প্রণয় হাওয়া লাগলো মনে পর্ব ৯

0
837

#প্রণয়_হাওয়া_লাগলো_মনে(০৯)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
________________

ভোর রাতে সারফারাজ বাড়িতে পৌছায়। কপালে ছোট্ট ব‍্যান্ডেজ। সারারাত ঘুম হয়নি। চোখে মুখে ক্লান্তি ও নিদ্রাহীনতার স্পষ্ট ছাপ। নিজের কাছে বাড়ির এক্সট্রা চাবি দিয়ে সদর দরজা পেরিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো। কাল থেকে বাড়িতে আসার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সারাফারাজের দোকানের বাধ‍্যগত কর্মচারী ছেলেটা সাথে সাথেই ছিল। সারফারাজকে বাড়িতে পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসতে চাইছিল। কিন্তু সারফারাজ কড়া কন্ঠে বলে দিয়েছে ‘আর এক মুহূর্ত নয়। সোজা বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নিবে। সাথে একটা দিনের ছুটি, কিছু টাকা বকশিষ।’

রুমে ঢুকে সর্বপ্রথম সারফারাজের নজরে আসলো জায়নামাজে ঘুমন্ত অন্বেষাকে। জায়নামাজের সল্প জায়গার মধ্যে কোনরকম শুয়ে আছে। সারফারাজ তা দেখে মৃদু হাসলো। এগিয়ে গিয়ে জায়নামাজ থেকে অন্বেষাকে কোলে তুলে বিছানায় শুয়ে দিয়ে গায়ে পাতলা কম্বল টেনে দিল। কপালে ভালোবাসার ছোট্ট পরশ একে দিতে ভুলল না মোটেও সারফারাজ। আলমারি থেকে প্রয়োজনীয় জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। উদ্দেশ্যে ফ্রেশ হওয়ার।

সর্বপ্রথম মায়ের সাথে দেখা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলো সারফারাজ। মা নিশ্চয়ই গতকালের খবর শুনে অস্থির হয়ে আছে। এক পলক ঘুমন্ত অন্বেষার দিকে চাইলো সারফারাজ। তার শুভ্রময়ী এখন গভীর ঘুমে মগ্ন। সারফারাজ আর সময় ব‍্যায় না করে মায়ের রুমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
সাওদা বেগম জায়নামাজে বসে কোরআন তেলওয়াত করছিলেন। সারফারাজের আগমনে তিনি কোরআন পড়া স্থগিত রেখে জায়নামাজ থেকে উঠে দাড়ালেন। কোরআন ও জায়নামাজ রাখার ছোট্ট সেলফে সেগুলো গুছিয়ে রেখে এগিয়ে গেলেন ছেলের দিকে। সারফারাজ মাকে দেখে সালাম দিল, “আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্, মা।”

সাওদা বেগম সালামের জবাব দিলেন, “ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্।”
তারপর ব‍্যাকুল স্বরে শুধালেন, “কি হয়েছিল বাবা? মেয়েগুলো বলতেই চাই না। কত অনুরোধের পর তোমার এহেন বিপদের সংবাদ জানালো আমাকে।”

“শান্ত হও মা। এতটা চিন্তার কিছু হয়নি। তবে হয়েছে অনেক কিছুই। জীবনে প্রথমবার এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি আমি।”

সাওদা বেগম শান্ত হওয়ার পরিবর্তে আরও অশান্ত হয়ে উঠলেন। সারফারাজের কপালের ক্ষতের ছোট্ট ব‍্যান্ডেজে হাত বুলিয়ে দিলেন। ঝরঝরিয়ে কেঁদে ভাসালেন সাওদা বেগম। ক্রন্দনরত স্বরে বললেন, “কি চিন্তাই ছিলাম বোঝাতে পারবো না বাবা। তোর বাবা থাকলে এদিন দেখা লাগতো না আমাদের। চিন্তাই ছটফট করেছি। শোনা মাত্রই অপেক্ষার প্রহর গুনেছি। কখন তুই সুস্থ শরীরে আমার কাছে ফিরে আসবি। তা বাবা! সেই ছেলেটা সুস্থ হয়েছে তো?”

