প্রণয়ের সূচনা পর্ব ১১

0
670

#প্রণয়ের_সূচনা
#লেখিকা_Nazia_Shifa
#পর্ব_১১
____________________________
নত মস্তকে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দাড়ানো সূচনা।সামনে থেকে আবারো প্রশ্ন –

–‘বললি না তো বেলী রাণী,কেমন আছিস?

নত মস্তক উপর করলো সূচনা।পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো অদ্ভুত মুখশ্রীর অধিকারী ইরাদের দিকে।এই মুহূর্তে তার মুখশ্রী সূচনার কাছে অদ্ভুত ই ঠে’কছে।কেমন যেন থমথমে চেহারা, চোখ জোড়ার নিচে কালি পড়েছে,চুলগুলো এলোমেলো,হালকা সাদা-গোলাপি রঙের ঠোঁট জোড়া কালচে বর্ণের হয়ে গেছে।সূচনা হালকা স্বরে জবাব দিলো –

–‘ আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?

ইরাদ বা’কা হাসলো।প্রাণহীন সেই হাসি। বু’কের বা পাশে হাত রেখে হাসতে হাসতে বললো-

–‘ভালো থাকার কি কথা? এই খানটা তো জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে বেলী রাণী। কিভাবে ভালো থাকব আমি?

সূচনা দৃষ্টি নত করলো।তাড়াহুড়ো করে বললো-

–‘আমার কাজ আছে ইরাদ ভাই আমি আসি।

পেছন ঘুরতে নিলে আবারও ইরাদ বললো –

–‘পালাচ্ছিস?এমনটা না হলেই কি হতো না?তুই তো জানতি সবটা, তাহলে?

সূচনা নিচু স্বরে বললো-

–‘দেখুন ইরাদ ভাই এখন এখানে এসব বলার সময় না।কেউ শুনলে তিল থেকে তাল বানাবে।আমি কোনো ঝা’মেলা চাই না।আমার বিয়ে হয়ে গেছে, এটাই সত্যি আর আমি মেনে নিয়েছি।আপনিও মেনে নিন,ভুলে যান আমাকে।

–‘আমার ভালোবাসায় খা’দ কি ছিল বলতে পারবি?

–‘আপনার ভলোবাসায় খা’দ ছিল না হয়তো তবে তা ছিল একতরফা।আমি কখনো আপনাকে ভালোবাসিনি,কখনো সেই নজরে দেখিনি। আমার জন্য নিহাদ ভাইয়া যেমন আপনিও তেমন।আসি।

সূচনা দ্রুতপায়ে প্রস্থান করল সেই স্থান।ইরাদ ব্যথাতুর নয়নে তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার পানে।নিজের রুমে আর গেল না সূচনা।রিশা আর হৃদুর কাছে গেল,তখন ঘুমিয়ে ছিল দু’জন তাই আর যায়নি।রুমে যেয়েই দেখল দু’জন মনোযোগ দিয়ে ফোনের ভেতর কিছু দেখছে।সূচনা কে দেখেই রিশা আসল তার কাছে। বলল-

–‘তুমি এমন হুট করে বিয়ে করে ফেলেছ, তাই তোমার ওপর রা”গ করেছিলাম।

–‘এখন কি রা’গ ভেঙেছে।

–‘হ্যা।থ্যাঙ্কিউ এতগুলা চকলেটের জন্য। এখন আর রা’গ নেই।

সূচনা অবাক হলো।কীসের চকলেট?সে তো কোনো চকলেট দেয় নি।তাহলে?রিশা কে কিছু জিজ্ঞেস করতে নিবে তখনই আগমন ঘটে প্রণয়ের।তার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ যায় হৃদুর দিকে। মুখ গোম’রা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।সূচনা আহ্লাদী স্বরে বললো-

–‘আমার পিচ্চিপাখি টা বুঝি আমার সাথে রা’গ করেছে।কথা বলবেনা আমার সাথে?

