পুনরারম্ভ, পর্ব-৭

0
401

#পুনরারম্ভ। পর্ব-৭
লেখক- ইতি চৌধুরী

অতুল ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রাখতেই তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার একমাত্র দুলাভাই শরিফ বলেন,
‘এই বিষয়টায় একটু বেশিই স্ট্রিক্ট হয়ে যাচ্ছো না?’
দুলাভাইয়ের হাত থেকে তার আধো খাওয়া সিগারেটটা নিয়ে তাতে একটা মাঝারি সাইজের টান দিয়ে অতুল বলে,
‘বুঝলে দুলাভাই কিছু কিছু বিষয়ে একটু শক্ত হতে হয়। আর যদি বিষয়টা হয় সারা জীবনের ব্যাপার তাহলে তো স্ট্রিক্ট হওয়াটা আবশ্যক।’
হুম বলেই শ্যালকের হাত থেকে নিজের সিগারেটটা নিয়ে তাতে টান বসান শরিফ। আপাতদৃষ্টিতে সবাই অতুল ও শরিফকে এক সঙ্গে দেখলে ফরমাল শালা-দুলাভাই বলেই ভাববে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের সম্পর্কটা বেশ গভীর। সময়বয়সী না হয়েও তারা একে অপরের জন্য বন্ধুর চাইতে কোনো অংশে কম নয়। একে অপরের কাছে তারা অনেকটা সিক্রেট বক্সের মতো। তাদের এমন কোনো সিক্রেট নেই যা এর টা ও আর ওর টা এ জানে না। একটা সিগারেট ভাগ করে খাওয়ার মতোই গভীর সম্পর্ক তাদের। ছেলেরা যার সাথে নিজের খাওয়া সিগারেট শেয়ার করতে পারে তার সাথে অনায়াসে যেকোনো কথা শেয়ার করতে পারে। শরিফ আরও বলেন,
‘ভেবে আগাচ্ছো তো? পরে না কোনো ভুল হয়ে যায়। মেয়েটা অন্য একজনকে ভালোবাসে। প্রেমের জন্য আজকালকার ছেলেমেয়েরা সবই করতে পারে বুঝলে শালাবাবু এখন আর সেই যুগ নেই বাবা মার মুখের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে দিবে। বরং দিন বদলেছে, ধরন পাল্টেছে। এখন ভালোবাসার জন্য মেয়েরা ঘর ছাড়তেও রাজি।’
শরিফের ফিরিয়ে নেয়া সিগারেট পুনরায় তার হাত থেকে নিয়ে নেয় অতুল। তা দেখে শরিফ বলেন,
‘আরেকটা জ্বালিয়ে নাও না ভাই।’
‘তুমি জ্বালিয়ে নাও। আমার এটা টানতেই বেশ লাগছে। যা বলছিলে, কখনো দেখেছ শতভাগ সিওর না হয়ে আমাকে কিছু করতে?’
‘তা অবশ্য দেখিনি। ঘটনা কি বলো তো? মেয়েটাকে কি আগে থেকেই চিনো নাকি?’
‘উঁহু, সেদিন দেখতে গিয়েই প্রথম দেখেছি।’
‘তাহলে এত আগ্রহ দেখাচ্ছ যে বরং?’
