নয়নতারা ৪৯

0
555

#নয়নতারা

পর্ব ৪৯

Suvhan Årag (ছদ্মনাম)

;;;;;

—-কি হলো?কথা বলছো না কেন?

তারার দুই বাহু ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো নাফিজ।তারা মাথা নিচু করে ফেলেছে।কি উওর দেবে সে?সে কি তবে বেশি দেরী করে ফেলেছে?

তারার হাত ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো নাফিজ।নিজের চুলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে জোরে চুল টানছে।এদিকে অঝোরে চোখের পানি তো পড়ছেই।

—-এটা কিভাবে করতে পারলি তুই কিভাবে?তুই জানিস আমার যন্ত্রণা টা!জানিস তুই?দম বন্ধ হয়ে যাওয়া যন্ত্রণা,নিরঘুম রাতের যন্ত্রণা!তুই সব সময় শুধু কষ্ট দিয়েছিস আমাকে মিষ্টি সব সময়।আজ দেখ তুই তারা হয়েও সেই কষ্ট আমাকে দিলি।কি করে পারলি আমাকে নিয়ে এভাবে খেলতে?আমার চোখের পানি গু লো কি একবার ও তোর চোখে পড়েনি?এতোটাই নিষ্ঠুর তুই।একবার ও কি তোর হৃদয় ভেজে নি!আমাকে আজ এভাবে ক্ষতবিক্ষত করে দিলি তুই।এইভাবে!

নাফিজ হাউমাউ করে দাতে দাঁত চেপে কাঁদছে।তার ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদতে।কিন্তু ঐ যে শব্দ টা বাইরে যাবে যে।কি দরকার মানুষকে সেটা শোনানোর?বাইরের শব্দটা সকলকে শোনানো যায়।কিন্তু ভেতরের রক্তক্ষরণ টা কাউকে কি দেখানো যায়?

নাফিজের কান্না দেখে তারাও কেঁদেই ফেলেছে।তার ছোট্ট একটা ভুল যে এভাবে নাফিজকে কষ্ট দেবে এটা জানলে তারা হয়তো সেদিন কিছুই লুকাতো না।নাফিজ আবার তারার দিকে তড়িৎ গতিতে এগিয়ে গেল।তারাকে জাপটে ধরলো নিজের সাথে।

—-আমি কতো অপেক্ষা করেছিলাম।এমন একটা দিনের অপেক্ষা করতাম।যেদিন আমার মিষ্টি আসবে আমার কাছে।আমি বুকে জড়িয়ে নেব ওকে।আর ছাড়ব না।কিন্ত এতো বড় কষ্ট টা আমাকে কিভাবে দিলে তারা?বলো।

নাফিজ তারাকে ছেড়ে দিল।খাটের ওপর গিয়ে বসলো।

—-তুই একটা বিশ্বাস ঘাতক।প্রতারক।মিথ্যুক তুই।তুই কখনো আমাকে ভালো বাসিস নি।বড্ড স্বার্থপর তুই।ছোট বেলায় আমার কাছে আশ্রয় পেতি।এই জন্য আমি ছাড়া কিছু চিনতিস না।আর আজ বড় হয়েও,,,,,তুই একটা স্বার্থপর।

তারা এবার আর চুপ থাকতে পারল না।তারা বললো,

—-বাহ!তুমি আমাকে এভাবে স্বার্থপর বলতে পারলে নাফিজ ভাইয়া!

নাফিজ ভাইয়া ডাকটা শুনেকখন আরো যেন ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে নাফিজের।এ তো গু লো বছর পর সেই ডাক।যার জন্য তার এতো অপেক্ষা,এতো চোখের পানি এতো রাত সাক্ষী ছিল।

—-খবরদার!একদম ঐ নামে ডাকবি না তুই আমাকে।একদম না।

—-একশ বার ডাকব।কি করবে তুমি?

—-বাহ!খুব ভালো কথা বলতেনা শিখেছিস।এখন এটা বল কেন করলি এমন?কেন?

—-কি করতাম আমি?বলে দিতাম আমি সেই মিষ্টি।তোমার কি আদৌ তোমার মিষ্টি পাখির কথা মনে আছে নাফিজ ভাইয়া?

তারার প্রশ্নে বিস্ফারিত চোখে তাকালো নাফিজ।

—-মানে?

—-তুমি তারা কে নিয়ে ভেবে বসেছিল।নিজের সব কিছু তাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলে।মিষ্টি নামে যে কেউ ছিল সেটা কিভাবে ভুলে গেছিলে?আর তুমি কি বলেছিলে মিষ্টিকে ভালোবাসো?আমি না হয় কিছু বুঝতাম না।তুমি তো সব বুঝতে।এখনো বোঝো।এটা বলোতো ভালোবাসলে তুমি এই তারাকে নিয়ে স্বপ্ন কিভাবে দেখলে?তুমি কখনো মিষ্টিকে ভালোই বাসোনি।সব তোমার আবেগ।

তারার প্রত্যেক টা কথা যেন নাফিজের হৃদয় ছিদ্র করে দিয়ে যাচ্ছে।অবাক হয়ে যাচ্ছে নাফিজ।তবে কি সে ভুল করেছিল!তার অপেক্ষা করাই কি উচিত ছিল।আজ তারা তার এতো বছরের অপেক্ষা কে মিথ্যা বলে দিল!

