#পথের_কাঁটা(৩)
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
____________________
বিছানার এক কোণে উবু হয়ে শুয়ে আছে ত্রয়ী। চোখের জলে বালিশের এক সাইড ভিজে গেছে। যত ফোঁটা চোখের পানি পড়ছে বালিশ সেটা শুষে নিচ্ছে। নিরবে কাঁদতে কাঁদতে কখনো কখনো ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। যা হওয়ার ছিল না, তাই হচ্ছে। এমনটা না হলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত?
‘ত্রয়ী ঘুমিয়েছিস?’ কপাটের বাইরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন ত্রয়ীর মা। ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকায় তিনি বুঝতে পারছেন না ত্রয়ী ঘুমিয়েছে নাকি জেগে আছে।
ত্রয়ী চটপট উঠে বসে দু’হাতে চোখের পানি এবং গালে লেগে থাকা পানি মুছে ফেলে। যথাসম্ভব কণ্ঠ এবং নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,’জেগে আছি মা।’
তিনি ঘরে এসে লাইট জ্বালান। ত্রয়ীর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে বিছানায় বসেন। খুবই শান্তভাবে জিজ্ঞেস করেন,’কবে থেকে তোদের সম্পর্ক?’ মায়ের কণ্ঠে চাপা বিষাদের সুর। অবিশ্বাসের রেশ।
ত্রয়ীর কষ্ট হয়। ধরে আসা কণ্ঠে বলে,’আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই মা। আমায় বিশ্বাস করো একটাবার। অঙ্কন ভাই যে আমায় পছন্দ করে আমি নিজেও জানতাম না। একই বাসায় থাকলেও আমাদের কথা হতো খুবই কম। বলতে পারো হতোই না তেমন। তাঁর সাথে আমার দেখা হতো শুধু রাতে খাওয়ার টেবিলে। মাঝে মাঝে তো তাও হতো না। পড়ার চাপের জন্য পরে খেতাম। ছুটির দিনটা বাড়িতে থাকলেও আমি বইয়ের মাঝেই ডুবে থাকতাম। তুমি যদি আমার কথা বিশ্বাস করে না থাকো তাহলে ফুপিকে ফোন করো। জিজ্ঞেস করে দেখো আমি তোমাকে কিছু মিথ্যে বলেছি কী-না।’
অকস্মাৎ কান্নায় ভেঙে পড়েন মা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলেন,’এরকমটা কেন হলো রে ত্রয়ী? আমি তো কখনো কল্পনাও করিনি এমন দিন আসবে, যেদিন আমি নিজের মেয়েদের অবিশ্বাস করব। ভাগ্য আমাকে কোথায় এনে দাঁড় করাল?’
ত্রয়ীর বলার মতো কোনো ভাষা নেই। ঠোঁট চেপে সে নিজেও কাঁদতে শুরু করে। তাঁর নিজের কাছেও এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব ঘটনা অবিশ্বাস্য লাগছে। মা চোখের পানি মুছে বললেন,’যা হওয়ার হয়েছে। দেখি আল্লাহ্ কী চান। তুই আর রাত জাগিস না। ঘুমিয়ে পড়।’ কথা শেষ করে তিনি লাইট অফ করে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যান। কান্নার দমক বেড়ে যায় ত্রয়ীর। আজ যদি এই ঘটনা না ঘটত তাহলে রাতটা অন্যরকম কাটতো। মা পাশে শুয়ে চুলে বিলি কেটে দিতেন। এটা প্রতিবারই হয়। যতবার ত্রয়ী ঢাকা থেকে গ্রামে বেড়াতে আসে এবং যতদিন থাকে ততদিন মা ত্রয়ীর সঙ্গে ঘুমায়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, চুলে বিলি কেটে দেয়। কিন্তু আজ! আজ সেসব দিন অতীত তো বটেই রূপকথার গল্পও মনে হচ্ছে। সময় কত দ্রুত বদলে যায়। কয়েক সেকেণ্ডের ব্যবধানেই পাল্টে যেতে পারে পুরো জীবন। সব জীবন রঙিন সুতোয় বাঁধে না, কিছু জীবন কাঁচের মতো ভেঙে গুড়িয়ে যায়।
.
.
