#পুনরারম্ভ। পর্ব-২
লেখক- ইতি চৌধুরী
রিকশা ধানমন্ডি থেকে মোহাম্মদপুরের উদ্দেশ্যে আগাতে থাকে। শংকরের কাছাকাছি আসতেই মাহিরকে আনমনা দেখে সেহের জিজ্ঞেস করে,
‘তোমার মন খারাপ?’
কিঞ্চিৎ আমতা আমতা করে মাহির বলে,
‘ননা তো।’
‘কি হইছে আমাকে বলবা না?’
‘না মানে আসলে…’
‘বলো না।’
‘না আসলে আমার কিছু টাকা দরকার ছিল। হাত একদম খালি। সবে মাত্র বাইশ তারিখ মাসের। এখন বাসায় টাকা চাইলে আম্মু দিবে না। তাই আর কি…’
‘তো এই কথা বলতে এত ইতঃস্তত করার কি আছে? কত লাগবে?’
‘হাজার পাঁচেক হলে ভালো হয় আর কি।’
‘পাঁচ হাজার!’
সঙ্গে সঙ্গেই মাহির আরও বলে,
‘পাঁচ হাজার না পারলে দুই হাজার হলেও আপাতত চলবে।’
‘আচ্ছা দেখছি দাঁড়াও।’ বলেই রিকশাওয়ালা মামাকে উদ্দেশ্য করে সেহের আরও বলে,
‘মামা সামনে কোনো বিকাশের দোকান দেখলে একটু দাঁড়াবেন।’
‘আইচ্ছা।’
সলিমুল্লাহ রোডের শুরুতেই রিকশা দাঁড় করে নেমে যায় সেহের একটা দোকানে বিকাশ থেকে টাকা তুলবে বলে। মিনিট পাঁচেক পর ফিরে এসে মাহিরের দিকে টাকা এগিয়ে দিতেই তার চোখ মুখ চকচক করে ওঠে। মাহির গুনে দেখে সম্পূর্ণ পাঁচ হাজার টাকাই আছে। টাকা মানিব্যাগে পুরতে পুরতে মাহির বলে,
‘এখানে তো পাঁচ হাজারই।’
‘হু, রাখো তুমি।’
‘সব দিয়ে দিলা? তোমার লাগলে?’
‘সমস্যা নেই আমার লাগবে না। আর লাগলে আমি বাসা থেকে নিয়ে নিব। এমনিতেও এটা আমার ব্যক্তিগত টাকা।’
‘আগামী মাসের শুরুতেই দিয়ে দিব তোমাকে চিন্তা করো না।’
‘তোমাকে কি বলছি আমি দিতে হবে। সবসময় বেশি বেশি না করলে হয় না, তাই না?’
‘না মানে…’
‘হইছে আর মানে মানে করা লাগবে না। মামা আপনি চলেন।’
‘দাঁড়াও মামা।’ রিকশাটা থামিয়ে নেমে পরে মাহির। তা দেখে সেহের জিজ্ঞেস করে,
‘নেমে পরলা যে?’
‘এর বেশি গেলে যদি তোমার ফ্যামিলির কেউ দেখে ফেলে তখন?’
‘ওহ! তাও কথা।’
‘বাসায় গিয়ে ফোন দিও। টানেন মামা।’
রিকশাটা কিছু দূর এগিয়ে যেতেই মাহির পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে তার বড়ো ভাই সামির বেশ কয়বার ফোন করেছে তাকে। মোবাইল ফোনটা সাইলেন্ট থাকায় টের পায়নি। তৎক্ষনাৎ ভাইকে কল বেক করে সে। লাইনের অন্যপাশ থেকে সামির কল রিসিভ করে ঝাড়ির সুরে বলে,
‘কতবার ফোন দিছি তোরে মাহির। থাকিস কই তুই?’
‘ক্লাসে ছিলাম ভাইয়া।’
‘ক্লাসে থাকলে গাড়ির শব্দ পাচ্ছি কেন?’
‘আরে ক্লাস শেষ করে বের হয়ে কল দিছি তোমাকে। আমি কি ক্লাসে বসে প্রোফেসরের সামনে দাঁড়িয়েই তোমাকে কল দিব নাকি?’
