#পত্রপ্রেম
#পর্ব_০২
লেখনীতে: স্পর্ষীয়া ভূমি।
বেলকনির দরজা খুলে রুমে কোথাও অদ্রিকে দেখা গেল না।হাতের ঘড়িটার দিকে নজর দিতেই ঘন্টার কাঁটাটা পাঁচ এর ঘরে দেখে কপাল কুঁচকাল রিক্ত।মেয়েটা কি হাওয়া হয়ে গিয়েছে নাকি?সরু চোখে এক দুইবার এদিক সেদিক তাকাল।না অদ্রি নেই। দু পা বাড়িয়ে রুম থেকে বের হবে ঠিক তখনই ওয়াশরুম থেকে অদ্রির গুণগুণানো কন্ঠ ভেসে আসল। ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে একবার তাকিয়ে খাটে হাত পা সোজা করে শুয়ে পড়ল রিক্ত। পুরো রাত তার ঘুম হয় নি।মাথা ব্যাথা করছে।সাথে তাল মিলিয়েছে চোখ।চোখজোড়া বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করেও অবশ্য বিশেষ লাভ হলো নাহ।মাথা ব্যাথা সমান তালেই বাড়ছে। রিক্ত দাঁত মুখ খিচে উঠে বসল।ঘুমের প্রতি চরম বিরক্তি নিয়ে ল্যাপটপটা এগিয়ে নিতেই চোখে পড়ল অদ্রিকে।উল্টোদিকে ফিরে শাড়ি পরতে ব্যস্ত সে।পরনে খয়েরি রংয়ের ব্লাউজ আর পেটিকোট। ভেজা চুলে লেপ্টানো উম্মুক্ত পিঠ সোজা দৃষ্টিতে চোখে পড়ছে। টুপটুপ করে পানি ঝরছে চুল থেকে।নজরটা অদ্রির ফর্সা পিঠে যেতেই তৎক্ষণাৎ নজর সরাল রিক্ত।হালকা কেঁশে তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,
‘ আমি যে এখানে আছি দেখেননি আপনি?আপনি তো দেখছি চরম বেহায়া।এসব শিখিয়েছে আপনাকে আপনার পরিবার?’
কানে পুরুষালী কন্ঠ যেতেই আৎকে উঠল অদ্রি।কন্ঠটা যে রিক্তের তাও চিনতে পারল মুহুর্তেই।কিন্তু?কিন্তু সে তো বেলকনিতে ছিল।রুমে কখন আসল?বিরক্তি আর লজ্জ্বায় শরীর গুলিয়ে উঠল অদ্রির।তৎক্ষণাৎ শাড়িটা কোনভাবে হাত দিয়ে মুঁছড়িয়ে ওয়াশরুমে ডুকল।কয়েক মিনিট পর শাড়িটা আধ ভেজা করে পরেও আসল।রিক্তর কাছাকাছি গিয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে বলল,
‘আপনি রুমে? বেলকনিতে ছিলেন না?’
চরম মাথা ব্যাথায় অদ্রির বোকা বোকা প্রশ্নটা আরো বিরক্তিকর লাগল রিক্তের কাছে।বেলকনিতে গিয়েছে মানে কি সে সারাজীবন বেলকনিতেই থাকবে?রুমে ডুকবে না?এই মেয়ের মাথায় কি বুদ্ধিসুদ্ধি কিছুই নেই।অদ্রির দিকে একনজর চেয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল,
‘ হ্যাঁ।তো?’
অদ্রি কাঁটকাঁট গলায় বলে উঠল,
‘ আমার শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাই ঘটনার বিস্তারিত জানানো ও তো প্রয়োজন তাই না?আমি ভেবেছিলাম আপনি বেলকনিতে তাই শাড়িটা নিয়ে রুমে এসেছিলাম।এর বাইরে কিছুই নাহ।আশা করি বুঝেছেন?’