মোরগের ডাকে সকালের ঘুম ভাঙে ত্রয়ীর। বেশ রাত করে ঘুমানোর ফলে মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু রুটিনমাফিক প্রতিদিন ত্রয়ী ছয়টা বাজে উঠে বলে, আজও ছয়টা বাজেই ঘুম ভেঙেছে। কিছু্ক্ষণ চুপ করে বিছানায় বসে থাকে। তারপর হেলতে-দুলতে ঘর থেকে বের হয়। কলপাড়ে গিয়ে মুখ ধুয়ে নেয়। জয়ীর ঘরের দরজা এখনও বন্ধ। মা রান্নাঘরে মাটির চুলায় রান্না বসিয়েছেন। ত্রয়ী ঘরে না গিয়ে আগে রান্নাঘরে যায়। মাকে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে মা চমকে ওঠেন। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বলেন,’হ্যাঁ, বল।’
‘তুমি কাঁদছ?’
‘আমার আর কান্না! তুই এত সকালে উঠেছিস কেন? আরেকটু ঘুমাতি।’
‘প্রতিদিন এই সময়েই উঠি। তাই অভ্যাস হয়ে গেছে।’
‘ঘরে মুড়ি আছে, গুড় আছে, রুটি-কলা আছে, ফল আছে কী খাবি খা।’
‘কিছু খাব না। মা, আমি আজ ঢাকায় চলে যাই?’
‘কেন?’
‘পড়ার অনেক চাপ এখন। কয়েক মাস পরই ফাইনাল পরীক্ষা। যত তাড়াতাড়ি যাব তত ভালো।’
‘ছুটি নিয়েছিলি কয়দিনের?’
‘পাঁচদিন।’
‘আচ্ছা তোর বাবা আসুক।’
ত্রয়ী উঠে ঘরে ফিরে আসে। মায়ের শুকনো মুখ দেখতে ভালো লাগছে না। আত্মীয়রা সব রাতেই চলে গেছে। অঙ্কনরা আছে নাকি নেই সেটা জানে না ত্রয়ী। ঘরের মাঝখানে পাটাতনের কাঠের ওপর সে বসে পড়ে। সে দোষী নয়। তবুও পরিস্থিতির শিকার হয়ে নিজেকে দোষী মনে হচ্ছে। জামশেদ রহমান ঘরে প্রবেশ করে দেখেন মন মরা হয়ে ত্রয়ী হাঁটুর ওপর মাথা রেখে বসে আছে। তিনি ছোটো ছোটো কদমে এগিয়ে গিয়ে ত্রয়ীর পাশে বসেন। ত্রয়ী এতটাই আনমনা হয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে যে, বাবার উপস্থিতিও টের পায়নি। বাবা ত্রয়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,’সকালে নাস্তা খেয়েছিস মা?’
চকিতে পাশ ফিরে তাকায় ত্রয়ী। কাল রাতে অঙ্কন যখন সবার সামনে বলল সে ত্রয়ীকে ভালোবাসে এরপর আর কথা হয়নি বাবার সাথে। তাঁর ধারণা ছিল অন্য সবার মতো বাবাও বোধ হয় ত্রয়ীকে ভুল বুঝেছে। কিন্তু বাবার কথাবার্তা খুব স্বাভাবিক। চোখের চাউনী শান্ত, স্থির। বিস্মিত হওয়ায় তৎক্ষণাৎ মুখ ফুঁটে ত্রয়ী কিছু বলতেও পারল না। শুধু দু’পাশে মাথা নাড়াল যার অর্থ সে খায়নি।
এ কথা শুনে বাবা স্মিতহাস্যে বললেন,’কেন? ঢাকা-শহরের নাস্তা ছাড়া গ্রামের নাস্তা মজা লাগে না?’ বাবার কথা শুনে মনে হচ্ছে কাল রাতে যেন কিছুই হয়নি। সবটাই ত্রয়ীর কল্পনামাত্র। আসলেই কল্পনা? নাকি বাবা-ই অতি স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন।
ত্রয়ী এবারও নিশ্চুপ। বাবা-ই বললেন,’কালকের ঘটনা নিয়ে মন খারাপ?’
