পানপাতার ঘর? শেষ পর্ব

0
1151

পানপাতার ঘর ??
শেষ পর্ব
লেখা – Mahfuza_Monira

মিশির কথা শুনে মইনুল সাহেব ধপ করে বিছানার উপর বসে পড়েন। যেই ভয়টা পাচ্ছিল সে,ঠিক সেটাই হলো। সে তো চাইছিল না যে মিশি এসব ব্যাপারে কিছু জানুক,তবে কেন জানলো ও? প্রকৃতি কেন বারবার তাদের বিপক্ষে যাচ্ছে…!

মিশি দাঁতে দাঁত চেঁপে বলে-
—————উদু আমি বলতাম না তুই পর হয়ে গেছিস?? আসলেই তুই পর হয়ে গেছিস। কি করে পারলি তুই আমার থেকে লুকোতে। এতগুলো দিন ধরে দুজনে একসাথে আছি,সেই ভালোবাসার খাতিরেও কি বলা যেতো না??

উদয়ের গলা কাঁপছে। শুকিয়ে আসছে বারবার। ধরা গলায় বলে-
—————-আমি চাইছিলাম না তুমি জানো।
—————-জানলে কী? তোমাকে ছেড়ে চলে যেতাম?
—————–নাহ। থেমে যেতে আমার মৃত্যু তে। চাইছিলাম না আমার মৃত্যুতে তুমি থেমে যাও একদমের জন্য মিশু।

দ্বিতীয় থাপ্পড় টাও মিশি তখনি মারে উদয়ের গালে। এতই জোরে যে উদয় মাথা নিচু করে জানালার গ্রিল ধরে সামলায় নিজেকে।

মিশির গলা দিয়ে ধোঁয়া আর চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছে রাগে।
বাজখাঁই গলায় বলে-
—————-আর এইজন্য এই পড়ন্ত নামের নাটক করলি তাইনা? আর ভাবলি আমি কান্না কাটি করবো কিন্তু পরে তোকে ভুলে গিয়ে অন্য কারো সাথে বিয়ে করে নেবো??

মইনুল সাহেব এগিয়ে আসতে তার দিকে ফিরে মিশি বলে-
————তোমরা আমার ভালোবাসা টাকে এতই ঠুনকো ভাবলা কেমনে??? সামান্য ঝড় আসতেই আমি সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাবো,কি করে ভাবলা এইটা??

উদয় ধীরে ধীরে গ্রিল ধরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পিঠ দেয়ালে ঠেকায়।
শরীর খারাপ লাগছে তার।
মিশি উদয়ের দু হাত নিজের হাতের ভেতর আবদ্ধ করে বলে-
————উদু,তুমি অসুস্থ হওয়ার পর থেকে প্রায় রাতে আমি স্বপ্ন দেখতাম যে আমি একটা নদীর পাড়ে দাড়িয়ে আছি। আর একটা ঘর বানাচ্ছি। পানপাতা দিয়ে। ঘর টা বাতাসের ঝাপ্টায় বারবার দুমড়ে মুচড়ে পড়ে যাচ্ছে,কিছু পাতা উড়েও যাচ্ছে তবুও আমি থামছি না। আমি বারবার বানাচ্ছি ঘর টা। দু হাত প্রশস্ত করে আমি বাতাস থেকে ঘর টাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছি। আর তখনি আমার ঘুম ভেঙে যেতো। আমি বুঝতাম না এই স্বপ্নের মানে,তবে আজ বুঝতে পারলাম। তুমি আমার সেই পানপাতার ঘর আর ক্যান্সার টা সেই বাতাস। কিন্তু আমি,আমি তোমাকে হারাতে দিবো না,হারতে দিবো না। যতই ঝাপটা আসুক,আমি তোমায় সামলে নিবো। ঠিক সামলে নিবো।

উদয় মিশির দুহাতের উপর মুখ রেখে গুঙিয়ে কেঁদে উঠে।
মিশি উদয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে-
———–আই লাভ ইউ রে উদু। তুই যদি নাও থাকিস তবু আমি তোর থাকবো, শুধু তোর। আমার সমস্ত কিছু জুড়ে তুই ছিলি,তুইই থাকবি। অন্য কেউ কখনো তোর জায়গা টা নিতে পারবে না রে।

