পুনরারম্ভ, পর্ব-৬

0
366

#পুনরারম্ভ। পর্ব-৬
লেখক- ইতি চৌধুরী

অতুল লিফট দিতে চাইলে সেহের আপত্তি করতে নিয়েও পরে আর আপত্তি করে না। কিন্তু পথিমধ্যে আর কোনো কথা হয় না দু’জনার। কীভাবে এই মহা বিপদ থেকে উদ্ধার হবে তা ভাবতে ভাবতেই সময় কেটেছে সেহেরের। সে নিজের চিন্তায় মগ্ন। পাশে বসে থাকা মানুষটাকে আপাতত তার চোখেই লাগছে না। অতুলের গাড়িটা সেহেরের ইউনিভার্সিটির সামনে এসে থামতেই সে বার দুয়েক হর্ন বাজায়। সেই শব্দে ঘোর কাটে সেহেরের। মুখ ঘুরিয়ে অতুলের মুখোপানে তাকাতেই সে বলে,
‘চলে এসেছি।’
পাশ ফিরে উইনডো গলে বাহিরে তাকিয়ে দেখে সে একপলক। কখন এসে পৌঁছে গেল খেয়ালও করেনি। গাড়ি থেকে নামার জন্য ব্যস্ত হলে পেছন থেকে অতুল সেহের বলে ডাকতেই সে থেমে যায়। মুখ ফিরিয়ে তাকালে তার দিকে একটা ভিজিং কার্ড তাক করে বলে,
‘আপনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেলে আমাকে জানাতে ভুলবেন না।’
সেহের আর অপেক্ষা করে না। অতুলের হাত থেকে কার্ডটা নিয়েই হুরমুর করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। কিছু দূর যাওয়ার পরেই আবার কি মনে করে একবার পেছন ফিরে তাকায় সে। তাকিয়েই দেখতে পায় লোকটা তার যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে এখনো। এক মুহূর্ত তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই আবার সামনের রাস্তায় মাপে। ইউনিভার্সিটির মেইন ফটক পেরিয়ে ভেতরে ডুকতেই সেহেরের দেখা হয় মাহিরের সাথে। প্রথমে সে মাহিরকে খেয়াল করেনি। বেচারী এখনো ঘোরের ভেতরেই আছে। এই ঘোর কাটতে তার সময় লাগবে বোঝাই যাচ্ছে। আচমকা কেউ একজন পাশ থেকে হাত ধরতেই থেমে গিয়ে কে হাত ধরে দেখার জন্য মুখ তুলে তাকানোর সাথে সাথেই মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যায় সেহেরের। এতক্ষণ তো মাহিরের কথা তার খেয়ালই ছিল না। এখন তো তাকে মাহিরকে ফেইস করতে হবে। ভেবেছিল সমস্যা সমাধান করে এসে সব জানাবে। কিন্তু সমস্যা তো আরও শক্ত হয়ে খুঁটি গেড়েছে তার জীবনে। মাহিরের কাছে কিছু লুকিয়ে রাখার আর কোনো মানেই হয়।
‘কই ছিলাম তুমি?’
মাহিরের কথার জবাব দিতে পারে না সেহের। গলা দিয়ে কথা বের হয় না তার। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও টেনশনে ঘামতে লাগে সে। সেহেরের কপালে ঘাম দেখে হাত বাড়িয়ে তা মুছে দিয়ে বলে,
‘ঘামছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে?’
মুখে রা করতে পারে না বেচারী। কেবল ডানে বামে মাথা ঝাঁকায়।
‘এতক্ষণ কই ছিলা তুমি?’
সেহের একবার আশেপাশে দেখে নেয়। এখানে অনেক মানুষ। এসব কথা বলার উপযুক্ত জায়গা এটা নয়। মাহির তার ডান হাতটা ধরে রেখেছে। বাম হাত বাড়িয়ে মাহিরের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এবার সেহের নিজে তার হাত ধরে কিছু না বলেই হনহন করে টেনে নিয়ে বেরিয়ে যায়। একটা নিরিবিলি জায়গা প্রয়োজন কথা বলার জন্য।
সেহের মাহিরকে টেনে নিয়ে ইউনিভার্সিটির পেছনের রাস্তা এসে হাত ছেড়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরে। এতটুকু রাস্তা আসার সময় কম করে হলেও বার দশেক মাহির জিজ্ঞেস করেছে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো কিন্তু সেহের জবাব দেয়নি। এখানে এসে দাঁড়াতেই দম না নিয়ে মাহির আবার জিজ্ঞেস করে,
‘তোমার কি হইছে বলবা? আজকে খুব উইয়ার্ড বিহেভ করতেছ তুমি। ঘটনা কী?’
