পরাণ দিয়ে ছুঁই (২য় পরিচ্ছেদ) পর্ব ২০

0
234

#পরাণ_দিয়ে_ছুঁই (২য় পরিচ্ছেদ)
#পর্বঃ২০
#Jhorna_Islam

নূর সৌন্দর্যের কথায় ভরসা খুঁজে পেলো।মনটা একবার বলছে কিছু হবে না তোর বাবার তো আরেকবার অন্য কথা বলে। কাল সারা রাত গল্প করেই কাটিয়ে দিয়েছে। কথা বলার সময় ও বুকের ভিতর টা বারবার মোচড় দিচ্ছিলো।

নূরের বাবা কে আগামী কালকের মাঝেই অপারেশন করানো হবে।তাই আজই হাসপাতালে এডমিট করানো হয়েছে। ডাক্তাররা সব রকমের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।নূরের মা সেই যে নামাজের রুমে বসে আছেন আর উঠছেনই না। এতক্ষন সব সৌন্দর্য সামলালেও এখন তার বড় আব্বু মি.রূপম ওয়াহিদ সব ফর্মালিটিস পূরণ করছে। সৌন্দর্য এখন নূর কে সময় দিচ্ছে মেয়েটা বাইরে থেকে শক্ত দেখালেও ভিতর থেকে একেবারে ভেঙে পরেছে। সৌন্দর্য নূরের চোখ দেখেই ভিতরের অবস্থা কিছু হলেও বুঝতে পেরেছে।

পরের দিন নূরের বাবা কে যখন তৈরি করা হয়েছে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার জন্য তখন একে একে সকলকেই ডাক দেওয়া হয় উনার সাথে দেখা করার জন্য। নূরের মা আর তূর এক সাথে যায়।নূর কিছুতেই সাহস পাচ্ছে না যাওয়ার। নূরের বাবা শুধু নূর কে না নূরের সাথে সৌন্দর্য কে ও দেখা করার কথা বলেছে।নূর একই ভাবে বসে আছে কিছুতেই জোর পাচ্ছে না বাবার সামনে যাওয়ার।

সৌন্দর্য এসে নূরের সামনে দাঁড়ায়। নূর চোখ তুলে সৌন্দর্যের দিকে তাকাতেই সৌন্দর্য চোখের ইশারায় উঠতে বলে। কিন্তু নূর কিছুতেই উঠবেনা সে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানায়।যাবে না সে তার এতো সাহস নেই।
‘– নূর কি হচ্ছে কি উঠো সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। (সৌন্দর্য)

নূর উত্তর দেয় না কোনো।

–‘ আমি কি বলছি শুনতে পারছো না তুমি নূর?

— স-্যার প্লিজ স্যার না।আমি পারবো না। আমি যেতে চাই না স্যার। আমি সাহস পাচ্ছি না যাওয়ার। আমি ঐখানে গেলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবো না। বাবা মানসিক ভাবে আরো ভেঙে পরবে।

— কিছু হবে না পরাণ উঠো বলেই সৌন্দর্য নিজেই নূরের হাত ধরে টেনে তুলে।
নূর ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।ক্যাবিনে ঢুকে দেখে বাবা তার দরজার দিকেই তাকিয়ে আছে। যেনো এতোক্ষন তাদের অপেক্ষাতেই ছিলো। নূর গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে বাবার পাশে বসে। নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌন্দর্য একটা চেয়ার টান দিয়ে তাদের কাছাকাছি ই বসে।

–‘ আম্মাজান?

ইসসস এই ডাক শুনলে কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়। বুকের ভিতর যেনো হাতুড়ি পিটাচ্ছে আর বলছে তুই হয়তো আর এই ডাক শুনতে পাবি না। কেন এমন হচ্ছে? এমন না হলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো? সব ঠিক ছিলো ভালোই তো ছিলো। হুট করে একটা ঝড় এসে সব এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে।

— হু বাবা বলো। বলেই ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকানোর চেষ্টা চালায় নূর।নূরের বাবা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,,এভাবে ভেঙে পরতে হয় না মা। ভাগ্যে যা আছে তা তো আর আমরা বদলাতে পারবো না। এটা আমাদের মেনে নিতে হবে আর মানিয়ে ও নিতে হবে। আমি জানি তুই পারবি তোকে যে পারতেই হবে। আমার অবর্তমানে তোকেই তো তূর আর তোর মায়ের দায়িত্ব নিতে হবে তাই না?

নূর বাবা বলেই চোখের পানি ছেড়ে শব্দ করে কেঁদে দেয়। নূরের বাবার ও চোখ দিয়ে পানি পরছে। সৌন্দর্য ওদের বাবা মেয়ের দিকে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারে না তার চোখ দুটো ভীষণ জ্বালাপোড়া করছে। চোখ দুটো বুঝি আজ তার সাথে বে’ঈমানী করতে চাইছে। কিন্তু সে সৌন্দর্য কিছুতেই চোখের পানি কে জিততে দেওয়া যাবে না। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে আগের মতো স্বাভাবিক আর ক:ঠোর করে নেয়। নূরের বাবা মেয়েকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছে। আরো নানা ধরনের কথা চলে দুইজনের মাঝে কিন্তু নূর বেশি কথা বলতে পারে না কান্নারত গলায় শুধু হুু,হা করে উত্তর দেয়।

নূরের বাবা নূরের সাথে কথা শেষ করে এবার সৌন্দর্যের দিকে তাকায়।,,, সৌন্দর্য বাবা?