উদয় মিশিকে জাপটে ধরে কেঁদে ফেলে। মিশির চোখ গড়িয়েও পানি পড়ে যায় কয়েক ফোঁটা।
মইনুল সাহেব মুখ চেঁপে কেঁদে ফেলেন। পড়ন্ত দরজায় দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিল এতক্ষণ।
সে অশ্রুসিক্ত চোখে রুমে প্রবেশ করে বলে-
———চাচা বলেছিলাম না,সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো কোনোদিন আলাদা করা যায়না।
.
.
সেদিন সে রাতেই কাজী ডেকে খুব ঘরোয়াভাবে বিয়ে হয়ে যায় মিশি আর উদয়ের। অবশেষে দুটো ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়ের অগাধ ভালোবাসা পূর্ণতা পায়।
.
বাসর ঘরে মেয়ে ভেতরে থাকে আর ছেলে পরে আসে। মিশি আর উদয়ের ক্ষেত্রে হয় আলাদা।
উদয় শুয়ে ছিল চুপ করে আর মিশি একটা ট্রে হাতে রুমে ঢোকে।
ট্রে তে একগ্লাস গরম দুধ আর ওষুধ রাখা সাথে পানি।
উদয় উঠে বসে।
মিশি দুধের গ্লাস টুকু এগিয়ে দেয় উদয়ের দিকে।
উদয় মুখের কোণায় দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে বলে-
———-এটার কিন্তু খুব দরকার ছিল গো।
মিশি ভ্রু কুঁচকে বলে-
———–ক্যান?
———–দুধ খেলে শরীরে শক্তি আসে। আর আজ তো শক্তি লাগবেই নাকি..

উদয় কথা টা বলে চোখে টিপ মারে। মিশি লজ্জায় নতজানু হয়।
কোনোমতে ধমকে বলে-
——–ছেলেরা জীবনেও শুধরাবে না। চুপ একদম চুপ। আগে দুধ টুকুন খাও আর ওষুধ খাও। তারপর দেখা যাবে।

উদয় দ্রুত গ্লাসের সমস্ত দুধ টুকু শুষে নেয়। তারপর ওষুধ খেয়ে নেয়।

মিশি ট্রে টা বিছানার পাশের ছোট টেবিলের উপর রেখে উঠতে গেলে উদয় মিশির হাত টেনে ধরে।
মিশি বাকা চোখে তাকিয়ে বলে-
——–কী?
উদয় মুচকি হাসি দিয়ে বলে-
——–আজকে বাসর হবে না? নাকি আজকেও আবার বাথরুমের মগ নিয়ে আসবা মারতে!!
মিশি ফিক করে হেসে ফেলে উদয়ের কথা শুনে। চোখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে বলে-
——–আগে বাথরুমে তো যেতে দাও। এরপর মগ আনি নাকি বালতি তা পড়েই দেইখো।

উদয় মিশির হাত ছেড়ে দিয়ে মিনতির সুরে বলে-
——-এখন তো আমাদের বিয়ে হয়েছে মিশি! আজকেও কি হবে না?

মিশি কিছু না বলে স্মিত হেসে বাথরুমের দিকে এগোয়। উদয় মুখ গোমড়া করে শুয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে,মিশি এবার বোধহয় বালতি নিয়ে আসবে!!

দু মিনিট যায়।
মিশি বের হয় বাথরুম থেকে।
হাতে তার মগ বালতি কিছুই নেই। তবে কাপড় বদলেছে। স্লিভলেস একটা টপস পড়েছে সে। ফর্সা বাহু,উরু, পা সব দেখা যাচ্ছে তার।
উদয় লাফ দিয়ে খাটে উঠে বসে। মিশি স্মিত হেসে বলে-
——-কী?
উদয় চোখ বড়বড় করে বলে-
——–আজকে খেলা হবে মেরি জান। কি যে লাগতেছো না….হায়েএএএএএএ….

উদয়ের বলার ধরন দেখে মিশি হোহো করে হেসে উঠে।
পরমুহূর্তেই হাসি থামিয়ে মুখ বাকিয়ে বলে-
——-নিজে একটা বাচ্চা,আবার আসছে বাসর করতে.!
উদয় ভ্রু নাঁচিয়ে বলে-
——–ওহ হো? আমি বাচ্চা? ওকে এই বাচ্চা কি কি করতে পারে। আজ দেখাবো। জাস্ট ওয়েট এন্ড সি..

মিশি কিছু বলতে নেওয়ার আগেই উদয় তাকে চেঁপে ধরে খাটে শোয়ায়। তারপর মিশির ঠোঁটজোড়া নিজের ঠোঁটের মাঝে ডুবিয়ে নেয়। মিশির চোখ বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে টুপ করে।
এত সুখ,এত শান্তি…এসব কি মিশির কপালে সইবে..!?
.
.

