়তো বিয়েতে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

” দাঁড়িয়ে কেন? আহা যাও। চা করে নিয়ে এসো। ”

” জ্বি যাচ্ছি। ”

চা বানাতে বানাতে মনে হলো মা বাবার সাথে কথা বলা দরকার। কোথাও খুব বড় ঝামেলা আছে।

চলবে

সূচনা পর্ব
#প্রদীপের নিচে আমি
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here