#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_০৮
__________________________
অবশেষে আগমন সেই আবেগঘন মুহূর্তের যখন একটা মেয়ের বিচ্ছেদ হয় তার পরিবারের সাথে। সেই চিরচেনা পরিবার,যেখানে তার জন্ম, তার শৈশব, তার বড় হওয়ার মুহূর্ত,যেখানে জুড়ে আছে অজস্র স্মৃতি। সেই পরিবারকে ছেড়ে যাওয়ার মূহুর্ত।বিদায়ের মূহুর্ত।সবার মুখশ্রী তেই মন খা’রাপের ছাপ। মেয়েকে বু’কে নিয়ে শব্দহীন কান্না মিসেস দিশার।তাদের থেকে একটু দূরে চোখ-মুখ শক্ত করে দাড়িয়ে আছেন আরহাম সাহেব।পুরুষ মানুষের কি অত সহজে কান্না করা মানায়?মিসেস দিশাকে জড়িয়ে ধরে ই সূচনা ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বললো –
–‘আম্মু আমি আজকে যাবনা।আজকে থাকতে দাও। কালকে চলে যাব।প্লিজ!
কান্নার মাঝেও মুচকি হাসলেন মিসেস দিশা। বললেন-
–‘পা*গলি মেয়ে।এমন হয় না।বিয়ে হয়ে গেছে এখন তো যেতে হবেই।কালকে তো আসবি আবার।
আরহাম সাহেব এগিয়ে এসে প্রণয়ের হাত ধরে বললেন –
–‘আমার আর ওর মা’য়ের কলি’জার টুক’রা, আমাদের একমাত্র প্রাপ্তি তোমার হাতে তুলে দিলাম।আগলে রেখো।
বিনিময়ে মুচকি হাসলো প্রণয়।সূচনার কাছে যেয়ে তার মাথায় হাত রেখে বললেন-
–‘আমি সেই দিনের অপেক্ষায় থাকব যেদিন তুই নিজে এসে আমাকে বলবি যে “বাবা আমার জন্য নেয়া তোমার আরেকটা বেস্ট ডিসিশন ছিল এটা।” মা’কে ছেড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো সে।
ইসহাক সাহেব বললেন –
–‘আপনাদের মতো করে হয়তো রাখতে পারবনা বা ততটা আদর দিতে পারবনা কিন্তু তার চেয়ে কম ও হবেনা।আপনি চিন্তা করবেন না,আমাদের আরেক মেয়ে ও।এবার তাহলে আমরা আসি।
আরহাম সাহেব মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন।
.
.
প্রণয়দের বাসায় আসতে আসতে প্রায় তিন ঘন্টার মতো লেগে গেছে।রওনা হয়েছিল আটটায় আর এখন দশটা।রাস্তায় প্রচুর জ্যামের কারণেই এই দশা।প্রণয়দের বাসায় তেমন কোনো মানুষই নেই।বাসায় এসে মিনিট দশেকের মতো বসেছিল ড্রয়িং রুমে তারপর মিসেস আফিয়া সূচনাকে প্রণয়ের রুমে পাঠিয়ে দিয়েছেন।মিহু,ইরা,দিনা আর তিথি সূচনাকে রুমে দিয়ে চলে গেছে।মিহুও এসেছে সাথে।রুমে আসার আগে প্রণয়কে দেখেছিল তন্ময়ের সাথে কথা বলতে।কিন্তু তন্ময় তো তাদের বাসায় যায় নি।রুমের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে সূচনা।চোখ ঘুরিয়ে দেখতে থাকে রুমটা।বেডের এক পাশে ছোট একটা টেবিল,আর এক পাশে কনসোল টেবিল যার ওপর দুইটা কাচের জারের মধ্যে মানি প্ল্যান্ট রাখা,ছোট শু র্যাক, মেহগনি উডেন স্লাইডিং ডোর আলমারি।অন্যপাশে একটা পড়ার টেবিল, তার পাশে লম্বা মতো একটা সেলফ, যাতে অনেকগুলো বই রাখা।টেবিলটা সূচনার কাছে নতুন ঠেকলো,তবে কি তার জন্য ই আনা?
