#প্রণয়_হাওয়া_লাগলো_মনে(০৭)
#সুমাইয়া_ইসলাম_জান্নাতি(লেখনীতে)
________________
রাতের আঁধার কে’টে ধরণীতে এবার ঝকঝকে দিনের সূচনা। রৌদ্রজ্জ্বল আকাশ। আঁধার কে’টে যেমন নব্য দিনের সূচনা হয়েছে তেমনি গতদিনের কলুষিত ঘটনা অতীতের পাতায় তালাবদ্ধ করে পুরো পরিবার সারফারাজ-অন্বেষার বিয়ের আনন্দে মেতে উঠেছে। তবে এত সবের মাঝেও সাইমার ভাব ভঙ্গি ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না। সে মাঝেমধ্যে খিলখিলিয়ে হেসে ভাইয়ের বিয়ের আনন্দ অনুষ্ঠানে সামিল হচ্ছে কখনও আবার মন খারাপের বিষাদের মেঘ তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। ফলস্বরুপ মন খারাপ করে থাকছে।
গতকাল হলুদের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত আত্মীয়ের অনেকে থাকলেও সাওদা বেগমের ছোট বোন এবং ছেলে না থাকাই এ নিয়ে অনেকের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। অনুষ্ঠানে কোথাও যেন ভাটা পড়েছিল। সবটাই সারফারাজের নজরে আসলেও সে নিরুপায়। কিইবা করার থাকতে পারে! সে ইচ্ছে করে তো আর এমনটা করেনি। কাল যদি সানাফকে শাসন না করতো হয়তো পরবর্তীতে অন্যায়ের আরও কয়েক ধাপ বাড়তো সানাফের দ্বারা। তাছাড়া শুধু সারফারাজ কেন, অন্য যেকোনো পুরুষ হলেও একই কাজ করতো। এটা ঠিক সারফারাজ অতিরিক্ত রাগী। সেক্ষেত্রে সানাফেরও বুঝে চলা উচিত ছিল।
আজ বিয়ে অর্থাৎ ছোট্ট করে রিসেপশন পার্টি দিবে। কারণ বিয়ে তো সেদিন হয়েই গিয়েছে। যেভাবেই হোক বিয়ে তো হয়েছে।
বেবি পিংক রঙের গাউন অন্বেষার আজকের ড্রেস। আর সারফারাজের জন্য একই রঙের পাঞ্জাবি। সে শেরওয়ানি পড়ে না।
আত্মীয়স্বজনের পদচারণায় বাড়ি মুখরিত। বাড়ির সবাই সবার কাজে ব্যস্ত। কেউ মেহমান আপ্যায়নে ব্যস্ত কেউ বা খাবারের দিকগুলো সামলাতে ব্যস্ত। কেউ নিজ কর্মে ব্যস্ত। যেমন হয় আরকি!
রুমে চুপটি করে গোল হয়ে বসে আছে অন্বেষা। তার সাজ সম্পন্ন। মাঝেমাঝে আত্মীয়েরা কেউ কেউ এসে দেখে যাচ্ছে। এই আত্মীয়দের মধ্যে আবার দুভাগ আছে। কেউ অন্বেষার প্রশংসায় পঞ্চমুখ কেউবা অন্বেষার চোখ ধাঁধানো রূপ দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। ফলস্বরুপ দুয়েকটা কটু বাক্য বলে যেতে ভুলছে না। সকাল থেকে অন্বেষাকে সারফারাজের থেকে আড়ালে রেখেছে মেয়েগুলো। আজ এখন দুপুর বেজে আড়াইটা। সারফারাজ তার শুভ্রময়ীকে এখানো এক পলক দেখেনি। মাঝেমধ্যে তৃষ্ণার্ত কা’কের মত রুমের আশপাশ দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে। কিন্তু ভেতরের অন্বেষাকে সে বরাবরই দেখতে ব্যার্থ হচ্ছে। এ অন্যায় কি মানা যায়? সারফারাজ না পারছে কাউকে বলতে আর না পারছে এহেন অন্যায় অবিচার সইতে।
“কি হইছে বাপ? তুমি এমনে রুমের বাইরে দাড়ায় উকিঝুকি দিতাছো কেন? রুমের মধ্যে যাও। দেহগে মা জননীরে কেমনে কইরা সাজাইছে আম্মারা মিলে।” হাসুর মায়ের কথায় সারফারাজের মুখ ফাঁটা বেলুনের মত চুপসে যায়। সর্তক দৃষ্টিতে চারপাশ ভালো করে অবলোকন করলো সে। আশেপাশে তার কথা মনযোগ দিয়ে শোনার মত মানুষের বড় অভাব। সে হাসুর মায়ের কথার প্রতিত্তোরে অসহায় কন্ঠে বলল, “খালা আমি এমনি দাড়িয়ে আছি। কোন সমস্যা নেই তো। আপনি দুপুরে খেয়েছেন তো?”