“গুরুতর আহত হয়নি। তবে অনেকটা রক্ত পড়েছিল। আল্লাহ সহায় ছিলেন। আমার রক্তের গ্রুপের সাথে বাচ্চাটার রক্তের গ্রুপের মিল ছিল। আমি দিয়েছি কিছুটা আর বাকিটা ব্লাড ব‍্যাংক থেকে নেওয়া হয়েছিল।”

“কিভাবে এমন দূর্ঘটনা হলো? আগে তো এমন কিছু হয়নি!”

“মা, আমি নিজেও বুঝতে পারিনি এমন কিছু হবে। গাড়ি বরাবরের মত ঠিক ভাবেই চালাচ্ছিলাম কিন্তু ছেলেটা হঠাৎ সামনে এসে পড়ে। সেদিকে চোখ পড়তেই দ্রুত ব্রেক করতে গেলেও দূর্ঘটনা যা হবার হয়েই গেল। আমার কপালে হালকা চোট লেগেছিল। বাচ্চাটাকে নিয়ে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে যায়। আমি নিজ থেকেই পুলিশকে খবর দিয়েছি। কিছু ফালতু পাবলিক ঝামেলা পাকানোর মতলব আটছিল। পুলিশ এসে সব ঝামেলার অবসান ঘটায়। আমি আবার দেখতে যাবো। তুমি চিন্তা করো না। ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।”

সবটা শুনে সাওদা বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন। বললেন, “সব ঠিক থাকলেই হলো। আচ্ছা দেখতে যাস। সারারাত অনেক ধকল গিয়েছে নিশ্চয়ই। খাবি চল!”

“না মা। এখন ক্ষুদা নেই। আমি ঘুমাবো। অনেক পরিশ্রম গিয়েছে।”

“কিছু খেয়ে বিশ্রাম নিলে হতো না!”

“পরে খাবো। এখন না। আমি তাহলে ঘুমাতে গেলাম। সাইমা, সাইফা কে বলো। সারারাত ওদেরও ঘুম হয়নি দেখো।”

“আচ্ছা। যা তাহলে।”

সারফারাজের মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের রুমে ঢুকে দরজা লক করে অন্বেষাকে একপ্রকার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ঘুমের দেশে পাড়ি জমানোর আয়োজন করলো। নরম গদি, অন্বেষার নরম মোলায়েম শরীরের স্পর্শে ঘুমাতে বেশি সময় লাগলো না ক্লান্ত সারফারাজের।

সকাল নয়টা। অন্বেষা ঘুম থেকে উঠে সারফারাজকে সেই যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছে মিনিট দশেক পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ছাড়ার নামগন্ধ নেই তার। খানিকক্ষণ পর পর দেহ হালকা দুলে উঠছে। ফুঁফিয়ে কাঁদছে মেয়েটি। সারফারাজ কিছু বলছে না। কাঁদার সুযোগ দিয়েছে। কান্না শেষ হলে এমনিই চুপ করবে। মেয়ে মানুষ এমনই খানিকক্ষণ কেঁদে কেঁটে চুপ করে থাকে নতুবা ঘুমিয়ে পড়ে। যেহেতু অন্বেষা ঘুম থেকে সবে উঠেছে তাই তার ঘুমানোর চান্স নেই। চুপ করেই থাকবে বোধহয়।
সারফারাজ অন্বেষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। মোলায়েম স্বরে বলল, “বোকা মেয়ে। এত কাঁদে কেউ? বলেছিনা একদম কাঁদবে না। তোমার কান্না আমার একটুও সহ‍্য হয় না। আমি ঠিক আছি তো। তাহলে এত কান্না কিসের?”

