“আন্টি তোমার বড় ছেলেটা সবসময় এমন ঝা’ড়ি মেরে কথা বলে কেন?”
মুরগির মাংস কষাতে কষাতে শেফা বেগম অসিফার এহেন কথা শুনে ভ্রু কুচকে তার দিকে চেয়ে বলে ওঠেন,
“কিরে? শিখন তোকে কিছু বলেছে? হঠাৎ এমনভাবে ক্ষে’প’লি কেন আমার বড় ছেলের ওপর?”
অভিমানের সুরে অসিফা বলে ওঠে,
“মা ছাদ থেকে শুকনো কাপড় তুলে আনতে বলেছিল কিছুক্ষণ আগে। ছাদে গিয়ে কাপড় তোলার সময় ভুলবশত টান লেগে শিখন ভাইয়ের লাল রঙের ওই টি-শার্টটা মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল। আর আমাদের হ’ট টে’ম্পা’র ওয়ালা নেতা সাহেব তখন ভরদুপুর বেলা ছাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভিটামিন ডি খাচ্ছিলেন! যেই দেখেছে যে তার টি-শার্ট নিচে পড়ে গেছে ওমনি আমার ওপর এমনভাবে চে’চি’য়ে উঠেছিল যেন আমি ইচ্ছা করে ফেলেছি। তুমিই বলো আন্টি এখানে কি আমার কোনো দোষ আছে?”
“না অবশ্যই না। এই ছেলেকে নিয়ে যে আমি কোথায় যাব! একটা মানুষের এত রাগও বা কোথা থেকে আসে কে জানে? তুই কষ্ট পাস না মা।” (শেফা বেগম)
“তোমার ছেলে তো চিনি ছাড়া চা খায়। এখন হতে চায়ের মধ্যে ৪/৫ চামচ চিনি গুলিয়ে দিও। আর পারলে ভাত এবং তরকারির সাথেও তা মিশিয়ে দিও। তাহলে যদি একটু কথায় মিষ্টতা আসে!”
অসিফার এহেন কথা শুনে শেফা বেগম হো হো করে হেসে উঠে বলেন,
“তুই এমনিতে কথা তেমন বলিস না। আর যদি বাই এনি চান্স বলিসও তাহলে এমন এক একটা কথা বলিস যা শুনে মানুষকে হাসতে হাসতেই দম বন্ধ হয়ে মা’রা যেতে হবে। যা বাসা থেকে দ্রুত গোসল করে আয়। মুরগির মাংস রান্না করছি, দুপুরের খাবার একসাথে খাব।”
শেফার কথা শেষ হতেই শিখন গামছা দিয়ে চুল মুছতে মুছতে রান্না ঘরে প্রবেশ করে। শিখনকে দেখে অসিফা মুখ ঝা’ম’টি মেরে স্থান ত্যাগ করার জন্য উদ্যত হয়।
অসিফাকে রান্নাঘর হতে বের হয়ে যেতে দেখে শিখন তার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“দুপুরে আমাদের বাসাতেই খেয়ে যা ক্ষে’পি।”
অসিফা দরজার সামনে গিয়ে পেছন ফিরে আড়চোখে শিখনের দিকে তাকিয়ে শেফা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
“আন্টি তোমার বড় ছেলেকে মানা করে দিও, আমাকে যেন ‘ক্ষে’পি’ বলে না ডাকে। আমার একটা সুন্দর নাম আছে। আর যদি তা উচ্চারণ করতে সমস্যা হয় তবে আমার সাথে একদম কোনো কথাই বলার দরকার নেই। আর তাকে এও বলে দিও আমার পেট ভরে গেছে।”
আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না অসিফা। দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নেমে দোতলায় তাদের ফ্ল্যাটে চলে যায়৷
শিখন প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে ওঠে,
“ক্ষে’পি এমন ক্ষে’পে আছে কেন মা?”
কষানো মাংসে পানি দিয়ে ঢাকনা দিয়ে তা ঢেকে কন্ঠে জোর এনে শেফা বেগম বলে ওঠেন,
“এমন ভাব করছিস যেন কিছুই বুঝছিস না! মেয়েটার সাথে ছাদে বসে ওমনভাবে ঝা’ড়ি দিয়ে কথা বলেছিস কেন? মেয়েটা অনেক ক’ষ্ট পেয়েছে।”
মায়ের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে শিখন। তারপর,”আচ্ছা! এই ব্যাপার তাহলে? দেখছি ব্যাপারটা।” বলে মাথা দোলাতে দোলাতে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।
———–
কলিংবেল বেজে উঠতেই ছুটে এসে নিলুফা বেগম সদর দরজা খুলে দেন। বাইরে শেফা বেগম ও তার ছোট ছেলে শাফিনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নিলুফা বেগমের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে।
“ভাবি ভেতরে আসেন।” (নিলুফা বেগম)
“অসিফা কোথায় ভাবি? (শেফা বেগম)
” একটু আগে গোসল করে বের হয়েছে। এখন মনে হয় পড়ার টেবিলে গিয়ে বসেছে।”
“ভাবি অসিফাকে নিয়ে যাচ্ছি। আজকে আমাদের সাথে দুপুরের খাবার খাবে ও।”
“আচ্ছা ভাবি কোনো সমস্যা নেই।”
শেফা বেগম আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সোজা অসিফার রুমে গিয়ে তাকে টেনে নিয়ে চারতলায় তাদের ফ্ল্যাটে চলে যান।
ডাইনিং রুমে নিয়ে অসিফাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেয় শেফা বেগম। অসিফার গালে হাত রেখে বলে ওঠেন,
“এই মেয়ে তোর চোখ-মুখ এমন ফোলা ফোলা কেন? কান্না করেছিস?”