–” হুু, আ ইয়ে মানে বাবা,,হুম বাবা বলুন শুনছি।

— এইদিকে আসো বলে অন্য পাশে বসার জন্য একটু সরে জায়গা করে দেয়। সৌন্দর্য না করে না চুপচাপ গিয়ে বসে পরে।

নূরের বাবা সৌন্দর্যের হাত নিয়ে ধরা গলায় বলে,,,আমার এই অবুঝ রত্নটি তোমার হাতে তুলে দিলাম বাবা।তুমি তার যত্ন নিও ও ঠিক ভাবে মূল্যায়ন করো।আমার মেয়ে টা বড্ড সহজ সরল তুমি ওকে ভুল বুঝো না কখনো।সব সময় সুখে দুঃখে পাশে থেকো। দেখে রেখো ওদের একটু বাবা।

সৌন্দর্য নূরের বাবার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলে উঠে,,, এসব আপনি কি বলছেন বাবা? কিছু হবে না আপনার। জাস্ট একটা ছোট্ট অপারেশন হবে তারপর আপনি সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনাকে সুস্থ হতেই হবে নূর,তূর আর মায়ের জন্য। আমার জন্য ও আপনাকে সুস্থ হতে হবে। ওদের দেখে রাখার এতো বড় দায়িত্ব আমার উপর দিয়ে আপনি কিছুতেই চলে যেতে পারেন না।

এসব বললে তো আর হবে না বাবা।(নূরের বাবা)

আপনি মনোবল কেন হারাচ্ছেন বাবা? আমাদের সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও নিজের মনোবল হারাবেন না। কিছু হবে না আপনার। (সৌন্দর্য)

এরমধ্যে নার্স এসে জানায় বেশি সময় যেনো আর নষ্ট না করা হয়। নূর কিছু সময় বাবা কে জরিয়ে ধরে রাখে। এতক্ষন আসতে চায় না আর এখন যেতে চায় না। সৌন্দর্য এবারও জোর করে নিয়ে যায় নূর কে। আর এতো কান্না করার জন্য বাইরে নিয়ে গিয়ে চাপা একটা ধমক দেয়।এমনিতে করে, কিন্তু বাবার সামনে কেন করতে গেলো? বাবা তো এমনিতেই মনের দিক থেকে দূর্বল হয়ে আছে।
নূর আর কথা বলে নাই।

*************
ইসরাত হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে। নূরের কাছে আরো আগেই যাওয়া দরকার ছিলো। কিন্তু কিছু সমস্যার কারণে যেতে দেরি হয়ে গেছে। এইদিকে জ্যামে আঁটকে আছে। রাগ উঠে যাচ্ছে ইসরাতের।একেইতো দেরি করে যাচ্ছে আবার এই জ্যামে আরো দেরি করে দিচ্ছে। বাইরের দিকে তাকাতেই ইসরাতের চোখ আটকে যায়।এটা সে কাকে দেখছে? তালহা স্যার নাকি অন্য কেউ? উহু অন্য কেউ হতেই পারে না। ইসরাত কখনো তালহা স্যার কে চিনতে ভুল করবে না। এটা তালহা স্যারই। গাড়ি চালক কে টাকা দিয়ে তারাতাড়ি করে নেমে যায় ইসরাত। পিছনে গিয়ে বসে বলে তারাতাড়ি চলুন স্যার এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।

তালহা ৪২০ ভোল্টের ঝটকা খেয়ে বসে আছে। হুট করে কি হচ্ছে সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
মানে? এই তুমি এখানে কোথা থেকে এসেছো? খারাপ মাথা আরো খারাপ হয়ে গেছে তোমার তাই না? নামো বলছি বাইক থেকে এখনই নামবে।কি হলো নামছো না কেনো?

“কেন নামবো? আপনার আর আমার গন্তব্য তো একি।তাহলে একই পথের পথিক না হয়ে ভিন্ন পথের পথিক হবো কেন বলুন তো?”

— মানে?

— উফফ এইখান দিয়ে তো জায়গা আছে তাহলে বাইক চালাচ্ছেন না কেনো? চালান, আপনিতো হাসপাতালেই যাচ্ছেন নূরের বাবার যে অপারেশন হচ্ছে ঐখানে। কি ঐখানে যাচ্ছেন না?

— হ্যা কিন্তু তুমি জানলে কি করে? জানার তো কথা না।আর না জেনে এতো শিউর হয়ে বলছো কি করে?

