#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৮
সুগন্ধার মৃত্যুতে ক্ষনিকের জন্য সব কিছু থেমে গেলেও পরবর্তীতে আবার নতুন ঝামেলা শুরু হলো। ইতিমধ্যে ওয়াহেদ নিজেও সরে পরতে চাচ্ছিলো। নিজের বরাদ্দকৃত জমিতে বাড়ি তুলে সেখানে থাকতে চেয়েছিল। পারিজার নিজেও এতেই রাজি ছিল। এখন কোনো পিছুটান নেই এই বাড়িতে। তাই, এখানে থাকা যা না থাকাও তা। কিন্তু, এহমাদ এতে রাজি নয়। বড় জমিদারী ওই বাড়িটাতে তিনটা ভাগ করে। নিজেদের মতো দেয়াল তুলে নিলো। ওয়াহেদ মাহমুদ দুজনেই নিজেদের প্রাপ্য ভাগ পেল।শেষে তাঁরাও এহমাদের মতো একই পথ অবলম্বন করলো।
বাড়ির ভেতরে নতুন করে সব রঙ করা হলো। পারিজাদের ভাগে পরেছে বড় বেলকনির সাইডটা। পেছনেই বড় তাল তলার পুকুর। পুকুর নিয়ে পারিজা অবশ্য একটু শঙ্কিত ছিল। নিতিন যদি খেলতে খেলতে পানিতে পরে যায়? ওয়াহেদ বাড়ির ঘরগুলো ভেঙ্গে নতুন করে ভেতরে দেয়াল তুলে নিজের পছন্দ মতো ঘর তুলে নিলো। বেলকনির ঘরটা অবশ্য আগের মতোই রইলো। পারিজা দিনরাত বেলকনিতে পরে থাকে। তাঁর সঙ্গে সঙ্গী হিসেবে থাকে ছোট্ট নিতিন। ছোট ছোট হাত দিয়ে সে মায়ের সঙ্গে গল্প করে। পুরোপুরি কথা বলতে শেখেনি এখনও। কিছু শব্দ বলতে শিখেছে। এক বছর হয়েছে তাঁর সবে। তাই, নতুন নতুন শব্দ এখনও সে শিখছে। তবে,নিতিন ভীষণ দুষ্টু। হাতের কাছে যাই পায় বেলকনি থেকে সবটা ফেলে দেয়।পারিজা রাগে মাঝেমধ্যে বকা দিলে গাল ফুলিয়ে কেঁদে ওঠে।
পারিজার এখন ভীষণ একা একা লাগে। আগে কথা বলার মতো মানুষ ছিল। মেজো বউ ছিল;টপা ছিল। মেজো বউ এখন নিজ সংসারে ব্যস্ত। টপাও সুগন্ধা মৃত্যুর কিছুদিন পরেই কাজ ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। তৃণলতার সঙ্গে নিতিনের জন্মের পরে আর দেখা হয়নি। মাঝখানে বেশ কয়েকবার চিঠি দেওয়া নেওয়া হয়েছে। এখন আর চিঠে দিয়ে আসার মতো লোক নেই। তাই পারিজা মাকে চিঠিও লিখে পাঠাতে পারে না। আগে টপা ছিল সে এই কাজটা খুব বিশ্বস্ততার সহিত করেছে। এখন বলতে গেলে সেরকম কেউ নেই।
ওয়াহেদ সন্ধ্যার পর বাড়ি ফেরে। নিতিন ছোট বাচ্চা। তাঁরও কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। এই খাওয়া তো এই ঘুম। পারিজা অনেকদিন আগে থেকেই একটা কথা ভাবছে। ওয়াহেদকে আর মুখ ফুটে বলার সাহস হয়নি।
পারিজা সাহস নিয়ে ঘরে গিয়ে দেখলো ওয়াহেদ সবে হিসাবের খাতা খুলে বসেছে। বিছানায় নিতিন এলোমেলো হয়ে ঘুমাচ্ছে। পারিজা ঘরে গিয়ে বললো,
— ওয়াহেদ তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল। বলবো বলবো করে আর বলা হচ্ছে না। ”
ওয়াহেদ পারিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
— হুম বলো পারিজা।”
পারিজা ওয়াহেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— আম্মার এখন বয়স হয়েছে ওয়াহেদ। আমি আম্মাকে আমার কাছে রাখতে চাই।”
ওয়াহেদ নিজের কাজের দিকে যতটুকু মনোযোগী ছিল তা ছেড়ে বললো,
— তোমার আম্মা তুমি ভালো বুঝবে। আমি আর এসবে মাথা ঘামাতে চাই না।”
পারিজা ওয়াহেদের দিকে দৃষ্টি রেখে উঁচু গলায় বললো,
— আম্মাকে কাল কে নিয়ে আসবে?”