অন্বেষা কান্নাভেজা কন্ঠে প্রতিত্তোর বলল, “হ‍্যাঁ আমার তো খুশি হওয়ার কথা। এত বড় বিপদ গেল অথচ আমি কাঁদতেও পারবো না! এত নিষ্ঠুর কেন আপনি?”

অন্বেষার শিশুসুলভ কথায় ফিক করে হেসে উঠলো সারফারাজ। পরক্ষণেই মনটা অনুতপ্ততায় ছেয়ে গেল। বলল,
“আমায় ক্ষমা করো অনু। তোমার সাথে অনেক বড় অন‍্যায় করেছি আমি।”

“এসব বলে আমাকে ছোট করবেন। প্লিজ! রাত অনেক আসবে। আমি কামনা করেছি আপনি এবং বাচ্চাটা যেন সুস্থ থাকেন এটাই। আমার মোনাজাতে আপনাদের মঙ্গল কামনা বাক‍্যই ঠাই পেয়েছে। অবিবেচকের মত ফালতু টপিক নিয়ে রেগে থেকে নিজেদের সম্পর্কে তিক্ততা আনার কোন মানে হয় না। বলছি, বাচ্চাটাকে দেখার খুব ইচ্ছে হয়েছে। নিয়ে যাবেন আমাকে?”

“ঠিক আছে যেও আমার সাথে। শুনে খুব ভালো লাগলো তোমরা সবাই বাচ্চাটার এত খোঁজ খবর নিচ্ছো।”

“কি যে বলেন! নিব না! এতবড় বিপদ গেল খবর যে নিতেই হয়।”

“বুঝেছি বিজিজান। আমার ক্ষুদা পেয়েছে তো। সারারাত অভুক্ত। এখন কিছু খেতে দাও!”

অন্বেষা লজ্জা পেল খুব। মানুষটা না খাওয়া অথচ সে বোকার মত তার বক্ষে আয়োজন করে দুঃখ বিলাস করছে। বুক থেকে মাথা উঠিয়ে অনুতপ্ততার স্বরে বলল, “সব ভুলে যায়। চলুন যাওয়া যাক। এতক্ষণ বিছানায় থাকা মোটেও উচিত হয়নি আমার। আম্মু, খালার কাজে সাহায্য না করে কত বেলা অব্দি ঘুমিয়েছি আমি।”
তাৎক্ষণিক অন্বেষা বিছানা ছাড়তে উঠতে নিলেই সারফারাজ হাতখানা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিল। সম্মোহনী গলাই বলল, “কই যাও বিবিজান? ক্ষুদা অবশ্যই লেগেছে। খাবো তো। আগে তোমার গোলাপের পাপড়ির ন‍্যায় নরম ওষ্ঠদ্বয়ের মিষ্টি মধুর স্বাদ নিতে দাও। তারপর সাধারণ খাবার ভক্ষণ করা যাবে।”

লজ্জায় আড়ষ্টতায় দ্রুত বিছানা থেকে সরে পড়ার ব‍্যার্থ চেষ্টা করলো অন্বেষা। কিন্তু সারফারাজের শক্তপোক্ত পুরুষালি দেহের সাথে পেরে উঠলো না নরম কোমল অন্বেষা। ফলস্বরুপ সাময়িকভাবে নবদম্পতি ডুব দিল এক অন‍্য ভুবনে। যেখানে হালালের সংস্পর্শে অন‍্যরকম সুখময় মুহূর্ত বিরাজ করছে।
________________