এবার মুখ খুলল ত্রয়ী। বলল,’অন্য সবার মতো তুমিও কি আমায় ভুল বুঝেছ বাবা? তুমি কি আমায় বিশ্বাস করো না? তুমিও কি ভাবো আমি আপুর পথের কাঁটা?’
‘ও কথা বলে না মা। আমি বিশ্বাস করি। আমার দু’মেয়েকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারি। কারণ তোদের দু’বোনকে আমি নিজ হাতে গড়েছি। নিজ হাতে মানুষ করেছি। গ্রামের সবাই তোদের বাবাকে আদর্শ শিক্ষক বলে জানিস তো? সেই বাবার আদর্শে তোরা আদর্শিত হয়েছিস। গ্রামের মানুষ, আত্মীয়রা যে যাই বলুক না কেন, আমি তো জানি আমার মেয়েরা কেমন। তাছাড়া আত্মীয়রা যখন উল্টাপাল্টা কথা বলছিল তখন অঙ্কন পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে সে একপাক্ষিক ভালোবাসে তোকে। তোর সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই।’
‘কিন্তু আপু আমায় ভুল বুঝেছে আব্বু। ওর ধারণা, আমি সব জানতাম। আপু আমার ওপর রাগ করে আছে।’
‘ওর কথায় মন খারাপ করিস না রে মা। মেয়েটার মানসিক অবস্থা বুঝতেই তো পারছিস। পরিস্থিতির শিকার জয়ী। ভুলটা আমারই। ওকে অঙ্কনের বিষয়টা আগে জানানোর প্রয়োজন ছিল।’ কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মোছেন।
উঠোন থেকে তখন জয়ীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। সে বেশ জোরেই শব্দ করে বলে,’মা রান্না কি হয়নি এখনও? না হলে যা আছে খেতে দাও। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
জামশেদ রহমান আর ত্রয়ী ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ান। জয়ী একবার শুধু ওদের দিকে দৃষ্টিপাত করে মায়ের দিকে তাকায়। মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করেন,’কোথায় যাবি তুই?’
‘স্কুলে। প্রাইভেট পড়াব আগে। তারপর ক্লাস।’
মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন,’তুই আজ স্কুলে যাবি?’
‘হ্যাঁ, যাব। কেন নিষেধ আছে? কিছু থাকলে দাও। নয়তো চলে যাই।’
মা অসহায়ভাবে বাবার দিকে তাকান। বাবা নির্বাক। মা বললেন,’ঘরে যা। খাবার দিচ্ছি।’
জয়ী এমন রুক্ষ মেজাজের ছিল না। তবে রাগী ছিল। ওর এমন পরিবর্তন বাবা-মাকে পীড়া দিচ্ছে। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারেন, জয়ীর মনের অবস্থা এখন ভীষণ খারাপ। কোনো কাজে এখন বাঁধা দেওয়া ঠিক হবে না। জয়ীকে ঘরে যাওয়ার জায়গা করে ত্রয়ী সরে দাঁড়ায়।
_________________
জয়ী হাই স্কুলের টিচার। ছাত্র-ছাত্রী যারা জয়ীর কাছে প্রাইভেট পড়ে ওদের ম্যাসেজ করে জানিয়েছে আজ যেন প্রাইভেট পড়তে আসে। ওদের মধ্যে কেউ কেউ পরিবারসহ জয়ীর বিয়েতে এসেছিল। তাই ওদের জানা রাতে কী হয়েছিল। এরপর আজ হুট করে প্রাইভেট! সবাই এত এত অবাক হয়েছে যে উন্মুখ হয়ে বসে আছে জয়ীর আসার।