মাহিরের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আর কিছু চিন্তা ভাবনা না করেই সেহের বলল,
‘আব্বু আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলছে।’
মাহির এমনভাবে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে যে তার মুখ দেখে কিছু বুঝা যাচ্ছে না মনের ভেতর কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। মাহিরের পক্ষ থেকে কোনোরকম রিয়্যাকশন পায় না সেহের। বেশ কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে মাহির। বুঝার চেষ্টা করে সেহের আসলে কোনো প্রাঙ্ক করছে না যা বলছে সত্যি বলছে। সেহের হাত বাড়িয়ে মাহিরের একটা হাত ধরতেই সে বলে,
‘প্রাঙ্ক করছ তাই না?’
‘একদমই না। সত্যি বলছি।’
‘কি যা তা বলছ তুমি? কাল রাতেও তো সব ঠিক ছিল। আজ সকালে এমন কি হয়ে গেল?’
‘আজ সকালে নয়। তোমার মনে আছে তিনদিন আগে আমি দুপুরে ক্লাস শেষ না করেই বাসায় ফিরে গেছিলাম। আব্বু বলছিল যাইতে জরুরী দরকার। সেদিনই দুপুরে পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে আসছিল। এমনকি বিয়েও ফাইনাল হয়ে গেছে। ডেটও দিয়ে দিছে। আগামী শুক্রবারের পরের শুক্রবারই বিয়ে।’
‘কি যা তা বলতেছ তুমি সেহের? আমি তোমাকে ভালোবাসি। এটা তোমার বিয়ে করার সময় না। আর এত কিছু হয়ে গেল তুমি এখন আসছ আমাকে বিয়ের দাওয়াত দিতে?’
‘আমি কি করব বলো আব্বুর মুখের উপর আমি কথা বলতে পারি না। আমি তোমাকে বিয়ের দাওয়াত দিচ্ছি না। চেষ্টা তো করলাম কিন্তু…’
‘কি চেষ্টা করছ তুমি? সকাল থেকে কই ছিলা?’
‘পাত্রের সাথে দেখা করতে গেছিলাম।’
‘বাহ এর মধ্যে বাইরে দেখা করাও শুরু হয়ে গেছে?’
‘প্লিজ মাহির আমার কথা শুনো। আমি এমনি এমনি দেখা করতে যাই না। আব্বুর মুখের উপর আমি বলতে পারব না কিছু তাই পাত্রের সাথে দেখা করছি তার হেল্প চাইতে। সে যেন বিয়েটা ভেঙে দেয়।’
‘আর তোমার পাত্র মানে হবু বর কি বলল?’
‘সেও না করে দিছে।’
বার দুয়েক জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে এবার মাহির সেহেরের হাত দুইটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বলে,
‘আমি সত্যি তোমায় অনেক ভালোবাসি সেহের। প্লিজ তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না।’
অসহায় দৃষ্টি নিয়ে মাহিরের দিকে তাকিয়ে রয় সেহের। দু’জনেরই দু গাল বেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো আশংকা অশ্রু বৈতে লাগে। বিচ্ছেদের ভাবনার যন্ত্রণাই যদি এত তীব্র হয় তাহলে বিচ্ছদে হলে তো এর চাইতে মৃত্যুও হয়তো মধুর হবে।

নিজের ঘরের লাইট অফ করে দেয়ালে পা তুলে দিয়ে শুয়ে আছে সেহের। কীভাবে কি করবে কোনো উপায়ান্তর খুঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু কিছু না কিছু একটা তো তাকে করতেই হবে। চিন্তায় বিভোর সেহেরের চিন্তার রেশ কাটে ফোনের রিং টোনের শব্দে। একই অবস্থায় শুয়ে থেকেই পাশে রাখা ফোনটা সে হাতে নেয়। একটা অপরিচিত নম্বর। সাতপাঁচ না ভেবেই কল রিসিভ করে কানে তুলতেই লাইনের অন্যপাশ থেকে বলে,
‘তারপর কি সিদ্ধান্ত নেয়া হলো?’
ফোনটা নামিয়ে নম্বরটা আরেকবার দেখে নেয় সেহের। আবার কানে তুলে জিজ্ঞেস করে,
‘কে বলছেন?’
‘বাহ! সকালে দেখা করে এর মধ্যেই ভুলে গেছেন দেখছি।’
‘ডাক্তার সাহেব!’ বেফাঁস ডাকটা বেরিয়ে যায় সেহেরের মুখ গলে। সামান্য হেসে অতুল বলে,
‘হ্যাঁ ডাক্তার সাহেব বলছি।’
উঠে বসে পরে সেহের। অবাক হয়ে জানতে চায়,
‘আপনি আমার নম্বর কোথায় পেলেন?’
