#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৯
পারিজার কাছে যুক্তিতে হেরে গিয়ে চুপ হয়ে গেল ওয়াহেদ। কয়েকদিন ওয়াহেদের সঙ্গে কথাও বললো না পারিজা। পারিজার অবহেলা সইতে না পেরে আদা জল খেয়ে নামলো ওয়াহেদ। শাশুড়ীর জন্য একটা ভালো ছেলে না খুঁজলে। তাঁকেই সংসার ছেড়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরতে হবে।
বাড়িতে ওয়াহেদ নিজেই ঘটক ডেকে নিয়ে এলো। পারিজা ঘটকের সঙ্গে কথা বলতেই ঘটক মেয়ের বয়স জিজ্ঞেস করলো। পারিজা নিজের মায়ের বয়স বলতেই ঘটকের চক্ষু চরক গাছ! এত বয়স্ক মহিলার আবার বিয়ে! পারিজা ঘটকের কথা শুনে বিন্দুমাত্র লজ্জাও পায়নি। নিজে থেকে দমেও যায়নি। ঘটক কয়েক জায়গায় খুঁজে খুঁজে কয়েকটা প্রস্তাব এনেছে। ওয়াহেদ পারিজাকে বলামাত্রই পারিজা পাত্রের সম্পর্কে জানতে চাইলো। ওয়াহেদ বিস্তারিত খুলে বললো। দেখা গেল শেষে একটা পাত্রকেও পারিজার পছন্দ হয়নি।
ওয়াহেদ দিনের পর দিন চেষ্টা করেই যাচ্ছিল। পারিজা নিজের সবটা দিয়ে আপ্রান চেষ্টা করছিল পাত্রকে যাচাই বাছাই করনে। এসব থেকে সবচেয়ে দূরে ছিল তৃণলতা। তৃণলতা এসবের কিছুই জানে না। পারিজা নিজেই তৃণলতার কাছ থেকে সবটা গোপন করে গেছে।
শেষে ঘটক একটা প্রস্তাব নিয়ে এলো। ভদ্রলোক বিপত্নীক, কিন্তু বেশ শিক্ষিত।একটা ছেলে আছে। ছেলে তাঁর বউ নিয়ে সুদূর প্রবাসে। মাঝেসাঝে এসে বাবার সঙ্গে দেখা করে দিন কয়েক থেকে আবার চলে যায়।একাকিত্ব ঘুচাতে নিজেই আবার কোনো অসহায় নারীকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক। পারিজার এই ব্যাপারটা সবচেয়ে অসাধারণ লাগলো। তৃণলতার বরাবরই সংসারের শখ। নিজের একাকিত্ব বোধ নিয়েই সারাজীবন কুড়ে কুড়ে কষ্ট পেয়েছে সে। এবার একটা সঙ্গী পেলে মন্দ হতো না। পারিজা নিজে থেকেই ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করলো।
পারিজা আর ওয়াহেদ ঘটকসহ ভদ্রলোকের বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলো। বাড়িটা খুব সুন্দর। লোকটির রুচির প্রশংসা করতেই হয়। পারিজা নিজ থেকেই কথা শুরু করলো। লোকটি জানালেন তাঁর নাম হায়দার গাজী। বিপত্নীক হয়েছেন বহুদিন যাবত। ছেলে অনেকবার বলেছে তাদের সঙ্গে চলে যেতে। কিন্তু, অন্যের দেশের মরেও শান্তি নেই। তাই নিজ ইচ্ছায় এখানেই থেকে গেছেন তিনি। পারিজা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তৃণলতার শুরু থেকে শেষটা খুলে বলতেই হায়দার সাহেব বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন পারিজার দিকে। উৎফুল্ল কন্ঠে বললেন,
— তুমি কোন ধাতুতে তৈরি মা! এমনও মানুষ হয়? নিজের মায়ের কথাও তুমি এতোটা ভাবো?”
পারিজা লজ্জামাখা হাসি দিয়ে মাথা নুয়ালো।
পারিজা বাড়ি ফিরে তৃণলতাকে সবটা খুলে বললেই তৃণলতা রাগে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
— পারিজা! এসব বাড়াবাড়ি আমার ভালো লাগে না! এক পা কবরে রেখেছি। এখন নাতী নিয়ে খেলার বয়স। এটা বিয়ের বয়স নাকি?”
পারিজা তৃণলতার কাছে গিয়ে বললো,
— নাতী নিয়ে খেলার সময় এখনও অনেক আছে। আগে তোমার বিয়ে দেবো তারপর সব হবে।”
পারিজা কনো কিছু শুনতে নারাজ। সে মায়ের বিয়ে দেবেই! নিজেই হায়দার সাহেবের সঙ্গে কথা বলে বিয়ের দিনক্ষন ঠিক করলো। তৃণলতা নানাকিছু বলে দিব্যি দিয়ে পারিজাকে থামানোর চেষ্টা করলো। মরার দিব্যি, বিষ খাওয়ার দিব্যি। তবুও পারিজার কোনো হেলদোল নেই। পারিজা যেন অন্তহীন। কারো কথা শুনতে রাজি নয় সে।
একদিন বিষের বোতল সামনে নিয়ে তৃণলতা পারিজাকে ভয় দেখাচ্ছিল। পারিজা তৃণলতাকে জবাবে বলেছিল,
— আম্মা তুমি মরে গেলে মরে যাও। তোমার লাশটাকেও যদি বিয়ে দিতে পারি তবুও আমার শান্তি। ”
শেষমেশ বিয়ের দিনটা চলেই এলো। হায়দার সাহেব এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন এলো বিয়েতে। সঙ্গে পারিজা ওয়াহেদ আর নিতিন। কাজী সাহেব আর সাক্ষী ব্যাতীত বাড়তি কোনো মানুষকে পারিজা জানায়নি। তৃণলতার লজ্জায় মরমর অবস্থা। পারিজার হাতে পায়ে বহুবার ধরেছে সে। পারিজা জোর করেই সাজিয়ে গুজিয়ে নিয়ে গেছে তৃণলতাকে। হায়দার সাহেব বাড়িতে ঢোকা মাত্রই পারিজা বলে উঠলো,
— এত দেরি করলেন যে বাবা!”
হায়দার সাহেব সহ উপস্থিত সকলেই চমকে উঠলো। কী সুন্দর সম্মোধন!
বিয়ে হওয়ার পরে ওয়াহেদের নিয়ে আসা খেজুর বিতরন করলো পারিজা নিজহাতে। ওয়াহেদের কোলে থাকা নিতিনের হাতেও একটা খেজুর পুড়ে দিলো পারিজা। হায়দার সাহেব ওয়াহেদের কোল থেকে নিতিনকে কোলে নিয়ে বললেন,
— এটাকে নাতী নাকি?”
পারিজা মুখ টিপে হাসলো। হায়দার সাহেব নিতিনের গাল টিপে দিয়ে বললেন,
— আমার নাতীর ভাগ্য দেখেছো? বাবা মায়ের বিয়েতে সে থাকুক আর না থাকুক। নানা নানুর বিয়েতে সে কিন্তু প্রধান অতিথি! এই আমার নাতীকে কেউ মিষ্টি দাও!”
হায়দার সাহেবের কথা শুনে তৃণলতাও ঘোমটার আড়ালে হেসে ফেললো। পারিজা হেসে নিতিনের গালে চুমু খেলো। পারিজার চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু জল। অতি সুখের সময়েও নাকি মানুষ কেঁদে ফেলে। পারিজা নিজেই আজ বিষয়টা টের পেল।
সমাপ্ত…