‘ আমি আপনাকে কৈপিয়ত দিতে বলিনি। আর এত সকালে গোসল করার ও কি আছে।এখন সবে ভোর পাঁচটা।বিরক্তিকর!’
‘ মন চেয়েছে তাই। আপনার অসুবিধা? উফফস!কাল থেকে ঘেমে ঘেমে আমার অবস্থা শেষ হয়ে যচ্ছে।আর ইনি প্রশ্ন করছেন এত সকালে গোসল কেন?আজব!কাল পুরোদিন ভারী শাড়ি পরেই পরেই কাটল আমার।এখন ভালো লাগছে।আহ!’
রিক্ত মৃদু হেসে বলল,
‘ সেকেন্ডবার কৈপিয়ত।আমি তো আপনাকে কৈপিয়ত দিতে বলিনি অদ্রিয়া। এনিওয়ে আপনার নাম অদ্রিয়াই তো?মনে নেই ঠিক।’
অদ্রি তেজ নিয়ে বলল,
‘ অদ্রিয়া শেখ।সবাই অদ্রি ডাকে।আর কৈপিয়ত না দিলে তো ভাবতেন আমাকে এসবই শিখানো হয়েছে।মানুষের সামনে শাড়ি পরা। তাই না? আর তাছাড়া কৈপিয়ত না চাইলে আপনি প্রশ্নই বা করবেন কেন আজব! আর হ্যাঁ, কান খুলে শুনে রাখুন আমি তেমন ধরণের মেয়ে নয় যে আপনার সামনে শাড়ি পরার মতো মানসিকতা থাকবে।’
‘ হ্যাঁ শুনলাম।’
‘ শুধু শুনলে হবে না।মনেও রাখবেন।ভবিষ্যৎ এ এমন কথা বলবেন তো সোজা মুখ বাঁধাই করে দিব।’
রিক্ত বিরক্ত নিয়ে বলল,
‘ আপনি ঝগড়ুটে ক্ষেতাব পেয়েছিলেন কখনো? কিংবা বাচাল?স্কুল, কলেজ অথবা ভার্সিটিতে?’
অদ্রি জ্বলে উঠল।ঝগড়ুটে অথবা বাচাল ক্ষেতাব মানে?ঝগড়ুটে বা বাচাল ক্ষেতাব পাবে কেন সে?ডিরেক্টলি কিংবা ইনডিরেক্টলি কথাটা দিয়ে চরম ভাবে অপমান করল তাকে এই মানুষটা।রাগে দুঃখে ফর্সা ধবধবে মুখটা লাল হয়ে উঠল অদ্রির।নাকের অগ্রভাগও লাল টকটকে হয়ে উঠল খুব দ্রুত।এতোটা অপমানবোধ সে জীবনেও অনুভব করে নি।জীবনেও না।লোকটা একের পর এক অপমান করছে তাকে।
প্রথমত কাল রাতে স্ত্রী হিসেবে মেনে নেয় নি বলে অপমান করেছে দ্বিতীয়ত এখন ইনডিরেক্টলি ঝগড়ুটে আর বাচাল বলে।অদ্রি রাগে জমে যাওয়া চোখজোড়া দিয়ে রিক্তকে গিলে নিবে এমন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাগ ফুসতে ফুসতে বলে উঠল,
‘ আমি ঝগড়ুটে? আমি বাচাল?কোন এঙ্গেল থেকে ঝগড়ুটে বা বাচাল মনে হচ্ছে আমায়?’