‘একটা নম্বর জোগাড় করা কি খুব কঠিন কিছু?’
‘না তা নয় মানে…’
‘আমার আম্মুকে দিয়ে আপনার আব্বুর থেকে নিয়েছি।’
‘ওহ আচ্ছা।’
‘তো যা জিজ্ঞেস করলাম বললেন না।’
‘কি?’
‘কি সিদ্ধান্ত নেয়া হলো?’
‘কোন সিদ্ধান্ত?’
‘বউ সেজে আমার জন্য অপেক্ষা করা হবে না বাবাকে জানিয়ে দেয়া হবে নিজের পছন্দের মানুষের কথা, কোনটা ঠিক হলো?’
বাবার নাম শুনতেই গলা শুকিয়ে আসে সেহেরের। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে অতুল এবার গলা খাকাড়ি দিয়ে সিরিয়াস কন্ঠে বলে,
‘অন এ সিরিয়াস নোট বলছি। তোমার হাতে সময় আছে কিন্তু আমার হাতে নেই। আমি জানি আমার জায়গা থেকে আমি চাইলেই তোমার হেল্প করতে পারি কিন্তু আমার পক্ষে আমার আম্মুকে ডিনাই করা সম্ভব নয়। তাকে আমি কষ্ট দিতে পারব না। তাই যা করার তোমাকেই করতে হবে। হয় সব ছেড়ে দিয়ে বিয়েটা করা নয় আঙ্কেলকে সব বলা দেয়া। যা করার তোমাকেই করতে হবে। যদি বিয়ে হয় সেক্ষেত্রে আমাকে কিছু প্রস্তুতিও নিতে হবে যেহেতু আমার তাড়া আছে।’
‘কিসের প্রস্তুতি?’
‘আমাদের বিয়ের পর আমার ফার্দার ডিগ্রীর জন্য আমি আমেরিকা যাচ্ছি। আর আমার স্পাউস হিসেবে তুমিও আমার সাথেই যাবে।’
‘বিয়ের পরেই!’
‘আগামী দুই মাসের মধ্যেই।’
‘সামনে আমার ফাইনাল পরীক্ষা।’
‘জানি তোমার পরীক্ষা। সেজন্যই আমি সব ব্যবস্থা করে আগে চলে যাব। তুমি তোমার পরীক্ষা শেষ করে আমার পেছন পেছন যাবে। আমার জন্য তো আর আমি আমার বউয়ের পরীক্ষা মিস করাতে পারি না। একটা লেভেল আছে না।’
‘ওহ!’
‘বিয়ে টা কি হচ্ছে তাহলে?’
‘অবশ্যই না।’
‘তাহলে জানতে চাইলে যে?’
‘কৌতুহল বশত জানতে চেয়েছি। যদি সত্যি বিয়েটা হতো সেক্ষেত্রে কি হতো ব্যস এর বেশি কিছু না।’
‘হুম বুঝলাম। তবে আমি যা বললাম মাথায় রেখো।’
‘আপনি যে ভদ্রতার সীমারেখা পার হয়ে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছেন এটা কি ঠিক হয়েছে?’
‘এটাই কি হওয়ার নয়?’
অতুলের কথার ধরনে কেমন ইতস্তত অনুভব হয় সেহেরের। কথার ইতি টানতে সে বলে,
‘আমি রাখছি।’
‘আরেকটা কথা, যাই করো বা সিদ্ধান্ত নাও চাইলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো। আই উইল অলওয়েজ বি দেয়ার ফর ইউ।’
সেহের আর কথা বলে না। কেমন যেন লাগে তার। মাথা ভার হয়ে আসে। অতুল নিজেই লাইনটা কেটে দেয়। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে ঝিম ধরে বসে থাকে বেচারী। গলার কাটা নামার নাম নিচ্ছে না বরং আরও শক্ত হয়ে আটকে যাচ্ছে।
অতুল লাইন কাটতে না কাটতেই সেহেরের ফোনটা আবার বেজে ওঠে। ফোনের দিকে তাকাতেই দেখে মাহিরের নামটা স্ক্রিনে ভাসছে। এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কলটা রিসিভ করে সে। মাহিনের অশ্রুসিক্ত চোখ জোড়ায়ই ভাসছে তার নয়নে। কলটা রিসিভ করতেই লাইনের অন্যপাশ থেকে মাহির বলে,
‘আমি কিন্তু তোমাকে হারাইতে পারব না।’
বুকের ভেতর হু হু করে ওঠে সেহেরের। এই মানুষটাকে ছাড়া সেও থাকতে পারবে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here