#পুতুল_খেলা
#পর্বঃ৮
#লেখিকাঃদিশা মনি
রিপ্তিকে সবার সাথে এরকম ব্যবহার করতে দেখে একজন খুব খুশি হয়। কারণ তার পরিকল্পনা যে সফল হতে যাচ্ছে। আয়নার সামনে দাড়িয়ে বলে,
‘আমিই এই খেলার মাস্টার মাইন্ড। সবকিছু আমার মনমতোই হচ্ছে। আমি যখন যাকে যেভাবে চাইছি সেভাবে পুতুল নাচ নাচাচ্ছি। সবাইকে নিয়ে খেলছি আমিই। অথচ আমিই কিরকম পর্দার আড়ালে আছি। এখন আমার এই খেলায় নতুন গুটি রিপ্তি। মেয়েটাকে প্রথমদিকে অবলা ভেবেছিলাম। এখন দেখছি ও ছিল একটা টাইম বো’ম। এই রিপ্তিকে দিয়েই এখন আমি সবকিছু আদায় করব। ওর বাবা-মাকেও তো আমিই মে’রে ছিলাম। এখন ওকে ভুল বুঝিয়ে ওর থেকে ওর বাবার সব সম্পত্তি নিজের করে নিতে হবে। ব্যাস তখন আর আমাকে দেখে কে? তার আগে এই মোর্শেদ,আমান,সিরাজ আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সিতারা বেগম,,,এদের একটা ব্যবস্থা করতে হবে৷ তাহলেই আমার রাস্তা একদম ক্লিয়ার।’
কথাটা বলেই অট্টহাসিতে মেতে ওঠে।
১৫.
রিপ্তি রান্নাঘরে আসে। চারিদিক ভালো করে দেখে কেউ তাকে দেখছে কিনা। আশেপাশে কেউ নেই এটা নিশ্চিত হয়ে কাউকে একটা ফোন করে রিপ্তি। ফোনটা রিসিভ করতেই রিপ্তি বলে,
‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করে আপনার কথামতো সব করছি। এখন আপনি বলুন এরপর কি করব।’
বিপরীত দিক থেকে উত্তর আসে,
‘তুমি এবার ঐ সিতারার একটা ব্যবস্থা করো। ঐ বুড়ি থাকলে তুমি কখনো নিজের বাবার খু’নি পর্যন্ত পৌছাতে পারবে না। ঐ বুড়ি সবকিছু যত্ন সহকারে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। যদি কোনভাবে বুড়িকে সরাতে পারো তাহলে তুমি আস্তে আস্তে সব জানতে পারবে।’
‘সেটা কিভাবে সম্ভব?’
‘সম্ভব। তুমি মোর্শেদকে ব্যবহার করে বুড়িকে সরাতে পারো। ঐ মোর্শেদের সাথে বুড়ির খুব ভাব। নিজের ছেলে না হলেও বুড়ি মোর্শেদকে অনেক ভালোবাসে। যদি কোনভাবে ওদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করতে পারো তাহলেই তুমি সফল হবে।’
‘আমাকে কোন উপায় বলে দিন।’
বিপরীত দিক থেকে ভেসে আসে ষড়যন্ত্রের মন্ত্র। রিপ্তি বাকা হেসে বলে,
‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। এবার আমি আপনার কথামতোই সব কাজ করব।’
ফোনটা কে’টে দিয়ে বিপরীত পাশের মানুষটা বলে,
‘বোকা মেয়ে। তুমি আমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে যে নিজের কতো বড় বিপদ ডেকে আনছ সেটা বুঝতে পারছ না। আমাকে বন্ধু ভেবে যাদের শত্রু মনে করে দূরে ঠেলে দিচ্ছ, তারাই আসলে তোমার বন্ধু। আর আমি,,,, আমিতো তোমার সবথেকে বড় শত্রু। হা হা হা।’
রিপ্তি ফোনটা কে’টে দিয়েই চলে আসে আমানের রুমে। আমান তখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সে আমানের লকার চেক করে। লকারের চাবি খোজার জন্য আমানের কাছাকাছি চলে আসে রিপ্তি। কাল দেখেছিল আমান নিজের বালিশের নিচ লকারের চাবি রেখেছিল। যখন রিপ্তি আমানের কাছাকাছি এসে চাবিটা নিতে যায় তখনই আমান তাকে ধরে ফেলে।
ভয়ে ঘামতে শুরু করে রিপ্তি। আমান রেগে না গিয়ে শান্ত গলায় বলে,
‘কি চাও তুমি? কেন এসেছ আমার কাছে?’
রিপ্তি একটু সাহস পায়।
‘সেই কৈফিয়ত দিতে আমি কারো কাছে বাধ্য নই। আমাকে আপনার লকারের চাবিটা দিন।’
‘যদি না দেই।’
‘আপনাকে দিতেই হবে।’
‘আগে বলো কেন চাও।’
‘মোর্শেদ,,,,’
‘লকারের প্রয়োজন নেই। আমি তোমাকে মোর্শেদের ব্যাপারে সবকিছু বলব। তুমি আমার সাথে যেমন ব্যবহারই করো, আমি তোমাকে নিজের স্ত্রী মানি। তাই আমি তোমার থেকে কিছু লুকাতে চাইনা।’
‘আমি কিভাবে আপনাকে বিশ্বাস করবো?’
‘এইমূহুর্তে আমাকে বিশ্বাস করা ছাড়া ভালো কোন অপশন কি তোমার কাছে আছে?’