–‘রুম পছন্দ হয়েছে?
আচানক কারো কণ্ঠ পেয়ে কেঁ’পে উঠল সূচনা।তা দেখে প্রণয় বললো –
–‘আরে রিল্যাক্স আমি।অন্য কেউ না।
পেছনে ঘুরে জোর পূর্বক হাসলো সূচনা।প্রণয় আবার জিজ্ঞেস করলো-
–‘বললে না তো?
সূচনা মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো –
–‘জ্বি হ’য়েছে।
–‘পছন্দ না হলেও সমস্যা নেই, তুমি নিজের মতো করে সাজিয়ে নিও।
জবাবে কিছু না বলে স্বল্প পরিসরে হাসলো সূচনা।
–‘ এবার এসব চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও।কাবার্ডে শাড়ি,থ্রি-পিস, টি-শার্ট,টপস সব আছে।যেটা তে কম্ফর্ট ফিল করো সেটাই পরো।ইট’স অল ইওরস।আমি অন্য রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছি।
প্রণয়ের স্বাভাবিক কণ্ঠে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে
জামা-কাপড় নিয়ে রুম থেকে চলে গেল। সূচনা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো ড্রেসিং টেবিলের দিকে।গহনা, হিজাব,চুনড়ি খু’লে গেল কাবার্ডের দিকে।কাবার্ডে একপাশে তার আরেক পাশে প্রণয়ের জিনিসপত্র।আলাদা আলাদা করে শাড়ি,টপস,থ্রি-পিস,টি-শার্ট সব রাখা।বাসায় টি-শার্ট পড়লেও আজকের জন্য টি-শার্ট অপশন থেকে বাদ।টি-শার্টের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে বললো-
–‘সরি জা’নু আজকে তোমাকে পড়তে পারবনা।শাড়ি পে’চিয়ে ঘুমাতে হবে আজকে।
একটা শাড়িতে চোখ আটকে গেল তার।হাতে নিয়ে নিল সেটা।হালকা গোলাপি রঙের শাড়িটা।সেটা নিয়েই তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমে ঢু’কলো।প্রায় একঘন্টা পর ওয়াশরুম থেকে বেরোলো সে।রুমে কেউ নেই।দরজাটাও আগের মতোই ভেড়ানো।ব্যালকনির প্রবেশ মুখে লাগানো গ্লাসটা খু’লে প্রবেশ করলো ব্যালকনিতে।ব্যালকনির দু’পাশে দু’টো মাঝারি সাইজের টব,তাতে আছে পাম ট্রি।ওপরে দুপাশে ঝোলানো দু’টো টবে ঝুমকোলতার গাছ।আর নিচে ছোট,বড়,ভিন্ন শেপের কতগুলো টব।সব মিলিয়ে ব্যালকনিতে নয়নতারা,পাথরকুচি,সন্ধ্যা-মালতি,পূর্তলিকা,
স্পাইডার প্ল্যান্ট,জবা,গোলাপ এর গাছ আছে।হাতের ডান পাশের দেয়ালে মানিপ্ল্যান্ট আর বাম পাশের দেয়ালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নীলকণ্ঠ গাছ।এত গাছ দেখে তার মনে প্রশ্ন জাগলো-“ছেলে মানুষ এত গাছ পছন্দ করে? “আবার নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলো- ” হ্যা সে করে হয়তো।” ডানপাশেই নিচে বসার জন্য একটা ম্যাট, তাতে দুইটা কুশন আর পাশে একটা জারের মধ্যে ফেয়ারি লাইট তবে জলন্ত না।ভেজা টাওয়ালটা ব্যালকনির রেলিং এ মে’লে দিয়ে পেছনে ঘুরতেই ধা’ক্কা খেল কারো সাথে।কেঁপে উঠলো সূচনা।মাথা তুলে ওপরে তাকাতেই দেখা গেল প্রণয়ের মুখশ্রী।দৃষ্টি তার সূচনার ওপরেই।সূচনা তার চোখে চোখ পড়তেই প্রণয়ের অদ্ভুত দৃষ্টি নজরে এলো।বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলোনা সে।চোখ নামিয়ে নিল।চোখ নামাতেই নিজের হাতের অবস্থান টের পেল।প্রণয়ের প্রশস্ত বু’কে তার বাম হাত।এখন হাত সরাতেও ইতস্তত বোধ হচ্ছে।তবুও আলতো ভাবে সরিয়ে নিল হাত।
–‘অযু করে আসো।নামাজ পড়ব দুই রাকা’ত।
তার ভাবনার মাঝে প্রণয়ের শীতল কণ্ঠে বলা উক্তি।
