#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_৪৩
________________________
প্রতিটা সকালের শুরুতে হয় জীবনের নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা। সূচনার জীবনেও নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। বিয়ের দেড়মাস পর এই অধ্যায়ের সাথে পরিচিত হয়েছে সে। অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ বোধহয় এমনি হয়, নাকি তাদের ক্ষেত্রেই এতটা সময় অতিক্রম হয়ে গেছে। হয়তো হ্যা হয়তো না,হয়েছে যে তাই অনেক। কিন্তু এরপরেও মনে বিষন্নতার মেঘেদের উড়াউড়ি। আজ দুইদিন প্রণয়ের ব্যবহার পুরোপুরি বদলে গেছে। তার সাথে ঠিকমতো কথা বলছেনা,তাকাচ্ছেনা পর্যন্ত। এসবের কারন জানেনা সূচনা। কারন খুঁজতে গিয়ে বারংবার শূন্য হাতে ফিরেছে। কারন পাবে কিভাবে? সে তো কিছু করেনি করবেই বা কিভাবে? সেদিন রাতে ঘটনার পরদিন সকালে যখন সূচনার ঘুম ভেঙেছে তখন সময় ছিলো সাড়ে আটটা আর বিছানায় সে একা ছিলো।প্রণয় ব্যালকনিতে ভেবে দ্রুত এলোমেলো শাড়িটা কোনোরকম সামলে ওয়াশ রুমে চলে যায়। গলায়,ঘাড়ে ও কানে কিছু দাগ দেখা যাচ্ছে,সেগুলো কা*মড়ের দাগ,প্রণয়ের দেয়া।যেগুলো স্পষ্ট মনে করিয়ে দিয়েছে গত রাতের কথা,লজ্জায় কান গরম হয়ে উঠেছে।ভালো করে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে যখন বের হয়ে দেখলো প্রণয় রুমে নেই, তখন প্রশ্ন জাগে, সে ভেবেছিলো বাগানে হাঁটতে বেরিয়েছে আর রুমে আসেনি। কিন্তু এতোটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও না আসায় কল লাগালো প্রণয়কে প্রথমবারের রিসিভ করেনি, দ্বিতীয়বারে করেছে। কিছু জিজ্ঞেস না করতেই প্রণয় হরবর করে বলে-
–‘ আমি অফিসে আছি,কথা বলতে পারবোনা।
বলেই খ*ট করে কেটে দেয়। একটু খারাপ লাগলেও ব্যস্ত আছে ভেবে তেমন পাত্তা দেয়নি সূচনা তখন। ভেবেছিল পরে কল দিবে কিন্তু সেদিন একবার ও কল করেনি প্রণয়।সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেও তেমন কথা বলেনি।ফ্রেশ হয়ে, ব্যালকনিতে যেয়ে দরজা অফ করে বসে ছিল,সূচনা কতবার ঘুরে গেছে,দরজায় নক দিয়েছে।কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি।নয়টার সময় বেরিয়েছে তারপর তাড়াতাড়ি করে খেয়ে রুমে এসে লাইট অফ করে শুয়ে পড়েছে। রুমে যে আরেকজন আছে তার খেয়ালই নেই যেন।রা*গ করে সূচনাও কিছু বলেনি।তারপর আজকের দিনও চলে গেল।এশার নামাজ পড়ে ব্যালকনিতে দাড়িয়ে এসবই ভাবছে সূচনা।প্রণয় ফিরেনি এখনও,কল দিয়েছিল কিন্তু রিসিভ হয়নি।মিনিট কয়েক বাদে টেক্সট এসেছে
— ‘ফিরতে দেরি হবে।’