রিক্ত মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘ গুড গার্ল!বলার আগেই বুঝে নিয়েছেন আপনি ঝগড়ুটে আর বাচাল। আর এঙ্গেল লাগবে কেন আপনাকে দেখলেই তো বোঝা যাচ্ছে আপনি ঝগড়ুটে এন্ড বাচাল।’
‘ আমি আপনাকে খুন করে ফেলব মিঃ চৌধুরী।জাস্ট খুন করে ফেলব।ঝগড়ুটে তো আপনি।প্রথমে ঝগড়ার রেশটা তো আপনিই টেনেছেন তাই না?আমি ঝগড়ুটে হলে আপনি তার থেকেও বড় ঝগড়ুটে।’
রিক্ত উঠে দাঁড়াল।মাথা ব্যাথাটা যে চরম পর্যায়ে পৌঁছে যাবে এই মেয়ের সাথে ঝগড়া করতে করতে তা আর বুঝতে বাকি রইল না।দাঁতে দাঁত চেপে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ আপনি আমার থেকে বয়সে কত বছরের ছোট?’
অদ্রি ভ্রু জোড়া কুঁচকে নিল।হঠাৎ এই প্রশ্ন।কিছুটা সময় চুপ থেকে বলল,
‘ কেন?’
রিক্ত টাউজারের পকেটে হাত ডুকিয়ে অন্য দিকে ফিরে বলল,
‘ এমন ইমম্যাচিউর তাই ভাবছি।দশ এগারো বছরের বাচ্চা মেয়ে কিনা।’
অদ্রি আবার ও রাগে জ্বলজ্বল করে উঠল।চোখেমুখে রাগের জ্বলন্ত আভা ফুটিয়ে নিয়ে বলল,
‘ আমি একুইশ বছর বয়সী যুবতী।নাহ আপনার মতো সাতাশ বছর বয়সী দামড়া বুড়ো আর না দশ এগারো বছর বয়সী বাচ্চা মেয়ে। এখন নিশ্চয় বলবেন আপনি বুড়ো না।হেন তেন আরো কত কি বলবেন।আপনার তো ঝগড়া করার জন্য গলা খিচখিচ করছে তাই না?বিরক্তিকর।’
রিক্ত বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে নিল।অদ্রির কথার পাল্টা উত্তরে আর একটা কথাও বলল না।কিছুটা সময় চুপ থেকেই খোচা দাঁড়িতে ডাকা গালে বাঁকা হাসি ফুটাল। অদ্রির দিকে এক নজর তাকিয়েই বেরিয়ে গেল।অদ্রিয়া মেয়েটির স্বভাবসুলভ যে নেহাৎই বাচ্চা বাচ্চা তা আর বুঝতে বাকি রইল না তার।
____________________
চারদিকে হালকা আলোর দেখা মিলছে সবে।ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর।ছাদের বামপাশে লাগানো গোলাপ গাছটার পাতাগুলোও বাতাসের তালে নিজেদের মিলিয়ে নেড়ে উঠছে।গোলাপ গাছের নেড়ে উঠা পাতাগুলোর মাঝে দেখা মিলছে লাল টকটকে আধ ফোটা গোলাপের কলিরও। রিক্ত মৃদু হাসল।গোলাপ গাছটার দিকে এক পলক চেয়ে চোখ ঘুরাল তার উল্টো পাশে।বেশ কয়েকটা কাঠগোলাপ গাছ ছিল সেখানে।রিয়ার লাগানো।কিন্তু এখন নেই।মাস দুই আগে রিক্তই সরিয়ে নিয়েছে সেগুলো।কাঠগোলাপ অপরিচিতার ও পছন্দের ফুল ছিল।তার দেওয়া চিঠিগুলোর অধিকাংশ চিঠিতেই কাঠগোলাপের কথা থাকত। কাঠগোলাপের প্রতি ভালো লাগা মূলত তখন থেকেই তৈরি রিক্তের।কিন্তু ভালো লাগাটাই পরবর্তীতে খারাপ লাগায় পরিণত হলো।যখন কাঠগোলাপ গাছগুলো সেই অপরিচিতার কথা মনে করাত।আর চটপট করে উঠত রিক্তের হৃদয়।সেসব কথা ভেবেই ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল রিক্ত।হাতের ঘড়ির দিকে নজর ফেলতেই ছাদে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ভ্রু কুঁচকাল।ঘাড় ঘুরিয়ে তৎক্ষণাৎ পেছনে তাকাতে রিয়াকে দেখে ভ্রু জোড়া আরো কিছুটা কুঁচকে নিয়ে বলে উঠল,
‘তুই?এত ভোরে ছাদে কি তোর রিয়ু?’