ওয়াহেদ কিছুক্ষন ভেবে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
— আমি নিয়ে আসবো গিয়ে। মাকে পেয়ে আবার আমাকে ভুলে বসো না যেন।”
পারিজা মুচকি হাসলো।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই ওয়াহেদ তৃণলতাকে নিয়ে আসতে গেল।
তৃণলতা ওয়াহেদকে দেখে প্রথমে খানিকটা চমকে গেল। ওয়াহেদ যখন বললো পারিজা তাঁকে নিয়ে যেতে বলেছে। তৃণলতার আনন্দে আত্মহারা অবস্থা! খুশিমনে ওয়াহেদের সঙ্গে সে চলে এলো পারিজার সঙ্গে দেখা করার জন্য। সঙ্গে কিছু কাপড় আর নিতিনের জন্য কিছু জিনিস।
পারিজা তৃণলতাকে ওয়াহেদের সঙ্গে দেখে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। এক ছুটে দৌড়ে গেল মায়ের কাছে। তৃণলতা মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে নিতিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছোট বেলার পারিজার মতো গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে আছে সে। তৃণলতা আদর করে নিতিনকে কোলে তুলে নিলেন। আদরে আদরে ভরিয়ে দিলেন কচি মুখটাতে।
সারাটাদিন তৃণলতার বেশ ভালোই কেটেছিল পারিজার সঙ্গে। সাথে নিতিন তো আছেই। নাতীর সঙ্গে দুষ্টুমি খুনসুটি আর মেয়ের সঙ্গে গল্প। এমন একটা দিনের অপেক্ষায়ই যেন পথ চেয়েছিলেন তৃণলতা।
— জামাই তোমাদের ভালোবাসে তোমাদের অনেক তাই না? তোমার একবারের কথায়ই এক ছুটে আমাকে গিয়ে নিয়ে এলো!”
পারিজা মায়ের কথা শুনে ক্ষীন হাসলো। এর পেছনে ঠিক কতটা দুঃখ কষ্টের গল্প আছে সেটা তৃণলতার অজানা। পারিজা কখনো চায়নি তৃণলতা এসব সম্পর্কে কিছু জানুক। পারিজা মাথা নাড়িয়ে বললো,
— হুম খুব।”
তৃণলতা নিতিনকে আবার আদর করতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। পারিজা উৎসাহের স্বরে মাকে বললো,
— আম্মা, এখন তোমার বয়স হয়েছে। ওই বাড়িতে কে দেখবে তোমাকে? ঝি চাকরই বা কয়দিন দেখবে? তুমি এখন থেকে এখানেই থাকবে। আমি কথা বলেছি তোমার জামাইয়ের সঙ্গে। সেও ঠিক একই কথাই বলেছে। এখান থেকে চলে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলে সেই ইচ্ছে তুঙ্গে তুলে রাখো। তোমায় আর আমি যেতে দিচ্ছি না।”
তৃণলতা মুখে কিছু বললেন না। মেয়ের পাশে বসে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদঁতে শুরু করলেন। পারিজা নানাভাবে সান্ত্বনা দিলেও তৃণলতা মেয়ের কোলে মাথা রেখে কেঁদে ফেললেন। তিনি রত্নগর্ভা! মেয়েটাকে সত্যিই মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে পেরেছেন।
বাড়ি যতই ভাগ হোক না কেন ভাই ভাইয়ের সম্পর্ক এখনও তেমনই। চায়ের দোকানে এখনও রোজ আড্ডা দেয় ওয়াহেদ আর মাহমুদ। এহমাদ অবশ্য ব্যস্ত মানুষ। তাঁর আবার এত সময় কোথায়?
আজ কথার মধ্য দিয়ে হঠাৎ মাহমুদ ওয়াহেদকে উদ্দেশ্য করে তাচ্ছিল্যের সুরে সকলের সামনে বললো,
— ভাই আমার আজ এক মহৎ কাজ করে ফিরেছেন। তাঁর নোংরা দেহ ব্যবসায়ী শাশুড়ীকে আজ বরন করে ঘরে তুলেছেন! আমার ভাই কত বড় মন নিয়ে চলাফেরা করেন! একই মনে বউ আর শাশুড়ী। ”
উপস্থিত সকলেই গলা তুলে হেসে উঠলো। ওয়াহেদ লজ্জায় সেই স্থান হতে প্রস্থান করলো।
রাতে শোয়ার পূর্বে পারিজা বললো,
— আমি আম্মাকে এখানে কেন এনেছি তুমি জানো?”
ওয়াহেদ না জানার ভঙ্গিতে মুখ বাঁকিয়ে বললো,
— কেন?”
পারিজা ওয়াহেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— আমি আম্মার আবার বিয়ে দিতে চাই। সেখানে গিয়ে এসব ঝামেলা করা সম্ভব না। তাই, এখানেই আম্মাকে নিয়ে এসেছি।”
ওয়াহেদ চমকে ওঠার ভঙ্গিতে চিৎকার করে বললো,
— তুমি কী হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছো পারিজা? আমার নাম ডোবানোর ষড়যন্ত্র করছো তুমি! পাড়াতে ছিছি পরে যাবে পারিজা। আমি আর কাউকে মুখ দেখাতে পারবো না! আম্মা এখানে থাকছে থাকুক। তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু বিয়ের ব্যাপারটা একেবারে বাড়াবাড়ি হয়ে যায় পারিজা।”
পারিজা শক্ত গলায় বললো,
— কেন বাড়াবাড়ি কেন হবে? আর লোকে ছি ছি কেন করবে? পুরুষ মানুষ দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারলে নারীরা কেন পারবে না? আমি আমার আম্মার আবার বিয়ে দেবো ওয়াহেদ। তুমি পাশে থাকো বা না থাকো।
চলবে…