‘বলতে পারো লাভ এট ফার্স্ট সাইড।’
‘এই যা! লাভ ট্রায়াঙ্গেল হয়ে গেল যে।’
‘ট্রায়াঙ্গেল না সরলরেখা তা তো সময়ই বলে দিবে দুলাভাই।’
‘তোমার কথায় রহস্য রহস্য গন্ধ পাচ্ছি।’
অতুল আর কথা বলে না। কথার এখানেই ইতি টানে কোনো উপসংহার ছাড়াই। দুলাভাইকে সামান্য অন্ধকারে রাখতে তার কাছে বেশ লাগছে। বিষয়টা দিনকে দিন ইন্টারেস্টিং হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তার জীবনটা কোনো টিভি সিরিয়াল হলে জাঁকজমকপূর্ণ টিবিসি হতো যার ডায়লগ হয়তো কিছুটা এমন হতো, “এরপর কী হতে চলেছে ডাক্তার অতুলের জীবনে! সেহের কি সিদ্ধান্ত নিবে শেষ পর্যন্ত! বাবার কথার কাছে কি হেরে যাবে ভালোবাসা? নাকি আরও একবার জয় হবে ভালোবাসার?” এসব উদ্ভব কথা ভাবতেই হাসি পেয়ে যায় অতুলের। মনের হাসি সামলাতে না পেরে সশব্দে হেসে ফেলে সে। আপানাআপনি অতুলকে হাসতে দেখে তার দিকে রহস্যময় দৃষ্টি নিয়ে তাকায় শরিফ। কিছুই পরিষ্কার হচ্ছে না তার কাছে। বেচারা ফেঁসে গেছে শ্যলকের কথার মার প্যাচে। এই রহস্য খোলাসা না হওয়া অব্দি তার শান্তি নেই।

সেহেরের মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে রয়েছে। কি করবে ভেবে কিছুই আসছে না তার মাথায়। এমনিতেই অতিরিক্ত চিন্তায়, ভাবনায় মাথা সারাক্ষণ হ্যাঙ্গ হয়ে থাকে। তারউপর একদিকে মাহির অন্যদিকে ডাক্তার সাহেব। দু’জনই সমান তালে তাকে প্যারার উপর প্যারা দিয়ে যাচ্ছে। অতুল প্রতিদিন অন্তত একবার হলেও ফোন করে জানতে চান কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। প্রতিদিনই শুকনো মুখে বলতে হয় ভাবছি। কিন্তু এই ভাবনার কোনো কূলকিনারা খুঁজে পায় না সে। অন্যদিকে মাহির, প্রতিমুহূর্ত তার একটাই কথা কিছু একটা করো, কিছু একটা করো। যেন সব তার হাতে। সে চাইলেই সব ঠিক করে ফেলতে পারবে। নিজের অবস্থাটা সে কাউকে বুঝাতে পারছে না। সব কিছু এতটাও সহজ নয় তার জন্য। কেন যে বাবাকে এত ভয় পায়! আর বাবাকে ভয় যেহেতু পায়ই তাহলে প্রেমটা যে কোন দুঃখে করতে গিয়েছিল ভাবতেই এখন মাথা আউলায় আসে বেচারীর। কথা সত্যি, ভীতুদের প্রেম করতে নেই। অথচ ভীতু হয়েও দিব্যি প্রেম করার মতো দুঃসাহস করে বসে রয়েছে সে। অথচ আরেকটু সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে তা বাবাকে বলতে পারছে না। চেষ্টা করেনি তাও নয়। বেশ কয়বারই চেষ্টা করেছে সেহের বাবাকে নিজের পছন্দের কথা বলতে কিন্তু পারেনি। ফিরে এসেছে পরাজয় হয়। তার প্রেমের কথা শুনে তার রিটায়ার্ড বাবা যখন তার বাজখাঁই কন্ঠে একটা ধমক লাগাবে তাকে সেই ধমকেই সব তামাম হয়ে যাবে।
ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে করিডোরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চিন্তা মগ্ন হয় সেহের। নতুন করে চিন্তায় মগ্ন হওয়ারও কিছু নেই অবশ্য। একটু আগে কি ক্লাস করেছে, ক্লাসে স্যার কি বলেছে এসবের কিছুই সেহেরের মস্তিষ্ক ধরতে পারেনি। তার মাথার ভেতর আপাতত কেবল একটা শব্দই ঘুরপাক খাচ্ছে চরকির মতো। বিয়ে, বিয়ে, বিয়ে…।
সেহের যখন নিজের সমস্যা নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন তখনই আচমকা মাহির এসে তার একটা হাত ধরে তাকে টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়ে যায়। সে এতটাই ক্লান্ত তার একটুও ইচ্ছা হচ্ছে না জিজ্ঞেস করতে তাকে এভাবে টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। যাক যেখানে খুশি, সে জানতে চাইবে না। তাকে নিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যাক মাহির তাতেও আপত্তি করবে না। এখানে থাকলে বিচ্ছেদের ভাবনা সারাটাক্ষন মাথার ভেতর যন্ত্রণা করে বেড়ায়। এর চাইতে ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে সে অজানায় হারিয়ে যাবে সেই ভালো।
সেহেরকে সঙ্গে নিয়ে ইউনিভার্সিটির পেছনের রাস্তায় এসে দু’জনে পাশাপাশি বসে। বেশ কিছুক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা নেই। লম্বা বিরতির পর মাহির জিজ্ঞেস করে,
‘আঙ্কেলকে বলছ? কি বলছেন উনি সব শুনে?’
