#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৭
এরমধ্যেই বেশ অনেক দিন কেটে গেছে।পারিজা এতদিন তৃণলতার কাছেই ছিল।
হঠাৎ মাঝরাতে পারিজার প্রসব বেদনা উঠলো। পারিজা ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে তৃণলতাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো। তৃণলতা পারিজাকে দেখে চমকে উঠলেন। প্রসব বেদনায় তাঁর মেয়ের প্রান যায় যায় অবস্থা। তৃণলতা তড়িঘড়ি করে ঝি-কে দিয়ে দাইকে ডেকে পাঠালেন।দাই এসে তৃণলতাকে গরম পানি আর গামছা দিতে বললেন। তৃণলতা তাড়াতাড়ি সব এনে দিতেই দাই কাজ করতে শুরু করলো। পারিজা তীব্র ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। তৃণলতা আল্লাহকে ডাকতে শুরু করলেন। একটা মাত্র বুকের ধন তাঁর। এর কিছু হয়ে গেলে বাঁচবেন কী করে?
অনেকটা সময় কাটার পর ভোরের দিকে পারিজা পুত্র সন্তান জন্ম দিলো। পুত্র সন্তানটি ভূমিষ্ট হতেই পারিজা জ্ঞান হারালো। দাই বাচ্চাটিকে পরিস্কার করে কাপড়ে মুড়িয়ে তৃণলতার কোলে তুলে দিলো।দিয়ে বললো,
— বকসিস দাও বকসিস। কত সুন্দর রাজপুত্তুর হয়েছে দেখো। তোমার মেয়ের ভাগ্য দেখি সোনায় সোহাগা। প্রথম বেলাতেই ছেলে!”
তৃণলতা আঁচল থেকে টাকা বের করে দাইয়ের হাতে দিলেন। পারিজার ছোট্ট ছেলেটার কপালে চুমু খেলেন। ছেলে কোলে নিয়ে পারিজার কাছে গিয়ে দেখলেন পারিজা গভীর নিদ্রায় মগ্ন। ছেলে কেঁদেই চলেছে ঠোঁট ফুলিয়ে। কচি মুখটা দেখে তৃণলতার বড্ড মায়া হলো। পাশেই নির্বিগ্নে মেয়েটা ঘুমিয়ে রয়েছে। কপালে বিন্দু ঘাম, খুব ধকল গেছে আজ মেয়েটার ওপর দিয়ে।
পারিজা বেশ অনেকক্ষন পর চোখ খুলতেই দেখলো তৃণলতা ছোট বাচ্চা হাতে পারিজার নিকটে বসে আছে। এক হাতে কাপড়ে মোড়া ছেট বাচ্চা। আরেক হাতে পাখা দিয়ে পারিজাকে বাতাস করছেন। পারিজা উঠে বললো,
— আম্মা আমার বাচ্চা?”
তৃণলতা বাচ্চাটাকে পারিজার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
— চাঁদের মতো রাজপুত্র হয়েছে দেখো।”
পারিজা হাত বাড়িয়ে ছেলেটাকে কোলে তুলে নিলো। ছোট্ট পা, ছোট্ট হাত দুটোতে সযত্নে পারিজা চুমু খেলো। পায়ের পরশ পেয়ে ছেলেটা খানিকটা নড়ে উঠলো। তৃণলতা হেসে নাতীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
— এতক্ষন খিদেয় কান্নাকাটি করে আমাকে জ্বালিয়ে। এখন মাকে দেখে ঘুমানো হচ্ছে? ”
পারিজা ছেলে কোলেই মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।
সকালে খবর পাওয়া মাত্রই ওয়াহেদ পারিজার কাছে চলে এলো। এসেই দেখলো বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে পারিজা। হাতে কাঁথায় মোড়া একটা বাচ্চা। ওয়াহেদ এক ফুটে পারিজার সন্নিকটে এসে পৌঁছালো। পারিজার কোলের ছেলেটার কোলে চুমু খেলো। হাতের আঙুল নিয়ে খেললো। পারিজার কপালেও হঠাৎ একটা চুমু খেয়ে বসলো। তৃণলতা হঠাৎ লজ্জায় সেখান থেকে সরে গেলেন। চোখটা কেন যেন ঝাপসা ঝাপসা লাগছে তাঁর। মেয়ের কপাল খানা দেখে কেন যেন আজ খুব হিংসে হচ্ছে। ইশ! তাঁর বেলাতেও এমন হতো! তৃণলতা দুইবার মুখ থেকে থুতু নিক্ষেপ করলেন নিচের দিকে। তাহলে আর কখনো নজর লাগে না। তৃণলতা চান না তাঁর জন্য পারিজার কিংবা বাচ্চার কোনো ক্ষতি হোক।
তৃণলতার কাছে পারিজা ছেলের চল্লিশ দিন না হওয়া অবধি থাকলো। এরপর ওয়াহেদ এসে পারিজাকে নিয়ে গেল।
পারিজা যেদিন ছেলে নিয়ে শশুড় বাড়ি ফিরে গেল। ওইদিন অনেকেই পারিজার ছেলেটাকে দেখতে এলো। পারিজা ছেলের ডাক নাম রেখেছে নিতিন। ভালো নাম এখনও ঠিক করা হয়নি। দিন কয়েক পরেই ওয়াহেদ ধুমধামে ছেলের আকিকা দিলো।
পারিজাকে প্রথম সন্তান ছেলে হওয়াতে সবচেয়ে অখুশি ছিল উমা। সবাই পারিজার গুনগান করছিল দেখে উমা রাগে ফেটে পরছিল। টপা অনেকবার ছোট্ট নিতিনকে কোলে নিয়ে ঘুরপাক খেলো। ঘুম পাড়ানি গান শোনালো। সুগন্ধা যখন প্রথমবার নাতীর মুখ দেখে নিতিনের গলায় সোনার মোটা একটা চেইন পরিয়ে দিলো। উমা বড় বড় চোখে সোনার চেইনটা দেখলো। তাঁর ইচ্ছে করলো নিতিনের গলা থেকে চেইনটা টেনে তুলে নিজের গলায় পড়তে।
সময়ের গতিতে সময় চলে গেল। নিতিন তখন পাঁচ মাসের। কোমড়টা সবে শক্ত হয়েছে তাঁর। একটু একটু করে বসতে পারলেও দাঁড়াতে পারে না। সুগন্ধার সঙ্গে নিতিনের খুব ভাব। নিতিনের বাড়ির কমবেশি সবার সঙ্গেই ভাব। মিশুকে স্বভাবের হওয়ায় সবার কোলে ঝাঁপিয়ে পরে সে।
সুগন্ধার কয়েকদিন যাবত খুব শরীর খারাপ। চোখে ঠিকমতো দেখেন না। একা একা বিরবির করেন। পারিজার সঙ্গে সম্পর্ক অনেকটা আগের মতোই। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে দেখতে পারতেন না। হঠাৎ শরীরের এই দূরাবস্থা দেখে সবাই বুঝতে পারলো সুগন্ধার হাতে বেশি সময় নেই। রোগে শরীরটা কুঁজো হয়ে গেছে। ঠিকঠাক ভাবে দাঁড়াতেও পারেন না। খেতে গেলে হাত কাঁপে। শয্যাশায়ী এই অবস্থায় হঠাৎ তিনি পারিজাকে ডেকে পাঠালেন। পারিজস নিতিনকে টপার কাছে দিয়ে সুগন্ধার কাছে গেল। সুগন্ধা বিছানায় শুয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে পারিজার হাতটা ধরে বললেন,
— মাগো, তোমার সঙ্গে অনেক অন্যায় করেছি। অনেক জুলুম করেছি। আল্লাহ সবকিছুর ফল আমাকে কড়ায় গন্ডায় দিয়েছে। তুমি আমাকে মাফ করে দিয়ো মা। রাগে দুঃখে কত সময় কত কথা বলেছি। মুখে যা এসেছে তাই বলেছি। মাগো তুমি আমাকে মাফ করে দিয়ো। আমার সময় শেষ। আমাকে যেতে হবে।”
পারিজার চোখে টলটলে অশ্রু। ভেজা কন্ঠে পারিজা বললো,
— এসব কী বলছেন আম্মা? আমার নিতিনের বিয়ে দেখার আগেই চলে যাবার চিন্তা করছেন? আপনার কিছু হবে না আম্মা। আপনি ভালো হয়ে যাবেন।”
সুগন্ধা রুগ্ন মুখে বললো,
— তোমার শশুর চলে যাওয়ার পর জমিদারী এহমাদের হাতে পরলো। কোন অ/মানুষকে মানুষ করেছি আমি! আমার সাধের সংসারটা তছনছ করে দিলো এহমাদ আর ওর বউ। খাওয়ার জন্য অবধি আমায় কথা শোনাতো। এক সময় আমার রাজত্ব চলতো এই বাড়িতে। সেই আমি ভিখিরির মতো এই অবস্থায় পরে আছি! জীবন কাকে কোন পথে নেয়! তুমি আমাকে মাফ করে দিয়ো মাগো। সব পাপের ফল তো পেয়েছি। না জানি কবরে আল্লাহ আমাকে আর কত কষ্ট দেবেন! তুমি সব ভুলে আমাকে ক্ষমা করে দিও মা। তোমাকে কত কথা বলেছি। কত গাল দিয়েছি। একবার রাগে পুকুর পাড় থেকে ফেলে দিলাম। এতটা অবুঝ আমি কী করে হলাম! আল্লাহর দোহাই লাগে তুমি আমাকে মাফ করে দিও!”
সুগন্ধার হাতে হাত রেখে পারিজা কাঁদতে কাঁদতে বললো,
— আমি এসব মনে রাখিনি আম্মা। আমি ক্ষমা করে দিয়েছি আম্মা। আপনি আবারও ভালো হয়ে যাবেন আম্মা সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এইটুকু বলেই পারিজা অশ্রুভেজা দৃষ্টিতে ঘর থেকে চলে গেল। সত্যি বলতে পারিজার আর কিছু বলার মতো ভাষা নেই। অতি আনন্দে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে।আজ পরম সুখ লাগছে তাঁর। সুগন্ধার এই নরম গলায়ে মা ডাকটাই তো সে শুনতে চেয়েছিল। আজ পারিজার প্রাপ্তির খাতায় আরেকটা প্রাপ্তি লিপিবদ্ধ হলো। পারিজা আনন্দে অশ্রু বিসর্জন দিলো।
পারিজার এই সুখ আর বেশিক্ষন ক্ষনস্থায়ী হলো না। দ্বিতীয় বারের মতো সুগন্ধার গলা থেকে মা ডাক শোনার আকাঙ্খা রয়েই গেল। রাতেই সুগন্ধা ইহকালের মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন। পারিজার দুঃখ আরো খানিকটা বৃদ্ধি পেল। কোথাও যেন একটা অপ্রাপ্তি রয়েই গেল!
চলবে…