প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো সূচনা।ব্যালকনি থেকে ওয়াশরুমে গিয়ে ওযু করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিল একসাথে।নামাজ শেষ হলে প্রণয় ই আগে যেয়ে শুয়ে পড়লো। তারপর সূচনার উদ্দেশ্যে বললো-
–‘আমার রুমে কোনো সোফা নেই।আর এত ঠান্ডার মধ্যে তো আর আমি ফ্লোরে শুবোনা, তোমাকেও শুতে দিবনা তাই আই হোপ বুঝতে পারছ কোথায় শুবে।
প্রণয়ের কথার মানে বুঝতে দেরি হলো না সূচনার।ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো বেডের কাছে।প্রণয়ের থেকে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে গুটিশুটি মেরে শুয়ে রইলো।লাইট অফ করে দিল প্রণয়।এই মূহুর্তে সূচনার অবস্থা সম্পর্কে অবগত প্রণয়। তাই আশ্বাস এর স্বরে বললো-
–‘প্রণয় অত খা’রাপ না।কথা যখন দিয়েছে, কথা রাখতেও জানে।নিশ্চিন্তে থাকো।স্ত্রী যখন আমার তাকে কাছে পাওয়ার সময় অনেক আছে,জোর করবোনা।তোমার স্বামী হওয়ার আগে বন্ধু হব।অন্তত সেই হিসেবেও বিশ্বাস রাখতে পারো।রিল্যাক্স।
নিজের পাশ থেকে দুজনের মাঝে একটা কোল’বালিশ রাখলো প্রণয়।
প্রণয়ের কথা শুনে স্মিত হাসলো সূচনা।তার কথার মাঝে আশ্বাস খুঁজে পেয়েছে।সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই নেমে আসলো ঘুম দু জোড়া চোখে।
__________________________________
ফজরের আযান পড়তেই জেগে গেল সূচনা।চোখ খুলতেই অবাক সামনে প্রণয়কে দেখে।এক মূহুর্তের জন্য মনে প্রশ্ন জাগলো “এটা কে?কোত্থেকে আসলো?” পরমুহূর্তেই মনে পড়লো ‘আরে এটাতো তারই বর,কালকেই তো বিয়ে হলো।ঘুম থেকে উঠলে যে নিজের মাথা ঠিক থাকেনা, উল্টাপাল্টা ব’কে সে সম্পর্কে অবগত সে।মাঝেমধ্যে তো মিসেস দিশা ঘুম থেকে উঠাতে গেলে তাকেই জিজ্ঞেস করতো “আন্টি আপনি কে?ডাকাডাকি করছেন কেন?” তারপর যখন মিসেস দিশা মাথায় চাটি মা’রতেন তখন হুশ ফিরত বোধহয়।নিজের মা’কেই যেখানে আন্টি বলতো সেখানে প্রণয়ের ক্ষেত্রে তো স্বাভাবিক।দুনিয়ায় বোধহয় সেই একমাত্র মানুষ যে ঘুমালে সেন্স হারিয়ে ফেলে।প্রণয়ের থেকে চোখ সরিয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে চমকে গেল সূচনা।শাড়ির অবস্থা নাজে’হাল।কিসের কুঁচি, কিসের আঁচল।কোনোটাই জায়গা মতো নেই। তাড়াতাড়ি করে উঠে কোনো রকম ঠিক করে দৌড় লাগালো ওয়াশরুমে।নামাজ পরে বিছানায় আসল আবার। কিন্তু চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটা ও নেই।মিনিট বিশেক বিছানায় এপাশ ওপাশ করে উঠে পড়লো। মাথা ধরেছে প্রচুর। এই মুহূর্তে চা না হলে অবস্থা বেগ’তিক হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। কিন্তু কি করবে?নতুন বউ বিয়ের প্রথম দিনই পারমিশন ছাড়া রান্নাঘরে ঢু’কে যাবে?ক্ষিদেও পেয়েছে প্রচন্ড।বিড়বিড়িয়ে নিজে ই নিজেকে বললো-ধুর ছাই “আসার সময় কাবার্ড থেকে চিপস আর চকলেট গুলো লাগেজে করে নিয়ে আসলেও তো এখন খেতে পারতাম।”ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সবে ছয়টা বেজেছে।বেচারি ভেবেছিল হয়তো আটটা সাতটা বাজে। সবাই উঠে পড়বে কিন্তু। উপায় না পেয়ে পা টিপে টিপে দরজার দিকে গেল সে।
–‘কোথায় যাচ্ছ?
