#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_১৭
_________________________________
–‘আপনি বুঝতে পারছেন না আমি আপনাকে পছন্দ করি না,কেন বারবার কল করছেন,কেন মেসেজ দিচ্ছেন?
ওপাশ থেকে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে কেউ বললো-
–‘ কেন কী সমস্যা?এত অপছন্দ কেন আমাকে?
উত্তর দিতে পারলনা ইরা।কী দিবে সে?তার তো অপছন্দ না।তাহলে অপছন্দ হওয়ার কারণ হিসেবে কী দেখাবে সে?
–‘আমি তোমাকে ভালোবাসি ইরুপাখি।কতবার বলব আর, এতদিনে কী আমার জন্য একটু অনুভূতি ও জন্মায়নি তোমার মনে?
ইরা শক্ত কণ্ঠে বললো –
–‘না জন্মায়নি আর জন্মাবে ও না।আমি এসব পছন্দ করিনা বললাম তো।আমার দ্বারা এসব দুইদিনের স্বার্থের সম্পর্ক করা সম্ভব না।আপনি স্বার্থপর আর আপনার মতো মানুষের সাথে তো কোনোদিনও না।
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ, তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে হাসতে ই বললো-
–‘কোন অপরাধে এই সুন্দর উপাধি দিকে সেটাও বলো।
–‘নিজের কৃতকর্মের ব্যাপারে আপনি জানেন না বুঝি।
–‘যখন কিছু করিই নি তাহলে জানব কী করে?
–‘অপ/রাধ করার পর সেটা সামনে আসলে সব অপ/রাধী এ কথাই বলে।
–‘অপরা/ধ না করেই যদি তার জন্য দো/ষী সাব্যস্ত করা হয় তখন কি বলে সেটা বলতে পারো?
চুপ হয়ে গেল ইরা।তা দেখে ওপাশের মানুষটা কড়া গলায় বললো-
–‘তুমি আমার, এটা মাথায় রাখবে।তোমাকে নিজের করে নিতে জোর করতেও দু’বার ভাবব না।রাখলাম,,খুব শীঘ্রই আসছে মুগ্ধ,তার ইরাবতীকে নিজের করতে।
বিচ্ছিন্ন হলো সংযোগ।থম মে’রে বসে রইলো ইরা।এ কথাগুলো যদি সত্যি হত তাহলে কী খুব খা/রাপ হয়ে যেত?কিন্তু এগুলো তো মিথ্যা,ক্ষণিকের জন্য।একাধারে দুই দুইটা মেয়ের জীবন যে নষ্ট করতে চাইছে সে নিশ্চয়ই ভালো হবেনা।আর এমন মানুষের জন্য ই কিনা এই ছোট্ট হৃদয়ে অনুভূতির মেঘ জমেছে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইরা।
____________________________________
মাঝে কেটে গেছে তিনদিন।সূচনা ফিরে যাচ্ছে তাদের বাসা থেকে।ইরাদকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করা হয়েছে আজকে সকালেই।আরহাম সাহেব নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন কিন্তু ইরাদ কোনোভাবেই রাজি হয়নি,অসুস্থ তাই তার মতামতের বাইরে কেউ কিছু বলেনি আর।বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাকে।সূচনাও আর থাকেনি প্রণয়কে ফোন দিয়ে বলেছে নিয়ে যেতে।বিকেলের শেষভাগে অফিস শেষে সূচনাদের বাড়িতে এসেছে প্রণয়।দেরি করেনি একটু বসেই বেড়িয়ে গেছে তাকে নিয়ে।প্রকৃতির এক মায়াবী ক্ষণ সন্ধ্যা।উজ্জল ধরণী,কর্মমুখর দিনের ইতি ঘটিয়ে রাতের মাঝামাঝি সময়ে ক্ষণিকের জন্য তার আগমন ঘটে, মিলিয়ে যায় আবার।গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরেই তাকিয়ে ছিল সূচনা।হুট করেই উঠে গেল জানালার কাচ।সূচনা কিঞ্চিৎ ভড়কে গেল।পাশ ফিরে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
–‘কাচ উঠালেন কেন?
–‘ধুলো আসছে।
কিছু টা মন খা/রাপের স্বরে সূচনা বললো-
–‘ভালো লাগছিল দেখতে।
–‘উঠিয়ে দিব?