রিপ্লাই করেনি সূচনা।তার এবার রীতিমতো কান্না পাচ্ছে,এজন্যই বলে অনুভূতির প্রকাশ হয়ে গেলে আর মূল্য থাকে না।প্রণয় ও তাই করছে,এতদিন তো এমন করেনি,আর এখন যেই না বলেছে নিজের অনুভূতি তৎক্ষনাৎ আচরণে পরিবর্তন।দাড়ানো থেকে ব্যালকনিতে ডান পাশে নিচে পেতে রাখা ম্যাটে পা গুটিয়ে বসে পড়লো সূচনা।পাশে রাখা ফেয়ারি লাইট টা আজ জ্ব*লন্ত।সূচনা কোলে দুইটা কুশন একসাথে নিয়ে থুতনিতে হাত রেখে কয়েক পল ভাবলো কী করা যায়,কিন্তু লাভ হলো না কোনো।কোনো পথ বেরোলো না। তার ওপর নতুন এক চিন্তা ভিড় করেছে মাথায়।আজ বিকেলে ছাঁদে গিয়েছিল সে,উদ্দেশ্য সেই চিলেকোঠার রুমে কি আছে দেখা, কিন্তু লাভ হয়নি কোনো।তালাবদ্ধ রুমে কি আর ঢোকা যায়?মুখ ল*টকে ফিরেছে।তারপর থেকে চিন্তা ভিড়েছে ‘কী এমন আছে এই ঘরে?এত লুকানোর কি আছে?’ভাবতে ভাবতে ঠোঁট উল্টে কান্না করে দিল সূচনা।এত চা*প কি সে নিয়েছে কখনো,ছোট খাটো একটা মাথা তার,তার মধ্যে এত জ*টলা।উফফফ,হু হু করে কান্নার স্বর তুলে দিল সে।
–‘এভাবে কাঁদছো কেন?বর ম*রেছে তোমার?
আ*তকে উঠলো সূচনা,অতি নিকটে শোনা গেল স্বরটা।চকিতে তাকালো পাশে,প্রণয় হাটুতে ভড় করে তার দিকে ঝুকে আছে,দৃষ্টি উৎসুক তার,আর ক্লান্তির ছাপ চোখে মুখে।সূচনা তড়িৎ গতিতে প্রণয়ের মুখে হাত চেপে ধরলো,তার চোখে মুখে স্পষ্ট আতংক। আতংকিত গলায় ই বললো-
–‘কী বলছেন এসব?মাথা খারাপ হ’য়ে গেছে আপনার।
নিজের মুখ থেকে সূচনার হাতটা সন্তপর্ণে সরিয়ে নিল প্রণয়।গাম্ভীর্যের ভাব বজায় রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললো-
–‘তেমন কিছু বলিনি।এখানে কী করছো ঠান্ডার মধ্যে আর কান্নাকাটি ই বা করছো কেন?
সূচনা এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বাচ্চা কণ্ঠে বললো-
–‘হাত ছুয়ে কথা দিন আর এমন উল্টা পাল্টা কথা বলবেন না।
–‘বাচ্চামো কেন করছো?
–‘করছি বাচ্চামি তা ও কথা দিন।
–‘কাঁদছো কেন?
–‘দিবেন না কথা?
হাফ ছাড়লো প্রণয়।বললো-
–‘ঠিক আছে দিলাম এখন বাদ দাও।বলো কী হয়েছে?
এবার মুখ চুপসে গেল সূচনার,আরও কান্না পেল কারণ জিজ্ঞেস করায়।যেন কান্না সব দলা পাকিয়ে গলায় এসে আ*টকেছে।মাথা নিচু করে নিল,নিচু স্বরে বললো-
–‘কিছুনা এমনি।
–‘ তাড়াতাড়ি বলো।কিছু না বলো না আবার, এমনি মাথা গ*রম।
–‘আপনার মাথা সবসময়ই গ*রম থাকে।
–‘হ্যা থাকে এখন আরও হচ্ছে। না বললে আরো খা*রাপ হবে।বলো,ফাস্ট।
সূচনা কিয়ৎপরিমাণ চুপ রইলো।তারপর নিচু স্বরে বললো-
–‘আপনি দুইদিন ধরে এমন করছেন কেন?
–‘কেমন করছি?
–‘ইগনোর করছেন,কথা বলছেন না, তাকাচ্ছেন ও না।কি করেছি আমি?