‘আচ্ছা আচ্ছা বুঝছি। তোর এ্যাকাউন্টটা চেক করে নিস। পনেরো হাজার চেয়েছিল পুরোটাই পাঠিয়ে দিয়েছি।’
‘থ্যাংকিউ ভাইয়া।’
‘হইছে, তবে আব্বু আম্মুকে বলিস না কিন্তু। জানতে পারলে অহেতুক তুলকালাম করবেন। ঢাকায় থেকে লেখাপড়া করার কস্টিংটা আমি বুঝি বলেই তোকে কখনো বাঁধা দেই না কিছুতে। তুই কি করছিস না করছিস এসব ইনফরমেশন নেয়া আমার জন্য কোনো ব্যাপার না। কিন্তু নেই না কারণ একটাই তুই যাই করিস না কেন সেমিস্টার শেষে তোর রেজাল্ট ভালো। শুধু মাত্র তোর রেজাল্টের জন্যই আব্বু আম্মুকে আড়াল করে আমি তোকে সাপোর্ট করি।’
‘জানি তো ভাইয়া। বারবার বলা লাগবে না। রেজাল্ট ভালো আসবে তুমি চিন্তা কইরো না।’
‘চিন্তা করি না আবার করিও। বারবার বলার কারণ একটাই আর কিছুদিন ভালোয় ভালোয় পাশ করে বের হলেই তোকে আমি আমার কাছে জার্মান নিয়ে আসবো। এই কয়টা দিন যাই করিস না কেন খারাপ কিছুতে জড়ায় যাইস না প্লিজ ভাই আমার। তোর ভবিষ্যৎ নষ্ট হয় এমন কিছু করিস না এটাই রিকুয়েষ্ট।’
‘তুমি একদম চিন্তা কইরো না ভাইয়া। তোমরা কষ্ট পাও এমন কিছুই আমি কখনো করব না। এখন রাখছি ভাইয়া। খুদা লাগছে কিছু খাবো। এরপর আরেকটা ক্লাস আছে আমার। রাখলাম।’
ভাইকে আর কিছু বলতে না দিয়ে কলটা কেটে দেয় মাহির। এতক্ষণ ওয়েটিংয়ে থাকা বড়ো আপুর কলটা রিসিভ করে সে। কল রিসিভ করতেই বাজখাঁই কন্ঠে মাহিরের বোন মাহিয়া বলে,
‘কিরে তুই! এতক্ষণ কার সাথে দিনদুনিয়ার প্যাঁচাল পাড়তেছিলি? খেয়াল আছে কতক্ষণ থেকে কল দিচ্ছি?’
‘আম্মুর সাথে কথা বলতেছিলাম আপু। আম্মুকে যদি বলতাম তুমি ফোন দিচ্ছো তাহলে হাজারটা প্রশ্ন করে জেরা করতো আমাকে। তখন কি বলতাম বলো?’
‘আচ্ছা বুঝছি। এখন সত্যি করে বলতো দশ হাজার টাকা দিয়ে কি করবি তুই?’
‘তোমারে তো বলছিই আপু। অনেকদিন শপিং করা হয় না। আব্বু আম্মুর কাছে চাইলে বলবে এখন দরকার নাই। তুমি না পারলে সমস্যা নাই।’
‘এ্যাকাইন্ট চেক করে নিস পাঠায় দিছি। আর শুন তোর দুলাভাইকে বলছিলাম হতে পারে ও তোকে কিছু টাকা পাঠাবে। ফোন টোন দিলে কিন্তু ভুলেও বলবি না আমি তোকে টাকা পাঠছি। আর যদি
কিছু পাঠায় নিয়ে নিস। শরম লজ্জা করার কোনো প্রয়োজন নাই।’
‘তুমি আবার দুলাভাইকে বলতে গেছ কেন?’
‘কেন বলছি সেটা আমি বুঝবো। তোকে যা বললাম তাই করবি। বুঝতে পারছিস?’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। এখন রাখছি আপু ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।’
বোনের কলটা কেটেই আবার আরেকটা নম্বর ডায়েল করে মাহির। লাইনের অন্যপাশ থেকে কল রিসিভ হতেই মাহির বলে,
‘দোস্ত সব টাকা ম্যানেজ হয়ে গেছে। রেডি থাক তুই আমি আসতেছি জিনিস আনতে যাব।’
ইদানিং খুব বাজে রকমের একটা গরম পরেছে। পথে ঘাটে বেরিয়েছে না কি ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। বাসায় ফিরেই শাওয়ার নিয়ে নেয় সেহের। শাওয়ার নিয়ে বাথরুম থেকে বের হতেই দেখে তার বিছানার উপর একটা হালকা কমলা রঙা কাতান শাড়ি রাখা। এই অসময়ে বিছানায় শাড়ি দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয় সে। বাসায় ডুকে আয়োজন দেখেই বুঝতে পেরেছিল হয়তো মেহমান আসবে। কিন্তু তার ঘরে শাড়ি রাখার কাহিনি ঠিক বুঝতে পারছে না। শাড়িটা তুলে হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে কিচেনের দরজায় এসে মাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে,
‘আমার বিছানায় শাড়ি রাখছ কেন আম্মু?’