—-কি হলো কথা বলো?আমি না হয় ভুল।নাফিজ ভাইয়া ছোটো ছিলাম আমি।কি বা মনে আছে আমার?বড় হতে হতে তোমাদের চেহারা গুলো ও ঠিক মতো মনে নেই আমার।আর তুমি তো সেই ছোট নাফিজ নেই।নিজেই দেখ।আমি কিভাবে চিনব তোমাকে?আমি নিজেও তো জানতাম না তুমি আমার সেই নাফিজ ভাইয়া আমার সেই বন্ধু যার নামটা আজো মনে আছে আমার।বাপির মুখে যেদিন থেকে শুনতাম ক্যাপ্টেন নাফিজ নামে একজনের সুনাম আমার বার বার মনে হতো তুমি কি যেন একটা হতে চেয়েছিলে।আর্মি অফিসার।আমি তো তোমাকে চিনতেই পারি নি।আর যতবার তোমার সাথে কথা হয়েছে কখনো একবার ও তুমি বলোনি মিষ্টি নামে কেউ ছিল তোমার জীবনে।কেন বলোনি বলো?মিষ্টি র প্রতি এতো টান থাকলে কেন বলোনি তখন?আর রইলো সেদিন জানানোর কথা।কি জানাতাম আমি?তুমি নিজেই তো বললে এর আগে ও একজন তোমাকে এই পরিচয় দিয়েছিল।তার পর থেকে তুমি বিশ্বাস করো না কাউকে।আমি সেখানে কিভাবে বলতাম।কি প্রমাণ দিতাম?ছবির কথা টাও মাথায় আসেনি আমার।এতো কিছু আমি ভাবিনি।আমি তখন শুধু এটা ভেবেছিলাম একবার সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে হারিয়েছিলাম,আজ সেই কাছের বন্ধু,আরো ভালোবাসার মানুষ তার চেয়ে বড় কথা স্বামী।তাকে হারাতে চাইনি আমি।তোমাকে যদি বলতাম তুমি যদি বিশ্বাস না করতে তখন?এজন্য তারা হয়েই থাকতে চেয়েছি আমি।আর থাকব নাই বা কেন?তুমি কি চেনো মিষ্টিকে?তুমি ভুলে গেছো মিষ্টিকে?মিষ্টিকে যদি তুমি ভালোই বাসো বিয়ে করলে কি করে তারাকে?আর তুমি নিজেই বলেছো তোমার জীবন জুড়ে এর পর শুধু তারা থাকবে।মিষ্টির অস্তিত্ব তুমি নিজেই মুছে দিয়েছো।

তারার কথাতে দম মেরে বসে আছে নাফিজ।তারা চুপ হয়ে গেছে।নাফিজের দিকে তাকিয়ে আছে।নাফিজ এবার চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো।তারার একদম মুখোমুখি দাঁড়ালো।

—-ঠিক ই বলেছো তারা।ভুল আমার।পরিবার এর কথা ভেবে নিজে এক টু স্বস্তির সাথে বাঁচতে আমি আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল করে ফেলেছি।তার থেকেও বড় ভুল করেছি মিষ্টির অপেক্ষা করে এতোগুলো বছর কাটিয়ে।এতো চেষ্টা চালিয়েছি ওকে খোজার।খুঁজতে খুঁজতে আজ যেই নদী কিনারায় এসে পৌছালাম সেই শুনছি নদীটাই আমার নয়।অপেক্ষা করাটাই ছিল আমার ভুল।

—-তুমি আমার কথা শোনো।তুমি ভুল বুঝছো।

—-কিভাবে পারলি তুই মিষ্টি?এতো বড় কথা গুলো বলে দিলি!আমি আজ ও সকালে উঠে ফোনের সামনে থেকে একবার দেখে যাই ছোট্ট মিষ্টি পাখিকে।আমি যতবার তারার কথা ভাবি তার থেকে দুবার বেশি ভাবি মিষ্টির কথা।ঐ নামটা আমার রক্তে মিশে আছে যেন।আমি এতোগুলো বছর অপেক্ষা করেছি।এতো গুলো বছর।তাও কিনা একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ের জন্য।সে বড় হয়ে কি হয়েছে কেমন হয়েছে সেটা না দেখেই।আজ যখন ক্লান্ত পথিকের মতো একটু বিশ্রামের জন্য তারার খোঁজে গেছি তখন তুই এটা বলে দিলি আমি মিষ্টিকে ভুলে গেছি!অনেক কষ্ট দিয়েছিস আজ অবধি আমাকে।কিন্ত এই কথা গুলো বলে এতোটা কষ্ট না দিলেও পারতি।কাটা জায়গায় মরিচ লবণ ছিটিয়ে দিয়েছিস একদম।