তার কথা শুনেও না শুনার ভান করলো যেন।সূচনা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো-

–‘মিষ্টি কিন্তু চলে যাবে,তুমি কথা না বললে,

এবারো চুপ হৃদু।আবার শোধালো সূচনা-

–‘চলে গেলে কিন্তু আর আসবনা, তখন যেন কেউ মিস না করে।

কথাটুকু বলে সূচনা বসা থেকে উঠতে নিলেই ছুটে এলো হৃদুকা।মিনিট দুয়েক তার দিকে তাকিয়ে থেকে ঝা’পটে ধরল তাকে।কান্নার রোল তুলে দিল একেবারে। চোখ আর নাকের পানি মিলে একাকার অবস্থা।সূচনার কাধে মাথা রেখে তার ছোট হাত খানি কপোলে রাখল সূচনার।আধো আধো গলায় বললো –

–‘মিত্তি তুমি অনেত পতা,,একতু ও আদল কলো না লিদুকে।লিদুকে দেখতে যাওনা।

–‘ঠিকই বলেছো তোমার মিষ্টি অনেক প’চা।

হৃদুকার কথার পিঠে বললো প্রণয়।তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো সূচনা।কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো-

–‘আমি আপনাকে কি করেছি?প’চা বললেন কেন?

–‘চু’রি করেছো তুমি।

–‘কিহ?কি চু’রি করেছি আপনার?

–‘প্রণয়ের টিম,হার্জ,কোর চুরি করেছ তুমি। এটা কি কম কথা।

–‘এক সেকেন্ড,কিসের নাম বললেন এগুলো?খাবারের নাম তো মনে হয় না।তাহলে?

–‘বাচ্চা মানুষ বুঝবেনা।সময় হলে ক্লিয়ারলি বলব।

প্রণয়ের দিকে বা’কা চোখে তাকালো সূচনা।তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে হৃদুকার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে প্রণয় বললো-

–‘চলো আমরা ঘুরে আসি।প’চা মানুষের সাথে থাকতে হবে না।

সূচনার কোল থেকে প্রণয়ের কোলে চলে গেল হৃদুকা।সূচনা অবাক হয়ে গেলো। তাকে টা’ন দিয়ে নিজের কোলে নিয়ে নিল।বললো –

–‘ও যাবেনা।

প্রণয় আবার সূচনার কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে নিল।গাঢ় কণ্ঠে বললো –

–‘যাবে

–‘বললামনা যাবেনা।

তাদের টানাহেঁচড়া আর তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে বেচারি হৃদুকা কেঁদেই দিল।দুজনেই থতমত খেয়ে গেল।তাকে চুপ করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।সে চুপ হতেই আবার বাঁধলো তর্কাতর্কি।প্রণয়ের দিকে আঙুল তাক করে সূচনা বললো –

–‘আপনার জন্য কেঁদেছে ও।আপনি কাঁদিয়েছেন।

–‘তোমার সাহস তো কম না আমার দিকে আঙুল তাক করে আবার ব্লেম দিচ্ছ।তুমি কাঁদিয়েছ।

–‘আপনি কাঁদিয়েছেন।

–‘তুমি।

–‘আপনি,,

আবারো হৃদুর কান্নার আওয়াজ।প্রণয় আর সূচনা দুজন দুজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।হাঁটু মুড়ে তার সামনে বসে কানে ধরে দু’জন একসাথেই বলে উঠলো –

–‘সলিই পাখিই।

হৃদু আধো আধো গলায় ইংরেজিতে বললো-

–‘ইস ওকে।

তার কথা শুনে দুজনই হেসে দিল।প্রণয় তার গাল টেনে দিয়ে বললো-

–‘তুমি অনেক কিউট।কান্না করলে তো আরও কিউট লাগে।

সে কি বুঝল কে জানে।খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো।সূচনার দিকে তাকিয়ে মন খা’রাপ করে বললো-

–‘মিত্তি মাম্মাম বলেতে দিদুন নাকি তোমাকে একা বের হতে দেয়না তাই তুমি লিদুকে দেখতে তার বাসায়,যাওনা।কিন্তু একন তো তোমাল বিয়ে হয়ে গেতে,একন গেলে তো দিদুন জানবে না।একন কি মিত্তি যাবেনা?

