পারিজাত পর্ব ১৫

0
911

#পারিজাত
#নুজহাত_আদিবা
পর্ব ১৫
তৃণলতা চিঠির মাধ্যমে নিজের মেয়েকে শুভেচ্ছা জানালো। চিঠিতে সে লিখেছিল,
” আমি তোমার সুখবর পেয়েছি মা।দোয়া করবো তোমার জন্য। তোমার কোলে যেন একটা চাঁদের মতো সুন্দর সন্তান খেলা করে। আমারও তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে মা আমার।”

পারিজার সাত মাস চলছে। কিছুদিন পরই হয়তোবা তাঁর কোলে চাঁদের মতো সুন্দর একটা সন্তান আসবে। এই কয়দিনে পারিজা বহুবার ওয়াহেদকে বলেছে তাঁকে তাঁর মায়ের কাছে নিয়ে যেতে। ওয়াহেদ এটা সেটা বলে এড়িয়ে গেছে। শেষমেশ কাল রাতে চিৎকার চেচামেচি করে পারিজা ওয়াহেদকে বলেছে সে যদি পারিজাকে না রেখে আসে। তবে, পারিজা একাই চলে যাবে। শেষে বাধ্য হয়ে ওয়াহেদ পারিজাকে তাঁর মায়ের নিকটে রেখে আসতে যাচ্ছে।

পারিজা আস্তে আস্তে নামলো। নেমে বাড়ির সামনে গিয়ে দরজায় করাঘাত করলো। তৃণলতা আনমনে দরজা খুলে বাইরে এলেন। এসেই প্রচন্ড বিষ্মিত হলেন। তাঁর সামনে তাঁর একমাত্র কন্যা পারিজাত দাঁড়িয়ে। খুশিতে, সুখে তাঁর চোখে জল টলমল করতে শুরু করলো। পারিজা আনন্দে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরলো। পাশ থেকে ওয়াহেদ তৃণলতাকে বললো,
— আম্মা ওকে দেখে রাখবেন। আপনার দায়িত্বে রেখে গেলাম।”

তৃণলতা ওয়াহেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ভেতরে এসো বাবা।”

ওয়াহেদ ব্যস্ততার ভঙ্গি করে বললো,
— আরেকদিন আসবো আম্মা। আজ যেতে হবে।”

তৃণলতা ওয়াহেদকে আর জোর করলেন না। ওয়াহেদ চলে যেতেই তৃণলতা নিজ কন্যার কপালে চুমু খেলেন। কতদিন পর তাঁর হীরা মানিক রতন তাঁর নিকট ফিরে এসেছে।

পারিজার চুলে তেল দিয়ে বিনুনি করে দিলেন তৃণলতা। পারিজা মায়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে কথা প্রসঙ্গে বললো,
— আমি নাহয় সংসারের জন্য আসতে পারিনি। তুমি তো একটা বার আমায় দেখতে আসলে না আম্মা। তুমি জানো? এমন কোনো দিন নেই। আমার তোমাকে মনে পরেনি। তুমি ছাড়া আমার কে আছে আম্মা?”

তৃণলতা করুন দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। মেয়েকে হয়তোবা তিনি মুখে কিছু বলতে পারবেন না।মেয়ের শশুর বাড়িতে গেলেই পূর্বের পরিচয় ফাঁস হবে। মেয়ের সংসারে নানারূপের অশান্তি হবে। মেয়েকে কষ্ট পেতে হবে। তাই ভেবে তিনি সেদিকে পা মাড়াননি।

তৃণলতা মেয়ের গাল টিপে দিয়ে বললেন,
— মাগো, তুমি বিশ্বাস করো আর নাই করো। কত রাত তোমার জন্য কেঁদেছি আমি। আমার আল্লাহ আর আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। আমি বাড়ি এসে শুনলাম তুমি এসেছিল মাগো। আমার বুকে কত যে যন্ত্রণা হয়েছে! আমার সন্তান আমাকে দেখতে না পেয়ে ফিরে গেল। এই দুঃখ আমি কীভাবে ঘুচাবো?”