নাফিজ চোখ মুছে চলে যেতে নিলেই তারা নাফিজের হাত ধরে বসে।

—-আমার কথাটা শোনো তুমি।

তারা নাফিজের দিকে এগুতে গেলেই নাফিজ ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় তারাকে।

—-আআআহ।

এতোটাই জোরে দিল নাফিজ তারা ছিটকে ফ্লোরে পড়েছে একদম।ব্যথায় উহ করে উঠলো তারা।চোখ দিয়ে পানি চলে এসেছে।

নাফিজ দরজা খুলতে যাবে তার আগে তারাকে ঐ অবস্থায় দেখে থেমে যায়।দ্রুত কোলে তুলে নেয় তারাকে।খাটে এনে শুইয়ে দেয়।নাফিজ তারাকে ছেড়ে দিতে গেলে তারা নাফিজের শার্টের কলার ধরা বসে।নাফিজ মলিন হাসি দিয়ে কলার টা ছাড়িয়ে নেয়।

—-আমার কথাটা শোনো নাফিজ ভাইয়া।

—-ভালো থাকিস।তোর পায়ের ব্যথার কাছে আমার বুকের ব্যথাটা কিছুই না।আজ থেকে সব শেষ।না তারা না মিষ্টি।কেউ থাকবে না নাফিজের জীবনে।তোর আমার সম্পর্ক এখানেই শেষ।আর কোন দিন তোর সামনে আসব না।কখনো না।ভালো থাকিস যন্ত্রণা।

নাফিজ তারার কপালে চুমু দিয়ে চোখ মুছে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

—-ক্যাপ্টেন ক্যাপ্টেন শুনুন আমার কথাটা।

তারা আর উপায় না পেয়ে উঠে বসে কষ্ট করে ক্রাচ টা আরেক পা দিয়ে ফ্লোর থেকে টেনে আনলো।সেটা উঠিয়ে হাতে নিয়ে নিজেও বাইরে গেল।তারা নিচে নামতেই দেখতে পেল না নাফিজকে।আব্রাহাম সাহেব বসে আছেন।

—-বাপি।

—-হ্যা মা বলো।

—-ক্যাপ্টেন কোথায়?

—-ও তো চলে গেছে।ইউনিট থেকে ওকে ডেকেছে।আবার ওর মা বাবাকে নাকি তোদের গ্রামের বাড়িতে দিতে যাবে।এই সপ্তাহ আসতে পারবে না।তোকে কিছু বলেনি।

—-না না বলেছে।

—-আচ্ছা উপরে গিয়ে রেস্ট নে।দুদিন অনেক চাপ গেছে তোর।

—-হুম।

আব্রাহাম সাহেব কে মিথ্যা বললো তারা।নাহলে তিনি চিন্তা করবেন।

নিজের ঘরে গিয়ে নাফিজের নাম্বারে কয়েকবার ফোন করলো তারা।কিন্তু নাফিজ ফোন তো তুললো ই না।উল্টা সুইচ অফ করে দিল শেষে।

;;;;;

এক সপ্তাহ কেটে গেছে।

ঘরে শুয়ে কাঁদছে তারা।নাফিজ এ কদিনের এক বার ও তার সাথে যোগাযোগ করেনি।তারার ইচ্ছে করছে ও বাড়ি ছুটে যেতে নাফিজের কাছে।কিন্তু কি বলে যাবে সে।

এর মধ্যে মাহমুদা বেগম আর আব্রাহাম সাহেব ঘরে এলেন।

—-তারা।

মাহমুদা বেগমের কথা শুনে তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে উঠে বসলো তারা ।

—-মা কিছু বলবে।

—-হুম।

আব্রাহাম সাহেব মাহমুদা বেগম দুজনে তারার দু পাশে গিয়ে বসলেন।

—- কি হয়েছে তারা?নাফিজ চলে যাওয়ার পর থেকে এমন ঘর বন্দী হয়ে থাকো।নাফিজ এর ফোন ও বন্ধ।কিছু কি হয়েছে তোমাদের মধ্যে?

—-বাপি মা।

তারা কেঁদেই দিল দুজনের সামনে।একে একে সব কিছু খুলে বললো।মাহমুদা বেগম আব্রাহাম সাহেব অবাক হয়ে গেছেন সব শুনে।

—-তারা।মা তুমি কি তোমার পরিবারের কাছে যেতে চাও?

—-কিসের পরিবার?তোমারাই আমার পরিবার।আর কেউ না।মা আমি ওখানে যেতে চাই না।আমি ক্যাপ্টেন কে হারাতে চাই না মা।মা আমি নাফিজের কাছে যাব মা।ও বাপি আমাকে নিয়ে চলো না।আমি খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি ওনাকে।

দুজনকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো তারা।

চলবে‌————

দুজনের মিল ঘটিয়ে,ফজলে শেখ কে শাস্তি দেওয়া সব কিছু গুছিয়ে তবেই ইনশাহআল্লাহ এনডিং দেব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here