প্রণয়ের দিকে দৃষ্টি সূচনার,মৃদু হাসার চেষ্টা করলো।হৃদুর ছোট ফোলা গালে হাত রেখে বললো-

–‘মিষ্টি যাবে তার হৃদুকে দেখতে।

–‘মিষ্টি চলে গেলে আমার কি হবে পাখি?আমি বউ ছাড়া কি করে থাকব?

কথাটা ফট করে বলে উঠলো প্রণয়।তার কথা শুনে অজান্তেই লাজ রাঙা হলো সূচনা।হুট করেই খেয়াল হলো রিশার কথা৷সে তো এদিকে।চট করে মাথা তুলে প্রণয়কে নিচু হতে নিচু স্বরে বললো-

–‘আপনার আক্কেল নেই,,শা’লীর সামনে কি সব বলছেন এসব।ছোট একটা মেয়ে কি ভাববে?

প্রণয় মুখ বা’কিয়ে বললো-

–‘তোমার মতো বো’কা নাকি আমি।আমার শা’লী চকলেট পেয়ে চলে গেছে সেই কবে।এতক্ষণ কত ঝগড়া’ঝাটি করে ফেলেছ আর এখন হুশ হয়েছে।

রুমের চারিদিকে চোখ বুলালো সূচনা। রিশা নেই।অথচ তার এতক্ষণে একবার ও খেয়াল হয়নি।হৃদুর দিকে তাকাতেই দেখল সে তাকিয়ে আছে তার দিকে।সে তাকাতেই হৃদু হাসি হাসি মুখে বললো-

–‘এটা কি আমার ফুফা মিত্তি?

একপলক প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে সূচনা মাথা নাড়িয়ে বললো-

–‘হ্যা,,তোমার ফুফা।

সূচনা বলতেই প্রণয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো হৃদু।তারপর আদুরে কণ্ঠে বললো –

–‘মিত্তির বিয়ে তো তোমাল সাতেই হয়েচে তো তুমি নিয়ে যাবে মিত্তিকে আমাদেল বাসায়।

প্রণয় আবারো তার গাল টেনে দিল।মুচকি হেসে বললো-

–‘তা ঠিক বলেছ। এই কিউট, মিষ্টি পরীটাকে আমি একটু কোলে নিতে পারি?

হৃদু আরও ভালো করে গলা জড়িয়ে ধরে প্রণয়ের কাধে মাথা রাখল।হাসিমুখে তাকে কোলে নিয়ে উঠে বেড়িয়ে গেল প্রণয়।তাদের যাওয়ার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে রইলো সূচনা।সাথে মুচকি হাসলো।তখন প্রণয়ের বলা কথাটুকু বারবার কানে বাজছে তার-“বউ ছাড়া কি করে থাকবে সে?”
___________________________
সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু অবস্থা।হাল্কা বাতাস,কিছুটা নিরবতায়,আচ্ছন্ন প্রকৃতি।শরৎ এর আকাশের গুটি গুটি তুলোর ন্যায় মেঘগুলো মিলিয়ে গেছে।আকাশ ছেয়ে আছে গোলাপি আভায়।অদ্ভুত! আকাশে গোলাপি রঙের খেলা?আকাশ ও রঙ বেরঙের খে’লায় মত্ত।আর এদিকে ভাবনায় মত্ত সূচনা।ছাদের একপাশে রেলিং ধরে দাড়িয়ে আছে সে।অদূরেই তিথি,দিনা,ইরা,আফরিন,রিশা,মিহু আড্ডা দিচ্ছে।হৃদু এখনও প্রণয়ের কোলেই।তাকে কোলে নিয়ে প্রণয় ছাঁদ থেকে নিচের জিনিসগুলো দেখাচ্ছে হৃদুকে।তার একেকটা প্রশ্নের জবাব শান্ত ভাবে দিচ্ছে প্রণয়।চোখেমুখে বিরক্তির কোনো ছাপ নেই।সূচনার দৃষ্টি তার মধ্যে ই নিবদ্ধ ছিল।প্রণয় হুট করে তাকালো তার দিকে।চোখাচোখি হলো দুজনার।সূচনাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রণয় এক ভ্রু উঁচু করে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো- কী?