আলতো হাসলো হাসুর মা। অনুষ্ঠান বাড়ির এত মানুষ, ব্যস্ততার ভিরেও ছেলেটা তার খোঁজ খবর নিতে সামান্য ভুলেনি। কৃতজ্ঞতায় চোখ ফে’টে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু সারফারাজের কঠোর নিষেধাজ্ঞা এভাবে যখন তখন কাঁদা যাবে না। তার সামনে সর্বদা হাসিখুশি মুখে থাকতে হবে। হাসুর মা তার বাপজানের সুন্দর মিষ্টি আদেশ কি করে অমান্য করে! প্রতিত্তোরে বলল, “কি যে বল না বাপজান! এত কাম কাজ রাইখা কেমনে খাই বল তো! আফায় কইছে মেহমানদের খাওয়া হয়ে গেলে বাড়ির সবাই খেয়ে নিবে। আমিও তোমাগো লগে খামু। আমার খাওয়া নিয়ে চিন্তা কইরো না তো। তুমি কোন কাজে এইহানে আইছিলা? আমারে কও আমি কইরা দিতেছি।”
“না খালা। আমি আসলে এখানে….”
“তুমি এত দ্বিধাবোধ করো না তো বাপ। বলো কি হইছে?”
“আসলে খালা হয়েছে কি, সকাল থেকে এ পর্যন্ত অন্বেষাকে একবারও দেখিনি আমি। ওরা আমাকে ডুকতেই দিচ্ছেনা রুমে। তাই তো বারবার ব্যার্থ চেষ্টা করছি রুমে ঢুকতে।” সারফারাজের খুব ইচ্ছে হলো একদমে কথাগুলো হাসুর মাকে বলতে। কিন্তু লাজুক সারফারাজ তা মন অব্দি রেখে দিল। শব্দ হয়ে মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলো না। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল, “খালা, আমার রুমে কিছু দরকার ছিল। কিন্তু মেয়েরা আছে বিধায় ঢুকছি না। তুমি কি একটু দেখবে?”
“আইচ্ছা খাড়াও। দেখতাছি।”
হাসুর মা এক মুহূর্ত সময় ব্যায় না করে দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকে পড়লো। অন্বেষার আশেপাশে আবিষ্কার করলো কতগুলো অল্প বয়সী মেয়ে মানুষ। হাসুর মা তাদের উদ্দেশ্য বললেন, “মাইয়ারা তোমরা খাইতে যাও। ওদিকে তোমাগো ডাকতাছে।”
ওদের মধ্যে একজন বলে উঠলো, “কিন্তু খালা! আমরা সবাই গেলে নতুন ভাবির কাছে কে থাকবে?”
“তোমরা যাও। আমি থাকমুনে। মা জননীর কাছে থাকবানি আমি। যাও, যাও!”