‘ আমি আরো ভোরেই এসেছি।তখন মে বি ভোর চারটে।একটু রুমে গিয়েছিলাম।এখন আবার আসলাম।’
‘ ওহ। কিন্তু এতো সকালে ছাদে কি তোর?’
রিয়া দু পা এগিয়ে এসে ভাইয়ের দিকে তাকাল।কিছু না বলে ছাদের রেলিংয়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে ফিরে চাইল।পাশের বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়েই নিষাণের বেলকনিতে নজর দিল। বেলকনিতে কেউ নেই।কিছুটা সময় সেদিকে তাকিয়ে থেকেই আপসোস হলো তার।চরম ভাবে মন খারাপ হলো।ভাইয়ের দিকে একনজর তাকিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,
‘ ভাইয়া, নিষাণ খুব খারাপ। জানিস?’
রিক্ত অবাক হলো।যে মেয়ে নিষাণকে ছাড়া ছোটবেলা থেকে কিছু বুঝত না আজ সেই মেয়ের কাছে নিষাণ খারাপ?রিক্তের কপাল তৎক্ষণাৎ কুঁচকে গেল।
‘ কি বলছিস রিয়ু?নিষাণ একটু ফাইজলামি করে তাই বলে ও খারাপ হবে কেন?’
‘ আমার সারারাত ঘুম হয় নি ভাইয়া।ওকে কল করে জিজ্ঞেস করলাম কি করলে ঘুম হবে।কিন্তু ও না বলে কল কেটে দিল।আমি এতগুলো কল দিলাম ও রিসিভ করল না।তো ও খারাপ নয়?’
‘ এটাতে খারাপেরই কি আছে?’
রিয়ার দাঁত মুখ শক্ত হলো।নিজের ভাইয়ার উপরও চরম রাগ হচ্ছে তার।নিষাণ অবশ্যই খারাপ কাজ করেছে।চরম খারাপ কাজ করেছে ওর এতগুলো কলের একটা কলও না ধরে।চোখেমুখে কিছুটা কাঠিন্য এনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল রিয়া,
‘ কিছুই না।’
কথাটা বলেই কয়েক সেকেন্ড পর আবারো বলে উঠল রিয়া,
‘ কাল তোর নামে একটা চিঠি এসেছিল ভাইয়া।আমি দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। ‘
রিক্তর দৃষ্টি সরু হলো।চিঠি?কে পাঠাবে চিঠি?যে চিঠি দিত সে তো এখন আর চিঠি দেয় না।চোখেমুখে অবাকের রাজ্য মেলেই বলে উঠল রিক্ত,
‘ চিঠি!কে পাঠাল?’
‘ অপরিচিতা, চট্টগ্রাম।’
এই ছোট দুটো শব্দ শুনেই বুকের ভেতর ধুকবুক শুরু হলো।এতোগুলো দিন পর সে চিঠি দিয়েছে?হাত পা কেমন কেঁপে উঠল।অদ্ভুত অনুভূতিতে মনের ভেতর বয়ে গেল চাঞ্চল্য।দ্রুত বলে উঠল,
‘ চিঠি কোথায় রিয়ু?’
রিয়া দাঁত কেলিয়ে হাসল।
‘ দিব না।’
রিয়ার হাস্যকর কথাটা মোটেই হাস্যকর মনে হলো না রিক্তর কাছে।চোখ মুখ তৎক্ষণাৎ লাল হয়ে উঠল।রাগে শিরা উপশিরা কেঁপে উঠল।রিয়ার হাসির দিকে আর একবারও না তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ দিতে বললাম তো।আমার দরকার আছে।’
‘ কি খাওয়াবি?’