দুদিকে মাথা নাড়িয়ে সূচনা ও ইশারায় জবাব দিল -‘কিছু না।

প্রণয় থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো নিশ্চুপভাবে।একরাশ ভাবনা এসে হানা দিল মন মস্তিষ্কে।কিছু মানুষের জীবন কত এলোমেলো।জীবনের সব হিসাবের মেলবন্ধন হয়না।গণিতে যেমন এত বড় একটা অঙ্ক করার পরে শেষে যেয়ে উত্তর আসে শূন্য।ঠিক তেমনই কিছু মানুষের জীবন ও লম্বা এক অঙ্কের মতে যার শেষে যেয়ে উত্তর আসে শূন্য।লিখাতে হয় অপ্রাপ্তির খাতায় নাম।এই যে হুট করে একজন এলো তার জীবনে, অনুভূতির জোগান দিল,বুঝতে শেখালো তারপর ভেঙেচুরে দিয়ে হারিয়ে গেল।ইরাদ নামে কেউ তাকে ভালোবাসলো কিন্তু সেই মানুষটার প্রতি তার অনুভূতি জাগেনি কখনো।উল্টো তার অনুভূতি জানার পরে তার থেকে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখেছে।ক্লাস এইটের সেই কিশোরী মেয়েটা আলাভোলা মনে একবার জিজ্ঞেস করেছিলো-

–‘আপনি আমাকে বেলী রাণী কেন ডা’কেন ইরাদ ভাই?

সেদিন সেই মানুষটা হাসি টেনে সহসা উত্তর দিয়েছিল-

–‘বেলী আমার প্রিয় ফুল আর তুই আমার প্রিয় মানুষ তাই তোকে বেলী রাণী বলে ডাকি।

সেদিন তার কথার মানে বুঝতে না পারলেও বয়স আর সময়ের সাথে বুঝতে আর বেগ পেতে হয়নি।তারপর টানলো দূরত্ব।তাদের বাড়িতে একদিন হুট করেই আগমন ঘটলো তার। বিধ্বস্ত অবস্থায়।তার হাত ধরে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে ব্যক্ত করলো তার অনুভূতি। সন্দেহ থেকে নিশ্চিত হলো সূচনা।দূরত্বের পরিমান বেড়ে হলো দ্বিগুণ। ফিরিয়ে দিল তাকে। স্পষ্ট বাক্যে ব্যক্ত করলো, ক্লিয়ার করল সব।কিন্তু সেই মানুষটা পিছু হাটে নি।মনের এক কোণে তার জন্য অনুভূতি নিয়ে চলছিল সে। মনের এক কোনে সুপ্ত আশা ছিল তাকে পাওয়ার।তারপর ঘটলো প্রণয় নামের সম্পূর্ণ অচেনা একজনের।তার আশার ইতি ঘটলো।নতুন #প্রণয়ের_সূচনা ঘটাতে হয়তো।যার সাথে জুড়ে গেল।হয়তো আজীবনের জন্য?জানে না সে।তবে এই সম্পর্কের বিচ্ছেদ ও চায়না সে যদি অতীত এর কারণ হয়।কারণ সেই অতীত কে তো কবেই পায়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে এসেছে।সেই অতীত যেন না আসে সামনে।না ফেলে প্রভাব তাদের সম্পর্কে।সব যেন স্বাভাবিক হ’য়ে যায়।

–‘আযান পড়ে গেছে।নিচে আসো তাড়াতাড়ি।

ভাবনায় মত্ত অবস্থার ইতি হলো।আচানাক কণ্ঠে এবার আর চম’কালো না সে।শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো –

–‘চলুন।

পা বাড়ালো দুজন একসাথে।তবে জীবন চলার পথেও কি দু জোড়া পা একসাথে মিলবে?নাকি আলাদা হবে পথ?

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here