সেহের এক মুহূর্ত পাশ ফিরে মাহিরের মুখে দিকে তাকিয়ে আবার সামনের দিলে মুখ তাক করে বলে,
‘আব্বুকে কিছুই বলি নাই আমি।’
নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে সেহেরের মুখোমুখি বসে মাহির বলে,
‘বলো নাই মানে?’
‘বলি নাই মানে বলি নাই। আমার জায়গা থেকে এই কথা আব্বুকে বলা এত সহজ না মাহির।’
‘এখানে কঠিনের কি আছে? সহজ একটা কথা। তোমার বাবার সামনে গিয়ে বলবা তুমি বিয়েটা করতে পারবা না। এই কথা শুনে সে যখন কারণ জানতে চাইলে বলবা তুমি একজনকে মানে আমাকে ভালোবাসো। ব্যস, শেষ। কত সহজ দেখলা?’
‘এভাবে দূরে বসে বসে ভাবা, বলা অনেক সহজ। কিন্তু সামনাসামনি বলা মোটেও সহজ না। তুমি তোমার জায়গায় বসে আমার অবস্থাটা বুঝবা না। আমি আব্বুকে প্রচন্ড রকম ভয় পাই। এতটা বেশি যা আমি কাউকে বুঝায় বলতে পারব না। আমার আব্বু অনেক স্ট্রিক্ট একজন মানুষ। সে জানতে পারলে যে কি হবে আমার।’
‘তুমি তার মেয়ে। কি করবেন? বড়োজোর বকাঝকা করবেন। কয়টা কথা শুনাবেন। আমার জন্য এতটুকু শুনতে পারবা না তুমি?’
‘বিষয়টা বকাঝকার না। তুমি বুঝবা না। আমার বাবা কেমন তা আমি জানি। তোমার কথা বললে সে আমাকে বাসা থেকে বের করে দিতেও হয়তো দুইবার ভাববেন না। হইতে পারে মেরেই ফেলবে আমাকে বা উল্টাও হইতে পারে আমাকে ধরে বেঁধেই বিয়ে দিয়ে দিলো। তার জন্য তার প্রিন্সিপালস সব কিছুর আগে।’
আগের চাইতে আরেকটু নরম হয় মাহির। এতক্ষণ সেহেরকে সে সামান্য প্রেশার দেয়ার চেষ্টা করলেও এখন তা ছেড়ে দিয়ে আলতো স্পর্শে তার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
‘তুমি অহেতুকই ভয় পাচ্ছো। আমার মন বলছে এমন কিছুই হবে না। তুমি প্লিজ অন্তত আমার জন্য একবার তোমার বাবার সাথে কথা বলো। বিয়েটা আটকাও। আমি সত্যি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না।’
‘আমি নিজেও পারব না মাহির। এমনিতেই আব্বু বলে দিছে কাল থেকে আমি ক্লাসে আসবো না।’
‘মানে!’
‘মানেটা খুব সহজ। বিয়ের আর বাকি মাত্র পাঁচদিন। তাই এই কয়দিন বাসায় থাকতে বলছে আমাকে।’
আগের চাইতে আরেকটু শক্ত করে সেহেরের হাতটা ধরে মাহির বলে,
‘কিছু একটা করো প্লিজ।’
বিয়ের কথা মাহিরকে বলার পর থেকে তার এই কিছু একটা করো কথাটা শুনতে শুনতে সেহেরের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। কি করবে সে? চেষ্টা তো না করেনি তা নয়। কিন্তু লাভ হয়নি। আপাতত বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না সেহের। তাকিয়ে থাকে প্রিয় মানুষটার অসহায় মুখের দিকে, অসহায় দৃষ্টি নিয়ে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষ এত অসহায় হয় কেনো?