উত্তর দেয় না অসিফা। শেফা বেগম কিছুটা দূরে আরেকটা চেয়ারে বসে থাকা শিখনের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে কিছু একটা বলেন ইশারায়। সাথে সাথে শিখন চেয়ার হতে উঠে অসিফার সামনে এসে দাঁড়ায়।
“আর কোনো দিন ঝা’ড়ি দিয়ে কথা বলব না আমি। আসলে তখন মাথা গরম থাকায় তোর ওপর রা’গ দেখিয়ে ফেলিয়েছি। যেটা একদম উচিত হয়নি। একজনের রা’গ আরেকজনের ওপরে দেখানোটা আসলেই যুক্তিহীন। সরি রে ক্ষে’পি।”
কথাগুলো বলা শেষ করেই অসিফার দিকে কয়েকটা ডেইরিমিল্ক চকলেট এগিয়ে দেয় শিখন। অসিফা জোর পূর্বক মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে তা নিতে গেলেই কি একটা ভেবে যেন শিখন চকলেটগুলো সরিয়ে নেয়। শিখনের কেন যেন মনে হচ্ছে অসিফা তার ঝা’ঝা’লো কথায় ক’ষ্ট পেয়ে কান্না করেনি।
চকলেটগুলো শেফা বেগমের হাতে দিয়ে সে বলে ওঠে,
“উহুহ! আগে ভাত খাবি তারপর আম্মু তোর হাতে চকলেট দেবে। তার আগে না। কি বলেছি আম্মু শুনেছো? এখন দ্রুত খেতে দাও।”
“আচ্ছা। তাড়াতাড়ি বস গিয়ে।” (শেফা বেগম)
—-
আগস্ট মাসের শেষের দিক। এই সময়ে আকাশের বোধ হয় মুড সুইং হয়। কখনো বা মাথার ওপর তীব্র রোদ বিরাজ করে। কখনো বা আকাশ কালো করে হয় ঝিরিঝিরি বা ভারী বর্ষণ। আবার কখনো বা স্বচ্ছ নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো তুলোর ন্যায় সাদা সাদা মেঘ গুলো সকলের চোখ জুড়িয়ে দেয়।
এমনি একদিন, প্রাইভেট পড়া শেষ করে পড়ন্ত বিকালে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরছে অসিফা। শনিবার হওয়ায় আজ আর স্কুল নেই তার। হঠাৎ তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তামিম। মুহূর্তের মাঝে অসিফার চোখ-মুখে স্পষ্ট রাগের আভা ফুটে ওঠে। তামিম বলে ওঠে,
“তুমি গতকাল হঠাৎ ব্রেকআপ করলে কেন অসিফা? আর কিছু না বলে ব্লকও বা করলে কেন?”
তীব্র কন্ঠে অসিফা বলে ওঠে,
“আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই। আমার যাকে ব্লক করতে ইচ্ছা করবে তাকে ব্লক করব। আর তার জন্য একদম কোনো কৈফিয়ত দিতে আমি বাধ্য নই। এবার আসি ব্রেকআপের কথায়! তুমি তো একটা চি’টা’র। কি ভেবেছো? আমি কিছুই জানব না?তোমার সব কীর্তিকলাপ সম্পর্কে আমি জেনে গেছি। আমারই বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করো, ঘুরতে যাও। আর ভেবেছো আমি কিছুই জানব না? তোমরা দুজনই তো বে’ঈ’মা’ন। আজকের পর থেকে যদি কখনো আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করো তবে তুমি শেষ। পথ ছাড় আমার।”
অসিফার দিকে আরও এক কদম এগিয়ে তামিম বলে ওঠে,
“যদি না ছাড়ি?”
অসিফা ফু’স’তে ফু’স’তে বলে ওঠে,
“আমার জীবনটাকে তো উলোটপালোট করে দিয়েছিস। আর কি করতে চাইছিস বল আমাকে? বল?”
অসিফা ছোটবেলা হতেই শান্তশিষ্ট। আর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী হওয়ায় তো পড়াশোনার চা’পে আরও শান্তশিষ্ট হয়ে গেছে। এমন শান্তশিষ্ট মেয়ের মাঝে হঠাৎ এমন আ’ক্র’ম’না’ত্ম’ক রূপ দেখে ভীত হয়ে যায় তামিম। তামিমকে আরও অবাক করে দিয়ে পাশ থেকে বড় একটা ইট তুলে নিয়ে তার দিকে তে’ড়ে যায় অসিফা।
“আর ফের যদি তোকে আমার সামনে দেখেছি তো তোর একদিন কি আমার যে কয়দিন লাগে।”
তামিম আর এক মুহূর্ত সেখানে দাড়ায় না। দৌড়ে দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যায়। হাত থেকে ইটটা ফেলে দিয়ে অসিফা সেদিকে তাকিয়েই কেঁদে ওঠে।
“তোর মতো পড়াকু মেয়েও যে প্রেম করতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবিনি আমি। তা বাসায় জানে এ কথা?”
পেছন হতে হঠাৎ এহেন কথা কানে ভেসে আসতেই আঁতকে উঠে পেছনে ঘুরে তাকায় অসিফা। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে দেখে ভ’য়ে সারা শরীর তার কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। এবার যদি এই লোকটা তার বাবা-মাকে এসব কথা বলে দেয়!
চলবে…
#প্রতিদিন_তুমি_আমার
#সূচনা_পর্ব
#আফিয়া_অন্ত্রীশা
[এবার আর স্যাড এন্ডিং দেব না প্রমিস। আপনারা কষ্ট পেয়েছেন বলেই এবার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আবার শিখন-অসিফাকে নিয়ে এসেছি। কেমন লেগেছে জানাতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ]