পারিজাত পর্ব ১৬

0
888

#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৬

পারিজা উঠে চলে যাবার পর তৃণলতা নিজের অতীতে ফিরে গেলেন। সেদিন তাঁকে দেখতে এসেছিল ছেলে পক্ষ। দরিদ্র মা বাবার মেয়ে সে। বাবা ধার করে বাজার করলেন। মা কয়েক পদ রাধলেন ছেলে পক্ষের জন্য। ছেলেটার নাম আজাউল। নিজের মাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল সে। বললো বাবা শৈশবে মারা গেছে। বিয়ের দিনখন ঠিক হলো। তৃণলতার বাবা মা খুব খুশি ছিলেন। এতদিনের বোঝা তাঁরা ঘাড় থেকে নামাতে পেরেছেন। তৃণলতার নিজেরও আজাউলকে বেশ মনে ধরেছিল। গোপনে গোপনে কত স্বপ্ন দেখেছিল সে! বিয়ে হলো কিন্তু বিয়ের দিন রাতে আজাউল নিজের আসল রূপে ফিরে এলো। তৃণলতার ঘাড় ধরে পালঙ্কে ছুঁড়ে মারলেন। মুখে অকথ্য ভাষায় গালি গালাজ করলেন। তৃণলতা হঠাৎ শুনতে পেল আজাউল নারী বিক্রির ব্যবসা করে। এভাবে বহু মেয়েকে বিয়ে করে সে বিক্রি করে দিয়েছে। তৃণলতাকেও সে বাদ দেয়নি। সেই রাতেই তৃণলতাকে অচেনা কয়েকটা লোকের কাছে তুলে দিলেন। সেই সঙ্গে হাতে হাতে মোটা অঙ্কের টাকা গুনে নিলেন। তৃণলতার সংসারের স্বপ্নের পরিসমাপ্তি ঘটলো এখানেই!

পতিতাপল্লি থেকে পালানোর পর পারিজাকে পেটে নিয়ে তৃণলতা বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। গ্রামে বিষয়টা জানাজানি হলো। সকলেই সেখানে তৃণলতার দোষ খুঁজে বেরালেন। সকলে বললেন এই মেয়ে ঘরে তুললে অমঙ্গল হবে। সবাই তাদেরকে একঘরে করে দেবে। লোকের ভয়ে নিজের বাবা তৃণলতাকে অস্বীকার করলেন। তৃণলতা দুঃখে অন্যত্র চলে এলেন। এই সংসারের কেউ তাঁর খোঁজ রাখলো না! একজন দেহ ব্যবসায়ীর খোঁজ কেই বা নেবে?

তৃণলতা অতীত থেকে বেড়িয়ে এসে পারিজার পাশে শুয়ে পরলেন। পাশ ফিরে পারিজার ক্রদনরত মুখটি দেখে নিজেও কেঁদে ফেললেন। মা মেয়ে দুজনেই বিছানার দুই পাশ ফিরে কাঁদছে। জীবন আবারও তাদের কাঁদালো!

পারিজা সকাল বেলা উঠে দেখলো তৃণলতা তাঁর আগেই উঠে পরেছে। পারিজা উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙলো। নিম গাছের ছাই দিয়ে দাঁত মাজলো। তৃণলতা পারিজাকে রুটি আর মাংসের তরকারি খেতে দিলো। পারিজা খাবার নিয়ে মুখে দিতেই চোখ বুজে এলো। রুটি আর মাংসের তরকারি পারিজার বড্ড পছন্দের খাবার। নিচে কীসের যেন ডাকাডাকি। পারিজা বেলকনি থেকে বাইরে উঁকি দিলো। একটা লোক বড় বয়ামে করে আচার বিক্রি করছে। কুল, জলপাই, আম কোনো কিছুই বাদ নেই। তৃণলতা পারিজাকে বেলকনির দিকে যেতে দেখে। কৌতুহলবশত নিজেও পারিজার পিছু নিলেন। নিজের মেয়েকে আচারের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে মনে হেসে ফেললেন। এই আচার ওয়ালা এই আচার বলে ডাক দিলেই পারিজা এক ফুটে তৃণলতার কাছে আসতো। আচারের জন্য আঁচল ধরে ধরে বায়না করতো। নিষেধ করলেই গাল ফুলিয়ে মুখ লাল করে বসে থাকতো। পুরনো স্মৃতি মনে আসতেই তৃণলতা হেসে ফেললেন। পারিজার সেই ছোটবেলার মিষ্টি মুখখানা আবার তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকলো। আহা! পারিজাত! মেয়েটা কত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল!

বিকেল হতেই ওয়াহেদ এসে হাজির। পারিজাত রাগের চূড়ান্ত সীমানায় অবস্থান করছে। এমনি কখনো বলেও ওয়াহেদকে এখানে আনাতে পারেনি। এখন সে এসেছে। ওয়াহেদও ঘুর ঘুর করতে চলে এসেছে। আকাশের অবস্থা বেশি ভালো না। বৃষ্টি আসবে বলে মনে হচ্ছে। পারিজা ওয়াহেদকে গিয়ে বললো,
— কী হলো যাচ্ছো না যে?”

ওয়াহেদ আমতাআমতা করে বললো,
— আজ থেকেই যেতাম নাহয়। এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে আবার যাওয়ার কী দরকার? ”

পারিজাত মুখ গম্ভীর করে বললো,
— বৃষ্টি এখনও আসেনি। তাই তো তোমাকে চলে যেতে বলছি। এমনিতেও তোমার বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বরটর কিছু আসে না। তাড়াতাড়ি বের হয়ে যাও। তাহলে, বাড়ি পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে না।”

বেচারা ওয়াহেদ ইশারা ইঙ্গিতে বেশ কয়েকবার বোঝালো সে আজ থেকে যেতে চায়। পারিজা না বোঝার ভান করে শেষমেশ ওয়াহেদকে বিদায় করেই ছাড়লো। ওয়াহেদ চলে যেতেই তৃণলতা পারিজাকে বললেন,
— এই সময় জামাই বাবাকে বের হতে বারন করলে না কেন? আজ থেকে যেতো।”

পারিজা হেসে বললো,
— থেকে যাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। আমি না বোঝার ভান করে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। একদিন থাকতে দিলে রোজ রোজ আসবে। ওনাকে চেনো না তুমি।”

তৃণলতা মেয়ের কথায় মুচকি হাসলেন। ওয়াহেদ তাঁর মেয়েটাকে ভালো রাখলেই তাঁর শান্তি!

ওয়াহেদের মনেও যে খুব শান্তি এমন কিন্তু নয়। সুগন্ধার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। উমা আর এহমাদ বাড়িতে একটা না একটা অশান্তি করেই যাচ্ছে। পারিজাও নেই যাকে দুটো মনের কথা বলবে ওয়াহেদ। কী যে খাপছাড়া অবস্থা বাড়ির! এইদিকে মাহমুদ আর মেজো বউয়ের মধ্যে কী বিশাল ঝামেলা। কাল ব্যাপারটা হাতাহাতি অবধি গড়িয়েছে। আর কত কী যে দেখতে হবে! কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছে না ওয়াহেদ।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here