জয়ী আসামাত্র সকলে উঠে দাঁড়ায়। জয়ীর মুখ থমথমে, গম্ভীর। ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে জয়ী সবসময় হেসে হেসে কথা বলে। দুষ্টুমি করে। কিন্তু ঐ জয়ীর সাথে আজ এই জয়ীর মিল নেই বললেই চলে। জয়ী চুপচাপ বসে থাকে কিছু্ক্ষণ। তারপর বলে যেটা পড়া ছিল ঐটা যেন লিখে। সে মাথা নিচু করে বসে থাকলেও বুঝতে পারে ওরা একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করছে। কৌতুহল ওদের সবার মাঝে। ক্লাসে প্রবেশ করার আগে ছাত্র-ছাত্রীদের কথোপকথন ওর কানে এসেছে। ওদের কথেপথনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল জয়ী। কেউ সহমর্মিতা দেখাচ্ছে তো কেউ করছে করুনা। কেউ কেউ আবার হাস্যরসাত্মক কাহিনী বানাচ্ছে।
এক ঘণ্টা প্রাইভেট পড়িয়ে জয়ী টিচার্সরুমে ফিরে আসে। কলিগদের সামনে দাঁড়াতেও তাঁর ভীষণ লজ্জা লাগছে। গতকাল তাদের অনেকেও বিয়েতে উপস্থিত ছিল। জয়ীর মনে হচ্ছে বাড়ির বাইরে বের হয়ে ভুল করেছে। জেদের বশে কাজটা ঠিক হয়নি। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে সে। হ্যান্ড ব্যাগ টেবিলের ওপর রেখে একটা চেয়ার টেনে বসে।
‘ছুটি এত তাড়াতাড়ি শেষ ম্যাডাম? আজই চলে আসলেন যে?’ কথাটা বলল জয়ীর এক কলিগ। সে বিয়েতে যায়নি। তবে মনে হয় না এতক্ষণেও তিনি জানতে পারেনি গতকাল কী হয়েছে!
আরেকজন তখন বলল,’স্যার বাদ দিন এসব কথা এখন। কেমন আছেন জয়ী ম্যাম?’
তিনি বিয়েতে এসেছিলেন। সাহায্য করলেন নাকি করুণা বোঝা গেল না। জয়ী মাথা নাড়িয়ে বলল,’ভালো।’
স্কুলে সকলের বাঁকা চোখে তাকানো, স্কুলে কেন এসেছে আজ জিজ্ঞেস করা, সম্মুখে দাঁড়িয়ে সমবেদনা দেখানোর নাম করে টিটকারি করা, মজা করা এসবকিছু জয়ীকে তিক্ত করে তুলছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তাঁর।
টিফিন টাইমে কাউকে কিছু না জানিয়েই জয়ী স্কুল থেকে চলে আসে। বাজারের, দোকানপাটের দোকানদার, কয়েকজন রিকশাওয়ালা কমবেশি সবাই জয়ীকে চেনে। তাঁরা ওকে দেখেই কানাকানি করছে, ফিসফিস করে কথা বলছে। কোনো কিছুই জয়ীর দৃষ্টিঅগোচর হয় না। গ্রামের মহিলাগণ তো সরাসরিই ধিক্কার জানাচ্ছে। পুরো রাস্তা এতদিনের পরিচিত মানুষগুলোর অপরিচিত রূপ দেখতে দেখতে এসেছে। সহ্য হচ্ছে না আর। বাড়িতে পৌঁছে দৌঁড়ে নিজের ঘরে চলে আসে জয়ী। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। বিছানার ওপর দপ করে বসে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে। মুখে হাত চেপে ধরে কান্নার শব্দ আটকানোর চেষ্টা করছে। দু’হাতে মাথার চুল মুষ্টিবদ্ধ করে আহাজারি করে কান্না করে। কান্না করতে করতে দম আটকে আসে তাঁর। সে স্বগতোক্তি করে বলে,’আল্লাহ্! কী দোষ ছিল বলতে পারো? এরা কেন আমায় সুস্থভাবে বাঁচতে দিচ্ছে না? কেন!’
কান্নার দমক বেড়ে যায় জয়ীর। প্রচণ্ড, রাগ, জেদ, ক্ষোভ, বিষাদে চেপে ধরে তাকে। দু’হাতে চোখের জলের স্রোত মোছার চেষ্টা করে আলনার ওপর থাকা একটা ওড়না টেনে নেয়। যতবার চোখের পানি মুছছে ততবার পানিতে ভরে যাচ্ছে দু’চোখ। একটা চেয়ার নিয়ে খাটের ওপর ওঠে সে। ফ্যানের সাথে খুব শক্ত করে ওড়না বাঁধতে শুরু করে। মুক্তি দিয়ে যাবে সে সবাইকে। এ কষ্ট, এ দহন অসহ্যকর বেদনাদায়ক!
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]