–‘দিন একটু।
জানালার কাচ বেশ খানিকটাই উঠিয়ে দিল প্রণয়।সূচনা আবার মনোযোগী হলো বাইরের পরিবেশ দেখতে।
.
.
বাসায় এসে কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুললেন মিসেস আফিয়া।প্রণয়রা দোতলায় থাকে।নিচ তলা আর উপর তলা ভাড়া দেয়া।মিসেস আফিয়া দরজা খুলেই ব্যস্ত গলায় প্রশ্ন জুড়লেন-
–‘তোর চোখমুখ এমন লাল দেখাচ্ছে কেন প্রণয়?
মিসেস আফিয়ার কথা শুনে সাথে সাথে ই সূচনার চোখ গেল প্রণয়ের দিকে।অসম্ভব রকমের লাল প্রণয়ের চোখ।শ্যামবর্ণের সে তবু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার নাকের ডগা লাল।প্রণয় মিসেস আফিয়া কে বু/ঝুং বা/ঝুং বোঝানোর চেষ্টায় ব্যস্ত।মিসেস আফিয়া চিন্তিত মুখে বললেন-
–‘ধুলো তে এমন হয়েছে তাই না?জানালার কাচ লাগাসনি কেন? তুই জানিস তোর ধুলো-বালি তে এলার্জি তাহলে খেয়াল রাখিসনা কেন?কী সমস্যা তোর?আমাকে এভাবে টেনশন দিয়ে কী মজা পাস বল তো তোরা।এদিকে ইরা টা ও কিছু বলেনা,ইদানিং কেমন চুপচাপ,গোমরা হয়ে থাকে।তুই তো কিছু বলিস ই না।তোরা কিছু মনে করিস না আমাকে। জানি তো আমি।
এক নাগাড়ে কথাগুলো বললেন মিসেস আফিয়া।কেদে দেয় দেয় এমন অবস্থা তার।প্রণয় এক পাশ থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথার সাথে মাথা ঠেকিয়ে বললো-
–‘আমাদের কাছে তুমি কি সেটা মুখে বলে প্রকাশ করার প্রয়োজন আমি মনে করিনা।তোমার এই ব/কা গুলোতেও ভালোবাসা আছে তাই মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে এমন করি।
–‘আমাকে বাচ্চা পেয়েছিস হ্যা?চার চারটা ছেলে মেয়ের মা আমি,ক’দিন পর দাদি হয়ে যাব আর তুই আমাকে এসব পড়া দিস।চোখের সামনে থেকে যাবি না কান টেনে ছিড়/ব?
–‘ হ্যা তারপরের দিন নিউজে হেডলাইন হবে-“ছেলের কান টেনে ছিড়/লেন তার মা।” তারপর মিসেস আফিয়া ভাইরাল।
প্রণয়ের কথা শুনে মিসেস আফিয়া ফিক করে হেসে দিলেন।প্রণয়ও হাসলো সাথে।কিন্তু সূচনা নিশ্চুপ, নত মস্তক,ফ্লোরে দৃষ্টি।মিসেস আফিয়ার তখনকার কথায়,সূচনার লজ্জা পাওয়ার কথা কিন্তু সে ভাবলেশহীন। মাথায় তার একটা জিনিস ই ঘুরছে।প্রণয়ের ধুলোবালিতে এলার্জি,কিন্তু সে বলল না কেন?তাহলে তো আর এমন হত না।তার জন্য এমন অবস্থা হয়েছে। অন্ধকার ছিল আর সে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখতে এতই মনোযোগী ছিল যে খেয়ালই করেনি প্রণয়ের দিকে।এদিকে মিসেস আফিয়া যেন ভুলেই গিয়েছিলেন সূচনার কথা।নিজের কাজে নিজেই খানিক লজ্জাবোধ করলেন।মেয়েটা কি ভাববে -এখানে যে সে আছে তাকে কোনো গুরুত্ব ই দেয়া হচ্ছে না।তারা নিজেরাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।মিসেস আফিয়া কড়া কণ্ঠে প্রণয়কে বললেন-
–‘প্রণয় যা তো, তোর জন্য আমার মেয়েকেই ভুলে গেছি আমি।
প্রণয় বিনা বাক্যে প্রস্থান করলো সেখান থেকে।মিসেস আফিয়া সূচনার থুতনিতে হাত রেখে তার নত মস্তক উপরে উঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
–‘কেমন আছে আমার মেয়েটা?
–‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
–‘আলহামদুলিল্লাহ।জানিস তো আজকে শান্তি লাগছে তুই এসে পড়েছিস।এবার মনে হচ্ছে আমার ছেলে বিয়ে করিয়েছি,ঘরে ছেলের বউ এসেছে।
সূচনা জোরপূর্বক হাসল।মনের ভেতর খচখচ করছে তার।প্রণয়কে জিজ্ঞেস করতে হবে,সে ঠিক আছে তো?
–‘রুমে যা,,হাত মুখ ধুয়ে নেয়।
মাথা নাড়ালো সূচনা। দ্রুত পায়ে ছুটলো রুমে।সে রুমে যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ই প্রণয় ওয়াশরুম থেকে বের হলো।সূচনা তড়িৎগতিতে তার সামনে দাড়ালো।সোজা জিজ্ঞেস করলো-
–‘আপনি আগে বলেননি কেন আপনার ধুলোতে এলার্জি?তাহলে তো আমি জেদ ধরতামনা।কেন করলেন এমন?
প্রণয় অবাক হলো না যেন তার আগে থেকেই জানা ছিল এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।সে সোজাসাপটা উত্তর দিলো-
–‘এমনি বলিনি,কিছু হয়নি,ঠিক হয়ে গেছে। যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও।
সূচনা কয়েক মিনিট প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর বড় বড় পা ফেলে কাবার্ড থেকে জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেল। সে যেতেই প্রণয় টান টান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল।অতকিছু ভাবার সময় নেই।ঘুমাতে হবে নাহলে নির্ঘাত সে পাগ/ল হয়ে যাবে।টানা তিনরাত নির্ঘুম কাটিয়েছে সে,আর না।
.
.
হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে দাড়িয়ে আছে সূচনা।দৃষ্টি তার ঘুমন্ত প্রণয় এর ওপর।সাড়ে নয়টার মতো বাজে এখন।প্রণয় খায়নি এজন্য দুজনের খাবার রুমে নিয়ে এসেছিল।কিন্তু প্রণয় তো কত আরাম করে ঘুমোচ্ছে।সূচনার একটু ও ইচ্ছে হলো না তার এই আরামের ঘুম হারা/ম করতে। বে/চারা তিনরাত ঘুমাতে পারেনি।এখন ঘুমিয়েছে আর সে জাগিয়ে দিবে।অসম্ভব, সে ভালো করে জানে ঘুম ভাঙিয়ে দিলে মেজাজের যে কয়টা বাজে। হাতের প্লেটটা টেবিলে রেখে দিল।রুমের দরজা লক করে আস্তে করে শুয়ে পরল প্রণয়ের পাশে।মনে মনে ভাবল ইরার সাথে কালকে কথা বলতে হবে।কিন্তু বলবে কিছু তাকে?
.
.
–‘প্রণয়ী উঠ।
ঘুমের ঘোরে কানে আবছা কণ্ঠ আর হাতে টান পড়ায় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটালো সূচনার।উপেক্ষা করলো সে,তলিয়ে যেতে চাইল ঘুমে কিন্তু পারলনা।এক ঝটকায় তাকে শোয়া থেকে টান দিয়ে উঠিয়ে দিল কেউ।চমকে গেল সে কিন্তু ক্ষণিকের জন্য বটে।পিটপিট চোখে দর্শন হলো প্রণয়ের মুখ।চোখমুখ কুচকে বিরক্তি মাখা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো-
–‘রাত দুপুরে এমন টানাটানি করছেন কেন? কী হয়েছে?
–‘শখ হয়েছে বউয়ের আঁচল ধরে ঘুমাব।দেখি আঁচল টা।
–‘পা/গল হয়ে গেছেন?সরুন আমি ঘুমাব।
সূচনা আবার শুতে নিলে হাত ধরে আটকে দিল প্রণয়। বললো-
–‘শোও সমস্যা নেই। কিন্তু আগে খেয়ে নাও তারপর।
–‘মাঝরাতে খাওয়ার জন্য ঘুম ভাঙিয়েছেন?আশ্চর্য!