পেছন ফিরে মেয়েকে দেখে কামরুন্নাহার বলেন,
‘বেরিয়েছিস, শাড়িটা তোর জন্য। পরে তৈরি হয়ে নে।’
‘হঠাৎ শারি পরতে বলছ ঘটনা কি আম্মু?’
‘তোকে বলা হয়নি, আজ পাত্রপক্ষ আসবে তোকে দেখতে।’
‘কি!’ হুট করে মায়ের মুখে এমন কথা শুনে হাত থেকে শাড়িটা পরে যায় সেহেরের। কামরুন্নাহার মেয়ের দিকে তাকিয়েই থাকেন। মাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সেহের নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
‘আমাকে আগে কিছু বলো নাই কেন আম্মু?’
পেছন থেকে সেহেরের বাবা শাহরিয়ার সাহেব এগিয়ে এসে শাড়িটা তুলে নিয়ে বলেন,
‘আমি তোমার আম্মুকে বারন করেছিলাম তোমাকে আগে থেকে কিছু বলতে।’
আচমকা বাবাকে দেখেই গলায় শুকিয়ে আসতে লাগে সেহেরের। পৃথিবীতে এই একজন মানুষ যাকে যমের মতো ভয় পায় সে। শাহরিয়ার সাহেব রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। চার ছেলে মেয়ের মধ্যে সেহের তৃতীয়৷ চারজনই বাবাকে প্রচন্ড রকম ভয় পায়। কিন্তু সেহেরটা যেন একটু বেশিই ভয় পায় বিনা কারণেই। আরেকবার নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করে সেহের টেনে টুনে বলে,
‘কি কিন্তু আআব্বু আমার তো এএখনো পড়ালেখা…’
মেয়েকে কথা শেষ করতে না দিয়ে শাহরিয়ার সাহেব বলেন,
‘আজ তারা কেবল তোমাকে দেখতে আসছে। দেখলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না। যাও তৈরি হয়ে নাও। তারা যেকোনো মুহূর্তে এসে উপস্থিত হবেন।’
আর একটা শব্দও বের হয় না সেহেরের গলা দিয়ে। বাবা নামক যমদূতকে সে এতটাই যমের মতো ভয় পায় যে বাবার সামনে মুখ দিয়ে কথাই বের হয় না বেচারীর।
আর কোনো বাক্য ব্যয় ছাড়াই নিজের ঘরে ফিরে আসে সেহের। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে পরে হতাশ চেহারা নিয়ে। চিন্তায় এখনই পেটের ভেতর পাক দিয়ে আসে। মনে হচ্ছে হরহর করে বমি হয়ে পেটের ভেতর যা আছে সব বেরিয়ে আসবে। পরমুহূর্তেই আবার মনে হয় সেই সকালে খাওয়া হয়েছিল তার। এরপর এখনো কিছু খাওয়া হয়নি। পেটের ভেতর নাড়িভুঁড়ি ব্যতীত বেরিয়ে আসার মতো কিছু নেই।
‘কিরে আপু এখনো শাড়ি পরিসনি? জলদি কর।’
পেছন থেকে ছোট বোন সোনিয়া তাগাদা দেয় সেহেরকে। মুখ তুলে মিরর দিয়েই বোনের দিকে তাকায় সে। আবার চোখ নামিয়ে শাড়িটা দেখে। চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয় তার কপাল জুড়ে। ড্রেসিং টেবিলে রাখা নিজের মোবাইল ফোনটা তুলে হাতে নেয়। বিষয়টা মাহিরকে জানাবে বলে। কিন্তু আবার ভাবে এখনো তো কিছুই হয়নি। বাবার বলা কথাটাও মস্তিষ্কে আলোড়ন সৃষ্টি করে। দেখতে আসলেই যে বিয়ে ঠিক হয়ে যায় তেমনটাও নয়। হতে পারে তাকে পছন্দ হলো না বা পাত্রকে তার বাবার পছন্দ হয়নি। কিছু না হওয়ার আগেই অহেতুক মাহিরকে এসব জানিয়ে অযথা চিন্তা দেয়ার কোনো মানেই হয় না। নিজেও চিন্তা করাটা অহেতুক জেনেও চিন্তা হয় সেহেরের। চিন্তার ছাপ কপালে টেনে নিয়েই উঠে দাঁড়ায় শাড়ি পরে তৈরি হবে বলে। তৈরি হবো না বা পাত্রপক্ষের সামনে যাবো না এ জাতীয় প্রতিবাদ করার সাহস তার নেই। বরং এধরনের কথা বলায় বাবা যদি একটা ধমক দেয় তাতেই কেঁদে কেটে চোখের নাকের পানি এক করে ফেলবে সে।
চলবে…