‘ তুই যা বলিস।’
‘ ওকে। আমার টেবিলের ড্রয়ারে একটা হলুদ খাম আছে। আমি অবশ্য খুলিনি । খামের উপরে প্রেরকের ঠিকাটায় অপরিচিতা চট্টগ্রাম লেখাটা দেখেছি কেবল।এই অপরিচিতা টা কে রে ভাইয়া?’
রিক্ত হতবাক চেয়ে রইল।তার মানে সত্যিই অপরিচিতা চিঠি দিয়েছে?কিন্তু এতদিন পর?একবছর পর চিঠি!তাও তার বিয়ে হওয়ার পরই।এখনতো চাইলেও অপরিচিতাকে তার জীবনে আনা সম্ভব না।কিছুতেই না।রিয়ার প্রশ্নবোধক চাহনি দেখে লম্বা শ্বাস টানল রিক্ত।ছোট করে বলল,
‘ কেউ না।’
রিয়া হতবাকের মতো রিক্তর যাওয়ার পথে চেয়ে রইল।কে এই অপরিচিতা?ভাইয়া এই অপরিচিতার কথা শুনে এতটা উদ্বিগ্ন হলো কেন?মাথায় হাজার চিন্তা চাপল।কিন্তু ফলাফল শূণ্য। একটা প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে পাওয়া গেল না।বিরক্তিতে ঠোঁট মুখ কুঁচকে সামনে তাকাতেই নিষাণের বেলকনিতে দেখা মিলল নিষাণ নামক ছেলেটির।পরনে ব্লু কালারের শার্ট আর থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট।শার্টের হাতা গুলো অন্যদিনের মতো ফোল্ড করা নয়।হাতের কব্জি পর্যন্ত পড়ে আছে হাতা। নিষাণ অগোছালো চুল গুলোকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়েই শার্টের হাতা ঠিক করল।রিয়াকে দেখেই ড্যাবড্যাব করে তাকাল।চোখ গুলো কেমন শুকনো দেখাচ্ছে মেয়েটার।চুলগুলো ঐ হাত দিয়ে খোপা করা।রিয়ার চোখের দৃষ্টি নিজের দিকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে হাত দিয়ে ইশারা করে বলল নিষাণ,
‘ কি?’
রিয়া হাসল।ডান চোখ টিপে দিয়েই বলল,
‘ কি ব্যাপার দোস্ত?তুই এত সকালে ঘুম থেকে উঠলি?তোর গার্লফ্রেন্ড ড্যাট এ যাবে এত সকালে?’
নিষাণ বিরক্ত নিয়ে বলল,
‘ তোর সবসময় আমার গার্লফ্রেন্ড নিয়েই কেন এত ইন্টারেস্ট থাকে বল তো? আমার গার্লফ্রেন্ড মোটেই তোকে পছন্দ করে না তাও ওকে নিয়েই কেন কথা বলতে হবে?’