পারিজা তৃণলতার কোলে মাথা রাখলো। তৃণলতা পারিজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
— এখন তো মায়ের দুঃখ বুঝবে না। কয়দিন পর আসছে একজন তোমাকে জ্বালাতে। তখন বুঝবে মা হওয়া কাকে বলে। তুমি অবশ্য ছোটবেলায় খুব লক্ষীটি ছিলে। সারাদিন আমার আঁচলে মুখ গুঁজে থাকতে। আমার সব কথা শুনতে। তোমার মতো সন্তান দশটা হলেও সেই মায়ের কোনো দুঃখ থাকবে না।”

পারিজা মায়ের কথা শুনে হাসলো।

ওপাশের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পারিজা তৃণলতাকে প্রশ্ন করলো,
— এটা কী গাছ আম্মা? ফুলগুলো খুব সুন্দর। ”

পারিজা গতবার যখন এসেছিল তখন এই ঘরটা তালাবদ্ধ ছিল। এই ঘরে টাকা পয়সা দরকারী জিনিস পত্র রাখেন তৃণলতা। তাই এই ঘরটা তৃণলতার অনুপস্থিতিতে তালাবদ্ধ থাকে। তাই আগের বার এই ঘরের বারান্দায় থাকা গাছটি পারিজা দেখেনি।
তৃণলতা পারিজার কথার জবাবে বললেন,
— এটা পারিজাত ফুলের গাছ।”

পারিজা বিষম খেয়ে মায়ের দিকে তাকালো। তৃণলতা হেসে বললেন,
— তুমি যেদিন বিয়ে হয়ে চলে গেলে। এরপরের দিন আমি এই গাছটা এনেছি। আমার সবচেয়ে দামী জিনিস তুমি। তোমার মতো করে আমি এই গাছটাকে পরিচর্চা করেছি। আমি তোমার নামকরণ করেছিলাম এই ফুলের নামে। পারিজাত ফুলের মতো তুমিও খুব সুন্দর মা। কোন ভালো কাজের ফল হিসেবে তোমায় আমি পেয়েছি মা কে জানে।”

পারিজা মায়ের কথা শুনে হাসলো।

নিজের অনাগত সন্তানের জন্য পারিজা অপেক্ষারত। কখন তাঁকে কোলে তুলে আদর করবে! তাঁর গালে চুমু খাবে।পারিজা সব ভেবে রেখেছে। পারিজা একবার চেয়েছিল নিজের সন্তানের জন্য নকশীকাঁথা সেলাই করতে। কিন্তু, বাড়ির সকলেই মানা করেছে। সন্তান ভূমিষ্ট হবার পূর্বে কোনো কিছু না করতে। তাই, পারিজা আর কাঁথা সেলাই করেনি।

তৃণলতা মেয়ের সঙ্গে গল্প করেই সময় কাটান। কতদিন পরে মেয়ের সঙ্গে কথা। চিঠিতে নাহয় মনের কথাগুলো প্রকাশ করা যায়। কিন্তু, নিজ চোখে চেয়ে দেখার আকাঙ্খা কী কমে?

পারিজা ইচ্ছে করেই এখানে চলে এসেছে। সন্তান ওখানে জন্ম নিলে তৃণলতা কখনোই তাঁকে দেখতে পেতো না। কেউ এখানে আসতেও দিতো না তাঁকে। বাচ্চাটা হলেই তারপর বাড়ি ফিরবে পারিজা। এর আগে যা ইচ্ছে তাই হয়ে যাক।

তৃণলতা পারিজাকে খাইয়ে দিতে দিতে বললেন,
— সংসারের প্রতি মনোযোগী হও মা। তোমার সংসার তুমি যেভাবেই গড়বে সেভাবেই সেটা টিকে থাকবে। তুমি অবহেলা করবে যত্ন নেবে না। কেউই তোমাকে মনে করবে না মা। কেউ তোমার পাশে থাকবে না।”

পারিজা টলমলে চোখে চেয়ে বললো,
— তুমি তো সংসারের কত কিছু জানো আম্মা। জীবন তোমার সঙ্গে কী খেলা খেললো? তুমি সংসারী হতে পারলে না কেন?”

তৃণলতার ঠোঁটের কোন থেকে হাসির রেখাটা সরে গেল। অতীতের ভয়ংকর স্মৃতির তাড়নায় খানিকটা ভড়কে গেলেন। চিকচিক করা অশ্রুতে ভরে গেল চোখদুটো।

পারিজা খাবারের থালার সামনে থেকে উঠে গেল। ঘরে গিয়ে মনে মনে একটা প্রতিশ্রূতি দিলো নিজের মনকে।সে আবার তৃণলতার বিয়ে দিতে চায়। হয়তোবা সমাজ সেটিকে ভালো ভাবে মেনে নেবে না। কিন্তু, তৃণলতার মনের আশা তো পূরন হবে। লোকে তো কত কিছুই বলবে। সব মনে রাখলে জীবন চলবে?

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here