হাসুর মায়ের ভরসা বাক্যে আস্থা রেখে তারা একে একে সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রুমে রইল শুধু দুটো প্রাণি। হাসুর মা দরজার একপাশে একপ্রকার লুকিয়ে থাকা সারফারাজকে অভয় গলাই বললেন, “যাও বাপজান রুমে যাও। কেউ নাই এহন।”
সারফারাজ কৃতজ্ঞতার স্বরে বলল, “অনেক অনেক ধন্যবাদ খালা। আমি তাহলে রুমে যাচ্ছি। একটু দেখবেন কেউ যেন হুট করে চলে না আসে।”
“আইচ্ছা।”
রুমে ঢুকতেই সারফারাজের চক্ষুদ্বয় আটকে গেল বিছানায় বসা এক অতীব সুন্দর লাস্যময়ী রমনীর রূপে। মেয়ে তো নয় যেন হৃদয়হরণী। সারফারাজ বিড়বিড়িয়ে বলল, “মা শা আল্লাহ্! মা শা আল্লাহ্।”
সারফারাজকে দেখে অন্বেষা সামান্য অবাক হলেও অবাকতার রেশ কাটিয়ে মুচকি হাসলো। সারফারাজ আহত সৈনিকের ন্যায় বুকে হাত দিয়ে মোহনীয় স্বরে বলল, “ওহে শুভ্রময়ী ওভাবে হেসো না। আমার হৃদয় যে করেছো হরণ। এখন আমার কি হবে শুভ্রময়ী?”
সারফারাজের কথা বলার অদ্ভুত ভঙ্গিমায় মুখে হাত চে’পে শব্দ করে হেসে ওঠে অন্বেষা। সারফারাজের কানে সে হাসির শব্দ সুমধুর পাখির কুজনের মত লাগলো। অন্বেষার পাশে গিয়ে বসলো সে। জীবনে বহু মেয়ে মানুষের সাক্ষাৎ হয়েছে তার সাথে। স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির পার্ট ছাড়িয়ে এখন একজন সফল মধ্যমান ব্যবসায়ী সে। কর্মের সূত্রে এখন আরও বেশি মেয়ে মানুষের সান্নিধ্য থাকা লাগে তার। কই কখনও তো এমন অনুভব হয়নি তার। কম সুন্দর মেয়ে মানুষ দেখেনি সে। কিন্তু এমন নেশালো লাগেনি তো আগে। অন্বেষা নামক মেয়েটির আশেপাশে থাকলেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়। তার চোখে মেয়েটাকে অনিন্দ সুন্দরী লাগে। সে জানে না মেয়েটা কত সুন্দর। শুধু জানে তার চোখে সবচেয়ে সুন্দরী রমনী হচ্ছে অন্বেষা। যার চোখ ধাঁধানো রূপে জ্ব’লে পু’ড়ে ঝ’ল’সে যায় সে।
“কেমন লাগছে আমায়?” লাজুক স্বরে সারফারাজের উদ্দেশ্য প্রশ্ন বাক্য ছুড়ে দিল অন্বেষা।
প্রতিত্তোরে সারফারাজ পূর্বের ন্যায় মোহনীয় স্বরে বলল, “বললে বিশ্বাস করবে?”
সারফারাজের প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করা অন্বেষার কাছে অন্যরকম লাগলো। সে প্রতিত্তোরে কিছুই বলল না। নিরব রইলো। সে ভেবেছে তাকে দেখতে হয়তো খুবই বা’জে লাগছে। নতুবা খুব হাস্যকর লাগছে।
সারফারাজ অন্বেষার মিইয়ে যাওয়া লক্ষ্য করে শব্দ করে হেসে উঠলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, “মেয়ে তুমি কি অবুঝ? সব কথা মুখে বলে বোঝানো লাগবে? আমার চোখমুখ দেখে কিছু বুঝতে পারো না? তোমার রূপে প্রতিনিয়ত এই নিষ্পাপ আমি ঝলসে যাচ্ছি তার কি প্রতিকার হবে শুনি? কি অদ্ভুত তাই না! প্রণয় হাওয়ার এক ধাপে থাকে যেমন সুখময় শান্ত শীতল হাওয়া। ঠিক তেমনি অন্য প্রান্তে থাকে শুধুই হৃদয় পুড়ানো অনুভূতি। যা শুধু প্রণয়ের হাওয়া যে মানুষটার মনে লাগে সে ব্যতীত অন্য কেউ সামান্য বুঝতে পারে না। তুমি কি বোঝ?”