রিয়া হাসিখুশি মুখটা হুট করেই কালো হয়ে গেল।কেন কে জানে।তবে মনের ভেতর অদ্ভুত এক কষ্ট নাড়া দিয়ে উঠল।নিষাণের সাথে তার বন্ধুত্বটা বরাবরই ভালো।ছোটবেলা থেকেই।ইন্টারে পড়াকালীন সময়েই নিষাণ একবার ওকে ভালোবাসি বলেছিল।সেটা মজা কি বাস্তব আজও জানে না সে।তবে সেদিন রিয়া ফিরিয়ে দিয়েছিল নিষাণকে।ঐ টুকু সময়ে ভালোবাসা নিয়ে ভাবার মতো বোধবুদ্ধি তার হয়েছিল নাকি?তারপর থেকে সেসব ভালোবাসা নিয়ে আর কোনদিন তাদের মধ্যে কথা হয় নি।কখোনই না।তবে তাদের বন্ধুত্বটার সুর কেটে গিয়েছিল হয়তো।নিষাণ রিলেশনে গেল।নিষাণের গার্লফ্রেন্ডের জন্য অসহ্যকর এক বস্তু হয়ে উঠল রিয়া।এরপর থেকে নিষাণের সাথে খুব অল্প সময়ই কাটায় সে।তবে বন্ধু হিসেবে আজও নিষাণ বেস্ট। আজও সে সবকিছু শেয়ার করা সেই নিষাণের সাথে।যদিও আজ নিষাণ আর তার সাথে সবকিছু শেয়ার করে না।রিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল।প্রসঙ্গ পাল্টাতে হাসিমুখে বলে উঠল,
‘ আমি কি তোর গার্লফ্রেন্ডের সতীন বল?সে আমায় দু চোখেই দেখতে পারবে না কেন? আচ্ছা আমার তো আর দুচোখের বিষ না ও তাই না?সো আমি বলতেই পারি ও কে নিয়ে কথা।’
নিষাণ শার্টের কলারটা ঠিক করে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।রিয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
‘ সারারাত না ঘুমানোর কি কারণ তোর?কারো প্রেমে ট্রেমে পড়িস নি তো?পরে কিন্তু সাজেশন নিতে আসলেও দিব না। চটফট বলে ফেল কার প্রেমে পড়লি?’
‘ উহ!আমাকে তোর কি মনে হয়?’
‘ কি মনে হবে?’
রিয়া ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
‘ আমি তোর থেকে লুকাব মনে হলো কি করে তোর?তাই তো ছাদে দাঁড়িয়ে আছি।দেখছিস না?তোকে বলব বলে।’
নিষাণ সরু চোখে চেয়ে বলল,
‘ রুমে যা।কল কর। এভাবে বললে সবাই শুনবে।তোর বাপ ভাই জানলে ডিরেক্ট হাত পা বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিবে।তোর কপাল তো ভোগে সাথে আমার সারাজীবন ও কাঁটকাঁট হয়ে যাবে।’
রিয়া অবাক চোখে চেয়ে বলল,
‘ তোর জীবন কাঁটকাঁট হবে মানে?কি বলিস নিষাণ ভূত?’
নিষাণ বেলকনি থেকে পা সরাতে সরাতেই বলল,
‘ ফটাফট রুমে যা। কল দিবি।যতক্ষন পর্যন্ত না আমার মোবাইল অন হবে ততক্ষন কল দিবি।আমার মোবাইল অন হলে আমি নিজে কল দিব।যা ফুট।’
রিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।নিষাণ আবারও তাকে রেখে চলে গেল কথার মাঝপথে।সে খুব ভালো করেই জানে নিষাণকে এখন কল দিলে পাওয়া যাবে না।কল দিতে বলেছে মানে তার মোবাইল অফ।আবারও দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলল।বন্ধুত্ব কোথাও সুর কেঁটে গেছে। হ্যাঁ। সেই বন্ধুত্বটা আজ আর নেই।আজ সবাই ব্যস্ত।ব্যস্ত নগরীর ব্যস্ত সব বন্ধু।তাদের সময় কোথায় তার সাথে কথা বলার?কথার মাঝপথে হুটহাট ছেড়ে যাওয়া সব বন্ধু।