এবার নীরব রইলো প্রণয় ও।আলতো স্পর্শে সূচনার এক হাত মুঠোবন্দি করলো প্রণয়,প্রগাঢ় দৃষ্টি স্থাপন করলো সূচনার পানে।নীরবতা ভে*ঙে শীতল কণ্ঠে বললো-
–‘তেমন কিছু না,আমার মনে হচ্ছিল সেদিন রাতে আমাদের মধ্যে যা হয়েছে তা আমার ভুলে হয়েছে।তোমার অনুমতি নেইনি আমি,নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল।তার জন্য মনে হচ্ছিল তুমি আমাকে নিয়ে খা*রাপ ধারণা রাখবে। তাই..
সূচনা কিছু সময় থম মে*রে তাকিয়ে রইলো, অতঃপর ফিক করে হেসে দিল।তার হাসিতে ভ্রু কুচকালো প্রণয়,থমথমে গলায় জিজ্ঞেস করলো-
–‘হাসছো কেন?একটু আগে তো ফ্যাচফ্যাচ করে কান্না করছিলে।
মুখে হাত চেপে হাসি আ*টকালো সূচনা।বললো-
–‘আপনি কী লজ্জা পাচ্ছেন?
প্রণয় ধমকানো স্বরে বললো-
–‘লজ্জা পাবো কেন হ্যা?লজ্জা পাওয়ার কি আছে?
–‘বিহেভিয়ার দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। শুনুন আপনার যেমন মনে হচ্ছে সেটা আসলে আমার মনে হওয়া উচিত কিন্তু মনে হচ্ছে না কারণ যা হয়েছে তা হওয়ারই ছিল একদিন। আর অসম্মতি তে কিছুই হয়নি । যা হয়েছে দু’জনের সম্মতি তে হয়েছে।
–‘মানে তোমার সম্মতি ছিল?
–‘আপনার মনে হয়েছে আমার কোনো অসম্মতি ছিল?
–‘মনে নেই আবার দেখতে হবে।
সূচনার দিকে আরেকটু ঝুঁকে চোখ মে*রে বললো প্রণয়।সূচনা লজ্জা পেয়ে প্রণয়ের বুকে দু হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললো-
–‘সরুন,দূরে যান।
–‘কেন?একটু আগেই তো বললে যে..
–‘আমি কিছু বলিনি।
–‘ঠিক আছে যাও ছেড়ে দিলাম।
–‘ধন্য।
–‘প্রণয়ী?
হঠাৎ গম্ভীর স্বরে ডাক দিল প্রণয়।সূচনা সহসা জবাব দিল-
–‘হু।
–‘তুমি আমাকে পেয়ে ভাগ্যবতী না বরং প্রণয় স্বয়ং প্রণয়ীকে পেয়ে ভাগ্যবান।
–‘আউচচ,দিল পে লাগি।
–‘আহ্লাদ।
–‘হু।
জানেন মেয়েরা তাদের কাছেই আবদার করে, তাদের সামনেই আহ্লাদী ভাব ধরে যারা তার খুব কাছের কেউ,যারা তার সেই আহ্লাদী ভাবটাকে বা সেই আবদার গুলোকে মূল্যায়ন করতে পারে।আর মেয়েদের একটা অদ্ভুত শক্তি আছে তারা সেই মানুষগুলোকে না খুব তাড়াতাড়ি ই চিনে নিতে পারে। তবে কিছু মেয়েরা আবার বুঝতে একটু বেশি ই সময় ব্যয় করে ফেলে কিন্তু বুঝতে পারে ঠিকই। পার্থক্য হয় এখানে যদি আগে বুঝতে পারতো তাহলে হয়তো খা*রাপ কিছু হওয়া থেকে রেহাাই পেত,হয়তো বড়সড় ঝড় বয়ে যেত না,হয়তো পরিস্থিতি টা অন্য রকম হত, আরও সুন্দর হত।ব্যস এতটুকু ই।
–‘বাহ বাহ,তুমি জানো তুমি মাঝেমধ্যে হুট করে অনেক বড় হয়ে যাও, অনেক বেশি বুঝদার মনে হয় তোমাকে।আবার মাঝেমধ্যে হুট করে ই কেমন বাচ্চা বনে যাও।
–‘কিন্তু মানুষ আমি একটাই।
–‘হুম..