সবে দরজার লকে হাত দিয়েছিল সূচনা।আচমকা প্রণয়ের কণ্ঠ পেয়ে চমকে ছেড়ে দিল লক,বু’ক কেঁপে উঠলো তার। ঘুমিয়ে ছিল সে,জাগলো কখন?বু’কে ফু দিয়ে কিছুটা রা’গী গলায় বললো –
–‘কি সমস্যা আপনার?এমন হুটহাট কোথা থেকে টপ’কান?ভয়ে আত্মা কে’পে উঠেছিল আমার।যতসব।
বলে আবারো ফু দিল বু’কে।
বো’কা বনে গেল প্রণয়। সে কি এমন বললো যে সূচনা এত ভয় পেল।প্রণয় চোয়াল ঝুলি’য়ে সূচনার দিকে তাকিয়ে বললো-
–‘আশ্চর্য! আমি কি এমন বললাম যে তোমার আত্মা কেঁ’পে উঠলো?
সূচনা কেমন করে যেন তাকালো তারপর বললো-
–‘কিছুনা,,
প্রণয় ও কথা বাড়ালো না। জিজ্ঞেস করলো-
–‘যাক গে।এত সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছিলে?
–‘বাইরে যাচ্ছিলাম।
–‘কেন?
মুখ লট’কে ‘ক্ষুধা লাগসে ভাই খাই’তে যেতাম’,কথাটা মনে মনে আওড়ালো সূচনা।কিন্তু মুখে বা কথায় প্রকাশ করলো না। বললো –
–‘ঘুম ভেঙে গেছে, নামাজ পড়ে শোয়ার পর আর ঘুম আসছিল না তাই বাইরে,,
–‘আচ্ছা,, তুমি এখন বাইরে গেলে যে আমার কত বড় ক্ষতি হত জানো?
সূচনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
–‘আমি বাইরে গেলে আপনার ক্ষতি হবে মানে?
বিছানা থেকে উঠে সূচনার সামনে যেয়ে দাঁড়ালো প্রণয়।তারপর বললো-
–‘নরমালি বিয়ের পরেরদিন সকালে কাপলরা দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। ওয়াইফ এর ভেজা চুল,চেহারায় আলাদা গ্লো,লজ্জা আর খুশি খুশি ভাব থাকে যার মাধ্যমে মানুষ মনে করে যে তাদের মধ্যে স্পেশাল কিছু হয়েছে। কিন্তু আমাদের মধ্যে তো কালকে তেমন স্পেশাল কিছু হয়নি বাট এট লিস্ট প্রিটেন্ড তো করতেই পারো যেমন-সকালে শাওয়ার নিবে,মুখে আলাদা খুশি বজায় রাখবে আর আমার সামনে আসলে লাজরাঙা হবে।এই তো।
প্রণয়ের কথা শুনে ইতিমধ্যে লাজরাঙা হয়ে গেছে সূচনা।তা দেখে প্রণয় বাঁকা হাসলো। বেড সাইড টেবিল থেকে ফোন নিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেল।
#চলবে