________________________
রিয়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে চিঠির খামটা নিয়েছে এই দুইঘন্টা।কিন্তু চিঠিটা পড়া হলো না।উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছে কেমন।এতগুলো দিন, এতোগুলো মাস পর চিঠি এল।ঠিক আগের মতোই আনন্দ হচ্ছে কিন্তু কোথাও এক পাহাড় বিষাদ যন্ত্রণা। ক্ষণেই ক্ষণেই বুকের কোথাও তড়তড় করে বেড়ে উঠছে সেই অসহ্য যন্ত্রনা।খাম খুললে চিঠিটায় কি লেখা থাকবে?অপরিচিতাকে কি সে ঠকিয়েছে?তার ভালোবাসাকে ঠকিয়েছে? মাথার মধ্যে শত সহস্র প্রশ্নের ঘুরফাক খেললে ও কোন উত্তরই খুঁজে পেল না রিক্তের মস্তিষ্ক।অনেক্ষণ যাবৎ চিঠির খামের দিকে তাকিয়ে থাকল একদৃষ্টে।দূর থেকে সবটাই পর্যবেক্ষণ করল অদ্রি।মাথায় তার ও হাজার প্রশ্ন।এই লোক কি পাগল?একটা চিঠির খাম নিয়ে এতক্ষণ এইভাবে একইভাবে তাকিয়ে আছে।বোকা বোকা চাহনিতে রিক্তকে এতক্ষণ দেখে চললেও এবার মাথায় বিরক্তি নামক শব্দটার জম্ম হলো।এই লোকের অদ্ভুত কাজকর্ম দেখে ঠাস করে চড় মেরে ঠুস করে দাঁত ফেলে দিতে মন চাইল।সেই ইচ্ছে মনের ভেতর পোষণ করে দু পা এগিয়েও গেল।রিক্তর থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েই ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
‘ কি ব্যাপার বলুন তো?আপনার প্রেমিকা চিঠি দিয়েছে? তখন থেকে কেবল দেখেই যাচ্ছি আপনি খামটার দিকে তাকিয়ে আছেন তো তাকিয়েই আছেন।’
রিক্ত অদ্রির কথাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে উঠে দাঁড়াল।খামটা অতি সযত্নে ড্রয়ারে রেখে আবারও একই জায়গাতে বসল।ল্যাপটপটা কোলে বসিয়ে অন করতে করতে মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ আপনি আমাকে ফলো করছেন অদ্রিয়া?’
কথাটা শুনে চরম বিরক্ত হলেও চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল অদ্রি।ঠোঁট টেনে বলল,
‘ লোকজন সামনে থাকলে এমনিই চোখে পড়ে।ফলো করতে হয় না।আর তাছাড়া যাকে তাকে ফলো করার প্রশ্নই আসে না।’
রিক্ত ল্যাপটপেন স্ক্রিনে মনোযোগ দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,
‘ রাইট।’
অদ্রি ভাব নিয়ে দুই হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ আমি এমনিতেই সবসময় রাইট কথাবার্তা বলে থাকি মিঃ চৌধুরী।’
রিক্ত আড়চোখে একবার অদ্রির দিকে তাকাল।তারপর হু হা করে হেসে উঠল।হাসিটা এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যেন থামানোই যাচ্ছে না হাসিটা।অবশেষে মিনিট দুই পর অনেক কষ্টে হাসিটা থামিয়েই বলল,
‘ ওহ আচ্ছা।’
অদ্রি সরু চোখে তাকাল।ভ্রু জোড়া আর কপাল ইতিমধ্যে কুঁচকে গিয়েছে।সে যে রেগে গিয়েছে তা বোঝাতেই ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল,
‘ হাসলেন।হাসলেন কেন আপনি?আমি হাসির কথা বলেছি?আপনি হাসবেন কেন!হুয়াই?’
রিক্ত ঠোঁট টেনে আবার ও হাসল।
‘ কি আজব!আপনার জন্য কি আমি হাসি বন্ধ করে মারা যাব অদ্রিয়া?’
অদ্রি রাগে ফুলে উঠল।ফর্সা ধবধবে গাল ফুলে গেল।একমুহুর্তও রিক্তের সামনে না দাঁড়িয়ে মুখ ভেঙ্গিয়ে হনহন করে সরে গেল সেইখান থেকে।এই অসহ্যকর লোকটার সামনে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তার নেই।এটুকুও না।
#চলবে…..
( ভুলত্রুটি ক্ষমাদৃষ্টিতে দেখবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।)