_______________________
–‘স্যার সেই নাম্বার থেকে আবারও ভয়েস মেসেজ এসেছে একটা।আগের বারের টার মতো এটাতেও একই কথা।’তার মামাকে কেন মে*রেছি আমরা?সেই একই স্বর।টানা তিনদিন একই মেসেজ আসলো।আপনার কথা মতো সেই নাম্বারের ডিটেইলস বের করেছি।কয়দিন আগেই সেই সিম টার রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে,রেহান আদনান নামে। সে আমেরিকাতে থাকতো, কিছুদিন আগেই ফিরেছে,আমেরিকা তে কিন্তু উনিও থাকতেন। স্যার আমার মনে হচ্ছে..
–‘যা মনে হচ্ছে তাই।
তন্ময়কে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো প্রণয়।
আবারও বললো-
–‘ আচ্ছা তন্ময় শোনো কালকে অফিস শেষে এটা নিয়ে কথা বলবো।এখন রাখি তাহলে?
–‘ঠিক আছে স্যার।
–‘অফিস আর কারো সামনে ছাড়া স্যার বলতে নিষেধ করেছি তো।
–‘ঠিক আছে ভাইয়া।
–‘দেট’স লাইক আ গুড ব্রো।আচ্ছা রেস্ট কর তাহলে।
–‘ঠিক আছে।
কল কে*টে দিয়ে দাড়িয়ে রইলো ব্যালকনিতে।পেছন থেকে ডেকে উঠল সূচনা-
–‘খেতে আসুন।
দৃষ্টি সামনে রেখেই জবাব দিল-
–‘যাও আসছি।
–‘তাড়াতাড়ি আসুন।
তাড়া দিয়ে আসতে বলে চলে গেল সূচনা।প্রণয় মিনিট পরেই চলে গেল।
_____________________________
রাতের খাবারের পালা শেষ,ফ্রেশ হয়ে কা*পতে কাপ*তে কোনোরকম কম্বলের নিচে ঢুকেছে সূচনা।প্রণয় আগে থেকেই ছিল বিছানায় আধশোয়া হয়ে।সূচনার কাঁপা কাপি দেখে জিজ্ঞেস করলো-
–‘আজকেও গিজার অন করে নাও নি?মন কোথায় থাকে হ্যা?
সূচনা কম্বলের ভেতর থেকে ই জবাব দিল-
–‘মনে না থাকলে কী করব?
–‘কি করবে কাপ*তে থাকবে।
প্রণয় টুক করে কম্বলের ভেতর ঢুকে গেল।কামিজ ভেদ করে পেটে শীতল হাতের স্পর্শ পেয়ে কেঁ*পে উঠলো সূচনা।ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে প্রণয় বললো-
–‘এখন বুঝি শীতকালে সিঙ্গেল ছেলেমেয়ে গুলো এমন বিয়ে বিয়ে করে কেন?
–‘কেন?
–‘এমন নরম, গরম তুলতুলে একটা ব্যক্তিগত কম্ফোর্টার পেতে হলেও বিয়ে করা উচিত।
–‘ছিহ
স্ব শব্দে হাসলো প্রণয়।ঘাড়ে নাক ঘষতে লাগলো আবারও। সূচনা নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলো-
–‘ভালোবাসার রঙ কী প্রণয়?
–‘সেটা নির্ভর করে সেই মানুষটার ওপর,তার অনুভূতির ওপর, ভালোবাসা নিয়ে তার স্বংজ্ঞা কী তার ওপর।সবার ক্ষেত্রে ভালোবাসার ডেফিনেশন এক হয়না,তাই সবার জন্য ভালোবাসার রং ও এক হয় না।বুঝেছো মেয়ে?
#চলবে