একটু আগেই সেহের পার্লার থেকে মেহেদি দিয়ে আসছে। বাসায় আসতে আসতেই তার মেহেদি শুকিয়ে গেছে। কাল গায়ে হলুদ, পরশু বিয়ে। আত্মীয় স্বজন দিয়ে বাড়ি রমরম করছে। মাথা ধরার কথা বলে নিজের ঘরের খিল দিয়ে বসে আছে সে। মাথায় একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে তার। ফোনটা বেজে উঠতেই ভাবনাচ্ছেদ হয়। মাহিরের নামটা স্ক্রিনে ভাসতে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস বুক থেকে উন্মুক্ত করে সে। একবার রিং হয়ে কলটা কেটে যেতেই আবার কল আসে। দ্বিতীয়বারে কলটা রিসিভ করে সেহের। লাইনের অন্য পাশ থেকে মাহির বলে,
‘কই ছিলা কল দিলাম।’
‘এখানেই আছি।’
‘হু’
সেহেরের মনে হয় তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। সে আর এসব নিতে পারছে না। বিচ্ছেদের এই যন্ত্রণা নিয়ে সে বেঁচে থাকতে পারবে না। জীবনটা অনেক ভার হয়ে দাঁড়াবে তার জন্য। এই ভার তার পক্ষে বয়ে বেড়ানো অসম্ভব। জীবন এত কঠিন কেনো?
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মাহির বলে,
‘শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকে হারায় ফেললাম।’
লাইনের এই পাশ থেকে সেহের স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার ভালোবাসার মানুষটার চোখ গলে অশ্রু ধারা বইছে। নিজেকে সামলে রাখতে পারে না আর। কলটা কেটে দিয়ে কান্না ভেঙে পরে সেহেরও।
অনেক চিন্তা ভাবনা করেছে, তার পক্ষে এই বিয়েটা করা সম্ভব নয়। তাই না চাইতে ভীষণ কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে সেহরকে। এছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই তার কাছে। বাবাকে সে মাহিরের কথা বলতে পারবে না। আর মাহিরকে ছাড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়।
যে পার্লারে মেহেদি লাগাতে গিয়েছিল সেহের। সেখানে একটা মেয়ে কনে সাজতে এসেছিল। সেজে আর বাড়ি ফিরে যায়নি ওখান থেকেই পালিয়ে গেছে। খুব হট্টগোল হয়েছিল এটা নিয়ে। সেই থেকেই সেহেরের মাথায় বারবার এই ভাবনাই ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার কাছেও এই রাস্তা অবলম্বন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বাবাকে মাহিরের কথা বললেও হয়তো সে মেনে নিবে না। কীভাবে মেনে নিবে? মাহির এখনো স্টুডেন্ট। এমনিতেই সমবয়সী প্রেম বা বিয়ে কোনোটাই তার বাবা পছন্দ করে না। তারউপর ছেলে স্টুডেন্ট, বেকার। প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার পাত্র রেখে কোনো বাবা-মাই তার আদরের সন্তান বেকার ছেলের হাতে তুলে দিবেন না কেবল মাত্র ভালোবাসার দোহাই দিয়ে। এই ভাবনাটাও সেহের ভেবেছে। আর ভেবেছে বলেই বারবার চেষ্টা করেও সে বাবাকে মাহিরের কথা বলতে পারেনি। বলতে নিয়েও ফিরে এসেছে। পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কিছু করার নেই সেহেরের হাতে। কিই বা হবে? বড়োজোর বাবা তার মুখ দেখবে না। কতদিনই বা দূরে ঠেলে রাখবে? যখন দেখবে সে ভালো আছে তখন ঠিকই আদর করে কাছে টেনে নিবেন, মাফ করে দিবেন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here