— এটা হচ্ছে ম্যাজিক।ম্যাজিক দিয়ে জেনেছি।কিন্তু একটাই আফসোস আপনার মন টা ম্যাজিক করে পেলাম না শেষের কথাটা বিরবির করে বলে ইসরাত যা তালহার কান অবধি পৌঁছায় নি।

তালহা বেশি কথা বাড়ায় না এখন তারাতাড়ি হাসপাতালে যাওয়া দরকার। ওদের পাশে থাকা দরকার। ইসরাত আবার তালহা কে ধরে বসে নি পিছনে ধরে রেখেছে। তালহা বাইক চালু করতে করতে বলে,, এমনিতেই একটা পরিবারের দুঃসময় যাচ্ছে তুমি কি চাও আরো বিপদ ঘটুক?

ইসরাত কিছু না বুঝে জিজ্ঞেস করে,,, কি বলবেন সোজাসাপটা বললেই পারেন।

আমাকে ধরে বসো।আমি হসপিটালে যাচ্ছি পুলিশ স্টেশনে যেতে চাই না। ইসরাত বেশ খুশি হয়ে যায়। তালহার কাঁধে হাত রাখতে গিয়ে বুঝলো হাতটা কাঁপছে। বুকে ফু দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতটা তালহার কাঁধে রাখে। তালহা লুকিং গ্লাসে সবই লক্ষ করেছে। মুচকি হেসে বাইক চালাতে থাকে।

বাইক চালাতে চালাতে হুট করেই তালহা বলে উঠে,, বায় দা ওয়ে,, বিয়ে পা’গল মেয়ে বিয়ে করবে না বলে নে’কা কান্না করছে এটা ভাবা যায়?

তালহা ঐদিনের জন্য যে খোঁচা দিয়ে কথা বলছে সেটা বুঝতে একটুও ভুল করলো না । কটমট করে তাকিয়ে তালহার কাঁধে রাখা হাতটা দিয়ে খা’বলে ধরে কাঁধ। বড় বড় নখ গুলো শার্টের উপর দিয়েই চা’মড়া মনে হয় ভে’দ করে ফেলছে। তালহা চোখ মুখ কোচকে বাইক ব্রেক করে। ধমক দিয়ে বলে,,এখনই তুমি বাইক থেকে নেমে যাও তোমাকে আমি নিবো না।

ইসরাত শুকনো ঢুক গিলে কয়েকবার সরি বলে।ভুল হয়ে গেছে আর এমন করবে না। এবারের মতো যেনো নিয়ে চলে।

তালহা আর কিছু না বলে বাইক চালাতে থাকে।

************
ঘন্টা দুয়েকের বেশি হয়ে গেছে নূরের বাবা কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি মানুষ ভীত মনে আল্লাহ কে ডেকে চলেছে, সব যেনো ঠিক থাকে। সকলের মনেই ভয় ঢুকে গেছে। নূর অপারেশন থিয়েটারের সামনে একবার গিয়ে আবার এসে পরেছে। বেঞ্চে না বসে নিচে বসে আছে। সকলের মাথায়ই টেনশন তাই কেউ কিছু বলছে না। নূরের পাশেই ইসরাত আর তূর বসে আছে। নূর ইসরাতের কাধে মাথা দিয়ে এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে।

দেখতে দেখতে আরো অনেক সময় কেটে যাচ্ছে। যতো সময় কাটছে ততো সৌন্দর্যের ভিতর ও কেন যেনো ভয় ঢুকে যাচ্ছে। সবার দিকে একবার তাকিয়ে সৌন্দর্য একটু একা থাকার প্রয়োজন মনে করলো।যাওয়ার আগে একবার নূরের দিকে তাকায় আর ভাবে এই মেয়ে কে কি করে সামলাবে সে? যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়। আবার নিজে নিজেই বলে,,এসব আমি কি ভাবছি কিছু হবে না।
সৌন্দর্যের পিছনে পিছনে তালহা ও যায়।

দুইজন নূরের বাবা কে নিয়েই কথা বলতে থাকে। আজ তালহার কাছে মনে হলো সৌন্দর্য নিজেই মনে বল পাচ্ছে না ভেঙে পরছে।তাই সৌন্দর্য কে বলছে সে যেনো ভেঙে না পরে তাহলে নূরের পরিবার আর নূর কে কি করে সামলাবে।

সৌন্দর্য তালহা কে কিছু বলার আগেই শুনতে পায়,,,, স্যা-স্যার….

সৌন্দর্য তালহা দুইজন ই ঘুরে তাকায়।তাকিয়ে দেখে নূর চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে।

নূর কি হয়েছে? (তালহা)

নূর তালহার প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না। দৌড়ে সৌন্দর্যের সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছু বলার আগেই সৌন্দর্যের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হু হু করে কেঁদে উঠে।
সৌন্দর্য শুকনো ঢুক গিলে তালহার দিকে তাকিয়ে নূরের মাথায় নিজের কাঁপতে থাকা হাতটা রাখে।

গলা দিয়ে যেনো কথা বের হচ্ছে না। অনেক কষ্টে মুখ দিয়ে বের করে,,,

প-প-পরাণ?

#চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here