–‘মাঝরাত কোথায় পেলে?সবে সাড়ে দশটা বাজে ম্যাডাম।
–‘কিহ?
–‘জ্বি।এখন চোখে মুখে পানি দিয়ে আসেন,আমি খাবার গরম করে এনেছি।
–‘আমি খাবনা,ঘুমাব।
–‘যাবে নাকি আমি ওয়াশরুমে দিয়ে আসব?
–‘না যাচ্ছি।
কোনোরকম অল্প একটু খেল সূচনা।প্রণয় আর বাগড়া দিলনা।ঘুম থেকে উঠে খাওয়া যায় না। যতটুকু খেয়েছে তাই বেশি।খাওয়া শেষে সব গুছিয়ে রেখে রুমে আসতেই দেখল সূচনা বিছানায় এলোমেলো অবস্থায় শুয়ে আছে।মুচকি হাসল প্রণয়।মিসেস দিশা কথায় কথায় বলেছিল “আমার মেয়েটা আবার একেবারেই ঘুমকাতুরে, যেন দুনিয়া একদিকে আর ওর ঘুম অন্য দিকে।সূযোগ পেলেই ঘুমাতে উদ্যত হয়।” খুব সাবধানে সন্তপর্ণে সূচনাকে ধরে ঠিক ভাবে শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়ল।
.
.
জানালার কাচ ভেদ করে সারারুমে সূর্যের ঝলকানি। ঘুম ভেঙে গেল সূচনার। ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছিল সে।নিজের হাতের অবস্থান টের পেল,কোলবালিশ টপকে প্রণয়ের পিঠের ওপর।সূচনা একমুহূর্তের জন্য থমকালো।হাত সরাতে পারলনা সাথে সাথে।যদি জেগে যায় প্রণয়?যতটুকু সাবধানে সরানো যায় ঠিক তাই করল সূচনা।নিঃশব্দে উঠে পড়লো বিছানা থেকে নেমে পড়ল।
.
.
–‘আমি যাচ্ছি,একটু সুন্দর করে বিদায় ও তো দিতে পার।
সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রণয় মুখ বা’কিয়ে সূচনাকে বললো কথাটা।
সূচনা মিহি স্বরে বললো-
–‘সাবধানে যাবেন।
–‘এটা ভালো করে বিদায় দেয়া?
সূচনা ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো-
–‘তাহলে কিভাবে দেয়?
সূচনার এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই বোধহয় ছিল প্রণয়।ঝট করে সূচনার মুখোমুখি হয়ে দাড়ালো সে।বরাবরের ন্যায় ভড়কালো সূচনা।প্রণয় কিছুটা ফিসফিসিয়ে ই বললো-
–‘আমি যতটুকু জানি জড়িয়ে ধরে বলতে হয় যে” যেয়ে আবার তাড়াতাড়ি আসুন।আর তারপর হাসবেন্ড কপালে চুমু খেয়ে বিদায় নেয়।এই তো।তবে তেমার জন্য জড়িয়ে ধরা আর চুমু খাওয়াটা তোলা থাক,পরে নিব সেটা,অধিকার নিয়ে। আপাদত ওইটুকুই বলো।
যেন লাজরাঙা হলো সূচনা।লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে বললো –
–‘যেয়ে আবার তাড়াতাড়ি আসুন।
প্রণয় হাসিমাখা কণ্ঠে বললো –
–‘দ্যাট্স লাইক মাই গার্ল।
চলে গেল প্রণয়। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে যতক্ষণ তাকে দেখা যাচ্ছিল সূচনা দাড়িয়ে রইলো ততক্ষণ।দরজা লক করে সূচনা সোজা আসল ইরার রুমে।ইরা বিছানায় শুয়ে ছিল।সূচনাকে দেখেই উঠে বসল।সূচনা হালকা হেসে বললো-
–‘তোমার সাথে কথা ছিল।
ইরা জানে সূচনা কী বলবে,তবুও জোরপূর্বক হেসে বললো-
–‘হ্যা বসো।কী কথা বলো।
#চলবে