সকালের ব্রেকফাস্ট হিসাবে সাওদা বেগম ছেলের পছন্দের ভুনা খিচুড়ি আর গরুর গোশত রান্না করেছে। অন্বেষার জন্য হাসুর মা বিশেষ যত্ন নিয়ে পায়েস রান্না করেছে। পুরো একটা রাত পরিবারের সকলের ওপর দিয়ে বেশ ধকল গিয়েছে। পরিবারের একজন সদস্য বিপদে মানে পুরো পরিবার বিপদে। সেখানে পরিবারের বর্তমান ও একমাত্র কর্তা সারফারাজের এতবড় বিপদে গোটা পরিবার মুষড়ে পড়েছিল। দুবোন গভীর রাত পর্যন্ত ভাইয়ের সুস্থতার উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে তার মঙ্গল কামনা করেছে। কেঁদেছে হাসুর মাও। অন্বেষা তো একেবারে ফজর নামাজ পর্যন্ত জেগে থেকে সব নামাজ আদায় করে হঠাৎ বেখেয়ালে জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। সাওদা বেগমের মনটা কু ডাকছিল। ঘুম ভেঙ্গে যায় তারও। কলিজার টুকরো সমতূল‍্য ছেলেটা বিপদে অথচ মা টের পাবে না তাই কি হয়! দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায় তার। মেয়েদের ডেকে আনে। একপর্যায়ে জানতে পারে ছেলের এতবড় বিপদের কথা। বাকি রাত ছেলের চিন্তাই ঘুম হয় না তারও। অন‍্যদিকে হায় প্রেশার।

খাবার টেবিলে সবাই খাচ্ছিলো। পরিবারের অল্প সদস্য হওয়ায় টেবিলে সব খাবার রেখে সবাই পাশাপাশি বসে খাবার খেয়ে নেয় তারা। খাওয়ার এক পর্যায়ে সাওদা বেগম ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন, “খিচুড়ি, গোশত ভুনা কেমন হয়েছে বাবা?”

সারফারাজ অন্বেষার দিকে দৃষ্টি তাক করে মায়ের কথার প্রতিত্তোরে বলল, “দুটোই জোশ।”

সন্তুষ্ট হলেন সাওদা বেগম। হাত পুড়িয়ে রান্না করা সফল হয়েছে তার। অন‍্যদিকে অন্বেষা হটাৎ বিষম লেগেছে। কেউ না বুঝুক সে অন্তত বুঝেছে সারফারাজের লাগামহীন কথা। লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না মেয়েটা। অন্বেষার অবচেতন মন বলে উঠলো, “বেডা মানুষ এমন নির্লজ্জ হয় কেন? সামান্য লাজ সরমের বালাই নাই। ছিঃ ছিঃ!”

খাওয়া অর্ধ সমাপ্ত রেখেই অন্বেষা রুমে চলে আসে। এ অবস্থায় সেখানে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব প্রায়।

বেলকনিতে গিয়ে সব ভাবনা একপাশে রেখে প্রকৃতি দেখাই মনোনিবেশ করলো অন্বেষা। নাজুক পরিস্থিতি মনে করে বারবার নুয়ে পড়ছে লজ্জায় সে। যার দরুণ গ‍ৌর বর্ণের মুখখানা গোলাপি আভা ধারণ করছে।

“সবেতো ট্রেইলার। পুরো সিনেমা তো এখনো বাকি। এটুকুতেই কুপোকাত? এমন হলে পোলাপানের বাপ বানাবে কেমনে আমায় হু!”

সারফারাজের উপস্থিতি ও লাগামহীন কথায় আরেকদফা লজ্জায় মিইয়ে গেল অন্বেষা। অবনত দৃষ্টিতে সফেদ রঙা টাইলসের মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। যেন দৃষ্টি সামনের মানুষটার দিকে দিলে মহা ক্ষতি হয়ে যাবে।

সারফারাজের মুখে প্রাপ্তির হাসি। আজ এ পর্যন্তই যথেষ্ট। পরক্ষণেই স্বাভাবিক স্বরে বলল, “যেতে হবে তো নাকি? তৈরি হও!”

অন্বেষা দ্রুতগতিতে বেলকনি থেকে প্রস্থান করলো। হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন।

ইনশাআল্লাহ চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here