রিপ্তি মাথা ঝাকিয়ে না বলে। আসলেই তার কাছে কোন অপশন নেই। আমান মৃদু হেসে বলে,
‘মোর্শেদ আমাদের জীবনের অত্যন্ত গোপন একটা অধ্যায়। যেই কথা আমি আগে কখনো কাউকে বলিনি আজ প্রথম তোমাকে বলছি।’
রিপ্তি চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করতে থাকে আমানের থেকে সবকিছু শোনার জন্য। আমান একটু থেমে বলে,
‘এই বাড়িতে দেয়ালেরও কান আছে। তাই এখানে কোনকিছু বলা ঠিক হবে না। তুমি আমার সাথে চলো। বাইরে কোথাও গিয়ে তোমাকে আমি সব বলব।’
‘আচ্ছা চলুন।’
১৬.
আমানের সাথে একটি রেস্টুরেন্টে এসে বসে আছে রিপ্তি। রিপ্তি অধৈর্য হয়ে বলে,
‘এই নিন বাড়ির বাইরে এসে গেছি। এখন কি বলতে চান বলুন। ‘
‘রিল্যাক্স। এই নাও আগে পানি খাও আমি সব বলছি তোমায় মোর্শেদের ব্যাপারে।’
রিপ্তি পানি খেয়ে নেয়। আমান বলতে শুরু করে,
‘জানো রিপ্তি, আমাদের না অনেক সুখী একটা পরিবার ছিল। আমি, আব্বু-আম্মু, সিরাজ ভাইয়া আমাদের এই চারজনের খুব সুখের ঘর ছিল। আমার আব্বু একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তার ছিল অঢেল সম্পত্তি। ছোটবেলা থেকে কোন কিছুর অভাব ছিলনা। আমরা দুই ভাই ভাবতাম আমরা হয়তো এই পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে সুখী। ছোট ছিলাম তো তাই বুঝিনি আমাদের চোখে রঙিন চশমা লাগিয়ে রাখা হয়েছিল। যত বড় হতে থাকি আমরা বুঝলাম পারি যে, বাস্তবে আমরা যতোটা সুখী ভাবি ততোটা সুখি নই। বিশেষত আমাদের আম্মু। আম্মুকে ছোটবেলা থেকে দেখেছি দামি শাড়ি,দামি গহনা পড়তে। ভালোমন্দ খাওয়া-দাওয়া করতে। তাই ভেবেছি সে খুব খুশি৷ যখন সবকিছু বুঝতে শিখলাম তখন দেখলাম আম্মু আসলে কতোটা দুখী। সারাদিন বাড়ির সব কাজ করার পর আম্মুকে আব্বুর খোটা শুনতে হয়। মাঝে মাঝে আব্বুর হাতে মা’র খেতে হয় আম্মুকে। সেটা কোন সাধারণ মা’র নয়। আব্বু যখন মা’রে আম্মুর অবস্থা তখন মৃতপ্রায় হয়ে যায়। শুধুমাত্র আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আম্মু সবকিছু সহ্য করে। সিরাজ ভাইয়া বরাবরই আব্বুর খুব ভক্ত। তাই তার এসব নিয়ে সেরকম মাথাব্যথা ছিলনা। বাট আমি আম্মুর এইসব কষ্ট দেখে নিজেও খুব কাদতাম। এভাবে সবকিছু চলতে থাকে। আমি যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে কলেজে ভর্তির প্রিপারেশন নেই তখনই জানতে পারি এক কঠিন বাস্তব। যা মুহুর্তে আমাকে ভেঙে চুরে শেষ করে দেয়। আমার আব্বুর একমাত্র স্ত্রী আমার আম্মু নয়। তার আরো একজন স্ত্রী আছে। সেই স্ত্রী গ্রামে থাকে। যেদিন প্রথম এটা জানতে পারি সেদিন খুব কষ্ট পাই। বাড়িতে এসে আম্মুর গলা জড়িয়ে কেদেছিলাম। আম্মু অনেক কষ্টে আমাকে সামলায়। একদিন হঠাৎ করে আম্মু আমায় বলল, আমাদের গ্রামের বাড়িতে যেতে। সেখানে নাকি কোন বড় সমস্যা হয়েছে। আমি গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখি একজন মহিলার লাশের পাশে বসে কাদছে দুটো বাচ্চা। আমি অবাক হয়ে দেখি সবকিছু। আমার দাদি এগিয়ে এসে বলে, যে মহিলাটা মারা গেছে তিনি নাকি আমার সৎমা। আর যে দুটো ছেলেমেয়ে আছে তারা আমার সৎ ভাইবোন। আমি তখনো কিছু বুঝতে পারিনি আম্মু কেন আমায় এখানে পাঠালো। মহিলার দাফনের পর আম্মু আমায় ফোন করে বলল ওনার বাচ্চা দুটোকে নিয়ে আসতে। আমি নিয়ে যেতে চাইনি কিন্তু আম্মু এতবার করে বলেছিল যে ফেলতেও পারিনি। শেষপর্যন্ত ঐ দুই ভাইবোনকে নিয়ে বাড়িতে আসলাম।’
রিপ্তির কাছে এখন সবকিছু পরিস্কার হয়। শুধু সে এটা বুঝতে পারে না যে,
মোর্শেদ যদি আমানের সৎ ভাই হয়। তাহলে তার বোন, মানে সেই মেয়েটা কোথায় এখন?
আমান সেটা বুঝতে পেরে বলে,
‘তুমি নিশ্চয়ই মোর্শেদের বোনের ব্যাপারে ভাবছ। আসলে,,,,’
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