শেষ পর্যন্ত মিশির কপালে সুখ সয়না। ৪ মাস পর উদয় মারা যায়। তখন মিশির পেটে উদয়ের বাচ্চার বয়স ১৭ দিন।
উদয়ের মৃত্যু তে মিশি কাঁদে না। সে জানতো একদিন উদয় চলে যাবে। ক্যান্সার এর রোগী রা এমনি হয়,সবাইকে ফাকি দিয়ে একদিন চলে যায়।
মিশি আগে থেকেই সব জেনে নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিল।
উদয়ের কবরের মাটি ছুইয়ে শপথ করে,উদয়ের দেওয়া শেষ এবং সবচেয়ে বড় উপহার তাদের বাচ্চা কে বুকে আগলেই মিশি আজীবন বাঁচবে।
.
১০ বছর পর।
মিশি তাদের গ্রামেই ছোট্ট একটা বোর্ডিং স্কুল খুলেছে বাচ্চাদের জন্য। স্কুলের নাম রেখেছে “পানপাতার ঘর”। অবশ্য স্কুল টাকে সাজিয়েছেও একদম পানপাতার মতো করেই।
এই স্কুল আর মালিয়াত কে নিয়েই সময় কেটে যায় তার।
.
মালিয়াত দৌড়ে এসে মিশিকে জাপটে ধরে বলে-
——–আম্মি আইসক্রিম খাবো।
মিশি বাচ্চাদের পরীক্ষার খাতা দেখছিল। খাতার ভেতরেই মুখ গুঁজে বলে-
———–ঠান্ডা লাগবে তোমার। কোনো আইসক্রিম খাওয়া খাওয়ি চলবে না।

মালিয়াত গাল ফুলিয়ে বলে-
——দিবা না?
মিশি মালিয়াতের দিকে মুখ করে বলে-
——-না।

মালিয়াত আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে মেঝেতে শুয়ে পড়ে। হাত পা এদিক ওদিক ছুড়াছুড়ি করতে করতে বলে-
——-ভালোই ভালোই দাও নয়তো নাগিন ডান্স দেওয়া বন্ধ করবো না হুহ।

মিশি খিলখিল করে হেসে উঠে। মেয়েটা হয়েছেও একদম..একদম বাপের মতো…
মিশি ৫ টাকার নোট মালিয়াতের হাতে ধরিয়ে দেয়। মালিয়াত খুশিতে ডগমগ হয়ে দৌড় দেয়।

মিশি উঠে গিয়ে এককাপ কফি বানিয়ে নেয়। তারপর উদয়ের ছবিটা নিজের কোলের উপর নিয়ে বারান্দায় বসে। ভালো না লাগলে সে প্রায় সময় কফি হাতে উদয়ের ছবির সাথে গল্প করে। আজও করবে।
মিশি কফিতে চুমুক দিয়ে বলে-
——-কতদিন হলো তোমার ছোঁয়া পাই না। একটু ছুঁয়ে যাও না উদু।

সাথে সাথেই কোথা থেকে একদলা বাতাস এসে মিশির নাক মুখ চোখ ছুঁয়ে যায়।
মিশি হালকা শিউরে উঠে।
——-আই লাভ ইউ উদয়। আর রেলি লাই ইউ…
বলে মিশি আবার কফির মগে চুমুক দেয়।

(সমাপ্ত)

[দীর্ঘ একমাস ধরে গল্প টা লিখছিলাম। জানিনা কার কেমন লাগলো গল্প টা। তবে আমি আমার সম্পূর্ণ চেষ্টা করেছি সুন্দর করে গল্পটাকে সাজানোর। আমি জানি অনেকেই আছে,যারা চুপ করে আমার গল্প পড়ে চলে গেছেন এতদিন। কোনো লাইক কমেন্ট করেন নি। তারাও না হয় আজ তাদের অনুভূতি টা কমেন্টে লিখে যাইয়েন।
আর লেখা হবে না উদয় মিশিকে নিয়ে।
তবে পরশু থেকে আবার নতুন গল্প আসতে চলেছে। আসতে চলেছে নিশুতি,প্রায়াণ,প্রেমা,পিউ,প্রত্যুষ, আবেগ ও নম্রতা…)
[আল্লাহ হাফেজ?]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here