“স্বর্গীয় সুধা পান করতে হলে অনলে সামান্য পুড়তে হবে এতো অতি স্বাভাবিক বটে। কাউকে ভালোবাসলে বিচ্ছেদের মরন সম যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা নিয়েই বাসা উচিত। যেখানে সুখ সেখানেই দুঃখ। আপনার আমার সন্ধি থাকুক আজীবন। নশ্বর দুনিয়া পেড়িয়ে চিরস্থায়ী জান্নাতে পর্যন্ত অটুট থাকুক এ বন্ধন। যেখানে না থাকবে দুঃখ আর না থাকবে কোন কষ্ট। শুধুই শান্তি।”
“ইন শা আল্লাহ্। আল্লাহ্ আমাদের কবুল করুন।”
“সুম্মা আমিন।”
সারফারাজ হাতঘড়ি চেইক করলো। আধ ঘন্টা হয়েছে সে রুমে অবস্থান করেছে। এখন সময় এসেছে বেরিয়ে যাওয়ার। না হলে বিচ্ছুগুলো চোখে পড়লে মান সম্মানের কুরবানি হতে একটুও বাকি থাকবে না। অন্বেষার কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে সারফারাজ উঠে দাড়ালো। যেতে যেতে বলল, “শোন শুভ্রময়ী! অনেক কষ্টে সব সামলে রেখেছি। আজ অশান্ত আমিকে তোমাকেই শান্ত করতে হবে। মনে রেখো।”
“ভয় দিচ্ছেন?”
“ভয় কেন হবে মেয়ে? শুধু সংকেত দিয়ে যাচ্ছি। তৈরি থেকো। যায় তবে!”
“আল্লাহ্ হাফেজ।”
দরজায় সাওদা বেগম দাড়িয়ে। মাকে দেখে সারফারাজ খানিকক্ষণ থম মে’রে দাড়িয়ে রইলো। সাওদা বেগম প্রথমে নিজেই বললেন, “তোকেই খুজছিলাম। মোটামুটি সবার খাওয়া শেষ। কেউ চলে যাচ্ছে কেউ বিশ্রাম করছে। বেলা তিনটার ঘরে। খাওয়া হলো না কারো। খেতে হবে তো নাকি! তুই ওদিকটায় যা। সব দেখ। আমি অনুকে নিয়ে আসছি।”
মায়ের বলা প্রত্যেকটা কথা মন দিয়ে শুনলো সারফারাজ এবং বুঝলোও। কিন্তু শেষের কথাটা বোধগম্য হলো না তার। মায়ের উদ্দেশ্য শুধালো, “অনু কে মা?”
“দেখো ছেলের কান্ড এটুকু বুঝলি না? অন্বেষাকে অনু বলে ডাকা শুধু করেছি আমি। অন্বেষা বড় লাগে। ছোট করে অনু দিয়েছি ভালো হয়েছে না? আর শোন, অন্বেষা থেকে অনু ডেকেছি সে নিয়েও মেয়ে একঘর কেঁ’দে ভাসিয়েছে। ওর মা নাকি ওকে অনু বলে ডাকতো। আমি কি ওর মা না? তবেই থেমেছে বোকা মেয়েটা।”
মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মায়ের হাসিমুখে বলা প্রতিটা কথা শুনলো সারফারাজ। শেষে বলল, “খুব ভালো হয়েছে মা। এভাবেই থেকে যেও মেয়েটার মা হয়ে। আমি যাচ্ছি মা। তুমি তোমার অনুকে নিয়ে আসো।”
ইনশাআল্লাহ চলবে…..
প্রচন্ড ব্যস্ততায় সময় হয়নি লেখার।ফোনটা সময় নিয়ে ধরার সময় পাইনি যে লিখবো। আশাকরি বুঝবেন। খুবই দুঃখিত। 🥺